বাউল শিল্পী মহারাজা আবুল সরকারকে সম্প্রতি ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ—তিনি আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। বাস্তবতা হলো, চার ঘণ্টার দীর্ঘ একটি পালাগান থেকে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ কেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই একই পালায় আবুল সরকার সৃষ্টিকর্তাকে অন্তত ৭০ বার ভক্তিভরে স্মরণ করেছেন। একজন শিল্পী যিনি সারাজীবন বাউলতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্বের গান গেয়ে স্রষ্টার সন্ধান করেছেন, তাঁকেই আজ কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে।
আবুল সরকারের এই গ্রেপ্তার কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির একটি ধারাবাহিকতা মাত্র। জুলাই অভ্যুত্থানের আগেও আমরা দেখেছি, যখনই ভিন্নমত, লোকজ সংস্কৃতি বা বাউল গানের প্রশ্ন সামনে আসে, তখনই সমাজের একটি অংশ ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর অভিযোগ তোলে। সম্প্রতি আবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লাসফেমি আইন চালুর দাবি জোরালো হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাউল আবুল সরকারের গ্রেপ্তার, ব্লাসফেমি আইনের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় উৎস এবং বর্তমান আইনি কাঠামো নিয়ে নির্মোহ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রেক্ষিতের ভিন্নতা ও ডিজিটাল ভুল বোঝাবুঝি
বাউল আবুল সরকারের ঘটনাটি মূলত ‘কনটেক্সট কলাপস’ বা প্রেক্ষিত বিচ্যুতির একটি উদাহরণ। বাউল বা সুফি দর্শনে ‘নিন্দা-স্তুতি’ বলে একটি গভীর তাত্ত্বিক বিষয় রয়েছে। এখানে ভক্ত তার প্রভুর সঙ্গে অভিমান করেন, ঝগড়া করেন, আবদার করেন। সাধারণ বা আক্ষরিক দৃষ্টিতে দেখলে এই অভিমান বা ঝগড়াকে ‘বেয়াদবি’ বা ধর্ম অবমাননা মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। যিনি বাউল দর্শনের এই রূপক ভাষা সম্পর্কে অবগত নন, ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও দেখে তার মনে আঘাত লাগাটাও বিচিত্র নয়।
কিন্তু সমস্যা হলো, বিচারের মানদণ্ড যখন এই ক্ষণস্থায়ী আবেগ দ্বারা নির্ধারিত হয়। লালন সাঁই থেকে শুরু করে শাহ আবদুল করিম—বাংলার বাউলরা যুগ যুগ ধরে এভাবেই গানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে খুঁজেছেন। আজকের ডিজিটাল যুগে ধৈর্য কমে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওতে এসে ঠেকেছে। সেখানে এই দীর্ঘ তাত্ত্বিক আলোচনা বোঝা কঠিন। একটি ৩০ সেকেন্ডের ক্লিপ দিয়ে চার ঘণ্টার পালার বিচার করা এবং তার ভিত্তিতে একজন প্রবীণ শিল্পীকে আইনি প্রক্রিয়ায় হেনস্তা করা—ডিজিটাল যুগের বড় সংকটের নমুনা। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া কেবল একটি জনগোষ্ঠীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ব্যবস্থা নেয়, তখন বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
ব্লাসফেমি আইনের উৎস: ফিকহ শাস্ত্র বনাম ঔপনিবেশিক আইন
ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার আইন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেকেই ধারণা করেন এটি কেবল ইসলামের বিধান। বিষয়টি আরেকটু গভীরভাবে দেখা প্রয়োজন। ইসলামি ফিকহ শাস্ত্রে আল্লাহ বা রাসুল (সা.)-এর অবমাননা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধানের উল্লেখ রয়েছে। ধ্রুপদী ইসলামি আইনশাস্ত্রে বা ক্লাসিক্যাল ফিকহ্-তে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এমন ক্ষেত্রে বিচারক (কাজি) সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে রায় দিতেন।
তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দণ্ডবিধিতে আমরা যে ‘ধর্ম অবমাননা’র আইন দেখি, তার কাঠামোটি অনেকাংশেই ঔপনিবেশিক। ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে আইন প্রণয়ন করে (যেমন দণ্ডবিধির ২৯৫-এ ধারা), তারা ফিকহ শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিচারিক প্রক্রিয়া বা তাত্ত্বিক গভীরতা থেকে আইনটিকে আলাদা করে ফেলে। তারা এমন একটি কাঠামো তৈরি করে যা মূলত ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি’ ঠেকানোর জন্য প্রণীত, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য নয়।
অন্যদিকে, ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক এবং এর চর্চা মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রবল ছিল। তখন রাজা ও চার্চের ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলাকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কথা বলা হিসেবে গণ্য করা হতো। গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসদের বিচার এই ব্লাসফেমির আলোকেই হয়েছিল। অর্থাৎ, বর্তমান সময়ে আমরা যে আইনের প্রয়োগ দেখি, তা একাধারে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ধারণা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনের একটি মিশ্রণ, যা অনেক সময় মূল ধর্মীয় শিক্ষার বালাই না রেখে কেবল ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় তাকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করার পরও তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন—এই উদাহরণগুলো আইনের কঠোর ধারায় প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে।
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন: ধর্মের নামে রাজনীতির হাতিয়ার
আমাদের দেশে একটি অংশ পাকিস্তানের আদলে কঠোর ব্লাসফেমি আইন চায়। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আমলে এমন আইন ছিল না। আশির দশকে স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক নিজের ক্ষমতার বৈধতা পেতে এবং রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করতে দণ্ডবিধিতে ২৯৫-খ এবং ২৯৫-গ ধারা যুক্ত করেন।
পাকিস্তানে এখন ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহার বা ‘অ্যাবিউজ’ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটি এখন ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। তিনটি কেস স্টাডি আলোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
১৯৯১ সালের গুল মসিহ কেস। পাঞ্জাবে গুল মসিহ নামে এক খ্রিস্টান এবং তার মুসলিম প্রতিবেশী সাজ্জাদ হোসেনের মধ্যে পানির কল মেরামত নিয়ে সাধারণ ঝগড়া হয়। পরে স্থানীয় ইমামের পরামর্শে সাজ্জাদ অভিযোগ করেন যে, ঝগড়ার সময় গুল মসিহ নবীকে কটূক্তি করেছেন। আদালতে কোনো সাক্ষী এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু বিচারক রায় দেন, ‘অভিযোগকারী সাজ্জাদ হোসেন একজন দাড়িওয়ালা যুবক এবং তাকে প্রকৃত মুসলমান বলে মনে হয়। তাই তার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।’ কেবল একজন ব্যক্তির চেহারার ওপর ভিত্তি করে গুল মসিহকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৯৩ সালের আনোয়ার ও মোহাম্মদ আলমের কেস। দুই বন্ধু—একজন মুসলিম, একজন খ্রিস্টান। ঝগড়ার একপর্যায়ে দুজনেই একে অপরের ধর্ম নিয়ে গালিগালাজ করেন। আদালতে মামলা উঠলে বিচারক অদ্ভুত এক রায় দেন। তিনি বলেন, ব্লাসফেমি আইন শুধু ইসলামের নবীকে কটূক্তি করলে কার্যকর হবে। অন্য ধর্মের যিশু বা ঈশ্বরকে গালি দিলে সেটা পাকিস্তানে অপরাধ নয়। এই রায় প্রমাণ করে, আইনটি কতটা বৈষম্যমূলক।
১৯৯৩ সালের আরশাদ জাভেদ কেস। সালমান রুশদির বইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে আরশাদ জাভেদ নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি উলঙ্গ হয়ে নাচতে শুরু করেন এবং প্রলাপ বকতে থাকেন। মেডিকেল রিপোর্টে তাকে ‘পাগল’ বা ক্লিনিক্যালি ইনসেইন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের আদালত রায় দেয়, ‘ব্লাসফেমি আইনের কোথাও লেখা নেই যে পাগল হলে ধর্ম অবমাননা করা জায়েজ।’ ফলে একজন মানসিক রোগীকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা: ডিএসএ থেকে সিএসএ এবং ভয়ের সংস্কৃতি
পাকিস্তান বা ইউরোপের উদাহরণ বাদ দিলেও বাংলাদেশের নিজস্ব প্রেক্ষাপটটি বিবেচনা করা জরুরি। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকেই ব্লাসফেমি আইনের দাবি উঠছিল। তবে বিগত সরকারগুলো কৌশলে ভিন্ন পথে হেঁটেছে। বিগত সরকার নিজেকে অসাম্প্রদায়িক দাবি করলেও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে ধর্ম অবমাননা সংক্রান্ত মামলাগুলোকে জামিন-অযোগ্য এবং কঠোর করে রেখেছিল।
ডিএসএ-এর ২৮ ও ২৯ ধারা ব্যবহার করে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর অভিযোগে অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।সম্প্রতি ডিএসএ বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার সেটিও বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে মামলার ধরণ খুব একটা পাল্টায়নি। এখনো দণ্ডবিধির ২৯৫-এ ধারা বা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার আদলে মামলা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও, ভিন্নমতের ওপর চাপ প্রয়োগের সংস্কৃতি রাতারাতি পরিবর্তন হয়নি।
বরং এখন দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী বা ‘প্রেসার গ্রুপ’ সরাসরি মাঠ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে থানা বা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এর ফলে প্রশাসন অনেক সময় আইনি প্রক্রিয়ার চেয়ে ‘মব’ বা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত রাখতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিগত সরকারের আমলে যেমন রাজনৈতিক ও ধর্মীয়—উভয় ধরনের ‘ব্লাসফেমি’র চর্চা ছিল (সরকার প্রধানের সমালোচনাকেও রাষ্ট্রদ্রোহের মতো দেখা হতো), বর্তমান সময়ে সেই রাজনৈতিক চাপ কমলেও সামাজিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার চাপ দৃশ্যমান।
সাংস্কৃতিক ও আইনি সংকট: উত্তরণের পথ কী?
বাউল আবুল সরকারের ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও আইনি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সমাজ যদি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার আগেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বা ‘সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল’-এর মাধ্যমে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলে, তবে তা রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা বাঞ্ছনীয়। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ধর্মকে অবমাননা করলে প্রচলিত আইনে তার সুষ্ঠু বিচার হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বাউল গান, লোকসংস্কৃতি বা তাত্ত্বিক আলোচনাকে যদি ঢালাওভাবে ‘ধর্ম অবমাননা’র কাতারে ফেলা হয়, তবে তা বাংলাদেশের হাজার বছরের সহনশীলতার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করবে।
আবুল সরকারের বিষয়টি কেবল একজন ব্যক্তির মুক্তি বা গ্রেপ্তারের বিষয় নয়। এটি আমাদের বাকস্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং আইনের শাসনের প্রশ্ন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ‘মব জাস্টিস’ বা গণউত্তেজনার কাছে নতি স্বীকার না করে, স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ধর্ম মানুষের আবেগের জায়গা, কিন্তু সেই আবেগকে পুঁজি করে কেউ যাতে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে না পারে এবং কোনো নিরপরাধ শিল্পী যাতে হয়রানির শিকার না হন—সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।
লেখক: গবেষক