বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁকে দায়ী করা হয়।
রায় ঘোষণার পর বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। আল জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান ও ডিডাব্লিউর মতো গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে এই খবর প্রচার করে।
গণমাধ্যমগুলো বিশেষ করে তুলে ধরেছে—২০১০ সালে শেখ হাসিনা নিজেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, সেই ট্রাইব্যুনালেই একই অভিযোগে তাঁর বিচার হয়েছে।
আল জাজিরা
কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার লাইভ ব্লগে রায়কে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বিশেষ করে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন দমনে হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সহিংসতার ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সহিংস দমনের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। রায়ের সময় তিনি পলাতক ছিলেন এবং অনুপস্থিত অবস্থায় তার বিচার সম্পন্ন হয়। আদালত তাকে আন্দোলন দমনের ‘মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রধান স্থপতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওই দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
প্রতিক্রিয়ার অংশে বলা হয়, ভারতের আশ্রয়ে হাসিনা নিরাপদ আছেন। তাঁর পরিবার দাবি করছে, এ মামলা রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক। অন্যদিকে নিহত ও আহতদের পরিবার ন্যায়বিচার দাবি করছে। ভারতের ভূমিকা ও আঞ্চলিক উত্তেজনার ঝুঁকিও তাদের প্রতিবেদনে গুরুত্ব পায়।
আল-জাজিরা জানায়, রায়ের আগে তাঁর ছেলে দাবি করেছিলেন—আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেবেই এবং দল নিষিদ্ধ থাকার কারণে তারা নির্বাচন বর্জন করতে পারে।
আল-জাজিরা আরও জানায়, শেখ হাসিনা এই রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। রায়ের পর এএফপিতে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ প্রতিক্রিয়া জানান।
ভারতে অবস্থান করে দেওয়া তার বিবৃতিতে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় একটি ‘কারচুপিমূলক ট্রাইব্যুনাল’ থেকে এসেছে। এই ট্রাইব্যুনাল একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে গঠিত হয়েছে, যার কোনো গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নেই।
আল-জাজিরার প্রতেবেদনে, আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, রায়ের পরও হয়তো ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না।
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত আল জাজিরাকে বলেন যে হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত ছিল। তবে ভারত কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রত্যর্পণ করবে না।
তিনি বলেন, ‘কোনো পরিস্থিতিতেই ভারত তাকে প্রত্যর্পণ করবে না।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘গত দেড় বছরে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। বহু সময়ে এই সম্পর্ককে ভঙ্গুর মনে হয়েছে।’
দত্ত জানান, হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল। তিনি বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে তার বিরুদ্ধে কঠোর বিচার আসছে।’
তিনি আরও যোগ করেন যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন—বাংলাদেশে এ মামলার বিচার দেশের প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হয়েছে।
দত্ত বলেন, ‘নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে, তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। প্রমাণ আছে যে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ পাল্টা বয়ান গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। তবে অধিকাংশ বাংলাদেশি বিশ্বাস করেন যে হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
সিএনএনে হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়।
বিবিসি
বিবিসি সকাল ১০টা থেকেই হাসিনার রায় নিয়ে লাইভ আপডেট প্রচার করে। তারা ঘটনাটিকে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জবাবদিহির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে উল্লেখ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তারা ড্রোন ও হেলিকপ্টারসহ প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার অনুমোদন করেছিলেন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সেই অভিযানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়।
বিবিসি ভুক্তভোগী পরিবারের শোক ও ক্ষোভ তুলে ধরে। অনেকেই রায়কে ন্যায়বিচারের পথে একটি ধাপ হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে, হাসিনা রায়টিকে ‘প্রহসন’ বলে মন্তব্য করেন এবং দাবি করেন যে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যাতে কোনো সহিংস প্রতিক্রিয়া না ঘটে।
আন্তর্জাতিকভাবে বিবিসি উল্লেখ করে—ভারতের ওপর এখন হাসিনাকে প্রত্যর্পণের চাপ বাড়ছে।
সিএনএন
সিএনএন রায়ের ওপর বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল মনে করেছে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের আন্দোলন দমন করতে সরাসরি নির্দেশ দেন এবং এর ফলে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সিএনএন আন্দোলনের পটভূমিও তুলে ধরে—যেখানে ছাত্রদের কোটা সংস্কার দাবি ধীরে ধীরে দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয় এবং তাঁর ‘স্বৈরাচারী শাসনের’ বিরুদ্ধে জনবিরোধ বাড়তে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে সহিংসতায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত ও ২৫ হাজার আহত হন। সিএনএন জানায়, নির্বাসন থেকে হাসিনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদকদের কাছে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তারা আরও উল্লেখ করে, রায়টি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সীমিত থাকলেও, দুই দেশের সম্পর্কে রায়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সিএনএন সতর্ক করেছে।
রয়টার্সে হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবেদন।
রয়টার্স
রয়টার্স রায়টিকে মাসব্যাপী চলা বিচারপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে বর্ণনা করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে দোষী প্রমাণ করা হয়েছে। তারা উল্লেখ করে যে, ফাঁস হওয়া ফোন রেকর্ডিং এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি করার মতো নির্দেশ দিয়েছেন।
রয়টার্স জানায়, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সংস্থার প্রতিবেদনে আন্দোলনের সময় তাঁর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। জন-প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। কেউ রায়কে স্বাগত জানালেও, অনেক জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গুলি চালানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে রয়টার্স জানায়, আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ হওয়ায় দলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। প্রবাসে থাকা শেখ হাসিনার ছেলে আরও অস্থিরতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, বিশেষ করে যদি রায়ের পর নতুন দমন-পীড়ন শুরু হয়।
দ্য গার্ডিয়ান
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুপস্থিত অবস্থায় ঘোষিত এ রায়ে শেখ হাসিনাকে উসকানি, হত্যার নির্দেশ দেওয়া এবং ‘জুলাই বিপ্লবের’ সময় নৃশংসতা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারকরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে হাসিনা ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওতে এক হাজারের বেশি মৃত্যুর প্রমাণও আদালতে উপস্থাপিত হয়।
প্রতিবেদনে নিহতদের পরিবারের আবেগঘন প্রতিক্রিয়াও তুলে ধরা হয়। ভারত থেকে হাসিনার পাঠানো একটি অডিও বার্তাও উদ্ধৃত করা হয়, যেখানে তিনি দাবি করেন যে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করবেন এবং তিনি তাঁর জনগণের সেবা করে যাবেন। দ্য গার্ডিয়ান জানায়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত তাঁকে প্রত্যর্পণ করছে না। পাশাপাশি ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়—অন্তর্বর্তী সরকার এটিকে ন্যায়বিচারের পথে একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখছে।
দ্য গার্ডিয়ানে হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়।
ডয়চে ভেলে (ডিডাব্লিউ)
ডিডাব্লিউ’র লাইভ আপডেটে রায়টিকে ২০২৪ সালের আন্দোলন-সংক্রান্ত প্রথম আইসিটি রায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসিনা শুধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যর্থ হননি, বরং তাঁর নির্দেশেই দমন-পীড়ন চালানো হয়, যেখানে প্রায় ১ হাজর ৪০০ মানুষ নিহত হয়। অভিযোগগুলো মূলত আন্দোলনের সময় তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে। তাঁর সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক পুলিশ প্রধানও দোষী সাব্যস্ত হন।
ডিডাব্লিউ জানায়, আগস্ট ২০২৪ থেকে তিনি ভারতে পলাতক অবস্থায় আছেন এবং আওয়ামী লীগ আদালতকে ‘ক্যাংগারু ট্রাইব্যুনাল’ বলে আখ্যা দিয়ে সারাদেশে ধর্মঘট ডাক দিয়েছে। প্রতিবেদনে আপিল ও প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার সম্ভাবনাও আলোচনা করা হয়। ২০২৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে—তাও তারা উল্লেখ করে। জাতিসংঘের মৃত্যুর হিসাব মানবাধিকার উদ্বেগের ইঙ্গিত দিলেও নির্দিষ্ট সংগঠনের প্রতিক্রিয়া তারা আলাদা করে উল্লেখ করেনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডকে ২০২৪ সালের দমন-পীড়নের জবাবদিহির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখছে। প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণভাবে উঠে এসেছে—রায়টির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য, হাসিনার নির্বাসন ও অভিযোগ অস্বীকার, ভুক্তভোগীদের আবেগ এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি।
এ ছাড়া ভারতকে প্রত্যর্পণের চাপ, আগাম নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায়সংগততা নিয়ে প্রশ্ন—এসব বিষয় প্রায় সব গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেই এসেছ। রায়টিকে তারা বাংলাদেশের উত্তাল রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনসূচক ঘটনা হিসেবে তুলে ধরছে এবং ন্যায়বিচার ও সংস্কারের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।