পুলিশ কখন আইনগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, অর্থাৎ কখন ‘গুলি চলানো’ বৈধ—এই প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও বিক্ষোভ বাড়ায় এ বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে।
রায়ের আগের দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার রবিবার (১৬ নভেম্বর ২০২৫) যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি কেউ গাড়িতে আগুন দেয়, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বা মানুষ ও পুলিশকে হামলা করে, তাহলে পুলিশ ‘আইন অনুযায়ী’ গুলি চালাতে পারবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশও কয়েক দিন আগে একই ধরনের কথা বলেন।
পুলিশি শক্তি ব্যবহারের প্রধান আইনগত ভিত্তি
দণ্ডবিধি (সিআরপিসি), ১৮৯৮:
গ্রেপ্তার, ভিড় নিয়ন্ত্রণ ও পুলিশের ক্ষমতার ভিত্তিমূল আইন। এতে ‘গুলি চালানো’ শব্দটি নেই, তবে ধাপে ধাপে শক্তি প্রয়োগের অনুমতি রয়েছে।
পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গল (পিআরবি), ১৯৪৩:
দাঙ্গা বা জন অস্থিরতার সময় পুলিশ কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে (রেগুলেশন ১৪৫–১৫৮)।
পেনাল কোড, ১৮৬০:
আত্মরক্ষা ও অন্যের সুরক্ষার নীতি নির্ধারণ করে (ধারা ৯৬–১০৬)। জীবন বা গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে শক্তি প্রয়োগ বৈধ হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধান:
জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে ৩১–৩২ অনুচ্ছেদ, নির্যাতন নিষিদ্ধ করে ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার দেয় ৩৭ অনুচ্ছেদ, তবে জননিরাপত্তার স্বার্থে সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে।
আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা:
বাংলাদেশ আইসিসিপিআর ও ক্যাট সনদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুসরণের দায়িত্ব রয়েছে। জাতিসংঘের ‘বেসিক প্রিনসিপলস অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ার আর্মস’-এ রয়েছে, শক্তি প্রয়োগ হবে শেষ উপায়, ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত ও একদম প্রয়োজনীয়।
সামগ্রিকভাবে এসব আইন বল প্রয়োগকে সীমিত, প্রয়োজনীয় ও জবাবদিহিমুখী করার ওপর জোর দেয়।
কোন শর্তে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারে
বাংলাদেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে পারে না। এর জন্য কঠোর শর্ত ও পরিস্থিতিগত প্রয়োজন থাকতে হয়। এখানে প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো—
১. গ্রেপ্তারের সময় (সিআরপিসি ৪৬ ধারা)
যদি কোনো আসামি গ্রেপ্তার এড়াতে প্রতিরোধ করে বা পালাতে চায়, পুলিশ ‘সব ধরনের প্রয়োজনীয় উপায়’ ব্যবহার করতে পারে।
প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তখনই বৈধ, যখন অপরাধটি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ডযোগ্য (যেমন—খুন)।
ছোট বা কম গুরুতর অপরাধে প্রাণঘাতী শক্তি বৈধ নয়; শক্তি ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে।
উদাহরণ: কোনো খুনের আসামি অস্ত্রসহ পুলিশকে আক্রমণ করলে গুলি চালানো যুক্তিযুক্ত হতে পারে, কিন্তু চুরি বা ক্ষুদ্র অপরাধে তা বৈধ নয়।
২. বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ (সিআরপিসি ১২৭-১৩১ ধারা)
পাঁচ বা ততোধিক মানুষ জনশান্তি বিঘ্নের সম্ভাবনা তৈরি করলে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ছত্রভঙ্গের নির্দেশ দিতে পারেন।
নির্দেশ অমান্য করলে প্রথমে ‘সিভিল ফোর্স’ ব্যবহার করা হয়।
তা-ও ব্যর্থ হলে সামরিক বাহিনী সহায়তায় আসতে পারে, তবে আইন নির্দেশ করে—বল প্রয়োগ হবে ‘যতটা সম্ভব কম’ এবং ক্ষতি ন্যূনতম রাখতে হবে।
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথা সিআরপিসিতে সরাসরি নেই, তবে পিআরবিতে বলা আছে—গুলির আগে সতর্কবার্তা দিতে হবে এবং এটি হবে শেষ উপায়।
মনে রাখা প্রয়োজন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে শুধু সম্পত্তি রক্ষার জন্য গুলি চালানো বৈধ নয়।
৩. আত্মরক্ষা বা অন্যকে রক্ষা (পেনাল কোড ৯৬-১০৬; পিআরবি ১৫৩)
জীবন বা গুরুতর আঘাতের আশঙ্কা থাকলে পুলিশ আত্মরক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
আগুন লাগানো, ককটেল নিক্ষেপ, প্রাণঘাতী হামলার মতো পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রভুক্ত।
শক্তি হতে হবে প্রয়োজনীয় ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দাঙ্গার সময় পিআরবি নির্দেশ দেয়—প্রথমে সতর্কবার্তা, তারপর সতর্কতামূলক ফাঁকা গুলি, এরপর শরীরের নিচের অংশে লক্ষ্য করে গুলি করে হুমকি নিষ্ক্রিয় করা। হুমকি শেষ হলেই গুলি বন্ধ করতে হবে।
৪. অন্যান্য সীমাবদ্ধতা
ছোটখাট অপরাধ, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ বা অতি তুচ্ছ হুমকির ক্ষেত্রে গুলি চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
২০১৩ সালের ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ হেফাজতে অতি বল প্রয়োগকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
সিআরপিসি ১৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সততা বা উদ্দেশ্য সৎ থাকলে সরকারের অনুমতি ছাড়া পুলিশকে অভিযুক্ত করা যাবে না—তবে এই ধারা দায়মুক্তির অপব্যবহারের কারণে সমালোচিত হয়েছে।
তদারকি, জবাবদিহি ও সাম্প্রতিক সংস্কার
তদন্ত প্রক্রিয়া:
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে বাধ্যতামূলকভাবে একটি নির্বাহী তদন্ত করতে হয়। এটি পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গল (পিআরবি)-এর ১৫৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারে। তবে তাদের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতা সীমিত।
যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ব্যাপক বেআইনি গুলিবর্ষণ হয়েছে। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীরাও লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এসব ঘটনায় খুব কম ক্ষেত্রেই জবাবদিহি দেখা গেছে। কেবল লাইভ অ্যামুনিশন বা তাজা গুলি ব্যবহারে ১৬০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেক ঘটনারই কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
২০২৪-পরবর্তী সংস্কার:
২০২৫ সালের মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। নিয়মিত পুলিশ বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়। এগুলো কেবল বিশেষায়িত ইউনিট যেমন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মধ্যে সীমিত রাখা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরি করা এবং অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ কমানো।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে নিরাপত্তা সংস্কারের রূপরেখা প্রস্তাব করেছিল, এই পদক্ষেপ তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সংকটের সময়ে ডিএমপি যে ব্যতিক্রমী নির্দেশনা দিয়েছে, তা দেখায় যে জরুরি পরিস্থিতিতে এসব নীতিতে ব্যতিক্রম ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের আইন নির্দেশ করে যে পুলিশ কেবলমাত্র চরম প্রয়োজনেই গুলি চালাতে পারে। এর মধ্যে আছে গুরুতর অপরাধে গ্রেপ্তারের সময় প্রাণঘাতী প্রতিরোধ, আত্মরক্ষায় তাৎক্ষণিক হুমকি, অথবা সহিংস জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে চূড়ান্ত ও অনিবার্য পরিস্থিতি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শক্তি ব্যবহার হতে হবে সর্বনিম্ন মাত্রায়।
তবে বাস্তবায়নে ঘাটতি ও অতীতের অপব্যবহার দেখায় যে আধুনিক, সুস্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক আইন এখন অত্যাবশ্যক। ডিএমপির সাম্প্রতিক নির্দেশনা আইনগতভাবে আত্মরক্ষার কাঠামোর মধ্যে পড়লেও, এর প্রয়োগ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত না হলে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে—বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়।
বিশেষজ্ঞ মতামত:
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। তাঁর মতে—
পুলিশ কখন গুলি করতে পারে, এই প্রশ্নটি শুধু নিরাপত্তা নয়, মৌলিক অধিকার ও সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। বিদ্যমান আইনগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হবে কেবলমাত্র চরম ও অনিবার্য পরিস্থিতিতে এবং তা হবে সর্বশেষ উপায়।
প্রথমত, সিআরপিসি, পেনাল কোড, পিআরবি এবং সংবিধান—এসব আইনগত কাঠামো স্পষ্টভাবে জানায় যে বলপ্রয়োগ হতে হবে প্রয়োজনীয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যথাসম্ভব সীমিত। গুলি চালানো কখনোই ‘স্বাভাবিক’ বা ‘রুটিন’ প্রতিক্রিয়া হতে পারে না। বিশেষ করে সম্পত্তির ক্ষতির মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহজেই প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার আইনগতভাবে ঠিক নয়। তাই গাড়িতে আগুন লাগানো বা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোর ঘটনাও আইনগতভাবে পরীক্ষা করতে হবে—এসব কি সত্যিই তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী হুমকি তৈরি করছে কিনা।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড—বিশেষ করে জাতিসংঘের বেসিক প্রিনসিপলস বলছে, গুলি হবে ‘অ্যাবসোলুটলি নেসেসারি’ এমন পরিস্থিতিতে। অর্থাৎ যেখানে অন্য কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ এই মানদণ্ড মানতে বাধ্য। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ব্যাপক বেআইনি গুলিবর্ষণের অভিযোগ, এবং সরাসরি গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যু—স্পষ্ট করে যে প্রয়োজনীয় জবাবদিহি তখন ছিল না।
তৃতীয়ত, ডিএমপি ও সিএমপির সাম্প্রতিক নির্দেশনা আইনগতভাবে আত্মরক্ষা নীতির মধ্যে পড়ে ঠিকই, কিন্তু এখানে ঝুঁকি হলো, এই বিধান অত্যন্ত পরিস্থিতিনির্ভর এবং সহজেই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। তাই যথাযথ আইনী প্রক্রিয়াতেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
চতুর্থত, ২০২৫ সালের সংস্কার যেখানে নিয়মিত পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে—এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সংকট দেখা দিলে আবার ব্যতিক্রমী অনুমতি দেওয়া হয়। আইন পরিবর্তন করা যত গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে আইন একভাবে, স্পষ্টভাবে এবং বৈষম্যহীনভাবে প্রয়োগ করা।
পুলিশের দায়িত্ব জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিন্তু নাগরিকের জীবন রক্ষাও সমানভাবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা ‘আইনগত অনুমতি’ পেলেই যথেষ্ট নয়; এর প্রতিটি ব্যবহার হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, অনুপাতমূলক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এই সতর্কতা আরও জরুরি। কারণ, তখন অপব্যবহারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ না হয়, তাহলে এটি জনবিশ্বাস ও মানবাধিকার—দুটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।