মানিকগঞ্জের বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সহনশীলতার কফিনে আরও একটি পেরেক ঠুকে দিয়েছে। গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরে পালাগানের আসরে আল্লাহকে নিয়ে কথিত ‘কটূক্তি’র অভিযোগে ১৯ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অথচ পালাগানের শ্রোতা ও বোদ্ধারা জানেন, বাউল বা সুফি ঘরানার গানে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কেবল ভয়ের নয়, বরং গভীর প্রেমের। সেখানে ‘মান-অভিমান’ থাকে, থাকে দার্শনিক প্রশ্ন। কিন্তু সেই দার্শনিক জিজ্ঞাসাকে যখন আক্ষরিক অর্থে বা ‘লিটারেল’ দৃষ্টিতে দেখা হয়, তখনই তা হয়ে দাঁড়ায় ‘ধর্ম অবমাননা’।
আবুল সরকারের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা দাবি করছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে মাজার ভাঙা, নারীদের হেনস্তা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজন পণ্ড করার যে মহোৎসব চলছে, আবুল সরকারের গ্রেপ্তার তারই ধারাবাহিকতা।’
কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির এই স্পর্ধা বা প্রশ্ন করার রীতি নতুন নয়। আজ বাউল আবুল সরকার যে অভিযোগে কারাগারে, ঠিক একই অভিযোগে ১০০ বছর আগে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল।
আল্লামা ইকবাল ও তাঁর ‘শিকওয়া’: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
১৯০৯ সালে লাহোরে আঞ্জুমান-ই-হিমায়াত-ই-ইসলামের এক সভায় আল্লামা ইকবাল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়া’ (অভিযোগ) পাঠ করেন। এই কবিতায় ইকবাল সরাসরি আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহর অধঃপতন নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ, কখনো কখনো তা মনে হতো স্রষ্টার প্রতি একধরনের ‘চ্যালেঞ্জ’। ইকবাল লিখেছিলেন:
‘কভি হম সে, কভি গায়রোঁ সে শিনাসাই হ্যায়
বাত ক্যাহনে কি নেহি, তু ভি তো হর্জাই হ্যায়।’
(কখনো আমাদের সঙ্গে, কখনো অন্যদের সঙ্গে তোমার ভাব;
কথাটা বলা উচিত নয়, কিন্তু তুমিও তো বহুরূপী বা ছলনাময়ী!)
ইকবাল আল্লাহকে ‘হর্জাই’ (বহুরূপী/বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকা) বা ‘নিঠুর’ বলার মতো স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, যারা তোমার নাম নিয়ে যুদ্ধ করল, জীবন দিল, তাদের কেন আজ এই দুর্দিন? আর যারা তোমার নাম নেয় না, তাদের কেন এত ঐশ্বর্য?
ইকবালের অভিযোগের ভাষা এতটাই তীব্র ছিল যে, তিনি স্রষ্টাকে সরাসরি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন:
‘রহমতেঁ হ্যায় তেরি আগিয়ার কে কাশানোঁ পর,
বর্ক গিরতি হ্যায় তো বেচারে মুসলমানোঁ পর।’
(তোমার রহমত বর্ষিত হয় অন্যদের [অবিশ্বাসীদের] আলয়ে,
আর বজ্রপাত হলে তা পড়ে কেবল বেচারা মুসলমানদের ওপর!)
এখানেই থেমে থাকেননি ইকবাল। তিনি আল্লাহর কাছে একরকম কৈফিয়ত তলব করেছিলেন এই বলে, মুসলমানরা যে তৌহিদের বাণী প্রচার করেছে, তা যেন তাদের ‘এহসান’ বা অনুগ্রহ ছিল। তিনি স্পর্ধা নিয়ে বলেছিলেন:
‘তুঝকো মালুম হ্যায় লেতা থা কোই নাম তেরা?
কুওত-এ-বাজু-এ-মুসলিম নে কিয়া কাম তেরা!’
(তুমি তো জানো, আমাদের আগে কেউ কি তোমার নাম নিত?
মুসলমানদের বাহুবলই তো তোমার কাজ [তৌহিদ প্রতিষ্ঠা] সম্পন্ন করেছে!)
প্রতিক্রিয়া ও ফতোয়া
ইকবালের এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আজকের বাংলাদেশের বাউলবিরোধীদের মতোই তৎকালীন আলেমরা ইকবালকে ‘কাফের’ বা অবিশ্বাসী ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ফতোয়া দেওয়া হয় যে, ইকবাল আল্লাহকে অপমান করেছেন, তাই তিনি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।
১৯১৩ সালে ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’ লেখেন আল্লামা ইকবাল। ছবি: গুডরিডস থেকে নেওয়াইকবালের এই পঙক্তিগুলো তৎকালীন আলেমদের কাছে মনে হয়েছিল চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ। একজন মাটির মানুষ হয়ে স্রষ্টাকে বলা, ‘আমরাই তো তোমার নাম টিকিয়ে রেখেছি’—এটাকে তারা সরাসরি কুফরি হিসেবে দেখেছিলেন। অথচ ইকবাল এই কথাগুলো বলেছিলেন সুফি দর্শনের ‘নাজ’ (প্রেমাস্পদের ওপর প্রেমিকের আবদার বা অভিমান) থেকে। ঠিক যেমন বাংলার বাউলরা গানে গানে আল্লাহকে ‘নিঠুর’, ‘পাষাণ’ বা ‘হিসাবি’ বলে সম্বোধন করেন। আবুল সরকারের পালাগানের প্রশ্নগুলোও সম্ভবত এই আধ্যাত্মিক তর্কেরই অংশ ছিল, যা লিটারেল বা আক্ষরিকবাদী মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু ইকবাল দমে যাননি। ১৯১৩ সালে তিনি এর উত্তর হিসেবে লেখেন ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’ (অভিযোগের উত্তর)। সেখানে তিনি আল্লাহর জবানিতে মুসলিমদের অধঃপতনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে, আল্লাহ অবিচার করেননি, বরং মুসলিমরাই তাদের ঐতিহ্য ও কর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাউল দর্শন ও অপব্যাখ্যার শিকার
আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতার ব্যাখ্যা দিয়ে মূলধারার কাছে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তিক বাউল শিল্পীরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। বাউল বা সুফি দর্শনে স্রষ্টাকে দেখা হয় ‘মনের মানুষ’ বা ‘প্রাণের বন্ধু’ হিসেবে। বন্ধুর সঙ্গে যেমন ঝগড়া করা যায়, অভিযোগ করা যায়, বাউলরাও গানে গানে তাই করেন। পালাগানে মূলত ‘শরিয়ত’ (ধর্মীয় বিধিবিধান) এবং ‘মারফত’ (আধ্যাত্মিকতা)-এর তর্ক হয়। এক পক্ষ প্রশ্ন ছোঁড়ে, অন্য পক্ষ উত্তর দেয়। আবুল সরকার হয়তো সেই তর্কের খাতিরেই কোনো প্রশ্ন বা ‘শিকওয়া’ পেশ করেছিলেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা এতটাই সংকুচিত করা হয়েছে যে, রূপক বা মেটাফোর বোঝার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে।
এর আগে ২০২০ সালে বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একই অভিযোগে মামলার শিকার হয়েছিলেন রিতা দেওয়ান। তাঁদের অপরাধ ছিল গানের মাধ্যমে ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নতা আনা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন মাজারে হামলার ঘটনা প্রমাণ করে যে, সহজিয়া বা উদার ধর্মীয় চর্চাকে সহ্য করা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতিতে একে ‘সাংস্কৃতিক নির্মূল’ বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ব্লাসফেমি আইন ও মব-সন্ত্রাস
বাংলাদেশে দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে কঠোর ‘ব্লাসফেমি আইন’ প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও এমন আইন পাস হয়নি, কিন্তু বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইন বা পুরনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অলিখিত ব্লাসফেমি আইন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো ‘মব জাস্টিস’। বাউল আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের পরে তাঁর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তাঁর ভক্তরা সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। পুলিশও অনেক ক্ষেত্রে ‘মব’ বা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার সহজ উপায় হিসেবে ভুক্তভোগীকেই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাচ্ছে।
আল্লামা ইকবালের ‘শিকওয়া’ আজ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ এবং ইসলামি জাগরণের কবিতা হিসেবে পঠিত হয়। অথচ একদিন এই কবিতার জন্যই তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আজ বাউল আবুল সরকার যে প্রশ্ন বা ‘স্পর্ধা’ দেখানোর জন্য কারাগারে, কে জানে হয়তো সেই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে গভীর কোনো আধ্যাত্মিক সত্য?
রাষ্ট্র ও সমাজ যদি প্রশ্নের পিঠে যুক্তি না দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয়, তবে তা কেবল একজন শিল্পীর কারাবাস নয়, তা চিন্তার মৃত্যু। বিশিষ্ট নাগরিকদের শঙ্কা অনুযায়ী, বাংলাদেশ যদি ভিন্নমতের জন্য কারাগার হয়ে ওঠে, তবে লালন, হাসন রাজা বা ইকবালের উত্তরাধিকার এই মাটিতে আর টিকবে না। আবুল সরকারের মুক্তি কেবল একজন ব্যক্তির মুক্তি নয়, এটি বাংলার সহজিয়া সুর ও দার্শনিক জিজ্ঞাসার মুক্তির প্রশ্ন।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক