leadT1ad

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুই টার্মিনালের চুক্তি নিয়ে বিতর্ক

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। সংগৃহীত ছবি

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনাসহ ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। গতকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) পৃথক অনুষ্ঠানে এই চুক্তি সই হওয়ার পরপরই তা নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। সরকার এই বিনিয়োগকে ‘বাণিজ্যে নতুন যুগের সূচনা’ বললেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ‘তাড়াহুড়া করে অস্বচ্ছভাবে’ এসব দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে, যা গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

এদিকে, এই চুক্তি এমন এক দিনে সই হয়েছে যেদিন জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি জনমতের মনোযোগ বিভ্রান্ত করার অভিযোগকে আরও উসকে দিয়েছে।

চুক্তি সম্পর্কে যা জানা গেল

চুক্তি অনুযায়ী, ডেনমার্কের এপি মুলারের মায়ের্সক শিপিং লাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৩০ বছরের জন্য এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এতে কোম্পানিটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশ কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পেয়েছে। টার্মিনালটির বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা থাকবে।

অন্যদিকে, ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডলগ এসএ (এমএসসি শিপিং কোম্পানি)। চুক্তি হয়েছে ২২ বছরের জন্য। মেডলগ মোট ৪ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এবং বাংলাদেশকে ১৮ কোটি টাকা সাইনিং মানি হিসেবে দিয়েছে।

চুক্তি অনুসারে, লালদিয়া টার্মিনালে বছরে ৮ লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে সরকার পাবে ২১ ডলার করে, আর ৮ লাখের বেশি হ্যান্ডলিং হলে পাবে ২৩ ডলার করে। পানগাঁও টার্মিনালে প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।

তবে চুক্তিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনামুখর হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘৪৮ বছরের চুক্তি এত দ্রুততার সাথে করে আশিক চৌধুরী গর্ব করছেন। ওনার কথা শুনলে মনে হবে, কত ইফিশয়েন্সি দেখালেন। আর্থিক মূল্যায়ন, কারগরি মূল্যায়ন করতে এত কম সময় নেয়ার অর্থ যে হতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নজর এড়িয়ে যাওয়া, পর্যালোচনা ছাড়া কিছু সুবিধাজনক প্যারামিটারের ভিত্তিতে ইভ্যালুয়েট করা, এটা তিনি শুধু না, অনেকেই বুঝতে চায় না। তারা ভুলে যায় আদানি চুক্তিতে কত দেশীয় স্বার্থবিরোধী শর্ত ছিল, ভুলে গেছেন কর্ণফুলী টার্মিনালের ফিজিবিলিটি স্টাডি করে রাতারাতি আর্থিকভাবে লাভজনক দেখাতে মনগড়া ট্রাফিক চলাচলের সংখ্যা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা ভুলে গেছেন বোয়িং কেনার চুক্তির আগে রাতারাতি মূল্যায়ন কমিটি ইভ্যালুয়েশনের প্যারামিটার চেঞ্জ করে ফেলেছে। দুই-চারদিনের ব্যবধানে দুই কমিটি দুই রিপোর্ট দিয়েছে। তারা ভুলে গেছে জাইকার প্রকল্প আর্থিক মূল্যায়নে সত্ত্বেও বাংলাদেশে মেট্রোরেলের খরচ অন্য দেশের তুলনায় বেড়ে গেছে।‘

তিনি আরও বলেন, ‘এইসবকিছু নিজেদের ইচ্ছামত, নিজেদের সময় মতো ভুলে যাওয়া যায়। তাই এখন ইভ্যালুয়েশন তাদের কাছে সঠিক মনে হচ্ছে। দেশের সংকটকালে সুবিধা নেয়া তো এদেশের নীতিনির্ধারকদের রেওয়াজ। করোনার সময় দেখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেখেছি। সব মনে রাখা হবে।’

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘এ ধরনের চুক্তির একটা আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া হচ্ছে দরপত্র দিতে হবে, তাদের শর্তগুলো জানতে হবে, শর্তগুলো দেশের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। শর্তগুলো যদি আমরা না জানি, তাহলে এই সিদ্ধান্তটা কে নিতে পারে, কীভাবে নিতে পারে? যে প্রক্রিয়ায় সরকার এই চুক্তি করেছে, তাড়াহুড়া করে অস্বচ্ছভাবে, আগে কোনও কিছু না জানিয়ে এবং এমন একটা দিন বাছাই করল, যেদিন সম্পূর্ণ একটা অস্বাভাবিক দিন। পুরা জিনিসটাই খুবই সন্দেহ সৃষ্টি করে।’

বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দর দেওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে দুর্নীতি ও অদক্ষতার কথা বলা হলেও তা সব সময় ঠিক নয় উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ নিউমুরিং বন্দরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল তো (এনসিটি) লাভজনক ছিল, সেটা কেন বিদেশি কোম্পানিকে দিল? বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে সেখানে মাসুলও বাড়ানো হচ্ছে।...বন্দরে দুর্নীতি থাকলে কে করছে, কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, এগুলো দূর করার পথ কি—সেটা তো বের করতে পারত সরকার। তা না করে তারা বিদেশি কোম্পানিকে টার্মিনাল তুলে দিচ্ছে।’

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুর্নীতি তো মন্ত্রণালয়েও হয়, সেই দুর্নীতি দূর করতে কি মন্ত্রণালয় বিদেশিদের দিয়ে দিতে হবে, নাকি দুর্নীতি দূর করার পথ বের করতে হবে? দুর্নীতি দূর করার পথ বের করা এবং জাতীয় সক্ষমতার পথের বাধাগুলো কী, সেটা চিহ্নিত করে এটা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে দেওয়া যেত। এই সরকার আছেই আর কয়েক মাস, তার কেন ৩০ থেকে ৪০ বছরের একটা চুক্তি করে ফেলল সম্পূর্ণ গোপনে! কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয় এটা? পুরো প্রসেসটাই খুবই সন্দেহজনক এবং কোনভাবেই এই সরকারকে যে বিশ্বাস করা যায় না সেটার একটা দৃষ্টান্ত।’

চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), জমিয়তে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম পৃথক বিবৃতিতে চুক্তির বিরোধিতা করেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভাষ্য, দেশীয় সক্ষমতা থাকা অবস্থায় বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল তুলে দেওয়া যৌক্তিক নয়।

বন্দরসম্পর্কিত ব্যবসায়ীরাও বলছেন, দেশীয় অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এড়াতে বিদেশি কোম্পানিকে আনা হয়েছে।

উদ্বেগ ও প্রতিবাদ

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়ার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে সোমবার পৃথক বিবৃতি দিয়েছে চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম।

এ ছাড়া আমদানির সঙ্গে যুক্ত দুজন শীর্ষ ব্যবসায়ী স্ট্রিমকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, দেশের বেশ কয়েকটি টার্মিনাল দেশীয় ব্যবসায়ীদের পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। তাঁদের কোনো সুযোগ না দিয়ে বিদেশিদের ডেকে আনা কতটা যৌক্তিক হলো, এই প্রশ্ন রয়ে যাবে।

তবে এই মুহূর্তে দেশীয় কোনো ব্যবসায়ীকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দিলে এ নিয়ে বিতর্ক উঠত বলেও মনে করেন ওই ব্যবসায়ীরা। কারণ ব্যাখ্যা করে তাঁরা জানান, টার্মিনাল পরিচালনায় অভিজ্ঞতা থাকা সবাই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সমর্থক। এ জন্য কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই উদ্যোগ থেকে সুবিধা নিত। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশিদের ডেকে এনেছে। এতে দেশের উদ্যোক্তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। এটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়েছে।

‘গাড়িটা আমাদের, তারা ড্রাইভার’

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মায়ের্সক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ডেনমার্কের কোম্পানির বিনিয়োগ দেশের জন্য নতুন সূচনা। ইউরোপ থেকে বৃহত্তর বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে।’

প্রধান উপদেষ্টার বিনিয়োগবিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, লালদিয়া টার্মিনালের মালিকানা পুরোপুরি বাংলাদেশের কাছেই থাকবে। তাঁর ভাষায়, ‘মনে করুন, গাড়িটা আমাদের। তারা ড্রাইভার। তাহলে কি গাড়িটা তার হয়ে গেল?’

আশিক চৌধুরী আরও জানান, টার্মিনাল নির্মাণে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস নিজেরাই বিনিয়োগ করবে এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বিনিময়ে বাংলাদেশ নির্দিষ্ট ফি পাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এই প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ ডয়েচে ভেলেকে বলেন বলেন, ‘এই চুক্তিগুলো সবাইকে জানিয়ে করা হচ্ছে৷ চুক্তি হওয়ার এক সপ্তাহ আগে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের ডজন ডজন প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে৷ আসলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমাদের আধুনিক পোর্ট লাগবে৷ সরকার সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে৷ পানগাঁও, নিউমুরিং একই উদ্দেশ্যে চুক্তি করা হয়েছে বা হচ্ছে৷’

লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এই চুক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য বড় অবদান৷ যাদের মধ্যে চুক্তি নিয়ে সন্দেহ ছিল, আশা করি তা দূর হবে৷’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত