‘গোয়েন্দা’ শব্দটা কানে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গভীর রাত, টেবিল ল্যাম্পের আলো-আঁধারিতে ঘেরা ঘর, আর চিন্তামগ্ন এক। যাঁর মগজাস্ত্রে একের পর এক জটিল রহস্যের জট খোলে। সেখানে থাকে টানটান উত্তেজনা, অকাট্য প্রমাণ আর সত্যের জন্য এক আপসহীন খোঁজ। কিন্তু যদি বলা হয়, এই ডিজিটাল যুগে সেই গোয়েন্দাদেরই এক জ্ঞাতি ভাইয়ের দেখা মেলে আমাদের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে যাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নেই—আছে স্মার্টফোন, আর আছে মগজাস্ত্রের চেয়েও ধারালো কি-বোর্ড।
বাস্তবের গোয়েন্দা আর অনলাইন সাংবাদিক, দুজনেরই কাজ আদতে তদন্ত। কিন্তু একজনের তদন্তে মেলে রহস্যের কিনারা, অন্যজনের তদন্তে মেলে ক্লিকের ফোয়ারা। সিনেমার গোয়েন্দা যেখানে সত্যের পেছনে ছোটেন, নিউজ পোর্টালের ব্রেকিং নিউজ হিরো ছোটেন ট্রেন্ডের পেছনে। পথ ভিন্ন হলেও দুজনের কাজেই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চের মিলমিশ ঘটে যায়।
তদন্ত যখন দুই রকম
ব্যোমকেশ বক্সী সূত্র ধরে এগিয়ে যান, প্রমাণ ছাড়া সামান্যতম সিদ্ধান্তে আসেন না। ফেলুদা তোপসেকে শিখিয়েছেন, ‘অবজারভেশনটা হলো আসল জিনিস।’ তাঁদের কাছে তদন্ত আসলে তপস্যা। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ থাকে মাপা, প্রতিটি সিদ্ধান্ত যুক্তির শানে দেওয়া। সামান্য একটা সিগারেটের ছাই কিংবা দরজায় লেগে থাকা এক চিলতে কাদা থেকে তাঁরা অপরাধের ইতিহাস বলে দিতে পারেন।
অন্যদিকে, অনলাইন সাংবাদিকের জগৎটা ঠিক এর উল্টো। সেখানে সময়ের বড় অভাব। দুই প্রতিবেশীর সামান্য ঝগড়া তাঁদের প্রতিবেদনের শিরোনামে হয়ে ওঠে ‘এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের রক্তাক্ত খেলা’। একটা ছোট অগ্নিকাণ্ড হয়ে যায় ‘শহরের বুকে নাশকতার ভয়াবহ ছক’। ফেলুদা যেখানে কেসের জট খুলতে তিন সপ্তাহ গবেষণা করেন, নিউজ রিপোর্টার সেখানে তিন মিনিটেই গুগল আর ফেসবুক ঘেঁটে ‘এক্সক্লুসিভ’ বানিয়ে ফেলেন। গোয়েন্দা যদি কোনো সূত্র না পান, সিগারেট হাতে চিন্তার সাগরে ডোবেন। রিপোর্টার সূত্র না পেলেও শিরোনাম দেন: ‘এর পেছনের কারণ জানলে আপনি চমকে উঠবেন!’
হাতিয়ারের ভিন্নতা
শার্লক হোমসের হাতে থাকে বিচক্ষণতার কাচ, আর তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ‘ডিডাকশন’। শার্লকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘অসম্ভবকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তা যতই অবিশ্বাস্য হোক, সেটাই সত্যি।’ এই মূলমন্ত্রেই শার্লক রহস্যের গভীরে প্রবেশ করেন। রয়েছে রসায়ন ল্যাব, বিভিন্ন ছদ্মবেশ নেওয়ার সরঞ্জাম আর লন্ডনের অলিগলির জীবন্ত মানচিত্র। শার্লকের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ওয়াটসন, যিনি প্রতিটি ঘটনাকে নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেন।
আমাদের নিউজ হিরোর সংস্করণটা একটু আলাদা। তাঁর মূলমন্ত্র হলো, ‘অসম্ভবকে বাদ দিয়ে এমন কিছু বানান যা দেখতে সম্ভব মনে হয়—বাকিটা ট্রেন্ডিং সামলে নেবে।’ তাঁর হাতে থাকে স্মার্টফোন, যা দিয়ে তিনি একই সাথে ছবি তোলেন, ভিডিও করেন, লাইভে যান আর দশটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে খবর ছড়ান। তাঁরও একজন সহকারী আছেন বটে—সাব-এডিটর, যাঁর প্রধান কাজ হলো শিরোনামে ‘রহস্য’, ‘চাঞ্চল্যকর’ কিংবা ‘এই প্রথম’ শব্দ জুড়ে দেওয়া, এমনকি সেই খবরে রহস্যের ছিটেফোঁটাও না থাকলেও। শার্লক যেভাবে হিন্ট ধরেন, আমাদের সাংবাদিক সেভাবেই হিট ধরেন। শার্লকের লাইব্রেরিতে থাকে ফরেনসিক বিজ্ঞানের বই, আর রিপোর্টারের ব্রাউজারে খোলা থাকে কুড়িটা ট্যাব, যার বেশিরভাগই উইকিপিডিয়া আর ফেসবুক।
মানসিকতার জগৎ: তপস্যা বনাম ম্যারাথন
গোয়েন্দাদের জগৎটা তপস্যার মতো। মাথায় একটাই চিন্তা—কেইস। মনে শুধু যুক্তির আনাগোনা, আর হাতে হয়তো পাইপ কিংবা সিগারেট। তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা ঘরে বসে থাকতে পারেন, সামান্য একটা সূত্র মেলানোর জন্য। এই নীরব সাধনাই তাঁদেরকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
বিপরীতে, সাংবাদিকদের কাজটা এক ধরনের ম্যারাথন দৌড়। হাতে ফোন, চোখের সামনে স্ক্রিন, আর পেছনে সম্পাদকের চিৎকার: ‘ট্রেন্ড মিস হয়ে যাচ্ছে ভাই!’ গোয়েন্দারা সত্যে পৌঁছাতে গিয়ে নিজের শান্তি হারান। নিউজ রিপোর্টার সত্যে পৌঁছানোর আগেই ইন্টারনেট সংযোগ হারিয়ে ফেলার ভয়ে তটস্থ থাকেন। একজনের হতাশা মানবজাতিকে নিয়ে, অন্যজনের হতাশা ধীরগতির ওয়াইফাই নিয়ে। গোয়েন্দা রাতে ঘুমাতে পারেন না রহস্যের চিন্তায়, আর সাংবাদিক ঘুমাতে পারেন না নতুন নোটিফিকেশনের শব্দে।
তদন্ত বনাম ট্রেন্ড
ফেলুদা যত কেসের গভীরে যান, সত্যের কুয়াশা তত পরিষ্কার হতে থাকে। নিউজ পোর্টাল যত রিপোর্টের গভীরে যায়, সত্য তত হারিয়ে যায় তথ্যের ভিড়ে। ফেলুদা একা মগজ চালান, নিউজ পোর্টাল চালায় সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও)। ব্যোমকেশের তদন্ত শেষ হয় অপরাধীর স্বীকারোক্তি দিয়ে। সাংবাদিকের স্বীকারোক্তি আসে অনেক দেরিতে, একটি ছোট বাক্যে— ‘শিরোনামে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।’ কিন্তু ততক্ষণে সেই পোস্টে পঁচিশ হাজার শেয়ার আর আট হাজার মন্তব্য জমা হয়ে গেছে, আর আসল সত্য বালুর নিচে চাপা পড়ে গেছে।
ভাবুন তো, ফেলুদা যদি আজকের ঢাকায় অনলাইন নিউজে যোগ দিতেন? তোপসে হয়তো রিপোর্ট লিখছে: ‘ফেলুদা বলেছেন, অপরাধী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।’ দশ মিনিট পর সম্পাদক এসে বলতেন, এই লাইনটা একটু বদলে দিন—‘অপরাধী একজন পরিচিত মুখ!’ ক্লিক বেশি আসবে।
ব্যস, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শেষ, নিউজের গোয়েন্দাগিরি শুরু। ব্যোমকেশ হয়তো তাঁর কেস ফাইলের নাম দিতেন—’খুন নয়, কন্টেন্ট।’ তিনি হয়তো ডায়রিতে লিখতেন, ‘সত্য খুঁজতে গিয়ে আমি গুগল ট্রেন্ডসের দাস হয়ে গেছি।’
চূড়ান্ত মুহূর্ত: রহস্যের উন্মোচন বনাম ‘আপডেট’
প্রতিটি গোয়েন্দা গল্পের চূড়ান্ত মুহূর্ত আসে ক্লাইম্যাক্সে। গোয়েন্দা সব সন্দেহভাজনকে এক ঘরে জড়ো করেন। থমথমে পরিবেশ। এরপর একে একে সবার অ্যালিবাই খণ্ডন করে আসল অপরাধীর দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘খুনি আর কেউ নন, আপনিই!’ অপরাধী তখন ভেঙে পড়ে, নিজের দোষ স্বীকার করে। রহস্যের যবনিকাপাত ঘটে।
অনলাইন সাংবাদিকতার ক্লাইম্যাক্সটা অন্যরকম। একটি ‘ব্রেকিং নিউজ’ পোস্ট করার পর শুরু হয় আসল খেলা। দশ মিনিট পর আসে ‘আপডেট ১: ঘটনায় নতুন মোড়।’ আরও বিশ মিনিট পর ‘আপডেট ২: প্রত্যক্ষদর্শীর চাঞ্চল্যকর বয়ান।’ সবশেষে, কয়েক ঘণ্টা পর একটি শান্তশিষ্ট বিজ্ঞপ্তি: ‘কারেকশন: পূর্বের সংবাদে পরিবেশিত তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আমরা এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।’ ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। গোয়েন্দার উন্মোচনে একজন অপরাধী ধরা পড়ে, আর রিপোর্টারের ‘আপডেট’-এ হাজার হাজার পাঠক বিভ্রান্ত হয়।
শেষ পর্যন্ত, গোয়েন্দা সত্য খুঁজে বের করে গল্পে একধরনের উপসংহার টানেন, সমাজে আনেন স্বস্তি। আর সাংবাদিক খবর খুঁজে বের করে কমেন্ট সেকশনে বাঁধিয়ে দেন নতুন ঝামেলা। গোয়েন্দার অকাট্য প্রমাণ লাগে, সাংবাদিকের একটা ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র’-ই যথেষ্ট।
তবু, দুজনের কাজেই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, শার্লক—তাঁরা সত্যের পেছনে ঘোরেন। আমাদের নিউজ রিপোর্টারও ঘোরেন, তবে সত্যের নয় ট্রেন্ডের পেছনে। সিনেমার গোয়েন্দা রহস্যের শেষে বলেন, ‘এখন সব জলের মতো পরিষ্কার।’ বাংলাদেশি নিউজ রিপোর্টারও বলেন, ‘ঘটনার বিস্তারিত আসছে, আমাদের সঙ্গেই থাকুন..’
দুজনেরই গল্প শেষ হয়, কিন্তু একজনের গল্পে রহস্যের সমাধান হয়, অন্যজনের গল্পে রহস্য চলতেই থাকে।