leadT1ad

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কেন লিখলেন না

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ১৩
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবিটি জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গ্রন্থাগার থেকে নেওয়া

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সারা জীবনে প্রায় কিছুই লিখলেন না। শিক্ষকতা করলেন, দাবা খেললেন আর গল্প করে গেলেন। অথচ লেখার মতো অনেক কিছু তাঁর ছিল। তাঁর শেষ না করা পিএইচডি থিসিস দেখলে তাতে সন্দেহ থাকে না। কিন্তু তিনি আর কিছু লিখলেন না।

লেখা যে ঝামেলার কাজ, এই কথা না মানার কারণ নেই। জীবন এলোমেলো করে দেয়। কার্ল মার্ক্সের দিকে তাকানো যাক। একটা বই লিখবেন—ডাস ক্যাপিটাল। ১৮৪৬ সালের মধ্যেই এই কাজ শেষ হচ্ছে না কেন বলে সম্ভাব্য প্রকাশক আর বন্ধুরা তাগাদা দিচ্ছেন। সেই বছরই মার্ক্স প্রকাশককে লিখছেন, ‘লেখার বিষয় আর লেখার ধরণ পুরোপুরি আবার না দেখে ছাপার প্রশ্নই ওঠে না। ছয় মাস আগে যা লেখা হয়েছে, কোনো লেখকই তা ছয় মাস পরে অবিকল ছেপে দিতে পারেন না।’

বারো বছর পর মার্ক্স আবার অজুহাত দিচ্ছেন। তখনও লেখা শেষ হওয়ার ধারে-কাছেও যায়নি। কেন? কারণ, ‘লেখা খুব ধীরে এগোচ্ছে। বহু বছর ধরে একটা কিছু নিয়ে অধ্যয়ন করে যেই না মনে হয় যে বিষয়টা সামলে আনা গেছে, তখনই বিষয়টার নতুন সব মাত্রা বের হয়ে আসতে শুরু করে। তখন আরও সময় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।’

লেখার জন্য রাশিয়ার সমাজ নিয়ে কিছু জানা দরকার বলে মনে হলো। ইংরেজি বা জার্মান ভাষায় সেসব নিয়ে লেখার অভাব নেই। কিন্তু মার্ক্স শুরু করলেন রুশ ভাষা শেখা। পুরোদস্তুর সেই ভাষা শিখে মূল ভাষায় পড়া শুরু করলেন। মূল লেখা শিকেয় উঠল। ওদিকে এঙ্গেলস চিঠিতে রীতিমতো বকাঝকা শুরু করেছেন। বার বার পেছাতে পেছাতে আর প্রকাশক ধরে রাখা যাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট না হয়েই মার্ক্স ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ড ছাপতে পাঠান ১৮৬৯ সালে। ১৮৮৩ সালে মারা গেলেন। পরের দুই খন্ড খণ্ড খসড়া কাগজ ঘেঁটে ছাপার জন্য তৈরি করেন এঙ্গেলস।

মার্ক্স কি জানতেন না যে এমন অবস্থা হবে? সেই ২৬ বছর বয়সে অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপিতে মার্ক্স লিখছেন, ‘যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার, সেগুলো বিপুল আর বিচিত্র। এই কারণে সেগুলোকে একটি মাত্র কাজের মধ্যে সংকুচিত করা যেত কেবল পুরোপুরি এফোরিজম (সংক্ষিপ্ত বাণী) ধরনের লেখার মাধ্যমে। অথচ, এই ধরনের এফোরিজম স্টাইলে কোনো কিছু উপস্থাপন করা হলে, তা নিজ থেকেই ‘‘খেয়ালখুশি মাফিক পদ্ধতি’’ হওয়ার একটা ধারণা তৈরি করতো।’

মানে, মার্ক্স তাঁর কাজের বিশালত্ব নিয়ে খুব ভালোভাবে জানতেন শুরু থেকেই। তাঁর সামনে বিকল্পও ছিল। সারা জীবন ধরে অক্লান্ত খেটেও শেষ না করতে পারার বদলে, বিশাল বিষয় নিয়ে ছোট ছোট এফোরিজম, বাণীর আকারে লেখা শেষ করে ফেলা। তিনি তা করলেন না। কারণ এফোরিজম হচ্ছে ব্যাখ্যার খোলা পদ্ধতি। একে চাইলে যে কোনো দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। মার্ক্স সেই ট্র্যাজিক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জেনেবুঝেও, শেষ করতে পারবেন না জেনেও পর্যালোচনা করে লিখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সেই পথে গেলেন না। তিনিও সম্ভবত জেনেবুঝেই পর্যালোচনার দিকে না গিয়ে এফোরিজমের দিকে গেলেন। তাও লিখলেন না। গল্প করতে করতে বলে গেলেন।

এফোরিজম বা ছোট বাণীকে আপনি আজকের দিনের শক্তিশালী একটি টুইট বা ক্যাচফ্রেজ হিসেবে ভাবতে পারেন। যেমন, ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল।’ টাকা নিয়ে সারা জীবন ধরে গবেষণা করে যাওয়ার ঝামেলা নেই। কিন্তু চাইলেই এরকম বাণীকে নিয়ে বহু কিছু বলা যায়। ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধরনের লেখা পাঠক ও লেখকের কাছে খুবই লোভনীয়।

এই বাণীগুলো সরাসরি আঘাত করে। বিশাল ভূমিকা বা যুক্তির দরকার হয় না। এক লহমায় সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। লেখক দ্রুত সাড়া পান, আর পাঠক পান দ্রুত একটি ‘চমৎকার তো!’ অনুভূতি। এগুলো সহজে উদ্ধৃতিযোগ্য। ক্যাচফ্রেজের মতো। যেহেতু এগুলো ছোট এবং ছন্দময় হয়, তাই এগুলো মনে রাখা এবং শেয়ার করা খুব সহজ। ফলে লেখকের ভাবনা দ্রুত ছড়ায়।

এর মধ্যে ব্যাপক দার্শনিকতা থাকে। ধাপে ধাপে প্রমাণের চাপ ছাড়াই আপনি নৈতিকতা, জীবন বা রাজনীতি নিয়ে বড় বড় প্রশ্ন তুলতে পারেন। লেখক স্বপ্নদ্রষ্টা বা কবির মতো থাকতে পারেন।

এফোরিজম ধরনের বাক্যগুলো জ্ঞানকে এমনভাবে ধারণ করে, যা প্রাচ্যের শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে খুব খাপ খায়। প্রাচ্যের প্রাচীন জ্ঞান যেমন—বেদ, উপনিষদ, বা কনফুসিয়াসের বাণী—শুরুর দিকে লিখিত ছিল না, বরং গুরু-শিষ্যের মাধ্যমে মুখস্থ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হতো। এফোরিজমের সংক্ষিপ্ততা, ছন্দ এবং গভীরতা এটিকে মুখস্থ করা ও স্মরণ রাখার জন্য আদর্শ করে তোলে।

এগুলো ছোট সূত্রের মতো। প্রাচ্যের দর্শন গভীর সত্যকে অল্প কথায় প্রকাশ করতে চেয়েছে। এতে তা ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত থাকে। এফোরিজম পাঠক বা শ্রোতাকে একটি ‘বীজ-বাক্য’ দেয়। অন্তর্নিহিত অর্থ বের করার ভার শ্রোতার নিজের ওপর বর্তায়। প্রাচ্যের বহু জ্ঞানই ব্যক্তিগত উপলব্ধি বা জ্ঞানের ফল। এই উপলব্ধিকে সরাসরি এবং জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতে হয়। এর জন্য এফোরিজমের জুড়ি নেই।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রাচ্য মানসের মানুষ ছিলেন। তিনি এত কিছু না লিখে আপ্তবাক্যের ধরণ জানিয়ে গেছেন আকাঙ্ক্ষী শ্রোতার কাছে।

এত কিছু জেনেও কিছু না লেখার মধ্যে এক রকম নিস্কাম ভাব থাকে। গীতার দর্শনের মতো, ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’ তোমার যা করণীয়, তা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমার আছে। কিন্তু ফলাফলের ওপর তোমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

খুব কাছ থেকে দেখে আহমদ ছফারও তাই মনে হয়েছে। ছফা স্পষ্ট বলেছেন, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে বা প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মতো অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ ছফাকে অতোটা প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে একটা জিনিস ছফা উল্লেখ করেছেন। তা হলো অধ্যাপকের, ‘নিষ্কাম জ্ঞানচর্চা’।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

উনিশশো বাহাত্তর সাল থেকে শুরু করে উনিশশো চুরাশি সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় এক যুগ সময় আহমদ ছফা অন্তত সপ্তাহে একবার প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। শুনেছেন নানা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে।

শুধু আহমদ ছফা নন। অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে দেশের নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত মানুষদের একটা বড় অংশ অধ্যাপক রাজাকের সান্যিধ্যে এসেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক, আমলা, রাজনীতিবিদ বা উকিল।

বিশাল সব বিষয় নিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক বলে গেছেন এফোরিজমের ধরণে। সেই সব কথা ধাক্কা দেওয়ার মতো। এর পেছনে ব্যাপক অধ্যয়ন। কিন্তু তিনি একে বলে গেছেন বাণীর মতো করে। তাও কেরানীগঞ্জের ডায়ালেক্টে। সামান্য কিছু বাক্যে ইতিহাস ও সমাজের বিশাল সত্য ধরিয়ে দিতে চাইছেন। যেমন, ‘আপনেরা নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিকে গ্লোরিফাই করার জন্য যত কথাই বলেন না কেন, বেশি দূর নিয়া যাওন, আপনেগো সম্ভব অইব না। যখন সিপাহি বিদ্রোহ চলছিল আপনেগো তথাকথিত মহাপুরুষেরা কোন ভূমিকা পালন করেছিলেন, মনেমনে কমপেয়ার কইরা দেখলে নিজেই জবাব পাইয়া যাইবেন। আধুনিক বাংলা গদ্যের বিকাশই অইল নাইন্টিনথ সেঞ্চুরির সবচাইতে মূল্যবান অবদান।’

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে যারা চিনতেন, তারা প্রায় সবাই অনুযোগ করে গেছেন যে তিনি কেন লিখলেন না। কিছু না লেখার এই সিদ্ধান্ত তিনি সচেতনভাবেই নিয়েছেন। তবে প্রাচ্যের লোক হিসেবে দেখলে, তিনি তাঁর অনেক পূর্বসূরীদের মতো বলে যাওয়াকেই কাজ হিসেবে নিয়েছেন। আহমদ ছফার পর্যবেক্ষণেও সেই ইঙ্গিত রয়ে গেছে—‘যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভ্যুলুশনের বাংলা এবং অবন ঠাকুরের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, সেই মানুষের পক্ষে অন্য কোনো মামুলি বিষয়ে কাজ করা অসম্ভব ছিল।’ মামুলি কাজ করার লোক তিনি ছিলেন না। বড় লেখার কাজও তিনি শুরু করেননি। তিনি ফলের প্রতি নিস্পৃহ হলেন। তাঁর ‘নিষ্কাম জ্ঞানচর্চা’ তাঁকে মুক্তি দিল দীর্ঘ লেখার দায় থেকে। যে কাজ শেষ হবে না, তা শুরু করেননি। করলে তা হয়তো আরেক ট্র্যাজিক সিদ্ধান্ত হতো।

জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক

Ad 300x250

সম্পর্কিত