হোয়াইট হাউসের লনে আহমেদ আল-শারার পায়চারি করছেন। আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলছেন। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছেন। মাত্র দুই বছর আগেও এসবকে নিছকই উদ্ভট কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সিরিয়ার এই বিদ্রোহী নেতার সাম্প্রতিক হোয়াইট হাউস সফরে এমন দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছে গোটা বিশ্ব।
আহমেদ আল-শারা আল-কায়েদার একজন প্রাক্তন সহযোগী। একসময় আমেরিকান বাহিনী তাকেই খুঁজে বেড়াত। অথচ তিনিই এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে রাজকীয় সংবর্ধনা পাচ্ছেন। ট্রাম্প তাঁকে ‘অত্যন্ত শক্তিশালী অতীত’ সম্পন্ন একজন ‘তরুণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের আদলে নতুন করে সাজাতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তহীন চেষ্টার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
গত ১০ নভেম্বর আল-শারার ওয়াশিংটন সফর ছিল কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্টের প্রথম হোয়াইট হাউস সফর। এই সফর নিঃসন্দেহে আল-শারার ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতীক। আল-শারা বছরের পর বছর আমেরিকান বন্দিশিবিরে কাটিয়েছেন। একসময় তাঁর মাথার দাম ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এখন তাঁর বিরুদ্ধে ‘সিজার অ্যাক্ট’-এর অধীনে থাকা নিষেধাজ্ঞা ১৮০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে। তাঁকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকেও সরিয়ে দিয়েছে।
এই সব কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সিরিয়াকে আইএস-বিরোধী জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি ২০২০ সালে আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তিও প্রসারিত করতে চায়।
তবে বিশ্লেষকরা একে আমেরিকান কূটনীতির কোনো বিজয় মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, এটি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী শাসকদের মধ্যে থেকে যখন যাকে সুবিধাজনক মনে হয়, তাকে আলিঙ্গন করার ওয়াশিংটনের বহুল প্রচলিত অভ্যাস।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ওয়াশিংটনের পুরোনো খেলার নতুন খেলোয়াড়
দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ দাবি করছে, আল-শারার এই উত্থানকে ঘিরে ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী মহলে ইতিমধ্যেই ঐকমত্য তৈরি হয়ে গেছে। আঞ্চলিক শক্তি সৌদি আরব ও তুরস্ক তাঁর পক্ষে তদবির করছে। তারা সিরিয়ায় ইরান ও রাশিয়ার ছেড়ে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করতে আগ্রহী। কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলগুলো তাঁর সঙ্গে নৈশভোজে মিলিত হচ্ছে।
সিরিয়ার দামেস্কের কেন্দ্রে অবস্থিত মেজেহ বিমানঘাঁটি দশকের পর দশক ধরে আসাদ সরকারের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান প্রতীক ছিল। শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন এই বিমানঘাঁটিতে সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, যা একটি শক্তিশালী ইঙ্গিত।
ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, ১৯৮০-এর দশকে সাদ্দাম হোসাইনঙ্কে ইরানের মৌলবাদের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হয়েছিল। আফগান মুজাহিদদের সোভিয়েত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বরণ করা হয়েছিল। লিবিয়ার বিদ্রোহীদের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কারক’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রতিবারই ওয়াশিংটন নিজেকে বুঝিয়েছে, তারা প্রকৃত অংশীদার খুঁজে পেয়েছে। আর প্রতিবারই বাস্তবতা নির্মম প্রতিশোধের সঙ্গে ফিরে এসেছে।
মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচক লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ফাওয়াজ গেরগেস তাঁর বিভিন্ন লেখায় এই প্রবণতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা একটি মৌলিক ভুল করছেন। তাঁরা বিশ্বাস করছেন একজন জিহাদি নেতার কৌশলগত ভোলবদল তাঁর আদর্শিক রূপান্তরের সমার্থক। আমেরিকা আজ যাকে স্থিতিশীলতার কারিগর ভাবছে, কাল সে-ই হয়তো মার্কিন স্বার্থের জন্য বুমেরাং হবে।’
বাস্তববাদী কূটনীতির যুক্তি ও তার সীমাবদ্ধতা
তবে অনেক বিশ্লেষকই দাবি করছেন, সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে এক ধরনের নির্মম বাস্তববাদী যুক্তিতে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য কমপক্ষে ২১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য কোনো উৎস থেকে আসার সম্ভাবনা নেই। আল-শারার সরকার দামেস্ক নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর উৎস যা-ই হোক না কেন, তিনি আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার বিকল্প কোনো গণতান্ত্রিক সিরিয়া নয়। এর বিকল্প হলো চলমান বিশৃঙ্খলা, শরণার্থীর স্রোত ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)-এর প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস রিচার্ড হাসের মতে, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনো নৈতিকতার প্রতিযোগিতা নয়। মাঝে মাঝে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য অপছন্দের শাসকের সঙ্গেও হাত মেলাতে হয়। সিরিয়াকে ইরানের প্রভাব বলয় থেকে বের করা আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইএসআইএস-কে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করাও জরুরি। আল-শারা যদি সেই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হন, তবে তাঁর অতীত নিয়ে অতিরিক্ত ঘাঁটাঘাঁটি করাটা হবে বিলাসিতা।’
কিন্তু এই বাস্তবতাগুলো স্বীকার করলেও হোয়াইট হাউসে আল-শারার সংবর্ধনাকে ট্রাম্পের অতি নাটুকেপনা বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সিরিয়াকে একঘরে করে রাখা ও প্রাক্তন আল-কায়েদা সহযোগীর জন্য লাল গালিচা বিছানোর মধ্যে বিশাল মধ্যবর্তী পথ রয়েছে বলেও মনে করেছেন অনেকে। মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো চার্লস লিস্টার সতর্ক করে বলেছেন, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) আল-কায়েদা থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কিন্তু এর গভীরে থাকা সালাফি-জিহাদি মতাদর্শ রাতারাতি উবে যায়নি। লিস্টার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই পরিবর্তন মূলত টিকে থাকার কৌশল, আদর্শিক রূপান্তর নয়। সুতরাং, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ বিশাল ঝুঁকির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
আইএস দমন: আসল উদ্দেশ্য আড়ালের কৌশল?
আল-শারার সঙ্গে এই সুসম্পর্কের আপাত কারণ হিসেবে সিরিয়াকে আইএস-বিরোধী জোটে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এটি আসল উদ্দেশ্য আড়ালের কৌশল। নিউ লাইনস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হাসান হাসানের বিশ্লেষণ মতে, আইএসআইএস বর্তমানে এতটাই দুর্বল যে তাকে দমনের জন্য আল-শারার মতো বিতর্কিত নেতাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য আসলে দামেস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও সিরিয়াকে আঞ্চলিক কাঠামোতে একীভূত করা, ইসরায়েল-সিরিয়া চুক্তিতে মধ্যস্থতা করা এবং সর্বোপরি ইরানের প্রভাব মোকাবিলা করা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামক বয়ানটি ব্যবহার করে এমন একজন নেতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, যাঁর সংগঠন নিজেই অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। তাদের মতে, আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে যুক্তরাষ্ট্রের আল-শারার অতীত অপরাধকে মুছে ফেলার এই প্রচেষ্টা উগ্রবাদের ভুক্তভোগীদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
অন্যদিকে, ভৌগোলিক নৈকট্য ও শরণার্থী সংকটের কারণে সিরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্য ইকোনমিস্ট তাদের সম্পাদকীয়তে এই বিষয়কে ‘আমেরিকার অপ্রয়োজনীয় অভিভাবকত্ব’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, সিরিয়ার পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতা প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় দায়িত্ব হওয়া উচিত। আমেরিকান সম্পৃক্ততা কেবল প্রকৃত নিরাপত্তা স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকবে।
অনিবার্য হতাশার পথ
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির কারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ভুল থেকে খুব কমই শিক্ষা গ্রহণ করে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বা কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর মতো থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর অনেক বিশ্লেষকই এখন আল-শারার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকে বিচক্ষণ বাস্তববাদী রাজনীতি বলছেন। কিন্তু আমেরিকান প্রভাবকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া ও আঞ্চলিক জটিলতাকে অবমূল্যায়ন করার সেই একই প্রবণতা এখনো বিদ্যমান।
আন্তর্জাতিক সংকট গোষ্ঠীর (আইসিজি) বিশ্লেষকরা তাঁদের প্রতিবেদনে প্রায়শই ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আহমেদ আল-শারা ও সিরিয়ার ওপর বড় জুয়া খেলছে’ বলে দাবি করে আসছে।
আল-শারার সফর মার্কিন-সিরিয়া সম্পর্কে সত্যিই নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। কিন্তু ইতিহাস বলে, মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আহমেদ আল-শারার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে হোয়াইট হাউসের অতিথি হয়ে ওঠার যাত্রা হয়তো অসাধারণ, কিন্তু নজিরবিহীন নয়।
আসল প্রশ্ন হয়তো এই নয় যে আমেরিকার সিরিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত কি না। বরং প্রশ্ন হলো, গত তিন দশক ধরে আমেরিকান মধ্যপ্রাচ্য নীতি প্রত্যাশা ও অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তা করতে সক্ষম কি না।