গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর)। এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করবেন।
গত বছরের জুলাইয়ে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনের সময় সহিংসতায় বহু হতাহত হয়, যা পরবর্তীতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ হিসেবে আলোচনায় আসে।
গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এ উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করা হয় এবং এর এখতিয়ারে জুলাইয়ের সহিংসতাজনিত অপরাধগুলো যুক্ত করা হয়। নতুন আইনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে যোগ করা হয়েছে, যা পূর্বের আইনে ছিল না।
পুনর্গঠনের পর ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় হওয়ায় এটি ভবিষ্যতের মামলাগুলোর দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। পাশাপাশি আসামিদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী, শহীদ ও আহত পরিবারগুলোর কাছে হস্তান্তরের আবেদন করা হয়েছে। শনিবার (১৬ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বিষয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এই রায় প্রত্যাশিত। প্রসিকিউশনের দাবি, তারা আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। রায়ের ঘোষণা করা অংশ সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থাও করেছে ট্রাইব্যুনাল।’
এই মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্টভাবে মোট পাঁচটি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ রয়েছে ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার।
প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগ হলো, ‘গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য’, ‘হেলিকপ্টার থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ’, ‘রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা’, ‘চানখাঁরপুলে হত্যা’ এবং ‘আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানো’।
গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে হামলা চালায়। এর মাধ্যমে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন করা হয়। এসব ঘটনায় আসামিদের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র ছিল বলে অভিযোগ আনা হয়।
হেলিকপ্টার থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এর মাধ্যমে আসামিরা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডে তাদের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
রাজধানীর চাঁনখারপুলে হত্যা
আন্দোলনকে ঘিরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনাতেও শেখ হাসিনাসহ তিন জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানো
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া এবং একইসঙ্গে গুরুতর আহত একজনকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় তিন আসামি কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের নির্দেশে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে।