.png)
আজ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। শোষণ ও বঞ্চনাহীন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে এ লেখা।

হুমায়ূন শফিক

১৯৪১-৪২ সালের কথা। হামিদাবাদে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। সেখানে উপস্থিত মওলানা ভাসানী। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মাহমুদাবাদের নবাবও সেখানে আসবেন। জনসভার আগের দিন মওলানা তাঁর তৎকালীন সেক্রেটারি মানিক সরকারকে ডেকে বললেন, ‘নবাব সাহেব ধুবড়ী থেকে আসবেন কীভাবে? ধুবড়ী থেকে তো কোনো রাস্তা নেই। ধুবড়ী থেকে হামিদাবাদ প্রায় ৬-৭ মাইল পথ। কী করা যায়?’
মওলানা তখন দুশ্চিন্তা পড়ে গেলেন। শিষ্যরা তাঁর দুশ্চিন্তা দেখে নেমে গেল রাস্তা তৈরির কাজে। আশ্চর্যজনকভাবে পরদিন বেলা ১০-১১টার মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল রাস্তা। নতুন এই রাস্তা দিয়েই হামিদাবাদে এলেন নবাব।
এরকম জনপ্রিয়তা ছিল ভাসানীর। শুধু মওলানার মুখের কথাই শিষ্যরা যেকোনো অসাধ্যকেও যতদূর পারা যায় সাধন করে ফেলত। তাঁর ডাকে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাড়া দিত। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকার যে কাজ করত দুই তিন মাস লাগিয়ে। সেই কাজ মওলানার শিষ্যরা করে দিত তার চেয়েও কম সময়ে।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন উপমহাদেশের তৃণমূল রাজনীতির এক কিংবদন্তী নেতা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রধান স্থপতিদের একজন। ১৯৪৭–এর পাকিস্তান থেকে ১৯৭১–এর বাংলাদেশ—দুই যুগের রাজনীতিতেই তাঁর ভূমিকা ছিল গভীর ও প্রভাবশালী।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যায়–অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭–এর আসামের বাঙাল খেদাও বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬–এর ফারাক্কা লংমার্চ—সবখানেই নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকেই তিনি বুঝেছিলেন, পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে পূর্ববাংলার টিকে থাকা কঠিন। জীবনের বড় অংশে তিনি বামধারা ও মাওপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তাঁকে ‘লাল মওলানা’ও বলা হতো। আজকে জানব, তাঁর জীবনের এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে।
১৯৪৪–৪৫ সালে অহোম মহাসভার উসকানিতে আসামে বাঙাল উচ্ছেদ তীব্র হয়। মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই, বরপেটা ও গৌহাটিতে ‘বাঙাল খেদা বিরোধী’ আন্দোলন চালান। গণপ্রতিরোধ সংগঠিত করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রায় সব আসনে জয়লাভ করে। বরপেটায় সরকারি দমন ও উচ্ছেদের প্রতিবাদে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। ২৬ জুন মঙ্গলদই মহাসম্মেলন ডাকেন, যা থেকে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এবং ৭ নভেম্বর ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ ঘোষণা করেন।
১৯৪৭ সালের বাংলা–আসাম সম্মেলনে পাকিস্তানে বাংলা ও আসামের সংযুক্তি দাবি করেন। মুসলিম লীগ নেতাদের অহিংস প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ ঘোষণা করে প্রথমে আসামের স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বক্তৃতা দেওয়ায় গ্রেফতার হন। ২১ জুন মুক্তি পেয়ে সিলেট গণভোট প্রচারণা চালান। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট চান। আগস্টে আবার গ্রেফতার হন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার দিনও ভারতীয় কারাগারে ছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বরের মুক্তির পর সীমান্ত পেরিয়ে টাঙ্গাইলে চলে আসেন। এর পর আসামের বাঙালিরা তাঁকে অনুসরণ করে। ফলে ‘ভাসানীহারা’ হয়ে পড়ে তাঁরা।
১৯৫০ সালে রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ হলে মওলানা ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ জানান। এটিকে রাষ্ট্রীয় বর্বরতা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
ঘটনার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বন্দীদের ওপর নির্বিচার হত্যা ও দমন-পীড়ন বন্ধের আহ্বান করেন তিনি।
দেশে গণ-আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করেন। খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনা পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারীরুপ উন্মোচিত করে। ভাসানীর প্রতিবাদ আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে।
১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারামুক্ত হন। মুক্তির পর তিনি পাকিস্তান সরকারের দমননীতি, কালাকানুন ও রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হন।
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে তাঁর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। এটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কারী প্ল্যাটফর্ম।

ভাসানী প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে একজন, যিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন, বাংলা অবশ্যই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হতে হবে।
ভাসানীর অবস্থান ছাত্রদের আন্দোলনে মনোবল আনে এবং আন্দোলন সর্বদলীয় বৈশিষ্ট্য পায়। তাঁর দাবি ও বক্তৃতা ভাষা আন্দোলনের জনসমর্থন বাড়ায়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ মাস কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এটি আন্দোলনের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও ত্যাগের প্রমাণ। ভাসানীর বক্তব্য, সভা–সমাবেশ ও ধারাবাহিক চাপ পাকিস্তানের দমননীতিকে চ্যালেঞ্জ করে।
১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একত্র করেন। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট। যা ছিল পূর্ববাংলার গণমানুষের রাজনৈতিক ঐক্যের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
ভাসানীর ডাকেই কৃষক–শ্রমিক, ছাত্র–জনতাসহ সাধারণ মধ্যবিত্তরা একত্রিত হয়। তিনি খাদ্য সংকট, বেকারত্ব, অন্যায় কর ও দমননীতির বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের জনসমর্থন গড়ে তোলেন।
ভাসানীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তার ‘মজলুম জননেতা’ পরিচয় ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক যুক্তফ্রন্টের প্রতি আস্থাকে বহুগুণ বাড়ায়।
ভাসানী সর্বত্র সভা–সমাবেশ করে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে গণমানুষের দাবি হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে—গ্রামীণ ভোটব্যাংক আর কৃষক–মজুরের শক্তিশালী সমর্থন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টির মধ্যে ২২৮টি আসনে জয় পায়। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৫৬ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ঢাকায় অনশন করেন। সরকার দাবি না মানা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যান। অবশেষে তাঁর কাছে হার মানে তৎকালীন সরকার।
পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণার বিরোধিতা করেন মওলানা ভাসানী। কাগমারী সম্মেলনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তা প্রত্যাখ্যান করলে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এভাবেই তিনি প্রকাশ্যে বামধারায় যুক্ত হন। কাগমারী সম্মেলনেই প্রথম তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেন।
১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী ছিলেন নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক ও প্রভাবশালীদের যারা বিরোধিতা করছিলেন তাদেরকে একত্রিত করেন।
ভাসানী এই সম্মেলনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র স্বার্থ রক্ষার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলিত করা যাবে না।
ভাসানী পাকিস্তান–মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি তুলেন। এতে বোঝানো হয় যে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিদেশী প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে।
কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রাধান্য দেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্রতা’ নিয়ে প্রথমবার প্রকাশ্যে কথা বলেন তিনি। এ ঘোষণাই পরে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের ঐতিহাসিক ভিত্তি তৈরি করে।
২৫ মার্চ ভাসানী সন্তোষে ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনী তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিলে সিরাজগঞ্জে চলে যান। এরপর সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় ভারত সীমান্তের দিকে রওনা দেন। ভারতীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সহায়তায় তাঁরা এপ্রিলের মধ্যভাগে আসামের ফুলবাড়ী পৌঁছান। পরে বিএসএফ তাঁদের আশ্রয় দিয়ে কলকাতায় পাঠায়। পার্কস্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
২৩ এপ্রিল তিনি একটি বিবৃতি দেন, যা কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি চীন ও মার্কিন নেতৃত্বকে বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। নিক্সনকে পাকিস্তানে অস্ত্র না পাঠানোর অনুরোধ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দিতে বলেন। ২৫ এপ্রিল তিনি সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছেও একই আবেদন জানান।
৩১ মে তিনি ঘোষণা করেন—বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন-মরণ লড়াই করছে এবং তাঁরা জয়ী হবেই। ৭ জুন তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চল বাঙালির রক্তে স্নাত, আর এই রক্তের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আসবে।
ভারতে থাকার সময় দুই দফা তাজউদ্দীন আহমদ কোহিনুর প্যালেসে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর পরামর্শ চান। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় বৈশিষ্ট্য দিতে আট সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। কমিটির মত ছিল—পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতা, দেরাদুন ও দিল্লিতে অবস্থান করেন। অনেকে পরে অভিযোগ করেন, ভারতে তিনি নজরবন্দি ছিলেন।

বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে সবসময় নজরদারিতে রাখা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কর্মকর্তা কিংবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট সবসময় ভাসানীর সাথে থাকতো।
বিভিন্ন লেখা ও গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য বেশ চিন্তিত ছিল ভারত। সেজন্য তারা মওলানা ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বলেও বিভিন্ন লেখায় উঠে আসে।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতার বাইরে অন্য কেউ তার সাথে দেখা করতে পারতেন না। মওলানা ভাসানীর সাথে কে দেখা করবেন এবং কে করবেন না সেটি নির্ভর করতো ভারত সরকারের মর্জির ওপর।
এমনকি ভাসানীর একান্ত অনুগত ও অনুসারী হিসেবে পরিচিত হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন এবং কাজী জাফর আহমেদও তার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। দুইবার অসুস্থ হয়ে তিনি এআইআইএমএসে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি।
১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘হক-কথা’ প্রকাশ শুরু করেন। বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও জাতীয়করণ নীতি এবং সংবিধানকে সমর্থন দেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে অনশন করেন। ১৯৭৪ সালে হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর আইন অমান্য আন্দোলনের সময় সন্তোষে গৃহবন্দি হন।
১৯৭৫ সালের দিকে, ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার অজুহাতে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানির সংকট দেখা দেয়।
এই অবিচারের বিরুদ্ধে, প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ মে এক প্রতিবাদী লংমার্চের ডাক দেন। ৯০ বছরের বেশি বয়স এবং অসুস্থ শরীর সত্ত্বেও এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফিরেই মওলানা ভাসানী এই লংমার্চের ঘোষণা দেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ২ মে তাঁকে প্রধান করে ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। লংমার্চের আগে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এর কারণ ব্যাখ্যা করে একটি চিঠিও লেখেন।
১৬ মে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠ থেকে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে এই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিলটি প্রায় ৬৪ মাইল পথ অতিক্রম করে। পথের ধারে সাধারণ মানুষ মিছিলকারীদের খাবার ও পানি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়।
পরদিন মিছিলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পৌঁছালে মওলানা ভাসানী এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ভারত যদি পানির ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে, তবে ভারতীয় পণ্য বর্জন করা হবে। কৌশলগত কারণে এবং ঝুঁকি এড়াতে, তিনি মিছিলকারীদের সীমান্ত পর্যন্ত যেতে নিষেধ করেন এবং সেখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এই লংমার্চের পর মওলানা ভাসানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ফারাক্কা লংমার্চ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে আজও পরিচিত।

১৯৪১-৪২ সালের কথা। হামিদাবাদে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। সেখানে উপস্থিত মওলানা ভাসানী। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মাহমুদাবাদের নবাবও সেখানে আসবেন। জনসভার আগের দিন মওলানা তাঁর তৎকালীন সেক্রেটারি মানিক সরকারকে ডেকে বললেন, ‘নবাব সাহেব ধুবড়ী থেকে আসবেন কীভাবে? ধুবড়ী থেকে তো কোনো রাস্তা নেই। ধুবড়ী থেকে হামিদাবাদ প্রায় ৬-৭ মাইল পথ। কী করা যায়?’
মওলানা তখন দুশ্চিন্তা পড়ে গেলেন। শিষ্যরা তাঁর দুশ্চিন্তা দেখে নেমে গেল রাস্তা তৈরির কাজে। আশ্চর্যজনকভাবে পরদিন বেলা ১০-১১টার মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল রাস্তা। নতুন এই রাস্তা দিয়েই হামিদাবাদে এলেন নবাব।
এরকম জনপ্রিয়তা ছিল ভাসানীর। শুধু মওলানার মুখের কথাই শিষ্যরা যেকোনো অসাধ্যকেও যতদূর পারা যায় সাধন করে ফেলত। তাঁর ডাকে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাড়া দিত। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকার যে কাজ করত দুই তিন মাস লাগিয়ে। সেই কাজ মওলানার শিষ্যরা করে দিত তার চেয়েও কম সময়ে।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন উপমহাদেশের তৃণমূল রাজনীতির এক কিংবদন্তী নেতা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রধান স্থপতিদের একজন। ১৯৪৭–এর পাকিস্তান থেকে ১৯৭১–এর বাংলাদেশ—দুই যুগের রাজনীতিতেই তাঁর ভূমিকা ছিল গভীর ও প্রভাবশালী।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যায়–অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭–এর আসামের বাঙাল খেদাও বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬–এর ফারাক্কা লংমার্চ—সবখানেই নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকেই তিনি বুঝেছিলেন, পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে পূর্ববাংলার টিকে থাকা কঠিন। জীবনের বড় অংশে তিনি বামধারা ও মাওপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তাঁকে ‘লাল মওলানা’ও বলা হতো। আজকে জানব, তাঁর জীবনের এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে।
১৯৪৪–৪৫ সালে অহোম মহাসভার উসকানিতে আসামে বাঙাল উচ্ছেদ তীব্র হয়। মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই, বরপেটা ও গৌহাটিতে ‘বাঙাল খেদা বিরোধী’ আন্দোলন চালান। গণপ্রতিরোধ সংগঠিত করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রায় সব আসনে জয়লাভ করে। বরপেটায় সরকারি দমন ও উচ্ছেদের প্রতিবাদে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। ২৬ জুন মঙ্গলদই মহাসম্মেলন ডাকেন, যা থেকে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এবং ৭ নভেম্বর ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ ঘোষণা করেন।
১৯৪৭ সালের বাংলা–আসাম সম্মেলনে পাকিস্তানে বাংলা ও আসামের সংযুক্তি দাবি করেন। মুসলিম লীগ নেতাদের অহিংস প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ ঘোষণা করে প্রথমে আসামের স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বক্তৃতা দেওয়ায় গ্রেফতার হন। ২১ জুন মুক্তি পেয়ে সিলেট গণভোট প্রচারণা চালান। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট চান। আগস্টে আবার গ্রেফতার হন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার দিনও ভারতীয় কারাগারে ছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বরের মুক্তির পর সীমান্ত পেরিয়ে টাঙ্গাইলে চলে আসেন। এর পর আসামের বাঙালিরা তাঁকে অনুসরণ করে। ফলে ‘ভাসানীহারা’ হয়ে পড়ে তাঁরা।
১৯৫০ সালে রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ হলে মওলানা ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ জানান। এটিকে রাষ্ট্রীয় বর্বরতা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
ঘটনার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বন্দীদের ওপর নির্বিচার হত্যা ও দমন-পীড়ন বন্ধের আহ্বান করেন তিনি।
দেশে গণ-আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করেন। খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনা পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারীরুপ উন্মোচিত করে। ভাসানীর প্রতিবাদ আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে।
১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারামুক্ত হন। মুক্তির পর তিনি পাকিস্তান সরকারের দমননীতি, কালাকানুন ও রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হন।
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে তাঁর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। এটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কারী প্ল্যাটফর্ম।

ভাসানী প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে একজন, যিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন, বাংলা অবশ্যই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হতে হবে।
ভাসানীর অবস্থান ছাত্রদের আন্দোলনে মনোবল আনে এবং আন্দোলন সর্বদলীয় বৈশিষ্ট্য পায়। তাঁর দাবি ও বক্তৃতা ভাষা আন্দোলনের জনসমর্থন বাড়ায়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ মাস কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এটি আন্দোলনের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও ত্যাগের প্রমাণ। ভাসানীর বক্তব্য, সভা–সমাবেশ ও ধারাবাহিক চাপ পাকিস্তানের দমননীতিকে চ্যালেঞ্জ করে।
১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একত্র করেন। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট। যা ছিল পূর্ববাংলার গণমানুষের রাজনৈতিক ঐক্যের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
ভাসানীর ডাকেই কৃষক–শ্রমিক, ছাত্র–জনতাসহ সাধারণ মধ্যবিত্তরা একত্রিত হয়। তিনি খাদ্য সংকট, বেকারত্ব, অন্যায় কর ও দমননীতির বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের জনসমর্থন গড়ে তোলেন।
ভাসানীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তার ‘মজলুম জননেতা’ পরিচয় ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক যুক্তফ্রন্টের প্রতি আস্থাকে বহুগুণ বাড়ায়।
ভাসানী সর্বত্র সভা–সমাবেশ করে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে গণমানুষের দাবি হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে—গ্রামীণ ভোটব্যাংক আর কৃষক–মজুরের শক্তিশালী সমর্থন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টির মধ্যে ২২৮টি আসনে জয় পায়। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৫৬ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ঢাকায় অনশন করেন। সরকার দাবি না মানা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যান। অবশেষে তাঁর কাছে হার মানে তৎকালীন সরকার।
পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণার বিরোধিতা করেন মওলানা ভাসানী। কাগমারী সম্মেলনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তা প্রত্যাখ্যান করলে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এভাবেই তিনি প্রকাশ্যে বামধারায় যুক্ত হন। কাগমারী সম্মেলনেই প্রথম তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেন।
১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী ছিলেন নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক ও প্রভাবশালীদের যারা বিরোধিতা করছিলেন তাদেরকে একত্রিত করেন।
ভাসানী এই সম্মেলনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র স্বার্থ রক্ষার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলিত করা যাবে না।
ভাসানী পাকিস্তান–মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি তুলেন। এতে বোঝানো হয় যে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিদেশী প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে।
কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রাধান্য দেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্রতা’ নিয়ে প্রথমবার প্রকাশ্যে কথা বলেন তিনি। এ ঘোষণাই পরে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের ঐতিহাসিক ভিত্তি তৈরি করে।
২৫ মার্চ ভাসানী সন্তোষে ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনী তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিলে সিরাজগঞ্জে চলে যান। এরপর সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় ভারত সীমান্তের দিকে রওনা দেন। ভারতীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সহায়তায় তাঁরা এপ্রিলের মধ্যভাগে আসামের ফুলবাড়ী পৌঁছান। পরে বিএসএফ তাঁদের আশ্রয় দিয়ে কলকাতায় পাঠায়। পার্কস্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
২৩ এপ্রিল তিনি একটি বিবৃতি দেন, যা কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি চীন ও মার্কিন নেতৃত্বকে বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। নিক্সনকে পাকিস্তানে অস্ত্র না পাঠানোর অনুরোধ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দিতে বলেন। ২৫ এপ্রিল তিনি সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছেও একই আবেদন জানান।
৩১ মে তিনি ঘোষণা করেন—বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন-মরণ লড়াই করছে এবং তাঁরা জয়ী হবেই। ৭ জুন তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চল বাঙালির রক্তে স্নাত, আর এই রক্তের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আসবে।
ভারতে থাকার সময় দুই দফা তাজউদ্দীন আহমদ কোহিনুর প্যালেসে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর পরামর্শ চান। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় বৈশিষ্ট্য দিতে আট সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। কমিটির মত ছিল—পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতা, দেরাদুন ও দিল্লিতে অবস্থান করেন। অনেকে পরে অভিযোগ করেন, ভারতে তিনি নজরবন্দি ছিলেন।

বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে সবসময় নজরদারিতে রাখা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কর্মকর্তা কিংবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট সবসময় ভাসানীর সাথে থাকতো।
বিভিন্ন লেখা ও গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য বেশ চিন্তিত ছিল ভারত। সেজন্য তারা মওলানা ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বলেও বিভিন্ন লেখায় উঠে আসে।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতার বাইরে অন্য কেউ তার সাথে দেখা করতে পারতেন না। মওলানা ভাসানীর সাথে কে দেখা করবেন এবং কে করবেন না সেটি নির্ভর করতো ভারত সরকারের মর্জির ওপর।
এমনকি ভাসানীর একান্ত অনুগত ও অনুসারী হিসেবে পরিচিত হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন এবং কাজী জাফর আহমেদও তার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। দুইবার অসুস্থ হয়ে তিনি এআইআইএমএসে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি।
১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘হক-কথা’ প্রকাশ শুরু করেন। বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও জাতীয়করণ নীতি এবং সংবিধানকে সমর্থন দেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে অনশন করেন। ১৯৭৪ সালে হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর আইন অমান্য আন্দোলনের সময় সন্তোষে গৃহবন্দি হন।
১৯৭৫ সালের দিকে, ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার অজুহাতে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানির সংকট দেখা দেয়।
এই অবিচারের বিরুদ্ধে, প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ মে এক প্রতিবাদী লংমার্চের ডাক দেন। ৯০ বছরের বেশি বয়স এবং অসুস্থ শরীর সত্ত্বেও এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফিরেই মওলানা ভাসানী এই লংমার্চের ঘোষণা দেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ২ মে তাঁকে প্রধান করে ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। লংমার্চের আগে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এর কারণ ব্যাখ্যা করে একটি চিঠিও লেখেন।
১৬ মে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠ থেকে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে এই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিলটি প্রায় ৬৪ মাইল পথ অতিক্রম করে। পথের ধারে সাধারণ মানুষ মিছিলকারীদের খাবার ও পানি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়।
পরদিন মিছিলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পৌঁছালে মওলানা ভাসানী এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ভারত যদি পানির ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে, তবে ভারতীয় পণ্য বর্জন করা হবে। কৌশলগত কারণে এবং ঝুঁকি এড়াতে, তিনি মিছিলকারীদের সীমান্ত পর্যন্ত যেতে নিষেধ করেন এবং সেখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এই লংমার্চের পর মওলানা ভাসানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ফারাক্কা লংমার্চ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে আজও পরিচিত।
.png)

আজ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। শোষণ ও বঞ্চনাহীন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর ছিল বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক পরিকল্পনাও। কোন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তিনি ভেবেছিলেন, তা জানা যাবে এ লেখায়।
৪ ঘণ্টা আগে
আজ বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের জন্মদিন। তাঁর বহুল পঠিত উপন্যাস 'জীবন আমার বোন'। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিজীবনে তাঁর প্রভাব নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
অনেক সময় কাউকে ফোন করা যায় না, কাউকে ইনবক্সে বলা যায় না, ‘আমি ভালো নেই।’ এ সময়েই অনেকেই মোবাইল বা ল্যাপটপে খুলে চ্যাটজিপিটির মতো এআই নিয়ে বসেন। আমার এক বন্ধুও আজকাল মন খারাপ হলে চ্যাটজিপিটির কাছে যায়। বন্ধুটির মনে হয় এআই যেন সত্যিই তাঁর উদ্বেগ বুঝতে পারছে।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা এক নাম টনি রবিন্স। তিনি শুধু মোটিভেশনাল স্পিকার নন, বরং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘লাইফ কোচ’ ও মেন্টর। অসংখ্য উদ্যোক্তা, নেতা ও সেলিব্রিটিকে তিনি গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
১ দিন আগে