অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশের জ্ঞানজগতের এক কিংবদন্তি। তিনি লিখেছেন সামান্য। আব্দুর রাজ্জাকের প্রজ্ঞাভরা কথামালা ছড়িয়ে যাঁরা তাঁর সানিধ্য পেয়েছেন, তাঁদের কাছে। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ সেই মানুষদের একজন। তিনি একটি ১৯৮৪ সালে আবদুর রাজ্জাকের একটি সাক্ষাৎকার নেন। প্রকাশক ও হুমায়ুন আজাদের বড় কন্যার অনুমতি নিয়ে এবং বানানরীতি অক্ষুণ্ন রেখে স্ট্রিম পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
স্ট্রিম ডেস্ক

আমাদের দেশটি ছোটো, আর এর মানুষেরাও বেশ ক্ষুদ্র। প্রথাগত ভুয়োদর্শন আমাদের উপদেশ দেয় বেশি না বাড়ার, বেশি উঁচু না হওয়ার। বেশি বৃদ্ধি পেলে ক্রুদ্ধ ঝড়ে ভেঙে পড়ার ভয় আছে। আমাদের প্রকৃতি ও মানুষ যেনো এ-ভয়ে আতঙ্কিত; তাই অভাব এখানে আকাশ-ছোঁয়া বৃক্ষের, দুর্লভ এখানে মহৎ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। মাঝারি, নিম্নমাঝারি ও নিম্ন আকারের ব্যক্তি ও বৃক্ষে পূর্ণ আমাদের লোকালয় ও অরণ্য। কাউকে পাওয়া খুব কঠিন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলে, যিনি আয় করেছেন মহত্ত্ব, অর্জনে বা ত্যাগে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ, এক রকম বিস্ময় ও কিংবদন্তি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাদের এই সময়ের সে-অনন্য পুরুষ, যাঁকে ঘিরে কয়েকদশক ধ’রে জড়ো হয়েছে নানা রহস্য; পরিণত হয়েছেন যিনি জীবিত উপকথা বা কিংবদন্তিতে। ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর বহুমুখি পাণ্ডিত্যের নানা গল্প, জীবনের অসংখ্য উপাখ্যান। শারীরিক সৌন্দর্যে দেবতুল্য নন তিনি যে তাঁকে দেখেই দর্শক ভক্ত হয়ে উঠবে; বাগ্মীও নন তিনি যে শ্রোতা তাঁর বাণী আস্বাদ ক’রে স্পর্শ পাবে অমৃতের। মোটা মোটা বই লিখেন নি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অলংকৃত করেন নি জ্যোতির্ময় বিভিন্ন আসন; এমনকি নিজের নামের সঙ্গে তিন অক্ষরের একটি উপাধিও যুক্ত করেন নি তিনি। তবু তিনিই হয়ে উঠেছেন আমাদের সাম্প্রতিক জ্ঞানজগতের কিংবদন্তি। এর মূলে আছে সম্ভবত দুটি সহজ কিন্তু অসাধারণ কারণ: প্রাচীন ঋষিদের মতো তিনি নিজের দীর্ঘ ও সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন জ্ঞান আহরণে, এবং ঋষিদের মতোই তিনি অবলীলায় অবহেলা ক’রে গেছেন পার্থিব সাফল্য। জ্ঞানের জন্যে এমন তপস্যা—জীবন, সংসার, সাফল্যের কথা ভুলে—এখন দুর্লভ ব্যাপার; আর তাই রূপ লাভ করতে দেখি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে। শুধুই জ্ঞানের জন্যে সব ত্যাগ ক’রে তিনি হয়ে উঠেছেন এই সময়ের জ্ঞানতাপস।
ছোটখাটো মানুষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তাঁর ক্ষীণ কাঠামোতে সত্তর বছর ধ’রেই বেশি মেদমাংস জমতে পারে নি। মুখে একগুচ্ছ দাড়ি, চশমার ভেতরে দীপ্ত দু’টি চোখ। কম দামের পাজামাপঞ্জাবিচাদর পরেন। চাদরটা কখনো ঝুলতে থাকে গলায়, কখনো জড়ানো থাকে শরীরে। রাস্তায় হাঁটার সময় বাঁ হাতে অনেকটা নিজেকে জড়িয়ে ধ’রে হাঁটেন। বসার সময় গুটিয়ে নেন নিজেকে, যেনো লুপ্ত হয়ে যাবেন আসনের অভ্যন্তরে। হাত দিয়ে যখন কিছু ধরেন, তখন মনে হয় জিনিসটি বোধ হয় এখনি গড়িয়ে পড়বে হাত থেকে। ওই হাত যেনো কিছুই ধ’রে রাখতে জানে না।
তাঁর সঙ্গে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমার দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। দাবা খেলতে ভালোবাসেন তিনি। এটা তাঁর দ্বিতীয় নেশা। পৌঁনে ছটার দিকে ক্লাবে এসে খেলার সাথী কেউ না থাকলে চুপ ক’রে ব’সে থাকেন নির্দিষ্ট আসনটির এক কোণায়। সাথী এলেই খেলা শুরু হয়ে যায়। তাঁর দাবা খেলায়ই ধরা পড়ে তাঁর চরিত্রের তিনটি বড়ো বৈশিষ্ট্য। দাবাড়ুরা সাধারণত একটু অহমিকাসম্পন্ন হ’য়ে থাকে—তারা একটি জিনিস খুবই ঘৃণা করে, তা হলো হারা। খুবই পছন্দ করে তারা জিততে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একের পর এক খেলে যেতে থাকেন, চাল ফেরত দিতে থাকেন বিপক্ষকে; কিন্তু জিতে উল্লাস আর হেরে বিষাদ বোধ করেন না কখনো। তাঁর সারাটি জীবনেও ঘটেছে তাই। জীবনের ইঁদুর দৌড়ে তিনি অংশ নেন নি, কখনো অধিকারের বিজয়ের বাসনায় কেঁপে ওঠেন নি তিনি। পরাভূত হ’য়ে বিপর্যস্ত বোধ করেন নি কখনো। দাবা খেলার সময় তিনি বিপক্ষের ঘুঁটি একটি একটি ক’রে খান, আর পাশের টেবিলে না জমিয়ে জমাতে থাকেন নিজের বাঁ মুঠোতে। এক সময় মুঠোতে ঘুঁটি জ’মে জ’মে উপচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প’ড়ে যায় চারদিকে। ধ’রে রাখার অভ্যাস নেই তাঁর। জীবনকেও তিনি এমনভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন সত্তর বছর ধ’রে। দাবা খেলেন তিনি মোটামুটি—অধিকাংশ চালই সাধারণ; কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি দিতে থাকেন অনুপ্রাণিত চাল আর শিউরে ওঠে দর্শকেরা, কেননা অমন চালের কথা কেউ ভাবে নি। ওই অনুপ্রাণিত দূরদর্শী চালগুলোর মধ্যেই আছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। জ্ঞানজগতের বিভিন্ন সমস্যা ও বিষয় সম্পর্কেও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেশ সাধারণ। কিন্তু হঠাৎ আলোর ঝলক লেগে কখনো কখনো আলোকিত হয় তার অন্তর্লোক, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অনুপ্রাণিত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। ওই জ্যোতিটুকুই তো তিনি। তাঁর আরো একটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে দাবার চালেই তিনি কারো পরামর্শ মতো চাল দেন না তা যতো অসাধারণ চালই হোক, তিনি নিজের বোধে নির্দ্বিধায় দেন খুবই ভুল চাল, এবং হেরে গিয়ে অনুতাপ করেন না। জীবনেও আবদুর রাজ্জাক তেমনি। একটা কোমল অথচ অত্যন্ত শক্ত গোঁ রয়েছে তাঁর ভেতরে, যা তাঁকে চালিয়েছে সারা জীবন।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ হেসে ওঠেন; শব্দ শুনে মনে হয় তাঁর ভেতরে খলখল ক’রে উঠছে নিষ্পাপ একটি শিশু। সারা মুখে চোখে ছড়িয়ে পড়ছে সারল্যের দ্যুতি। কথা বলেন তিনি ভরাট স্বরে। কখনোই বিশুদ্ধ চলতি বাঙলা বলেন না। আঞ্চলিক, চলতি বাঙলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে থাকেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। কথা যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে তাঁর ভাষাও হয়ে ওঠে সম্পূর্ণরূপে ইংরেজি। চলতি বাঙলার থেকে আঞ্চলিক ও ইংরেজি অনেক ভালো বলেন তিনি। একটানা কথা বলতে হ’লে, এবং বিষয়টি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে ইংরেজিই বেছে নেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। আটপৌরে কথা বলেন ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি পুরোনো বাংলোবাড়ির একতলায় বাস করেন তিনি। বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৯০৬ সালে বাঙলা ও আসামের একাউন্টেন্ট জেনারেলের বাসগৃহ হিসেবে। একটি বিশাল কক্ষে তিনি একলা থাকেন—চিরকুমার ও অবিবাহিত এ-বয়স্ক জ্ঞানতাপস বিশাল কক্ষটিতে নিঃসঙ্গ ঋষির জীবনযাপন ক’রে যাচ্ছেন বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধে। দিনের বেলা কক্ষটিতে ছড়িয়ে থাকে কিছুটা আলো আর অনেকটা অন্ধকার। কক্ষটির দক্ষিণ দিকে একটি বিরাট পড়ার টেবিল, বসার জন্যে রয়েছে আরামদায়ক চেয়ার। কক্ষের এদিকে সেদিকে শুধু বই—সাহিত্য, অর্থনীতি, শিল্পকলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, দাবা ও আরো অজস্র বিষয়ের বই। বইগুলোর মধ্যে খুবই স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে বিশ্বকোষগুলো। বিভিন্ন ধরনের বিশ্বকোষ তাঁর প্রিয় পাঠ্যগ্রন্থ। ঘরটির মাঝখানে দুটি সোফা, একটি ছোট্ট টেবিল। অবসরে সেখানে ব’সে পড়েন, কেউ এলে আলাপ করেন। উত্তর দিকে তাঁর শয্যা, তোষকবিছানো একটি চৌকি। বাসাটি যে পুরোনো আর এ-বাসার অধিকারী যে একদিন এক বিদেশি ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেছে কক্ষের পশ্চিম দিকে একটি বড়ো ফায়ারপ্লেস। বহু দিন তাতে কেউ আগুন জ্বালায় নি।
একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। আমি তাঁর বাসায় প্রবেশ করি। তাঁর ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াই, বাইরের উজ্জ্বল আলোর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা ঘরটিতে। উঁচু সিলিংয়ের বিশাল ঘর ভ’রে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার। অন্ধকারে টেবিল, তাকে এখানে সেখানে দাঁড়ানো এলানো ছড়ানো বইগুলোকে ছায়ামূর্তির মতো মনে হলো। ঘরের উত্তর দিকে চৌকিটিতে চাদর জড়িয়ে এক টুকরো নিঃসঙ্গতার মতো ঘুমিয়ে আছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। এ-বাড়িতে কোনো শিশুর কোলাহল নেই, যদিও শিশুদের তিনি খুব ভালোবাসেন। কোনো নারীর স্পর্শ নেই, চুলের ঘ্রাণ নেই। একটি কাজের ছেলে বারান্দার রকে ব’সে আছে। ছোটো চৌকিটিতে আরো ছোটো হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। জাগরণে কিছু অধিকার করতে চান নি কখনো তিনি, নিদ্রার মধ্যেও কোনো অধিকার বিস্তার করেন নি। ওই ছোটো চৌকিটিতে যেভাবে ঘুমিয়ে আছেন তিনি তাতে মনে হলো ওখানে আরো কয়েকজন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্বচ্ছন্দে ঘুম যেতে পারেন! কোনো বিবাদ বাঁধাবে না। তিনি কি খুব গভীর ঘুম যান? মনে হলো না। আমি তো নিঃশব্দেই হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম ঘরটি ও তাঁকে। তিনি ঘুম ভেঙে ‘ওহ্’ ব’লে জেগে উঠলেন। আলো জ্বালালেন, অন্ধকার কিছুটা দূর হলো। অন্ধকার বেশ দূর হলো যখন কথা বলতে বলতে খলখল ক’রে হেসে উঠলেন। আমার মনে হলো এ-বাড়ির কক্ষে কক্ষে যেনো মায়ের কোলে খিলখিল ক’রে উঠেছে শিশুরা।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো মানুষদেরই বোধহয় পুরোনো কালে জাতিস্মর বলা হতো। বাল্যকাল থেকেই সব দেখে এসেছেন দু-চোখ খুলে, আর স্মৃতিতে তা জমে আছে অমলভাবে। তবে তিনিও জানেন স্মৃতি বড়ো প্রতারক। জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি দুটি উপায়ে;—নিরপেক্ষ নিস্পৃহ দর্শক হিসেবে, আর পুস্তক পাঠ ক’রে। উৎসাহ তাঁর সব কিছুতে; মানবিষয়ক সব কিছুতেই তাঁর উৎসাহ, তাই জ্ঞানের যে-সমস্ত শাখা মানবকেন্দ্রীক, তার সবই আয়ত্তের সাধনা করেছেন তিনি। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও আগ্রহের অভাব নেই, কিন্তু তা আয়ত্ত করতে গিয়ে বার বার বিফল হয়েছেন। কিন্তু উৎসাহ কমে নি। তাঁর কাছে গেলে বহু বিষয়ে অজস্র বই পড়ার পরিশ্রম বেঁচে যায়, কেননা ওইসব বিষয়ের সারকথা আহরণ করা যায় তাঁর মুখ থেকেই।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক জন্মেছিলেন আজ থেকে সত্তর বছর আগে। ১৯১৪ সালে। জন্মের তারিখ জানেন না তিনি। ঢাকা সদর মহকুমার কেরানিগঞ্জ থানার কলাতিয়া তাঁর নিজের গ্রাম। অবশ্য ওই গ্রামে তাঁর জন্ম হয় নি; জন্ম হয়েছিলো মামা বাড়িতে, নবাবগঞ্জ থানার পাড়াগ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবদুল আলি, মায়ের নাম নান্নী বেগম। তাঁর একজন বিমাতাও ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আইএ ফেল, চাকুরি করতেন পুলিশ ইন্সপেক্টরের। শৈশব কাটে তাঁর বাবার বিভিন্ন চাকরিস্থলে—হুগলিতে, রংপুরে। ফোরে পড়ার সময় মায়ের মৃত্যু হয়। গ্রামে চ’লে আসেন, এবং গ্রামের স্কুলেই ফাইভ-সিক্সে পড়েন। সেভেনে উঠেই গ্রাম থেকে চ’লে যান, ভর্তি হন শ্রীরামপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। পড়াশোনায় আকর্ষণ শুরু হয় গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়ই।
পড়াশোনায় আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেন কখন থেকে? আমি জানতে চাই।
গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়ই। তখন বোধহয় ফাইভে পড়ি, বই পড়তে খুব ভালো লাগতে শুরু করে। জানান আবদুর রাজ্জাক।
কী বই পড়তেন?
গল্পের। একটা বইয়ের নাম এখনো মনে আছে। বইটা পাঁচকড়ি দের মনোরমার হত্যাকারী কে?
সেই শৈশবেই মুদ্রিত বস্তুতে আরেক জগৎ খুঁজে পান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। সেভেনে পড়ার সময় পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরো অনেক কিছু পড়ার সুযোগ আসে। তখন পড়তেন শ্রীরামপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। থাকতেন হুগলিতে। দুটি পত্রিকা ওই বয়েসেই নিয়মিত পড়তেন। একটি চিত্তরঞ্জন দাশের ফরোয়ার্ড, অন্যটি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়ক। ফরোয়ার্ড ছিলো অসাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাকাঙক্ষী পত্রিকা; নায়কও ছিলো রাজনীতিক পত্রিকা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় চ’লে আসেন ঢাকায়। তাঁর পিতার এক বন্ধু নিয়ে আসেন তাঁকে, ভর্তি ক’রে দেন মুসলিম হাইস্কুলে। এ-স্কুলে পড়ার সময় শনিবারের চিঠি, কল্লোল, কালিকলম পড়েছেন উৎসাহের সঙ্গে। মুসলিম হাইস্কুলের পাশেই ছিলো রামমোহন লাইব্রেরি, যেখানে বই পড়ার অবাধ সুযোগ পেয়ে ধন্য হয় তাঁর কৈশোর।
তখন প্রবেশিকা পরীক্ষার নাম ছিলো ‘হাইস্কুল পরীক্ষা’। ঢাকা শহরের স্কুলগুলো ও কয়েকটি কলেজ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো ঢাকা বোর্ড। ১৯২৯ সালে প্রথম বিভাগে হাইস্কুল পরীক্ষা পাশ করেন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্যে পেয়েছিলেন ফুরার মেমোরিয়াল বৃত্তি। সে-বছর হাইস্কুল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন আবদুস সোবহান চৌধুরী। হাইস্কুল পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন আইএসসি শ্রেণীতে, কিন্তু পনেরো দিন পর আইএসসি ছেড়ে ভর্তি হন আইএ শ্রেণীতে। ১৯৩১ সালে প্রথম বিভাগে সম্ভবত সপ্তম স্থান অধিকার ক’রে আইএ পাশ করেন। জীবনের লক্ষ্য কিছুই স্থির করেন নি তখন। প্রথমে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শ্রেণীতে। ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন শুরু হ’তে-না-হ’তেই একজন তাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো জ্ঞানের জগতে। একদিন তিনি পাঠাগারের বইয়ের আলমারিগুলোর কাছে ঘুরঘুর করছিলেন। যেখানে সারিসারি বইভরা আলমারি সেখানে ঢোকার অধিকার ছিলো না ছাত্রদের। তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন বইয়ের আলমারিগুলো। বুড়ো লোকটি, যে ভেতর থেকে বই এনে দিতো, সে জ্ঞানার্থী আবদুর রাজ্জাকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।
কী চাও? তাঁকে জিজ্ঞেস করে বুড়ো লোকটি।
বই পড়তে চাই। উত্তর দেন তরুণ ছাত্র আবদুর রাজ্জাক।
ভিতরে ঢুইক্কা বই দেখতে চাও? বেশ দয়ালু কণ্ঠে জানতে চায় বুড়ো।
হ, ঢুকতে দিলে তো ভিতরে যাই। উত্তর দেন আবদুর রাজ্জাক।
বুড়ো লোকটি তাঁকে নিয়ে যান ভেতরে, যেখানে শুধু বই আর বই। একটা বই দেখতে দেখতে আরেকটার দিকে চোখ পড়ে, সেটা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে আরেকটার দিকে। কয়েক ঘণ্টা জ্ঞানের গুপ্তকক্ষে পাগলের মতো কেটে যায় তাঁর সময়। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সোনা। তারপর নিয়মিত ঢুকতেন ওই গুপ্তধনের কক্ষে, পৃথিবী ও পাঠ্যসূচি ভুলে পড়তেন বই আর বই। একই ঘটনা ঘটেছিলো বিলেতে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। ১৯৪৫-৫০ সালে ওই পাঠাগারে অভিযাত্রী বেশি যেতো না। নিয়মিত যেতেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বুড়ো পোর্টার দুটি তাঁকে নিয়ে যায় বই রাখার কক্ষে, জ্বেলে দেয় ফায়ারপ্লেস; তিনি জ্ঞানের তাপে তপ্ত হতে থাকেন, বুড়ো পোর্টার দুটি বিশ্রাম নিতে থাকে।
১৯৩৫ সালে এমএ পরীক্ষার লিখিত অংশটুকুতে অংশগ্রহণ করেন তিনি, কিন্তু প্রথম শ্রেণী পাবেন না ভেবে মৌখিক পরীক্ষা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৩৬-এ এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। মৌখিক পরীক্ষার দিনই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণীর লেকচারাররূপে যোগ দেয়ার নিয়োগপত্র পান। তাঁকে নিয়োগপত্র দেয়াই উপাচার্য এ এফ রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জীবন। ছাত্র হিশেবে এখানে জ্ঞান লাভ করেছেন, শিক্ষক হিশেবে জ্ঞান বিতরণ করেছেন এখানে। তাঁর সময়ে যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের জীবন ও ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করেছেন তিনি মনোযোগের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনরীতিও যতোটা সম্ভব লক্ষ্য করেছেন। তাঁর ছাত্রজীবনে অর্থনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক ছিলেন ড. জে সি সিনহা, ডি এন ব্যানার্জি, কে বি সাহা, এস ভি আয়ার, মতিলাল দাম, এ কে দাশগুপ্ত, ড. পরিমল রায়, অজিতকুমার সেন, অবনীভূষণ রুদ্র, ও অক্ষয়কুমার বসাক।
হু আ : সে-সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শিক্ষক কারা ছিলেন?
আ রা : আমি ভর্তি হওয়ার আগে বিখ্যাত ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, বি এ সেন। আমার ছাত্রজীবনে বিখ্যাত শিক্ষক সত্যেন বোস, জে সি ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুশীলকুমার দে, মোহিতলাল মজুমদার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এস ভি কৃষাণ ও আরো দু-একজন।
হু আ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-পর্যন্ত সতেরোজন উপাচার্য হয়েছেন, তাঁদের ক-জনকে পণ্ডিত ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : দুজন। রমেশচন্দ্র মজুমদার, আর সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন।
হু আ : অন্যরা?
আ রা : তাঁরা চাকরি করেছেন।
হু আ : আপনি কি মনে করেন যে উপাচার্য হওয়ার জন্যে পণ্ডিত হওয়া দরকার?
আ রা : না, একেবারেই না। উপাচার্য পদটা তো বুড়ো বয়সে পাণ্ডিত্যের পুরস্কার না। উপাচার্য পদের জন্যে দরকার ভালো প্রশাসক, পণ্ডিতের দরকার নাই।
হু আ : আপনি কি মনে করেন যে পণ্ডিত না হ’লেই ভালো প্রশাসক হয়? যে-শিক্ষকেরা লেখাপড়া করেন না, শুধু তাঁরাই উপাচার্য হওয়ার যোগ্য?
আ রা : না, তা না। এ-পর্যন্ত উপাচার্য হয়েছেন তাঁদের মধ্যে হার্টগ আর মাহমুদ হোসেন ছাড়া কারোর কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য ছিলো না। তাঁরা শুধু চাকরি করেছেন। তাঁরা সার্থকও নয়, ব্যর্থও নয়। কারণ কোনো লক্ষ্য থাকলেই তো শুধু সার্থকতাব্যর্থতা নির্ণয় করা যায়। যাঁদের কোনো লক্ষ্য নাই তাঁদের আবার সার্থকতাব্যর্থতা কি? যদি কারো দালানকোঠা বানানোর লক্ষ্য থাকে, আর যদি বানাতে পারে, তবে তাঁকে বলতে পারি সার্থক। যেমন মাহমুদ হোসেন। তিনি মনে করতেন পণ্ডিত হওয়ার শক্তি তাঁর নেই। তিনি দালানকোঠা বানাতে চেয়েছিলেন। কেউ যদি জ্ঞানচর্চার জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চায়, আর তাতে সার্থক হয়, তাহলে তাকে বলতে পারি সার্থক। এমন কেউ নাই। প্রায় সব উপাচার্যের লক্ষ্যই ছিল চাকরি করা।

১৯৩৬-এ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যাপক হিশেবে নিজেকে খুব সার্থক মনে করেন না তিনি।
হু আ : ক্লাশে বক্তৃতা দিতে কেমন লাগতো আপনার?
আ রা : খুব খারাপ। ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো। মনে হতো আহা, ওদের কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নাই। আমার কথায় তো নয়ই। দু-একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিলো আমি নাকি এক আধটি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। পুরোনো কলাভবনে আমার ক্লাশের পাশেই ছিলো একটি পুকুর। সেই পুকুরে হাঁস ভাসতো অনেকগুলো। আমি জানালার বাইরে পুকুরের হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘণ্টা শেষ করতাম। ১৯৪২-৪৩ সালে কয়েকজন মিলে পাকিস্তান নামে একটি পাক্ষিক, পরে সাপ্তাহিক, পত্রিকা বের করেছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদকণ্ডলিতে ছিলেন যযহারুল হক, জসীমউদ্দীন ও তিনি। নিজে কম্পোজ করতেন পত্রিকাটি। অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলন তাঁর মনেও তীব্র সাড়া জাগিয়েছিলো।
হু আ : পাকিস্তান বলতেই এখন আমরা ইসলামি পাকিস্তান বুঝি। আপনারাও কি ইসলামি পাকিস্তান চেয়েছিলেন?
আ রা : মোটেই না। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পরবর্তী ঘটনা। মুহম্মদ আলি জিন্নাহকে ধার্মিক লোক বলা যায় না, ইসলামের জন্যে তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিলো না। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি আর ১৫ই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি তুলনা করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসবের প্রোগ্রামে ধর্মের কোনো নামগন্ধও ছিলো না। মওলানা আকরাম খাঁ, শাব্বির আহমদ ওসমানি, লিয়াকত আলিকে দিয়ে জিন্নাহকে অনুরোধ জানান অনুষ্ঠানে কিছু ধর্মকর্ম রাখতে। অনুষ্ঠান শুরু হ’লে দেখা যায় জিন্না সরদার আওরঙ্গজেব খানকে ডাকেন কোরান থেকে কিছু আবৃত্তির জন্যে। আওরঙ্গজেব খান ধর্মের ধার ধারতেন না। তিনি মঞ্চে এসে দু-একটা সুরাকলমা প’ড়েই বিদায় নেন। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা অনুষ্ঠান হয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুবিধিমতে। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পাকিস্তান হওয়ার পরের ঘটনা।
১৯৪৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যাত্রা করেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। পড়াশোনা করবেন নিজের খরচে। সম্বল মাত্র সাড়ে চারশো পাউন্ড। বোম্বে থেকে জাহাজে ওঠেন। সৈনিকদের জাহাজ। পাঁচ হাজার সৈন্য আর চারশো যাত্রী নিয়ে উনিশ দিনে জাহাজ বিলেতে পৌঁছোয়। বিলেতে থাকেন পাঁচ বছর—নিজের খরচে। মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গ্রন্থাগারবিজ্ঞান পড়ার জন্যে আরো সাড়ে চারশো পাউন্ড দেয়। মোট নশো পাউন্ডে, মাসে পনেরো পাউন্ড ব্যয় ক’রে, পাঁচ বছর কাটিয়ে দেন।
পড়াশোনা করতেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে। তাঁর গবেষণা পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কি। অধ্যাপক রাজ্জাকের গবেষণার বিষয় ছিলো ভারতের রাজনীতিক দল। সন্দর্ভ জমা দিয়েছিলেন। অধ্যাপক রাজ্জাকের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তব ব্যাপারে ঔদাসীন্য, সন্দর্ভে তা ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে।
মৌখিক পরীক্ষার সময় একজন বিশেষজ্ঞ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার থিসিসে রেফারেন্স নাম্বারগুলো আছে, কিন্তু পাদটীকায় রেফারেন্সগুলো কোথায়?’ প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে নিজের হাতের সন্দর্ভটি খুলে দেখেন, রেফারেন্সগুলো টাইপ করা হয় নি। টাইপিস্ট মেয়েটি যেভাবে টাইপ ক’রে দিয়েছে সেভাবেই সন্দর্ভ জমা দিয়েছেন তিনি। একবারও খুলে দেখেন নি।
বিব্রত হয়ে বললেন, ‘ভুলে টাইপ করা হয় নি, তবে রেফারেন্সগুলো আমার মনে আছে। কোনটা আপনি জানতে চান?’
রেগিনাল্ড কুপল্যান্ড ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি ভারতের রাজনীতিক দলগুলো সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার থিসিস থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পারবো।’
আবদুর রাজ্জাক জবাব দিলেন, ‘আপনি যে কমিটিতে থাকবেন তা তো আমি জানতাম না।’
তোমাকে আরো ছ-মাস থেকে থিসিস ঠিক ক’রে আবার জমা দিতে হবে।
আমি আর ছ-দিনও থাকবো না।

ডিগ্রি না নিয়ে প্রচুর বই ও প্রচুর অধীত বিদ্যা নিয়ে মালজাহাজে চেপে দেশে ফিরে আসেন আবদুর রাজ্জাক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। পদোন্নতির জন্যে কখনো দরখাস্ত করেন নি, যদিও কয়েকবার তাঁকে পদোন্নতি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাই অনেক দিন তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম সহকারী অধ্যাপক। লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক হন স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই মার্চে তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় অধ্যাপকের পদ। পাঁচ বছরের জন্যে। ওই পদে পাঁচ বছরের জন্যে আবার নিয়োগ করা তাকে ১৯৮০তে।
কোনো উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত না করার ঋষিসুলভ ঔদাসীন্য তাঁর স্বভাবগত। থেকে গেছেন চিরকুমার ও অবিবাহিত। কোনো বই লেখার উদ্যোগ নেন নি। পড়েছেন বিপুল, জ্ঞান দান করেছেন ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের, যারা তাঁর কাছে এসেছে, বা তিনি খুঁজে বের করেছেন যাদের। তাঁর ব্যক্তিগত, আবেগগত জীবনসম্পর্কে উৎসাহ অনেকের, এবং আমার।
হু আ : আপনি অবিবাহিত রইলেন কেন?
আ রা : বিশেষ কোনো কারণে না। বিয়ে করা হয় নাই।
হু আ : কারো সাথে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিলো?
আ রা : না তো।
হু আ : আপনি কখনো কোনো নারীকে স্পর্শ করেছেন, হাত ধরেছেন কোনো নারীর? ধরার আবেগ বোধ করেছেন?
আ রা : না। আমাদের সমাজব্যবস্থা যা তাতে আত্মীয় ছাড়া আর কোনো নারীর সংস্পর্শে আসারই সুযোগ ছিলো না। আত্মীয় যারা তাদের সঙ্গে সম্পর্কে ছিলো আইনকানুনে বাঁধা, কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা আগে থেকেই স্থির করা ছিলো। কারো জন্যে বিশেষ আবেগ জাগার ঘটনা তো মনে পড়ে না। মেয়ে দেখলে তো আবেগ জাগবে, মেয়েই তো দেখি নাই।
হু আ : কোনো নারীর সৌন্দর্য কখনো আপনাকে মুগ্ধ করেছে?
আ রা : হ্যাঁ, অনেক সুন্দরী মহিলা দেখেছি, মুগ্ধও হয়েছি। কাউকে কাউকে হয়তো এক-আধ মিনিট দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে। তবে বিশেষ নাম করার মতো কারো কথা তো মনে পড়ে না।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিকের মিশ্রণ ব’লে মনে করেন। ১৯৮০র মে মাসে তিনি ‘স্টেট অব দি নেশন’ নামে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ক’রে সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশ জাতীয় অবস্থার চালচিত্র নামে একটি বই’ই রচনা করেন; সম্প্রতি অধ্যাপক মনসুর মুসাও একটি প্রবন্ধে অধ্যাপক রাজ্জাকের বক্তব্যের ত্রুটি ধরেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি অনেকেরই আক্রমণের লক্ষ্য, কেননা তাঁরা মনে করেন ওই শব্দটি রাজনৈতিক ও দলীয়, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় ব্যবহৃত হ’তে পারে না।
হু আ : ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিতে আপনি দার্শনিক ও আদর্শগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন ব’লে অনেকে আপত্তি তুলেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দে আপনি কী জ্ঞাপন করতে চান?
আ রা : শব্দটি আমি এ-অর্থে ব্যবহার করি যে তিনি একটি প্রতীক ছিলেন, আর তিনি একেবারে পরোক্ষ অর্থে যে প্রতীক ছিলেন, তাও না। তিনি অনেকটা দেখা দিয়েছিলেন এ-এলাকার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মনুষ্যমূর্তি রূপে, তাঁর মধ্যেই মানুষেরা নিজেদের আশা মূর্ত দেখতো। তিনি একলা দেশ স্বাধীন করেন নি, তবে তাঁর অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরে তিনি বাংলাদেশের এক হাজার মাইলের মধ্যেও ছিলেন না, তবু সাধারণ ও একেবারে সাধারণ নয় এমন মানুষেরা তাঁর কথা ভেবেই অনুপ্রাণিত হতো। যদিও তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তিনিই সব কিছুর কেন্দ্রে আছেন ব’লে মনে করা হতো।
হু আ : আপনি কি ‘জাতির পিতা’ ধারণায় বিশ্বাস করেন?
আ রা : ‘জাতির পিতা’ ধারণাটি দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে যে একটি লোকের মধ্যেই জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে। একটি জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা ও আরো বহু ব্যাপার সংক্ষেপে জড়ো হয় ওই একটি শব্দবন্ধে। ওয়াশিংটনকে যখন বলা হয় আমেরিকার জাতির পিতা, গান্ধিকে ভারতের, জিন্নাকে পাকিস্তানের, তখন শুধু এটাই বোঝানো হয় যে ওই কয়েকজন মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
হু আ : শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আ রা : কেউ যখন নিহত হন, তখন বুঝতে হবে তিনি কোনো-না-কোনো উপায়ে বিশেষ কারো বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কারো স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছিলেন। লিংকন বা গান্ধি বা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে তাঁরা একদলকে শত্রুতে পরিণত করেছিলেন। এ-হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে না যে ওই ব্যক্তিরা খারাপভাবে শাসন করছিলেন, বা বহু ভুল করেছিলেন। মুজিবের সম্বন্ধেও তাই।
হু আ : শেখ মুজিব যেভাবে দেশ শাসন করছিলেন তাতে কি তাঁর রক্তাক্ত পরিণতি অনিবার্য ছিলো?
আ রা : বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে দেশ শাসনের অনিবার্য পরিণতিরূপে হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেয়া যায় না। ব্যাপারটি বোঝার জন্যে জানতে ও বুঝতে হবে যে তাঁর হত্যাকারী কারা? কী এমন ঘটেছিলো যাতে তারা এতোটা বিক্ষুব্ধ হলো যে তাদের হত্যার পথ বেছে নিতে হলো? তিনি কীভাবে দেশ শাসন করতেন সে-ব্যাপারটি এই হত্যার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। শেখ মুজিবর রহমানের রাজনীতিক দর্শন ঠিক কি ভ্রান্ত আমি সে-বিবেচনায় যেতে চাই না, শুধু এইটুকুই বুঝতে পারি যে তিনি একটা ব্যাপার বিশেষভাবে স্পষ্ট ক’রে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সামরিক বাহিনীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রে যে-গুরুত্ব দাবি করে শেখ মুজিব তাদের তা দিতে রাজি ছিলেন না। তাদের মতে তাদের যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হয় নি। তাদের ক্ষুণ্ণ করার জন্যেই এমন ঘটে।
হু আ : গত এক দশকের বাংলাদেশি রাজনীতির প্রধান লক্ষণ কী ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : প্রশ্নটা এতো নির্বিশেষ ভাষায় করা হয়েছে যে উত্তরটাও নির্বিশেষই হবে। এটা ঠিক যে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ—রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সময় একটু বেশি সোজাভাবে দাঁড়াতো, একটু বেশি শক্তিশালী বোধ করতো। তাঁর পরে যে তারা খুব খারাপ আর্থিক অবস্থায় পড়ে গেছে, বা তাঁর সময়ে যে খুব ভালো আর্থিক অবস্থায় ছিলো, তা না। তবে এটা আমি খুব স্পষ্টভাবেই বুঝি যে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ অনেকটা অসহায় বোধ করে, আগে এমন অসহায় বোধ করতো না। সমাজের যতো বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও সমাজের জন্যে অপরিহার্য, ততোই ভালো। গান্ধি বা জিন্না জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের অংশ ছিলেন না, কিন্তু মুজিবের সময় জনগণ এমন বোধ করতে থাকে যে শেখ মুজিব তাদেরই অংশ। বর্তমানে এ-অবস্থাটা নাই।
হু আ : আমার কাছে বাংলাদেশের সমাজকে নষ্ট সমাজ ব’লে মনে হয়। আপনার কেমন মনে হয়?
আ রা : আমি এর সঙ্গে একেবারেই একমত নই। বরং আমার কাছে এই এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা ব’লে মনে হয়। বাংলাদেশে ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার, তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে-সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশে আর কোথাও নাই। শুধু উপমহাদেশে কেনো, সারা পৃথিবীতেও নাই।
হু আ : তার অর্থ কি এই যে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের সমাজ ভালো?
আ রা : ভালো আর মন্দের তালিকা ক’রে যে বাংলাদেশের সমাজকে ভালো বলা যাবে, তা না। ভালো এই অর্থে যে এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ আর সম্ভাবনা আছে। কথা হলো আমার প্রত্যাশা কতোটা পূরণ হ’তে পারে? এমন কি আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝি সেখানকার কৃষকদের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই, কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসীদের সে-সুযোগ আছে।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বিশেষ কোনো দার্শনিক বা তাত্ত্বিক ধারার অনুসারী নন। তাঁকে উদার মানবতাবাদী বললে খিলখিল ক’রে হেসে ওঠেন, বুর্জোয়া চিন্তাধারার বললেও তেমনি হাসেন। তিনি জ্ঞানান্বেষী, যে-কোনো ধারা থেকে তা আহরণে তিনি উৎসাহী। রাষ্ট্রচিন্তায় তিনি গণতান্ত্রিক। আর্থিক শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্ভবত তাঁর পছন্দ। বাংলাদেশের জন্যে কোন ধরনের ব্যবস্থা তাঁর কাম্য, স্পষ্টভাবে তিনি তা জানাতে দ্বিধান্বিত, কেননা তাঁর বিশ্বাস যে কোনো ব্যবস্থাই কালপরম্পরায় পরিবর্তিত হয়ে যেতে বাধ্য।
হু আ : আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা—মোটামুটি রুশ বা চীন দেশীয় আদলে—আপনার কাছে কি অত্যাবশ্যক ব’লে মনে হয়?
আ রা : রুশ বা চীনদেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তো চিরস্থির না। যদি গত ষাট আর ত্রিশ বছরের রুশ আর চীনদেশীয় ব্যবস্থা মনোযোগের সঙ্গে দেখি, তাহলে চোখে পড়ে যে রাশিয়ায় আর চীনে বহু কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। লেনিন আর তাঁর সহকর্মীরা যে-সমস্ত লক্ষ্য সামনে রেখেছিলেন, তাদের যে-সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো, এখন আর তা নাই। চীনে প্রথম পনেরো-বিশ বছরে মাও সেতুং আর চৌ এন লাই যা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, এখনকার চীন ঠিক তাই চায় এমন মনে করার কোনো কারণ নাই। একশো পঞ্চাশ বছর আগে মার্ক্স যে-সব সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, লেনিন কোনো ঘোষণা না ক’রে পঁচাত্তর বছর পরে সেগুলোকে ব্যাপকভাবে বদলে দেন। আমাদের দেশে যারা রুশ বা চীনদেশীয় কাঠামো চায়, তাদের এ-সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হবে।
হু আ : শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা আমাদের জন্যে কতোটা দরকার?
আ রা : অর্থনীতিতক অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ংকর। একেবারে থাকবে না, এটাকে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ব’লে মনে হয় না। ষাট বছর কেটে যাওয়ার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে শতকরা দশজন লোক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, আর ওই শতকরা দশজন লোকই সব কিছু স্থির ও নিয়ন্ত্রণ করে। এটাতো অসাম্য দূর করার কথা না। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর হয়েছে, আর বেশি কিছু না। শুধু অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দিলে সমাজকে তো ঠিকমতো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। আমি যদি ব্যক্তি হিশেবে মূল্য না পাই অথচ আমার আয় যদি অন্যের সঙ্গে সমান হয়, তবে তা মূল্যবান না। এটা ঠিকই সোভিয়েত ইউনিয়নে আর্থিক অসাম্য দূর হয়েছে। তবে তার জন্যে মূল্য দিতে হয়েছে। সেই মূল্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অবিমিশ্র অসাম্য।
হু আ : বিশ্বব্যাপী এখন রাজনীতিতে মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। আপনার কি মনে হয় আগামী পঞ্চাশ বছরে সারা গ্রহ ভ’রে বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
আ রা : ধর্মের মূল কথা হচ্ছে এই জীবন মৃত্যুপরবর্তী এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহান জীবনের একটি অত্যন্ত গৌণ উপাংশ মাত্র। এ ছাড়া ধর্মের আর কোনো সংজ্ঞা নাই। আমার মনে হয় না যে এমন বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের কোনো যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে। এখন মানুষ নানান কথা কয়ে তাকে ধর্ম বলে চালানোর চেষ্টা করছে। ওই বিশ্বাস যে এ-জীবন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, পরলোকই সব, এমন বিশ্বাস ফিরে আসে নাই। পাঁচ-ছশো বছর আগে মানুষেরা সত্যিই বিশ্বাস করতো যে এ-জীবন নশ্বর, আসল জীবন প’ড়ে আছে সামনে মৃত্যুর পরে। এখন ধর্ম বলতে যা বলা হয় তা আমি বুঝি না।

হু আ : পৃথিবী এখন যারা চালাচ্ছে, তাদের কতোজনকে আপনি উন্মাদ বা অসুস্থ মনে করেন?
আ রা : উন্মাদ কিনা বলতে পারি না, তবে পৃথিবী যারা চালাচ্ছে, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সবাই বুড়ো, অনেকটা বাতিল মানুষ। বুলগেরিয়ায় দেখেছি সেখানকার তরুণেরা যেসব গান পছন্দ করে তার শতকরা আটানব্বইটাই মার্কিন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবপ্রতাপশালী চারপাঁচজন মানুষের কথা যদি ভাবি, ধরা যাক ক্রেমলিনের কর্তা, হোয়াইট হাউজের কর্তা, পিকিংয়ের কর্তা, টোকিওর কর্তা, নতুন দিল্লীর কর্তাকর্ত্রীর কথা, তাদের সমস্ত অনেকের মধ্যে চোখে পড়ে একটি সাদৃশ্য—তাদের কারো বয়সই সত্তরের বেশি কম না। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই তরুণ। যারা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তাদের কেউ পাঁচ-দশ বছরের বেশি বাঁচবে না। আমার ধারণা পৃথিবীর তরুণেরা তাদের শাসকদের চেয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি মিল দেখতে পায়। যে-কোনো দেশে সত্তর বছর বয়স্ক লোকের ওপর আগামী বিশত্রিশ বছরের পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা অনুচিত। বয়স যতো বাড়ে মানুষ ততো বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, অন্যের কথা মনে থাকে না। আর এ-দেশে তো তা ভয়াবহ।
হু আ : তবু পৃথিবীটা তো বুড়োরাই চালাচ্ছে!
আ রা : এই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বিপদ।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত আছেন পাঁচ দশক ধ’রে। জীবনের জ্ঞান তিনি বাস্তব থেকে যতোটা আহরণ করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি বই থেকে আহরণ করেছেন। আমাদের জ্ঞানচর্চার অতীত ও বর্তমান অনেকটাই তাঁর অভিজ্ঞতার মধ্যে।
হু আ : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞানচর্চার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কী ধারণা পোষণ করেন?
আ রা : আমাদের সমাজে লেখাপড়া বেড়েছে, শিক্ষায় অনেক অগ্রসর হয়েছি আমরা। কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা কতোটা কনট্রিবিউট করতে পারছি, তা পরিমাপ করার সহজ উপায় নাই। আমরা কেউই এতো পণ্ডিত না যে জ্ঞানের হাজারটা শাখায় কে কী করছে, তার মূল্যায়ন করতে পারি। তবে আন্তর্জাতিক সমতার মানদণ্ড প্রয়োগ ক’রে কিছুটা হিশেব করা যেতে পারে। পৃথিবীর উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রশিক্ষকদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমাদের ছাত্রশিক্ষকদের। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই যে আমাদের বিপুল সংখ্যক তরুণ পৃথিবীর প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের সমতুল্য বা প্রায় সমতুল্য। ’৪৭-এর আগে এমন ছিলো না।
হু আ : আমাদের সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, বিভিন্ন একাডেমি বিশেষ মহিমা অর্জন করতে পারছে না। এর কী কারণ ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : ওইসব প্রতিষ্ঠানের মহিমা বা মূল্য কতোটা তা ওই আন্তর্জাতিক সাম্যের মাপকাঠি দিয়েই নির্ণয় করতে হবে। আমি এ-দেশের জাতীয় অধ্যাপক, বিদেশে গিয়ে যদি সহকারী অধ্যাপকও হ’তে না পারি, তবে মহিমা থাকে কোথায়? শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সেনাবাহিনী, আমলা সব কিছু মাপার জন্যেই দরকার আন্তর্জাতিক সাম্যের মাপকাঠি। আমার ধারণা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যা ব’লে নিজেদের দাবি করে, কিন্তু তা হয়ে উঠতে পারে নাই ব’লেই এমন অবস্থা।
ব্যক্তি আবদুর রাজ্জাককে জানার জন্যে আমি কিছু ছোটো প্রশ্ন করেছিলাম। কিছুটা ধরা দিয়েছেন তিনি।
হু আ : আপনি তো আশাবাদী।
আ রা : আমি জানি না। আমি তথ্য নিই, আর তথ্যভিত্তি ক’রেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই।
হু আ : আপনি তো বেশ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ!
আ রা : সাধারণত। তবে মাঝে মাঝে মেজাজ নষ্ট হয়। কম বয়সে বেশি নষ্ট হতো।
হু আ : প্রথাগত ব্যাপার ও চিন্তার প্রতি কি আপনি শ্রদ্ধাশীল?
আ রা : শুধু প্রথাগত ব’লেই কোনো কিছুকে উড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, আবার প্রথাগত ব’লেই মেনে নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না।
হু আ : আপনি কি প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী?
আ রা : বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথাটা ওঠে না। কারণ ধর্ম সম্পর্কে কথাবার্তা বলার আগ্রহ আমি কখনো বোধ করি নাই।
হু আ : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবেন?
আ রা : বিশেষ না। তবে মরতে হবে এই পর্যন্ত নিশ্চিত।
হু আ : আজকাল কী ধরনের বই পড়ছেন?
আ রা : ফ্রান্সে এক ধরনের নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে, খুব চমৎকার। তার কয়েকটা দেখছি।
হু আ : জীবন যাপন আপনার কাছে বেশি আনন্দদায়ক না বইপড়া বেশি আনন্দদায়ক?
আ রা : জীবনযাপন করার মধ্যেই আছে ওই বইপড়াটা। বই ছাড়া জীবন অকল্পনীয়।
হু আ : বইপড়ার মধ্যে সুখটা কোথায়?
আ রা : হা-হা-হা, আপনি তা একটু বেশি ক’রেই জানেন।
হু আ : আপনাকে অতীত জ্ঞান বেশি সুখ দেয় না নতুন চিন্তা?
আ রা : নতুন মানে সত্যিকারভাবেই নতুন কথা খুব বেশি নাই। যদি আর্কিমিডিস আর আইনস্টাইনের চিন্তার তুলনা করেন তাহলে পার্থক্যটা পর্বতপ্রমাণ। আর প্লেটো যা চিন্তা করেছিলেন, এবং এখন ওই সব বিষয়ে যে চিন্তা করে, তাঁর কথা যদি ধরি, তাহলে, পার্থক্যটা খুব বেশি না। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই চিন্তার অগ্রগতি ঘটেছে অপরিসীম। আপনি যদি পৃথিবীর মানববিদ্যার প্রধান ব্যক্তিদের এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বলেন, তাহলে তাঁদের শতাব্দী কেটে যাবে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রধান ব্যক্তিদের বসিয়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছোতে বলেন, তাহলে তাঁরা বারো ঘণ্টার বেশি সময় নেবেন না। প্লেটো থেকে আজ পর্যন্ত চিন্তার যে-অগ্রগতি ঘটেছে, তা ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদের শ্রমেই ঘটেছে।
হু আ : জ্ঞানের কোন শাখাগুলো আপনাকে আকর্ষণ করে?
আ রা : মানুষ সম্পর্কে যা তার সবই।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রিয় শখ হচ্ছে বাজার করা, রান্না করা। লুঙ্গি প’রে বাজারে চ’লে যান, চকবাজারে যেতেই পছন্দ করেন বেশি। বিদেশে গেলেও কাঁচাবাজারে হানা দেন।
হু আ : শুনেছি বাজার করতে আপনি পছন্দ করেন?
আ রা : খুব। নিয়মিত বাজার করা শুরু করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর। রান্না শিখেছি ছোটবেলায়ই। আমি যে-কোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিশ দেখি, একটা কাঁচাবাজার অন্যটা বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে-দেশে বইয়ের দোকান নাই সে-দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায় দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকান অজস্র, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বই প্রচুর পাওয়া যায়। সেখানে দোকানে শতকরা ত্রিশপঁয়ত্রিশটা বই কমিউনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশপঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং ওই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্যে হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
বিভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু এলোমেলো প্রশ্ন করেছিলাম অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে। উদ্দেশ্য ওই প্রসঙ্গগুলো সম্পর্কে তাঁর মত, সংক্ষেপে হ’লেও, লিপিবদ্ধ হয়ে থাক।
নমুনা:
হু আ : এ-দেশে সামরিক শাসন টেকার কোনো কারণ আছে ব’লে মনে হয়?
আ রা : টেকার তো কোনো কারণ দেখি না, সামরিক শাসনের কোনো ভিত্তি নাই এ-দেশে। কতোদিন টিকবে তা বলা অবশ্য জ্যেতিষের কাজ। সামরিক শাসনের কোনো শিকড় নাই। খুবই আগাছার মতো টিকে আছে। তাদের টিকে থাকাটা প্রমাণ করে তাদের বিরোধীরা কতো সামান্য। মুজিবের মারা যাওয়ার পর ওই পাঁচ-ছজন লোক থাকলেও চলতো। যদি তারা জীবিত থাকতো তাহলে হয়তো একটা ডাইরেকশন দিতে পারতো, নেতৃত্ব দিতে পারতো। আমার নিজের ধারণা ’৭০/৭১-এ যারা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এর মধ্যে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এখন যে-সব জিনিশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করছে, যারা আওয়ামী লীগের নামে এখনো চালাতে যাচ্ছে, আমার মনে হয় তারা শিগগিরই বুঝতে পারবে যে এই সমস্ত কথা ব্যাপক জনসাধারণের কাছে মূল্য বহন করে না।
হু আ : আপনি যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের অন্তত দুজনের নাম বলবেন, যাঁদের আপনি অসাধারণ ব’লে গণ্য করেন?
আ রা : জয়নুল আবেদীন, জসীমউদদীন। অসাধারণ বলতে সাধারণত যা বোঝা হয় তার থেকে খুবই ভিন্ন রকম এঁরা। জসীমউদদীন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, তখন নানাজন খুবই বিরক্ত করেছে তাঁকে। আমি বলতাম আমরা ম’রে গেলে কেউ নামও নেবে না, জসীমউদদীনের নাম অনেক বছর থাকবে।
হু আ : সৃষ্টিশীল ও পণ্ডিতদের মধ্যে কোন শ্রেণীটিকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
আ রা : গুরুত্বপূর্ণ তো নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল মানুষ, তবে মানুষ হিসেবে তাঁরা এমন যে তাঁদের সঙ্গে বাস করা খুবই কঠিন। আমরা শিক্ষকেরা তো পাণিনিও না, পাণিনির টীকাকার মাত্র।
হু আ : বাঙালির জীবনে কোনো উৎসব নেই কেনো? এমন উৎসব যাতে তরুণতরুণীরা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারে?
আ রা : এটা বাঙালির, বাংলাদেশের একটা বিশিষ্টতা। উৎসবের কথা অতো বড়ো ক’রে না ধ’রে শুধু নাচের কথাই ধরতে পারি। বাঙালি এমন একটা গোষ্ঠী যাদের মধ্যে নাচের কোনো চল নাই। কোনো ধরনেরই নাই;—যুবক-যুবতী, খালি যুবক, খালি যুবতী, কোনো ধরনেরই নাচ নাই। উৎসব নাই, সম্ভাবনা দেখি না। উপজাতীয়দের উৎসব আছে, কিন্তু যারা তথাকথিত আর্য ও তাদের উত্তরাধিকারী, তাদের মধ্যে নাই। এটা চোখে না প’ড়ে পারে না, কিন্তু আমার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নাই। উৎসব না থাকাটা এ-দেশের বিশিষ্টতা। যেমন পাঁচ-ছশো বছর ধ’রে পাটনার পূবে কোনো যুদ্ধ হয় নি। যখন তারা বলে যে একটা স্থায়ী সামরিক সরকার খাড়া করবে আমি তা বিশ্বাস করি না, কেননা তা অসম্ভব। যেখানে যুদ্ধ হয় নাই সেখানে দামী ইউনিফর্ম কিনে সামরিক শাসন চালাবে, তা সম্ভবপর না।
হু আ : বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
আ রা : ভাষা, বাঙলাভাষা। ভাষা ছাড়া আর যা তা প্রায় সব সমাজেই একরকম, তবে এক সমাজে এইটার ওপর জোর দেয়া হয় অন্য সমাজে সেটার ওপর জোর দেয়া হয়।
হু আ : ভারতীয় নারীদের আপনার কাছে বেশি সুন্দর মনে হয় নাকি ইউরোপীয় নারীদের?
আ রা : সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে ভারতীয়-ইউরোপীয় শ্রেণীকরণ খুব সার্থক না। ভারতীয়দের কাছে নারীর মুখের গঠন, এটা ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সুন্দরীরা ফিগার সম্পর্কে অত্যন্ত কম সচেতন। সব মিলে যে সৌন্দর্য এ-বোধ নাই। চুল লম্বা, রঙ শাদা, দেখতে ভালো ইত্যাদিই এখানে প্রধান, কিন্তু ফিগারের দিকে চোখ নাই। এটাকে খুব সুষ্ঠু সৌন্দর্যবোধ বলা যায় না। ইউরোপে ফিগারের ওপরে খুব বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। ভারতীয় ভাস্কর্য, চিত্রকলায়ও তাই দেখা যায়, ফিগারের দিকে দৃষ্টি নাই। নৃত্যরত শিবের ব্যাপারটা ভিন্ন, ওটা প্রায় গাণিতিক সূত্র অনুসারে তৈরি। তবুও গ্রিক ভাস্কর্যে বিশুদ্ধ দেহসৌষ্ঠবের যে-উল্লাস দেখা যায়, ভারতে তা দেখা যায় না।
হু আ : আপনি কি গান শোনেন?
আ রা : শুনি। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করি না, বড়ো একঘেয়ে লাগে। নজরুলগীতি, ভারতীয় রাগসঙ্গীত ভালো লাগে, কীর্তনভজন ভালো লাগে। দীপালি তালুকদার, দিলীপ রায়কে পছন্দ করি।
হু আ : আপনি কোনো বই লিখলেন না কেনো?
আ রা : আলস্যবশত। হয়তো যা জেনেছি, তাও খুবই অকিঞ্চিৎকর। তবে এটা প্রতারণাও হ’তে পারে।
হু আ : আমাদের সমাজের গত বিশত্রিশ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ব’লে কাদের আপনি মনে করেন?
আ রা : আমাদের যা সমাজব্যবস্থা, মূল্যায়নের যে-পদ্ধতি, তাতে আমি যাঁদের নাম করবো, তাঁরা হয়তো অন্যদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব’লে বিবেচিত হবেন না। কিন্তু ওই শামসুর রাহমান, জয়নুল আবেদীন, জসীমউদদীন, এঁদেরই আমি ৪৭-এর পরের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে করি। এঁদেরই নাম সবচেয়ে বেশিদিন টিকবে।

হু আ : আপনার কোনো নেশা আছে?
আ রা : তামাক খাই, দাবা খেলি, রান্নাবান্না করি।
হু আ : আপনার যা চরিত্র তাতে আপনার তো হওয়া উচিত ছিলো একজন সুখী আর সংসারী ব্যক্তি।
আ রা : আমি সুখী আর সংসারী দুই-ই তো।
হু আ : আপনি আর কতো বছর বাঁচবেন বলে আশা করেন?
আ রা : আমি যে-কোনো মুহূর্তে বিদায়ের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কোনো দুঃখ নাই। কতো বছর বাঁচবো, তা ভাবি না। জীবনমৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশি ভাবি না। আমি অনেক বেঁচেছি, সত্তর বছর। নিজের হাতে জীবন নেবো, এই কথা কখনো ভাবি নাই, যে-কোনো মুহূর্তে মারা গেলে দুঃখ নাই। অনেক তো বেঁচেছি।
দিনরাত্রির রহস্যজড়ানো একটি বড়ো ঘরে ব’সে আছি আমরা দুজন একজন বলেন, ‘অনেক বেঁচেছি।’ আরেকজন মনে মনে বলে, ‘আমি আরো বাঁচতে চাই।’ একজন অনেক জেনেছেন, তার মৃত্যুর কোনো ভয় নাই। অন্যজন জানে নি কিছুই, কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে আমি দেখে আসছি দু-দশক ধ’রে;—দূর থেকে, কিছুটা দূর থেকে, আর অনেক কাছে থেকে। অনেক উপাখ্যান শুনেছি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর অতীত জ্ঞান সম্পর্ক। তাঁকে বই উৎসর্গ করেছেন দেশিবিদেশি অনেকে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেছেন অনেক জ্ঞানী ও জ্ঞানার্থী। তিনি জ্ঞানের তপস্যা করেছেন এমন এক দেশে, কালে, যেখানে যখন নির্জ্ঞানদেরই প্রাধান্য। সত্তর বছর জীবনযাপন ক’রেও তিনি রয়ে গেছেন চারপাশের উত্তেজিত কলরোলিত জীবনের বাইরে; কম্পিত হন নি কামনায়, বাসনা তাঁকে বিনিদ্র রাখে নি, উচ্চাশা তাঁকে দংশন করে নি। আমার মুখোমুখি এখন এক কিংবদন্তি;—জ্ঞানের ও ঔদাসীন্যের, কিন্তু আলোআঁধার জড়ানো সন্ধ্যায় আমার চোখ দেখতে পাচ্ছে একজন মানুষকে, যাঁর পোশাক, বসার ভঙ্গি, উচ্চহাসি আর দশজনের মতোই সহজ সরল সাধারণ।
এ-সাধারণত্বকেই তো অসাধারণ ক’রে তুলেছেন নিজের জীবনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক—একালের জ্ঞানতাপস—শুধু জ্ঞানের জন্যে জীবনকে অবহেলা ক’রে। জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হ’লে জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক।
রোববার ৭:৯, ২ ডিসেম্বর ১৯৮৪: ১৬ অগ্রহায়ণ ১৩৯১
*বানানরীতি লেখকের নিজস্ব

আমাদের দেশটি ছোটো, আর এর মানুষেরাও বেশ ক্ষুদ্র। প্রথাগত ভুয়োদর্শন আমাদের উপদেশ দেয় বেশি না বাড়ার, বেশি উঁচু না হওয়ার। বেশি বৃদ্ধি পেলে ক্রুদ্ধ ঝড়ে ভেঙে পড়ার ভয় আছে। আমাদের প্রকৃতি ও মানুষ যেনো এ-ভয়ে আতঙ্কিত; তাই অভাব এখানে আকাশ-ছোঁয়া বৃক্ষের, দুর্লভ এখানে মহৎ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। মাঝারি, নিম্নমাঝারি ও নিম্ন আকারের ব্যক্তি ও বৃক্ষে পূর্ণ আমাদের লোকালয় ও অরণ্য। কাউকে পাওয়া খুব কঠিন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলে, যিনি আয় করেছেন মহত্ত্ব, অর্জনে বা ত্যাগে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ, এক রকম বিস্ময় ও কিংবদন্তি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাদের এই সময়ের সে-অনন্য পুরুষ, যাঁকে ঘিরে কয়েকদশক ধ’রে জড়ো হয়েছে নানা রহস্য; পরিণত হয়েছেন যিনি জীবিত উপকথা বা কিংবদন্তিতে। ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর বহুমুখি পাণ্ডিত্যের নানা গল্প, জীবনের অসংখ্য উপাখ্যান। শারীরিক সৌন্দর্যে দেবতুল্য নন তিনি যে তাঁকে দেখেই দর্শক ভক্ত হয়ে উঠবে; বাগ্মীও নন তিনি যে শ্রোতা তাঁর বাণী আস্বাদ ক’রে স্পর্শ পাবে অমৃতের। মোটা মোটা বই লিখেন নি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অলংকৃত করেন নি জ্যোতির্ময় বিভিন্ন আসন; এমনকি নিজের নামের সঙ্গে তিন অক্ষরের একটি উপাধিও যুক্ত করেন নি তিনি। তবু তিনিই হয়ে উঠেছেন আমাদের সাম্প্রতিক জ্ঞানজগতের কিংবদন্তি। এর মূলে আছে সম্ভবত দুটি সহজ কিন্তু অসাধারণ কারণ: প্রাচীন ঋষিদের মতো তিনি নিজের দীর্ঘ ও সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন জ্ঞান আহরণে, এবং ঋষিদের মতোই তিনি অবলীলায় অবহেলা ক’রে গেছেন পার্থিব সাফল্য। জ্ঞানের জন্যে এমন তপস্যা—জীবন, সংসার, সাফল্যের কথা ভুলে—এখন দুর্লভ ব্যাপার; আর তাই রূপ লাভ করতে দেখি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে। শুধুই জ্ঞানের জন্যে সব ত্যাগ ক’রে তিনি হয়ে উঠেছেন এই সময়ের জ্ঞানতাপস।
ছোটখাটো মানুষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তাঁর ক্ষীণ কাঠামোতে সত্তর বছর ধ’রেই বেশি মেদমাংস জমতে পারে নি। মুখে একগুচ্ছ দাড়ি, চশমার ভেতরে দীপ্ত দু’টি চোখ। কম দামের পাজামাপঞ্জাবিচাদর পরেন। চাদরটা কখনো ঝুলতে থাকে গলায়, কখনো জড়ানো থাকে শরীরে। রাস্তায় হাঁটার সময় বাঁ হাতে অনেকটা নিজেকে জড়িয়ে ধ’রে হাঁটেন। বসার সময় গুটিয়ে নেন নিজেকে, যেনো লুপ্ত হয়ে যাবেন আসনের অভ্যন্তরে। হাত দিয়ে যখন কিছু ধরেন, তখন মনে হয় জিনিসটি বোধ হয় এখনি গড়িয়ে পড়বে হাত থেকে। ওই হাত যেনো কিছুই ধ’রে রাখতে জানে না।
তাঁর সঙ্গে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমার দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। দাবা খেলতে ভালোবাসেন তিনি। এটা তাঁর দ্বিতীয় নেশা। পৌঁনে ছটার দিকে ক্লাবে এসে খেলার সাথী কেউ না থাকলে চুপ ক’রে ব’সে থাকেন নির্দিষ্ট আসনটির এক কোণায়। সাথী এলেই খেলা শুরু হয়ে যায়। তাঁর দাবা খেলায়ই ধরা পড়ে তাঁর চরিত্রের তিনটি বড়ো বৈশিষ্ট্য। দাবাড়ুরা সাধারণত একটু অহমিকাসম্পন্ন হ’য়ে থাকে—তারা একটি জিনিস খুবই ঘৃণা করে, তা হলো হারা। খুবই পছন্দ করে তারা জিততে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একের পর এক খেলে যেতে থাকেন, চাল ফেরত দিতে থাকেন বিপক্ষকে; কিন্তু জিতে উল্লাস আর হেরে বিষাদ বোধ করেন না কখনো। তাঁর সারাটি জীবনেও ঘটেছে তাই। জীবনের ইঁদুর দৌড়ে তিনি অংশ নেন নি, কখনো অধিকারের বিজয়ের বাসনায় কেঁপে ওঠেন নি তিনি। পরাভূত হ’য়ে বিপর্যস্ত বোধ করেন নি কখনো। দাবা খেলার সময় তিনি বিপক্ষের ঘুঁটি একটি একটি ক’রে খান, আর পাশের টেবিলে না জমিয়ে জমাতে থাকেন নিজের বাঁ মুঠোতে। এক সময় মুঠোতে ঘুঁটি জ’মে জ’মে উপচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প’ড়ে যায় চারদিকে। ধ’রে রাখার অভ্যাস নেই তাঁর। জীবনকেও তিনি এমনভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন সত্তর বছর ধ’রে। দাবা খেলেন তিনি মোটামুটি—অধিকাংশ চালই সাধারণ; কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি দিতে থাকেন অনুপ্রাণিত চাল আর শিউরে ওঠে দর্শকেরা, কেননা অমন চালের কথা কেউ ভাবে নি। ওই অনুপ্রাণিত দূরদর্শী চালগুলোর মধ্যেই আছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। জ্ঞানজগতের বিভিন্ন সমস্যা ও বিষয় সম্পর্কেও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেশ সাধারণ। কিন্তু হঠাৎ আলোর ঝলক লেগে কখনো কখনো আলোকিত হয় তার অন্তর্লোক, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অনুপ্রাণিত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। ওই জ্যোতিটুকুই তো তিনি। তাঁর আরো একটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে দাবার চালেই তিনি কারো পরামর্শ মতো চাল দেন না তা যতো অসাধারণ চালই হোক, তিনি নিজের বোধে নির্দ্বিধায় দেন খুবই ভুল চাল, এবং হেরে গিয়ে অনুতাপ করেন না। জীবনেও আবদুর রাজ্জাক তেমনি। একটা কোমল অথচ অত্যন্ত শক্ত গোঁ রয়েছে তাঁর ভেতরে, যা তাঁকে চালিয়েছে সারা জীবন।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ হেসে ওঠেন; শব্দ শুনে মনে হয় তাঁর ভেতরে খলখল ক’রে উঠছে নিষ্পাপ একটি শিশু। সারা মুখে চোখে ছড়িয়ে পড়ছে সারল্যের দ্যুতি। কথা বলেন তিনি ভরাট স্বরে। কখনোই বিশুদ্ধ চলতি বাঙলা বলেন না। আঞ্চলিক, চলতি বাঙলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে থাকেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। কথা যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে তাঁর ভাষাও হয়ে ওঠে সম্পূর্ণরূপে ইংরেজি। চলতি বাঙলার থেকে আঞ্চলিক ও ইংরেজি অনেক ভালো বলেন তিনি। একটানা কথা বলতে হ’লে, এবং বিষয়টি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে ইংরেজিই বেছে নেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। আটপৌরে কথা বলেন ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি পুরোনো বাংলোবাড়ির একতলায় বাস করেন তিনি। বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৯০৬ সালে বাঙলা ও আসামের একাউন্টেন্ট জেনারেলের বাসগৃহ হিসেবে। একটি বিশাল কক্ষে তিনি একলা থাকেন—চিরকুমার ও অবিবাহিত এ-বয়স্ক জ্ঞানতাপস বিশাল কক্ষটিতে নিঃসঙ্গ ঋষির জীবনযাপন ক’রে যাচ্ছেন বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধে। দিনের বেলা কক্ষটিতে ছড়িয়ে থাকে কিছুটা আলো আর অনেকটা অন্ধকার। কক্ষটির দক্ষিণ দিকে একটি বিরাট পড়ার টেবিল, বসার জন্যে রয়েছে আরামদায়ক চেয়ার। কক্ষের এদিকে সেদিকে শুধু বই—সাহিত্য, অর্থনীতি, শিল্পকলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, দাবা ও আরো অজস্র বিষয়ের বই। বইগুলোর মধ্যে খুবই স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে বিশ্বকোষগুলো। বিভিন্ন ধরনের বিশ্বকোষ তাঁর প্রিয় পাঠ্যগ্রন্থ। ঘরটির মাঝখানে দুটি সোফা, একটি ছোট্ট টেবিল। অবসরে সেখানে ব’সে পড়েন, কেউ এলে আলাপ করেন। উত্তর দিকে তাঁর শয্যা, তোষকবিছানো একটি চৌকি। বাসাটি যে পুরোনো আর এ-বাসার অধিকারী যে একদিন এক বিদেশি ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেছে কক্ষের পশ্চিম দিকে একটি বড়ো ফায়ারপ্লেস। বহু দিন তাতে কেউ আগুন জ্বালায় নি।
একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। আমি তাঁর বাসায় প্রবেশ করি। তাঁর ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াই, বাইরের উজ্জ্বল আলোর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা ঘরটিতে। উঁচু সিলিংয়ের বিশাল ঘর ভ’রে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার। অন্ধকারে টেবিল, তাকে এখানে সেখানে দাঁড়ানো এলানো ছড়ানো বইগুলোকে ছায়ামূর্তির মতো মনে হলো। ঘরের উত্তর দিকে চৌকিটিতে চাদর জড়িয়ে এক টুকরো নিঃসঙ্গতার মতো ঘুমিয়ে আছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। এ-বাড়িতে কোনো শিশুর কোলাহল নেই, যদিও শিশুদের তিনি খুব ভালোবাসেন। কোনো নারীর স্পর্শ নেই, চুলের ঘ্রাণ নেই। একটি কাজের ছেলে বারান্দার রকে ব’সে আছে। ছোটো চৌকিটিতে আরো ছোটো হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। জাগরণে কিছু অধিকার করতে চান নি কখনো তিনি, নিদ্রার মধ্যেও কোনো অধিকার বিস্তার করেন নি। ওই ছোটো চৌকিটিতে যেভাবে ঘুমিয়ে আছেন তিনি তাতে মনে হলো ওখানে আরো কয়েকজন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্বচ্ছন্দে ঘুম যেতে পারেন! কোনো বিবাদ বাঁধাবে না। তিনি কি খুব গভীর ঘুম যান? মনে হলো না। আমি তো নিঃশব্দেই হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম ঘরটি ও তাঁকে। তিনি ঘুম ভেঙে ‘ওহ্’ ব’লে জেগে উঠলেন। আলো জ্বালালেন, অন্ধকার কিছুটা দূর হলো। অন্ধকার বেশ দূর হলো যখন কথা বলতে বলতে খলখল ক’রে হেসে উঠলেন। আমার মনে হলো এ-বাড়ির কক্ষে কক্ষে যেনো মায়ের কোলে খিলখিল ক’রে উঠেছে শিশুরা।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো মানুষদেরই বোধহয় পুরোনো কালে জাতিস্মর বলা হতো। বাল্যকাল থেকেই সব দেখে এসেছেন দু-চোখ খুলে, আর স্মৃতিতে তা জমে আছে অমলভাবে। তবে তিনিও জানেন স্মৃতি বড়ো প্রতারক। জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি দুটি উপায়ে;—নিরপেক্ষ নিস্পৃহ দর্শক হিসেবে, আর পুস্তক পাঠ ক’রে। উৎসাহ তাঁর সব কিছুতে; মানবিষয়ক সব কিছুতেই তাঁর উৎসাহ, তাই জ্ঞানের যে-সমস্ত শাখা মানবকেন্দ্রীক, তার সবই আয়ত্তের সাধনা করেছেন তিনি। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও আগ্রহের অভাব নেই, কিন্তু তা আয়ত্ত করতে গিয়ে বার বার বিফল হয়েছেন। কিন্তু উৎসাহ কমে নি। তাঁর কাছে গেলে বহু বিষয়ে অজস্র বই পড়ার পরিশ্রম বেঁচে যায়, কেননা ওইসব বিষয়ের সারকথা আহরণ করা যায় তাঁর মুখ থেকেই।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক জন্মেছিলেন আজ থেকে সত্তর বছর আগে। ১৯১৪ সালে। জন্মের তারিখ জানেন না তিনি। ঢাকা সদর মহকুমার কেরানিগঞ্জ থানার কলাতিয়া তাঁর নিজের গ্রাম। অবশ্য ওই গ্রামে তাঁর জন্ম হয় নি; জন্ম হয়েছিলো মামা বাড়িতে, নবাবগঞ্জ থানার পাড়াগ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবদুল আলি, মায়ের নাম নান্নী বেগম। তাঁর একজন বিমাতাও ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আইএ ফেল, চাকুরি করতেন পুলিশ ইন্সপেক্টরের। শৈশব কাটে তাঁর বাবার বিভিন্ন চাকরিস্থলে—হুগলিতে, রংপুরে। ফোরে পড়ার সময় মায়ের মৃত্যু হয়। গ্রামে চ’লে আসেন, এবং গ্রামের স্কুলেই ফাইভ-সিক্সে পড়েন। সেভেনে উঠেই গ্রাম থেকে চ’লে যান, ভর্তি হন শ্রীরামপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। পড়াশোনায় আকর্ষণ শুরু হয় গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়ই।
পড়াশোনায় আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেন কখন থেকে? আমি জানতে চাই।
গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়ই। তখন বোধহয় ফাইভে পড়ি, বই পড়তে খুব ভালো লাগতে শুরু করে। জানান আবদুর রাজ্জাক।
কী বই পড়তেন?
গল্পের। একটা বইয়ের নাম এখনো মনে আছে। বইটা পাঁচকড়ি দের মনোরমার হত্যাকারী কে?
সেই শৈশবেই মুদ্রিত বস্তুতে আরেক জগৎ খুঁজে পান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। সেভেনে পড়ার সময় পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরো অনেক কিছু পড়ার সুযোগ আসে। তখন পড়তেন শ্রীরামপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। থাকতেন হুগলিতে। দুটি পত্রিকা ওই বয়েসেই নিয়মিত পড়তেন। একটি চিত্তরঞ্জন দাশের ফরোয়ার্ড, অন্যটি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়ক। ফরোয়ার্ড ছিলো অসাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাকাঙক্ষী পত্রিকা; নায়কও ছিলো রাজনীতিক পত্রিকা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় চ’লে আসেন ঢাকায়। তাঁর পিতার এক বন্ধু নিয়ে আসেন তাঁকে, ভর্তি ক’রে দেন মুসলিম হাইস্কুলে। এ-স্কুলে পড়ার সময় শনিবারের চিঠি, কল্লোল, কালিকলম পড়েছেন উৎসাহের সঙ্গে। মুসলিম হাইস্কুলের পাশেই ছিলো রামমোহন লাইব্রেরি, যেখানে বই পড়ার অবাধ সুযোগ পেয়ে ধন্য হয় তাঁর কৈশোর।
তখন প্রবেশিকা পরীক্ষার নাম ছিলো ‘হাইস্কুল পরীক্ষা’। ঢাকা শহরের স্কুলগুলো ও কয়েকটি কলেজ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো ঢাকা বোর্ড। ১৯২৯ সালে প্রথম বিভাগে হাইস্কুল পরীক্ষা পাশ করেন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্যে পেয়েছিলেন ফুরার মেমোরিয়াল বৃত্তি। সে-বছর হাইস্কুল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন আবদুস সোবহান চৌধুরী। হাইস্কুল পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন আইএসসি শ্রেণীতে, কিন্তু পনেরো দিন পর আইএসসি ছেড়ে ভর্তি হন আইএ শ্রেণীতে। ১৯৩১ সালে প্রথম বিভাগে সম্ভবত সপ্তম স্থান অধিকার ক’রে আইএ পাশ করেন। জীবনের লক্ষ্য কিছুই স্থির করেন নি তখন। প্রথমে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শ্রেণীতে। ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন শুরু হ’তে-না-হ’তেই একজন তাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো জ্ঞানের জগতে। একদিন তিনি পাঠাগারের বইয়ের আলমারিগুলোর কাছে ঘুরঘুর করছিলেন। যেখানে সারিসারি বইভরা আলমারি সেখানে ঢোকার অধিকার ছিলো না ছাত্রদের। তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন বইয়ের আলমারিগুলো। বুড়ো লোকটি, যে ভেতর থেকে বই এনে দিতো, সে জ্ঞানার্থী আবদুর রাজ্জাকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।
কী চাও? তাঁকে জিজ্ঞেস করে বুড়ো লোকটি।
বই পড়তে চাই। উত্তর দেন তরুণ ছাত্র আবদুর রাজ্জাক।
ভিতরে ঢুইক্কা বই দেখতে চাও? বেশ দয়ালু কণ্ঠে জানতে চায় বুড়ো।
হ, ঢুকতে দিলে তো ভিতরে যাই। উত্তর দেন আবদুর রাজ্জাক।
বুড়ো লোকটি তাঁকে নিয়ে যান ভেতরে, যেখানে শুধু বই আর বই। একটা বই দেখতে দেখতে আরেকটার দিকে চোখ পড়ে, সেটা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে আরেকটার দিকে। কয়েক ঘণ্টা জ্ঞানের গুপ্তকক্ষে পাগলের মতো কেটে যায় তাঁর সময়। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সোনা। তারপর নিয়মিত ঢুকতেন ওই গুপ্তধনের কক্ষে, পৃথিবী ও পাঠ্যসূচি ভুলে পড়তেন বই আর বই। একই ঘটনা ঘটেছিলো বিলেতে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। ১৯৪৫-৫০ সালে ওই পাঠাগারে অভিযাত্রী বেশি যেতো না। নিয়মিত যেতেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বুড়ো পোর্টার দুটি তাঁকে নিয়ে যায় বই রাখার কক্ষে, জ্বেলে দেয় ফায়ারপ্লেস; তিনি জ্ঞানের তাপে তপ্ত হতে থাকেন, বুড়ো পোর্টার দুটি বিশ্রাম নিতে থাকে।
১৯৩৫ সালে এমএ পরীক্ষার লিখিত অংশটুকুতে অংশগ্রহণ করেন তিনি, কিন্তু প্রথম শ্রেণী পাবেন না ভেবে মৌখিক পরীক্ষা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৩৬-এ এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। মৌখিক পরীক্ষার দিনই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণীর লেকচারাররূপে যোগ দেয়ার নিয়োগপত্র পান। তাঁকে নিয়োগপত্র দেয়াই উপাচার্য এ এফ রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জীবন। ছাত্র হিশেবে এখানে জ্ঞান লাভ করেছেন, শিক্ষক হিশেবে জ্ঞান বিতরণ করেছেন এখানে। তাঁর সময়ে যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের জীবন ও ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করেছেন তিনি মনোযোগের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনরীতিও যতোটা সম্ভব লক্ষ্য করেছেন। তাঁর ছাত্রজীবনে অর্থনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক ছিলেন ড. জে সি সিনহা, ডি এন ব্যানার্জি, কে বি সাহা, এস ভি আয়ার, মতিলাল দাম, এ কে দাশগুপ্ত, ড. পরিমল রায়, অজিতকুমার সেন, অবনীভূষণ রুদ্র, ও অক্ষয়কুমার বসাক।
হু আ : সে-সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শিক্ষক কারা ছিলেন?
আ রা : আমি ভর্তি হওয়ার আগে বিখ্যাত ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, বি এ সেন। আমার ছাত্রজীবনে বিখ্যাত শিক্ষক সত্যেন বোস, জে সি ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুশীলকুমার দে, মোহিতলাল মজুমদার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এস ভি কৃষাণ ও আরো দু-একজন।
হু আ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-পর্যন্ত সতেরোজন উপাচার্য হয়েছেন, তাঁদের ক-জনকে পণ্ডিত ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : দুজন। রমেশচন্দ্র মজুমদার, আর সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন।
হু আ : অন্যরা?
আ রা : তাঁরা চাকরি করেছেন।
হু আ : আপনি কি মনে করেন যে উপাচার্য হওয়ার জন্যে পণ্ডিত হওয়া দরকার?
আ রা : না, একেবারেই না। উপাচার্য পদটা তো বুড়ো বয়সে পাণ্ডিত্যের পুরস্কার না। উপাচার্য পদের জন্যে দরকার ভালো প্রশাসক, পণ্ডিতের দরকার নাই।
হু আ : আপনি কি মনে করেন যে পণ্ডিত না হ’লেই ভালো প্রশাসক হয়? যে-শিক্ষকেরা লেখাপড়া করেন না, শুধু তাঁরাই উপাচার্য হওয়ার যোগ্য?
আ রা : না, তা না। এ-পর্যন্ত উপাচার্য হয়েছেন তাঁদের মধ্যে হার্টগ আর মাহমুদ হোসেন ছাড়া কারোর কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য ছিলো না। তাঁরা শুধু চাকরি করেছেন। তাঁরা সার্থকও নয়, ব্যর্থও নয়। কারণ কোনো লক্ষ্য থাকলেই তো শুধু সার্থকতাব্যর্থতা নির্ণয় করা যায়। যাঁদের কোনো লক্ষ্য নাই তাঁদের আবার সার্থকতাব্যর্থতা কি? যদি কারো দালানকোঠা বানানোর লক্ষ্য থাকে, আর যদি বানাতে পারে, তবে তাঁকে বলতে পারি সার্থক। যেমন মাহমুদ হোসেন। তিনি মনে করতেন পণ্ডিত হওয়ার শক্তি তাঁর নেই। তিনি দালানকোঠা বানাতে চেয়েছিলেন। কেউ যদি জ্ঞানচর্চার জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চায়, আর তাতে সার্থক হয়, তাহলে তাকে বলতে পারি সার্থক। এমন কেউ নাই। প্রায় সব উপাচার্যের লক্ষ্যই ছিল চাকরি করা।

১৯৩৬-এ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যাপক হিশেবে নিজেকে খুব সার্থক মনে করেন না তিনি।
হু আ : ক্লাশে বক্তৃতা দিতে কেমন লাগতো আপনার?
আ রা : খুব খারাপ। ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো। মনে হতো আহা, ওদের কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নাই। আমার কথায় তো নয়ই। দু-একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিলো আমি নাকি এক আধটি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। পুরোনো কলাভবনে আমার ক্লাশের পাশেই ছিলো একটি পুকুর। সেই পুকুরে হাঁস ভাসতো অনেকগুলো। আমি জানালার বাইরে পুকুরের হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘণ্টা শেষ করতাম। ১৯৪২-৪৩ সালে কয়েকজন মিলে পাকিস্তান নামে একটি পাক্ষিক, পরে সাপ্তাহিক, পত্রিকা বের করেছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদকণ্ডলিতে ছিলেন যযহারুল হক, জসীমউদ্দীন ও তিনি। নিজে কম্পোজ করতেন পত্রিকাটি। অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলন তাঁর মনেও তীব্র সাড়া জাগিয়েছিলো।
হু আ : পাকিস্তান বলতেই এখন আমরা ইসলামি পাকিস্তান বুঝি। আপনারাও কি ইসলামি পাকিস্তান চেয়েছিলেন?
আ রা : মোটেই না। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পরবর্তী ঘটনা। মুহম্মদ আলি জিন্নাহকে ধার্মিক লোক বলা যায় না, ইসলামের জন্যে তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিলো না। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি আর ১৫ই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি তুলনা করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসবের প্রোগ্রামে ধর্মের কোনো নামগন্ধও ছিলো না। মওলানা আকরাম খাঁ, শাব্বির আহমদ ওসমানি, লিয়াকত আলিকে দিয়ে জিন্নাহকে অনুরোধ জানান অনুষ্ঠানে কিছু ধর্মকর্ম রাখতে। অনুষ্ঠান শুরু হ’লে দেখা যায় জিন্না সরদার আওরঙ্গজেব খানকে ডাকেন কোরান থেকে কিছু আবৃত্তির জন্যে। আওরঙ্গজেব খান ধর্মের ধার ধারতেন না। তিনি মঞ্চে এসে দু-একটা সুরাকলমা প’ড়েই বিদায় নেন। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা অনুষ্ঠান হয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুবিধিমতে। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পাকিস্তান হওয়ার পরের ঘটনা।
১৯৪৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যাত্রা করেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। পড়াশোনা করবেন নিজের খরচে। সম্বল মাত্র সাড়ে চারশো পাউন্ড। বোম্বে থেকে জাহাজে ওঠেন। সৈনিকদের জাহাজ। পাঁচ হাজার সৈন্য আর চারশো যাত্রী নিয়ে উনিশ দিনে জাহাজ বিলেতে পৌঁছোয়। বিলেতে থাকেন পাঁচ বছর—নিজের খরচে। মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গ্রন্থাগারবিজ্ঞান পড়ার জন্যে আরো সাড়ে চারশো পাউন্ড দেয়। মোট নশো পাউন্ডে, মাসে পনেরো পাউন্ড ব্যয় ক’রে, পাঁচ বছর কাটিয়ে দেন।
পড়াশোনা করতেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে। তাঁর গবেষণা পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কি। অধ্যাপক রাজ্জাকের গবেষণার বিষয় ছিলো ভারতের রাজনীতিক দল। সন্দর্ভ জমা দিয়েছিলেন। অধ্যাপক রাজ্জাকের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তব ব্যাপারে ঔদাসীন্য, সন্দর্ভে তা ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে।
মৌখিক পরীক্ষার সময় একজন বিশেষজ্ঞ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার থিসিসে রেফারেন্স নাম্বারগুলো আছে, কিন্তু পাদটীকায় রেফারেন্সগুলো কোথায়?’ প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে নিজের হাতের সন্দর্ভটি খুলে দেখেন, রেফারেন্সগুলো টাইপ করা হয় নি। টাইপিস্ট মেয়েটি যেভাবে টাইপ ক’রে দিয়েছে সেভাবেই সন্দর্ভ জমা দিয়েছেন তিনি। একবারও খুলে দেখেন নি।
বিব্রত হয়ে বললেন, ‘ভুলে টাইপ করা হয় নি, তবে রেফারেন্সগুলো আমার মনে আছে। কোনটা আপনি জানতে চান?’
রেগিনাল্ড কুপল্যান্ড ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি ভারতের রাজনীতিক দলগুলো সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার থিসিস থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পারবো।’
আবদুর রাজ্জাক জবাব দিলেন, ‘আপনি যে কমিটিতে থাকবেন তা তো আমি জানতাম না।’
তোমাকে আরো ছ-মাস থেকে থিসিস ঠিক ক’রে আবার জমা দিতে হবে।
আমি আর ছ-দিনও থাকবো না।

ডিগ্রি না নিয়ে প্রচুর বই ও প্রচুর অধীত বিদ্যা নিয়ে মালজাহাজে চেপে দেশে ফিরে আসেন আবদুর রাজ্জাক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। পদোন্নতির জন্যে কখনো দরখাস্ত করেন নি, যদিও কয়েকবার তাঁকে পদোন্নতি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাই অনেক দিন তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম সহকারী অধ্যাপক। লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক হন স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই মার্চে তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় অধ্যাপকের পদ। পাঁচ বছরের জন্যে। ওই পদে পাঁচ বছরের জন্যে আবার নিয়োগ করা তাকে ১৯৮০তে।
কোনো উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত না করার ঋষিসুলভ ঔদাসীন্য তাঁর স্বভাবগত। থেকে গেছেন চিরকুমার ও অবিবাহিত। কোনো বই লেখার উদ্যোগ নেন নি। পড়েছেন বিপুল, জ্ঞান দান করেছেন ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের, যারা তাঁর কাছে এসেছে, বা তিনি খুঁজে বের করেছেন যাদের। তাঁর ব্যক্তিগত, আবেগগত জীবনসম্পর্কে উৎসাহ অনেকের, এবং আমার।
হু আ : আপনি অবিবাহিত রইলেন কেন?
আ রা : বিশেষ কোনো কারণে না। বিয়ে করা হয় নাই।
হু আ : কারো সাথে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিলো?
আ রা : না তো।
হু আ : আপনি কখনো কোনো নারীকে স্পর্শ করেছেন, হাত ধরেছেন কোনো নারীর? ধরার আবেগ বোধ করেছেন?
আ রা : না। আমাদের সমাজব্যবস্থা যা তাতে আত্মীয় ছাড়া আর কোনো নারীর সংস্পর্শে আসারই সুযোগ ছিলো না। আত্মীয় যারা তাদের সঙ্গে সম্পর্কে ছিলো আইনকানুনে বাঁধা, কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা আগে থেকেই স্থির করা ছিলো। কারো জন্যে বিশেষ আবেগ জাগার ঘটনা তো মনে পড়ে না। মেয়ে দেখলে তো আবেগ জাগবে, মেয়েই তো দেখি নাই।
হু আ : কোনো নারীর সৌন্দর্য কখনো আপনাকে মুগ্ধ করেছে?
আ রা : হ্যাঁ, অনেক সুন্দরী মহিলা দেখেছি, মুগ্ধও হয়েছি। কাউকে কাউকে হয়তো এক-আধ মিনিট দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে। তবে বিশেষ নাম করার মতো কারো কথা তো মনে পড়ে না।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিকের মিশ্রণ ব’লে মনে করেন। ১৯৮০র মে মাসে তিনি ‘স্টেট অব দি নেশন’ নামে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ক’রে সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশ জাতীয় অবস্থার চালচিত্র নামে একটি বই’ই রচনা করেন; সম্প্রতি অধ্যাপক মনসুর মুসাও একটি প্রবন্ধে অধ্যাপক রাজ্জাকের বক্তব্যের ত্রুটি ধরেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি অনেকেরই আক্রমণের লক্ষ্য, কেননা তাঁরা মনে করেন ওই শব্দটি রাজনৈতিক ও দলীয়, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় ব্যবহৃত হ’তে পারে না।
হু আ : ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিতে আপনি দার্শনিক ও আদর্শগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন ব’লে অনেকে আপত্তি তুলেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দে আপনি কী জ্ঞাপন করতে চান?
আ রা : শব্দটি আমি এ-অর্থে ব্যবহার করি যে তিনি একটি প্রতীক ছিলেন, আর তিনি একেবারে পরোক্ষ অর্থে যে প্রতীক ছিলেন, তাও না। তিনি অনেকটা দেখা দিয়েছিলেন এ-এলাকার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মনুষ্যমূর্তি রূপে, তাঁর মধ্যেই মানুষেরা নিজেদের আশা মূর্ত দেখতো। তিনি একলা দেশ স্বাধীন করেন নি, তবে তাঁর অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরে তিনি বাংলাদেশের এক হাজার মাইলের মধ্যেও ছিলেন না, তবু সাধারণ ও একেবারে সাধারণ নয় এমন মানুষেরা তাঁর কথা ভেবেই অনুপ্রাণিত হতো। যদিও তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তিনিই সব কিছুর কেন্দ্রে আছেন ব’লে মনে করা হতো।
হু আ : আপনি কি ‘জাতির পিতা’ ধারণায় বিশ্বাস করেন?
আ রা : ‘জাতির পিতা’ ধারণাটি দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে যে একটি লোকের মধ্যেই জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে। একটি জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা ও আরো বহু ব্যাপার সংক্ষেপে জড়ো হয় ওই একটি শব্দবন্ধে। ওয়াশিংটনকে যখন বলা হয় আমেরিকার জাতির পিতা, গান্ধিকে ভারতের, জিন্নাকে পাকিস্তানের, তখন শুধু এটাই বোঝানো হয় যে ওই কয়েকজন মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
হু আ : শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আ রা : কেউ যখন নিহত হন, তখন বুঝতে হবে তিনি কোনো-না-কোনো উপায়ে বিশেষ কারো বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কারো স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছিলেন। লিংকন বা গান্ধি বা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে তাঁরা একদলকে শত্রুতে পরিণত করেছিলেন। এ-হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে না যে ওই ব্যক্তিরা খারাপভাবে শাসন করছিলেন, বা বহু ভুল করেছিলেন। মুজিবের সম্বন্ধেও তাই।
হু আ : শেখ মুজিব যেভাবে দেশ শাসন করছিলেন তাতে কি তাঁর রক্তাক্ত পরিণতি অনিবার্য ছিলো?
আ রা : বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে দেশ শাসনের অনিবার্য পরিণতিরূপে হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেয়া যায় না। ব্যাপারটি বোঝার জন্যে জানতে ও বুঝতে হবে যে তাঁর হত্যাকারী কারা? কী এমন ঘটেছিলো যাতে তারা এতোটা বিক্ষুব্ধ হলো যে তাদের হত্যার পথ বেছে নিতে হলো? তিনি কীভাবে দেশ শাসন করতেন সে-ব্যাপারটি এই হত্যার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। শেখ মুজিবর রহমানের রাজনীতিক দর্শন ঠিক কি ভ্রান্ত আমি সে-বিবেচনায় যেতে চাই না, শুধু এইটুকুই বুঝতে পারি যে তিনি একটা ব্যাপার বিশেষভাবে স্পষ্ট ক’রে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সামরিক বাহিনীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রে যে-গুরুত্ব দাবি করে শেখ মুজিব তাদের তা দিতে রাজি ছিলেন না। তাদের মতে তাদের যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হয় নি। তাদের ক্ষুণ্ণ করার জন্যেই এমন ঘটে।
হু আ : গত এক দশকের বাংলাদেশি রাজনীতির প্রধান লক্ষণ কী ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : প্রশ্নটা এতো নির্বিশেষ ভাষায় করা হয়েছে যে উত্তরটাও নির্বিশেষই হবে। এটা ঠিক যে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ—রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সময় একটু বেশি সোজাভাবে দাঁড়াতো, একটু বেশি শক্তিশালী বোধ করতো। তাঁর পরে যে তারা খুব খারাপ আর্থিক অবস্থায় পড়ে গেছে, বা তাঁর সময়ে যে খুব ভালো আর্থিক অবস্থায় ছিলো, তা না। তবে এটা আমি খুব স্পষ্টভাবেই বুঝি যে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ অনেকটা অসহায় বোধ করে, আগে এমন অসহায় বোধ করতো না। সমাজের যতো বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও সমাজের জন্যে অপরিহার্য, ততোই ভালো। গান্ধি বা জিন্না জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের অংশ ছিলেন না, কিন্তু মুজিবের সময় জনগণ এমন বোধ করতে থাকে যে শেখ মুজিব তাদেরই অংশ। বর্তমানে এ-অবস্থাটা নাই।
হু আ : আমার কাছে বাংলাদেশের সমাজকে নষ্ট সমাজ ব’লে মনে হয়। আপনার কেমন মনে হয়?
আ রা : আমি এর সঙ্গে একেবারেই একমত নই। বরং আমার কাছে এই এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা ব’লে মনে হয়। বাংলাদেশে ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার, তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে-সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশে আর কোথাও নাই। শুধু উপমহাদেশে কেনো, সারা পৃথিবীতেও নাই।
হু আ : তার অর্থ কি এই যে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের সমাজ ভালো?
আ রা : ভালো আর মন্দের তালিকা ক’রে যে বাংলাদেশের সমাজকে ভালো বলা যাবে, তা না। ভালো এই অর্থে যে এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ আর সম্ভাবনা আছে। কথা হলো আমার প্রত্যাশা কতোটা পূরণ হ’তে পারে? এমন কি আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝি সেখানকার কৃষকদের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই, কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসীদের সে-সুযোগ আছে।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বিশেষ কোনো দার্শনিক বা তাত্ত্বিক ধারার অনুসারী নন। তাঁকে উদার মানবতাবাদী বললে খিলখিল ক’রে হেসে ওঠেন, বুর্জোয়া চিন্তাধারার বললেও তেমনি হাসেন। তিনি জ্ঞানান্বেষী, যে-কোনো ধারা থেকে তা আহরণে তিনি উৎসাহী। রাষ্ট্রচিন্তায় তিনি গণতান্ত্রিক। আর্থিক শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্ভবত তাঁর পছন্দ। বাংলাদেশের জন্যে কোন ধরনের ব্যবস্থা তাঁর কাম্য, স্পষ্টভাবে তিনি তা জানাতে দ্বিধান্বিত, কেননা তাঁর বিশ্বাস যে কোনো ব্যবস্থাই কালপরম্পরায় পরিবর্তিত হয়ে যেতে বাধ্য।
হু আ : আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা—মোটামুটি রুশ বা চীন দেশীয় আদলে—আপনার কাছে কি অত্যাবশ্যক ব’লে মনে হয়?
আ রা : রুশ বা চীনদেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তো চিরস্থির না। যদি গত ষাট আর ত্রিশ বছরের রুশ আর চীনদেশীয় ব্যবস্থা মনোযোগের সঙ্গে দেখি, তাহলে চোখে পড়ে যে রাশিয়ায় আর চীনে বহু কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। লেনিন আর তাঁর সহকর্মীরা যে-সমস্ত লক্ষ্য সামনে রেখেছিলেন, তাদের যে-সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো, এখন আর তা নাই। চীনে প্রথম পনেরো-বিশ বছরে মাও সেতুং আর চৌ এন লাই যা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, এখনকার চীন ঠিক তাই চায় এমন মনে করার কোনো কারণ নাই। একশো পঞ্চাশ বছর আগে মার্ক্স যে-সব সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, লেনিন কোনো ঘোষণা না ক’রে পঁচাত্তর বছর পরে সেগুলোকে ব্যাপকভাবে বদলে দেন। আমাদের দেশে যারা রুশ বা চীনদেশীয় কাঠামো চায়, তাদের এ-সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হবে।
হু আ : শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা আমাদের জন্যে কতোটা দরকার?
আ রা : অর্থনীতিতক অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ংকর। একেবারে থাকবে না, এটাকে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ব’লে মনে হয় না। ষাট বছর কেটে যাওয়ার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে শতকরা দশজন লোক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, আর ওই শতকরা দশজন লোকই সব কিছু স্থির ও নিয়ন্ত্রণ করে। এটাতো অসাম্য দূর করার কথা না। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর হয়েছে, আর বেশি কিছু না। শুধু অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দিলে সমাজকে তো ঠিকমতো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। আমি যদি ব্যক্তি হিশেবে মূল্য না পাই অথচ আমার আয় যদি অন্যের সঙ্গে সমান হয়, তবে তা মূল্যবান না। এটা ঠিকই সোভিয়েত ইউনিয়নে আর্থিক অসাম্য দূর হয়েছে। তবে তার জন্যে মূল্য দিতে হয়েছে। সেই মূল্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অবিমিশ্র অসাম্য।
হু আ : বিশ্বব্যাপী এখন রাজনীতিতে মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। আপনার কি মনে হয় আগামী পঞ্চাশ বছরে সারা গ্রহ ভ’রে বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
আ রা : ধর্মের মূল কথা হচ্ছে এই জীবন মৃত্যুপরবর্তী এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহান জীবনের একটি অত্যন্ত গৌণ উপাংশ মাত্র। এ ছাড়া ধর্মের আর কোনো সংজ্ঞা নাই। আমার মনে হয় না যে এমন বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের কোনো যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে। এখন মানুষ নানান কথা কয়ে তাকে ধর্ম বলে চালানোর চেষ্টা করছে। ওই বিশ্বাস যে এ-জীবন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, পরলোকই সব, এমন বিশ্বাস ফিরে আসে নাই। পাঁচ-ছশো বছর আগে মানুষেরা সত্যিই বিশ্বাস করতো যে এ-জীবন নশ্বর, আসল জীবন প’ড়ে আছে সামনে মৃত্যুর পরে। এখন ধর্ম বলতে যা বলা হয় তা আমি বুঝি না।

হু আ : পৃথিবী এখন যারা চালাচ্ছে, তাদের কতোজনকে আপনি উন্মাদ বা অসুস্থ মনে করেন?
আ রা : উন্মাদ কিনা বলতে পারি না, তবে পৃথিবী যারা চালাচ্ছে, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সবাই বুড়ো, অনেকটা বাতিল মানুষ। বুলগেরিয়ায় দেখেছি সেখানকার তরুণেরা যেসব গান পছন্দ করে তার শতকরা আটানব্বইটাই মার্কিন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবপ্রতাপশালী চারপাঁচজন মানুষের কথা যদি ভাবি, ধরা যাক ক্রেমলিনের কর্তা, হোয়াইট হাউজের কর্তা, পিকিংয়ের কর্তা, টোকিওর কর্তা, নতুন দিল্লীর কর্তাকর্ত্রীর কথা, তাদের সমস্ত অনেকের মধ্যে চোখে পড়ে একটি সাদৃশ্য—তাদের কারো বয়সই সত্তরের বেশি কম না। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই তরুণ। যারা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তাদের কেউ পাঁচ-দশ বছরের বেশি বাঁচবে না। আমার ধারণা পৃথিবীর তরুণেরা তাদের শাসকদের চেয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি মিল দেখতে পায়। যে-কোনো দেশে সত্তর বছর বয়স্ক লোকের ওপর আগামী বিশত্রিশ বছরের পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা অনুচিত। বয়স যতো বাড়ে মানুষ ততো বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, অন্যের কথা মনে থাকে না। আর এ-দেশে তো তা ভয়াবহ।
হু আ : তবু পৃথিবীটা তো বুড়োরাই চালাচ্ছে!
আ রা : এই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বিপদ।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত আছেন পাঁচ দশক ধ’রে। জীবনের জ্ঞান তিনি বাস্তব থেকে যতোটা আহরণ করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি বই থেকে আহরণ করেছেন। আমাদের জ্ঞানচর্চার অতীত ও বর্তমান অনেকটাই তাঁর অভিজ্ঞতার মধ্যে।
হু আ : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞানচর্চার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কী ধারণা পোষণ করেন?
আ রা : আমাদের সমাজে লেখাপড়া বেড়েছে, শিক্ষায় অনেক অগ্রসর হয়েছি আমরা। কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা কতোটা কনট্রিবিউট করতে পারছি, তা পরিমাপ করার সহজ উপায় নাই। আমরা কেউই এতো পণ্ডিত না যে জ্ঞানের হাজারটা শাখায় কে কী করছে, তার মূল্যায়ন করতে পারি। তবে আন্তর্জাতিক সমতার মানদণ্ড প্রয়োগ ক’রে কিছুটা হিশেব করা যেতে পারে। পৃথিবীর উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রশিক্ষকদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমাদের ছাত্রশিক্ষকদের। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই যে আমাদের বিপুল সংখ্যক তরুণ পৃথিবীর প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের সমতুল্য বা প্রায় সমতুল্য। ’৪৭-এর আগে এমন ছিলো না।
হু আ : আমাদের সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, বিভিন্ন একাডেমি বিশেষ মহিমা অর্জন করতে পারছে না। এর কী কারণ ব’লে আপনার মনে হয়?
আ রা : ওইসব প্রতিষ্ঠানের মহিমা বা মূল্য কতোটা তা ওই আন্তর্জাতিক সাম্যের মাপকাঠি দিয়েই নির্ণয় করতে হবে। আমি এ-দেশের জাতীয় অধ্যাপক, বিদেশে গিয়ে যদি সহকারী অধ্যাপকও হ’তে না পারি, তবে মহিমা থাকে কোথায়? শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সেনাবাহিনী, আমলা সব কিছু মাপার জন্যেই দরকার আন্তর্জাতিক সাম্যের মাপকাঠি। আমার ধারণা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যা ব’লে নিজেদের দাবি করে, কিন্তু তা হয়ে উঠতে পারে নাই ব’লেই এমন অবস্থা।
ব্যক্তি আবদুর রাজ্জাককে জানার জন্যে আমি কিছু ছোটো প্রশ্ন করেছিলাম। কিছুটা ধরা দিয়েছেন তিনি।
হু আ : আপনি তো আশাবাদী।
আ রা : আমি জানি না। আমি তথ্য নিই, আর তথ্যভিত্তি ক’রেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই।
হু আ : আপনি তো বেশ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ!
আ রা : সাধারণত। তবে মাঝে মাঝে মেজাজ নষ্ট হয়। কম বয়সে বেশি নষ্ট হতো।
হু আ : প্রথাগত ব্যাপার ও চিন্তার প্রতি কি আপনি শ্রদ্ধাশীল?
আ রা : শুধু প্রথাগত ব’লেই কোনো কিছুকে উড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, আবার প্রথাগত ব’লেই মেনে নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না।
হু আ : আপনি কি প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী?
আ রা : বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথাটা ওঠে না। কারণ ধর্ম সম্পর্কে কথাবার্তা বলার আগ্রহ আমি কখনো বোধ করি নাই।
হু আ : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবেন?
আ রা : বিশেষ না। তবে মরতে হবে এই পর্যন্ত নিশ্চিত।
হু আ : আজকাল কী ধরনের বই পড়ছেন?
আ রা : ফ্রান্সে এক ধরনের নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে, খুব চমৎকার। তার কয়েকটা দেখছি।
হু আ : জীবন যাপন আপনার কাছে বেশি আনন্দদায়ক না বইপড়া বেশি আনন্দদায়ক?
আ রা : জীবনযাপন করার মধ্যেই আছে ওই বইপড়াটা। বই ছাড়া জীবন অকল্পনীয়।
হু আ : বইপড়ার মধ্যে সুখটা কোথায়?
আ রা : হা-হা-হা, আপনি তা একটু বেশি ক’রেই জানেন।
হু আ : আপনাকে অতীত জ্ঞান বেশি সুখ দেয় না নতুন চিন্তা?
আ রা : নতুন মানে সত্যিকারভাবেই নতুন কথা খুব বেশি নাই। যদি আর্কিমিডিস আর আইনস্টাইনের চিন্তার তুলনা করেন তাহলে পার্থক্যটা পর্বতপ্রমাণ। আর প্লেটো যা চিন্তা করেছিলেন, এবং এখন ওই সব বিষয়ে যে চিন্তা করে, তাঁর কথা যদি ধরি, তাহলে, পার্থক্যটা খুব বেশি না। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই চিন্তার অগ্রগতি ঘটেছে অপরিসীম। আপনি যদি পৃথিবীর মানববিদ্যার প্রধান ব্যক্তিদের এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বলেন, তাহলে তাঁদের শতাব্দী কেটে যাবে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রধান ব্যক্তিদের বসিয়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছোতে বলেন, তাহলে তাঁরা বারো ঘণ্টার বেশি সময় নেবেন না। প্লেটো থেকে আজ পর্যন্ত চিন্তার যে-অগ্রগতি ঘটেছে, তা ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদের শ্রমেই ঘটেছে।
হু আ : জ্ঞানের কোন শাখাগুলো আপনাকে আকর্ষণ করে?
আ রা : মানুষ সম্পর্কে যা তার সবই।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রিয় শখ হচ্ছে বাজার করা, রান্না করা। লুঙ্গি প’রে বাজারে চ’লে যান, চকবাজারে যেতেই পছন্দ করেন বেশি। বিদেশে গেলেও কাঁচাবাজারে হানা দেন।
হু আ : শুনেছি বাজার করতে আপনি পছন্দ করেন?
আ রা : খুব। নিয়মিত বাজার করা শুরু করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর। রান্না শিখেছি ছোটবেলায়ই। আমি যে-কোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিশ দেখি, একটা কাঁচাবাজার অন্যটা বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে-দেশে বইয়ের দোকান নাই সে-দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায় দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকান অজস্র, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বই প্রচুর পাওয়া যায়। সেখানে দোকানে শতকরা ত্রিশপঁয়ত্রিশটা বই কমিউনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশপঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং ওই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্যে হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
বিভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু এলোমেলো প্রশ্ন করেছিলাম অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে। উদ্দেশ্য ওই প্রসঙ্গগুলো সম্পর্কে তাঁর মত, সংক্ষেপে হ’লেও, লিপিবদ্ধ হয়ে থাক।
নমুনা:
হু আ : এ-দেশে সামরিক শাসন টেকার কোনো কারণ আছে ব’লে মনে হয়?
আ রা : টেকার তো কোনো কারণ দেখি না, সামরিক শাসনের কোনো ভিত্তি নাই এ-দেশে। কতোদিন টিকবে তা বলা অবশ্য জ্যেতিষের কাজ। সামরিক শাসনের কোনো শিকড় নাই। খুবই আগাছার মতো টিকে আছে। তাদের টিকে থাকাটা প্রমাণ করে তাদের বিরোধীরা কতো সামান্য। মুজিবের মারা যাওয়ার পর ওই পাঁচ-ছজন লোক থাকলেও চলতো। যদি তারা জীবিত থাকতো তাহলে হয়তো একটা ডাইরেকশন দিতে পারতো, নেতৃত্ব দিতে পারতো। আমার নিজের ধারণা ’৭০/৭১-এ যারা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এর মধ্যে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এখন যে-সব জিনিশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করছে, যারা আওয়ামী লীগের নামে এখনো চালাতে যাচ্ছে, আমার মনে হয় তারা শিগগিরই বুঝতে পারবে যে এই সমস্ত কথা ব্যাপক জনসাধারণের কাছে মূল্য বহন করে না।
হু আ : আপনি যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের অন্তত দুজনের নাম বলবেন, যাঁদের আপনি অসাধারণ ব’লে গণ্য করেন?
আ রা : জয়নুল আবেদীন, জসীমউদদীন। অসাধারণ বলতে সাধারণত যা বোঝা হয় তার থেকে খুবই ভিন্ন রকম এঁরা। জসীমউদদীন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, তখন নানাজন খুবই বিরক্ত করেছে তাঁকে। আমি বলতাম আমরা ম’রে গেলে কেউ নামও নেবে না, জসীমউদদীনের নাম অনেক বছর থাকবে।
হু আ : সৃষ্টিশীল ও পণ্ডিতদের মধ্যে কোন শ্রেণীটিকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
আ রা : গুরুত্বপূর্ণ তো নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল মানুষ, তবে মানুষ হিসেবে তাঁরা এমন যে তাঁদের সঙ্গে বাস করা খুবই কঠিন। আমরা শিক্ষকেরা তো পাণিনিও না, পাণিনির টীকাকার মাত্র।
হু আ : বাঙালির জীবনে কোনো উৎসব নেই কেনো? এমন উৎসব যাতে তরুণতরুণীরা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারে?
আ রা : এটা বাঙালির, বাংলাদেশের একটা বিশিষ্টতা। উৎসবের কথা অতো বড়ো ক’রে না ধ’রে শুধু নাচের কথাই ধরতে পারি। বাঙালি এমন একটা গোষ্ঠী যাদের মধ্যে নাচের কোনো চল নাই। কোনো ধরনেরই নাই;—যুবক-যুবতী, খালি যুবক, খালি যুবতী, কোনো ধরনেরই নাচ নাই। উৎসব নাই, সম্ভাবনা দেখি না। উপজাতীয়দের উৎসব আছে, কিন্তু যারা তথাকথিত আর্য ও তাদের উত্তরাধিকারী, তাদের মধ্যে নাই। এটা চোখে না প’ড়ে পারে না, কিন্তু আমার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নাই। উৎসব না থাকাটা এ-দেশের বিশিষ্টতা। যেমন পাঁচ-ছশো বছর ধ’রে পাটনার পূবে কোনো যুদ্ধ হয় নি। যখন তারা বলে যে একটা স্থায়ী সামরিক সরকার খাড়া করবে আমি তা বিশ্বাস করি না, কেননা তা অসম্ভব। যেখানে যুদ্ধ হয় নাই সেখানে দামী ইউনিফর্ম কিনে সামরিক শাসন চালাবে, তা সম্ভবপর না।
হু আ : বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
আ রা : ভাষা, বাঙলাভাষা। ভাষা ছাড়া আর যা তা প্রায় সব সমাজেই একরকম, তবে এক সমাজে এইটার ওপর জোর দেয়া হয় অন্য সমাজে সেটার ওপর জোর দেয়া হয়।
হু আ : ভারতীয় নারীদের আপনার কাছে বেশি সুন্দর মনে হয় নাকি ইউরোপীয় নারীদের?
আ রা : সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে ভারতীয়-ইউরোপীয় শ্রেণীকরণ খুব সার্থক না। ভারতীয়দের কাছে নারীর মুখের গঠন, এটা ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সুন্দরীরা ফিগার সম্পর্কে অত্যন্ত কম সচেতন। সব মিলে যে সৌন্দর্য এ-বোধ নাই। চুল লম্বা, রঙ শাদা, দেখতে ভালো ইত্যাদিই এখানে প্রধান, কিন্তু ফিগারের দিকে চোখ নাই। এটাকে খুব সুষ্ঠু সৌন্দর্যবোধ বলা যায় না। ইউরোপে ফিগারের ওপরে খুব বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। ভারতীয় ভাস্কর্য, চিত্রকলায়ও তাই দেখা যায়, ফিগারের দিকে দৃষ্টি নাই। নৃত্যরত শিবের ব্যাপারটা ভিন্ন, ওটা প্রায় গাণিতিক সূত্র অনুসারে তৈরি। তবুও গ্রিক ভাস্কর্যে বিশুদ্ধ দেহসৌষ্ঠবের যে-উল্লাস দেখা যায়, ভারতে তা দেখা যায় না।
হু আ : আপনি কি গান শোনেন?
আ রা : শুনি। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করি না, বড়ো একঘেয়ে লাগে। নজরুলগীতি, ভারতীয় রাগসঙ্গীত ভালো লাগে, কীর্তনভজন ভালো লাগে। দীপালি তালুকদার, দিলীপ রায়কে পছন্দ করি।
হু আ : আপনি কোনো বই লিখলেন না কেনো?
আ রা : আলস্যবশত। হয়তো যা জেনেছি, তাও খুবই অকিঞ্চিৎকর। তবে এটা প্রতারণাও হ’তে পারে।
হু আ : আমাদের সমাজের গত বিশত্রিশ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ব’লে কাদের আপনি মনে করেন?
আ রা : আমাদের যা সমাজব্যবস্থা, মূল্যায়নের যে-পদ্ধতি, তাতে আমি যাঁদের নাম করবো, তাঁরা হয়তো অন্যদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব’লে বিবেচিত হবেন না। কিন্তু ওই শামসুর রাহমান, জয়নুল আবেদীন, জসীমউদদীন, এঁদেরই আমি ৪৭-এর পরের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে করি। এঁদেরই নাম সবচেয়ে বেশিদিন টিকবে।

হু আ : আপনার কোনো নেশা আছে?
আ রা : তামাক খাই, দাবা খেলি, রান্নাবান্না করি।
হু আ : আপনার যা চরিত্র তাতে আপনার তো হওয়া উচিত ছিলো একজন সুখী আর সংসারী ব্যক্তি।
আ রা : আমি সুখী আর সংসারী দুই-ই তো।
হু আ : আপনি আর কতো বছর বাঁচবেন বলে আশা করেন?
আ রা : আমি যে-কোনো মুহূর্তে বিদায়ের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কোনো দুঃখ নাই। কতো বছর বাঁচবো, তা ভাবি না। জীবনমৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশি ভাবি না। আমি অনেক বেঁচেছি, সত্তর বছর। নিজের হাতে জীবন নেবো, এই কথা কখনো ভাবি নাই, যে-কোনো মুহূর্তে মারা গেলে দুঃখ নাই। অনেক তো বেঁচেছি।
দিনরাত্রির রহস্যজড়ানো একটি বড়ো ঘরে ব’সে আছি আমরা দুজন একজন বলেন, ‘অনেক বেঁচেছি।’ আরেকজন মনে মনে বলে, ‘আমি আরো বাঁচতে চাই।’ একজন অনেক জেনেছেন, তার মৃত্যুর কোনো ভয় নাই। অন্যজন জানে নি কিছুই, কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে আমি দেখে আসছি দু-দশক ধ’রে;—দূর থেকে, কিছুটা দূর থেকে, আর অনেক কাছে থেকে। অনেক উপাখ্যান শুনেছি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর অতীত জ্ঞান সম্পর্ক। তাঁকে বই উৎসর্গ করেছেন দেশিবিদেশি অনেকে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেছেন অনেক জ্ঞানী ও জ্ঞানার্থী। তিনি জ্ঞানের তপস্যা করেছেন এমন এক দেশে, কালে, যেখানে যখন নির্জ্ঞানদেরই প্রাধান্য। সত্তর বছর জীবনযাপন ক’রেও তিনি রয়ে গেছেন চারপাশের উত্তেজিত কলরোলিত জীবনের বাইরে; কম্পিত হন নি কামনায়, বাসনা তাঁকে বিনিদ্র রাখে নি, উচ্চাশা তাঁকে দংশন করে নি। আমার মুখোমুখি এখন এক কিংবদন্তি;—জ্ঞানের ও ঔদাসীন্যের, কিন্তু আলোআঁধার জড়ানো সন্ধ্যায় আমার চোখ দেখতে পাচ্ছে একজন মানুষকে, যাঁর পোশাক, বসার ভঙ্গি, উচ্চহাসি আর দশজনের মতোই সহজ সরল সাধারণ।
এ-সাধারণত্বকেই তো অসাধারণ ক’রে তুলেছেন নিজের জীবনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক—একালের জ্ঞানতাপস—শুধু জ্ঞানের জন্যে জীবনকে অবহেলা ক’রে। জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হ’লে জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক।
রোববার ৭:৯, ২ ডিসেম্বর ১৯৮৪: ১৬ অগ্রহায়ণ ১৩৯১
*বানানরীতি লেখকের নিজস্ব

এই প্রজন্মের পাঠকের কাছে রাজ্জাক স্যারকে ঠিক কোন পরিচয়ে তুলে ধরাটা উচিত হবে তা নিয়ে আমি নিজেই কিছুটা সন্দিহান! শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, আড্ডারু না গুরুদের গুরু? সব পরিচয়ই তাঁর জন্য উপযুক্ত।
১০ ঘণ্টা আগে
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সারা জীবনে প্রায় কিছুই লিখলেন না। শিক্ষকতা করলেন, দাবা খেললেন আর গল্প করে গেলেন। অথচ লেখার মতো অনেক কিছু তাঁর ছিল। তাঁর শেষ না করা পিএইচডি থিসিস দেখলে তাতে সন্দেহ থাকে না। কিন্তু তিনি আর কিছু লিখলেন না।
১১ ঘণ্টা আগে
দুই মেরুর দুই বাসিন্দা—আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ; দুজনের মধ্যে প্রায়ই ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে যায়। পত্রিকায় সেসব বিবাদকাণ্ডের খবর আমরা পড়ি। নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ একদিন খেয়াল হলো দুজন বিস্ময়করভাবে একই গুরুর ‘শিষ্য’; গুরুর নাম আব্দুর রাজ্জাক। হুমায়ুন আজাদ রাজ্জাকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
১১ ঘণ্টা আগে
মানিকগঞ্জের বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সহনশীলতার কফিনে আরও একটি পেরেক ঠুকে দিয়েছে। গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরে পালাগানের আসরে আল্লাহকে নিয়ে কথিত ‘কটূক্তি’র অভিযোগে ১৯ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১২ ঘণ্টা আগে