leadT1ad

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কেন প্রভাববিস্তারী চিন্তক

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৩
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

দুই মেরুর দুই বাসিন্দা—আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ; দুজনের মধ্যে প্রায়ই ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে যায়। পত্রিকায় সেসব বিবাদকাণ্ডের খবর আমরা পড়ি। নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ একদিন খেয়াল হলো দুজন বিস্ময়করভাবে একই গুরুর ‘শিষ্য’; গুরুর নাম আব্দুর রাজ্জাক। হুমায়ুন আজাদ রাজ্জাকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপ, আড্ডা আর স্মৃতি নিয়ে ছফা লিখেছেন আস্ত একটি বই। ছফা রাজ্জাকের এক প্রশ্নাতীত শিষ্য; অন্যদিকে, হুমায়ুন আজাদ প্রথাগত অর্থে শিষ্য না হলেও রাজ্জাকের প্রতিভার বিচ্ছুরণ মেনে নিতে কার্পণ্য বোধ করেননি।

অথচ সেই গুরুর কোনো বই নেই, নিবন্ধিত ডিগ্রি নেই, বুদ্ধি প্রদর্শনের দৃশ্যমান কোনো বাহাদুরি নেই। পত্রিকা কিংবা বইপুস্তকে ছাপা ছবিমোতাবেক চোখের সামনে গুটিকয়েক দৃশ্যই ভেসে ওঠে—একটা বুড়োমতো লোক, মগ্ন হয়ে বই পড়ছেন। অন্যদের স্মৃতির পাতা থেকে উঠে আসে আব্দুর রাজ্জাকের বসে বসে দাবা খেলার দৃশ্য—হয়তো গুড়গুড় করে হুঁকা টানছেন, ধোঁয়া ছাড়ছেন; হয়তো উঠে আসে তাঁর বাজারে যাওয়ার দৃশ্য অথবা আয়েশি ভঙ্গিতে খাদ্য উপভোগ করার দৃশ্য। তরুণ বয়সে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি—ময়লা চাদর আর লুঙ্গি পরা, খাঁটি ঢাকাইয়া জবানে কথাবলা লোকটি কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টারি’ করেছেন—যাঁর মধ্যে ‘মাস্টার’ বা প্রভুর ভাব ও ভাষা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন গুরুগম্ভীর; আচরণ হবে বরফ-শীতল—চণ্ডালের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা ব্রাহ্মণের মতো, কথা বলবেন সংস্কৃতঘেঁষা মান বাংলায়, আর অবশ্যই কথাগুলো বলবেন মেপে মেপে, চিবিয়ে চিবিয়ে, যেন আভিজাত্যের শৈলশিখর থেকে ভেসে আসছে গম্ভীর কোনো ফরমান। আব্দুর রাজ্জাক সেরকম কিছু করেন না। হিমতুষার শীতলতা নেই, তীক্ষ্ণ চোখ মেলে কথা বলেন, হাসেন শিশুদের মতো। হুমায়ুন আজাদের চিত্রল বর্ণনায় আমরা তাঁকে এভাবেই পাই। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই ‘যাচ্ছেতাইরকম’ মানুষটার কাছেই হাজির হন আজাতশশ্রূ তরুণ থেকে শুরু করে পক্বকেশ প্রবীণ। সত্তর দশকের তরুণ সলিমুল্লাহ খানরা যেমন আসেন, তেমন করেই আসেন চল্লিশের দশকের সরদার ফজলুল করিমেরা। রহস্য কোথায়?

জ্ঞান ও সংলাপময়তা

রহস্যের জট খুলতে গিয়ে শুরুতেই একটি জবাব পাই—তা হলো, রাজ্জাকের প্রাজ্ঞবচন; সোজা বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘আলাপ’; আরেকটু বাড়িয়ে আমরা বলব, ‘জ্ঞান ও সংলাপময়তা’; পুস্তকের নির্জীব অক্ষর থেকে নয়, জ্ঞান জন্মাবে কথায় কথায়, আলাপে আলাপে। আর আলাপের জন্য দরকার ‘আড্ডা’; কথা ছাড়া আড্ডা জমে না। কাউকে না কাউকে কথা বলতেই হবে, থাকতে হবে কথক ও শ্রোতা, সংলাপের ভেতর দিয়ে উচ্চারিত হবে চিন্তা ও ভাষা। আড্ডায় চলতে থাকবে ডিসকোর্সের নিরন্তর লড়াই। রাজ্জাক যেন ছড়িয়ে দেন সেই আবহ। এখানেই রাজ্জাক হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভূ। যে বই তিনি পড়েছেন সেই বইয়ের অক্ষর আর চিন্তাগুলোকেও তিনি জ্যান্ত করে তোলেন। রাজ্জাক শোনেন ও বলেন।

রাজ্জাক-শিষ্য সরদার ফজলুর করিম কিন্তু রাজ্জাকের আলাপচারিতার গুণটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; সরদার লিখেছেন, ‘লিখতে তাঁর ভয়ানক অনিচ্ছা। অথচ সুন্দর আকর্ষণীয় আলাপচারী মানুষ তিনি। তাঁর আলাপে সমাজজীবনের বিভিন্ন যুগ এবং দিক সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ এবং জ্ঞানের পরিচয় প্রকাশ পায়। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেও আমাদের মুগ্ধ করেছিল।’ মুগ্ধ হয়েছেন ষাটের দশকের তরুণতর কবি-লেখকেরা। ফজলুল করিমের অনেক অনেক পরের প্রজন্ম—যারা রাজ্জাককে প্রত্যক্ষ করেননি, এমনকি তারাও কল্পদৃষ্টি দিয়ে তাঁকে দেখেছেন, একইভাবে আকর্ষিত হয়েছেন।

গুরু-শিষ্য। আব্দুর রাজ্জাক ও আহমদ ছফা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
গুরু-শিষ্য। আব্দুর রাজ্জাক ও আহমদ ছফা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেও হয়তো চলতে পারত রাজ্জাকের সংলাপময়তার আসর। কিন্তু তিনি নিজের বইপুস্তকে ঠাসা ঘরটিকেই বেছে নিয়েছেন আলাপের জায়গা বলে। হয়তো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। হয়তো সহজ আদান-প্রদানের আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। গ্রিসের পণ্ডিতরা যেমন আড্ডা জমাতেন তরুণদের সঙ্গে। আড্ডা ও সংলাপের ভেতর দিয়ে ঠিক তেমন করেই রাজ্জাক ছড়িয়ে দিয়েছেন ভাবনার খাত। রাজ্জাকের আড্ডা যেন মনে করিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো যেখানে ব্যর্থ, আড্ডাগুলো সেখানে সফল। এইসব অনানুষ্ঠানিক আলাপের পরিসর থেকেই বেরিয়ে আসে চিন্তার খোরাক।

বলা বাহুল্য, রাজ্জাকের আড্ডাবাজি বাঙালির জীবনের গুজব ও কুৎসাকেন্দ্রিক আড্ডাবাজি নয়। রাজ্জাক কোনো অ্যাকাডেমি খোলেন নি, তাঁর কোনো লাইসিয়াম ছিল না। রাজ্জাকের দিকে তাকালে মনে হয় জীবন্ত মানুষের বয়ান ও বাচনের ভেতর দিয়ে জ্ঞান হয়ে উঠছে সুস্বাদু আর দৃশ্যময়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে রাজ্জাকের এই তৎপরতা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ব্যক্তির শক্তিমত্তাকে হাজির করে, দেখিয়ে দেয় বিদ্যায়তনের শূন্যগর্ভ অস্তিত্বকে।

বহুজনের স্মৃতিই সাক্ষ্য দেবে রাজ্জাকের সংস্পর্শে কীভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঢুকে পড়া যেত আলাপের আমেজে। সীমানা ভেঙে এক শাস্ত্র থেকে ঢুকে পড়া যেত অন্য শাস্ত্রে; সাহিত্য ও রাজানীতির মাঝ-বরাবর তোলা হতো না ইস্পাতকঠিন দেয়াল, বিজ্ঞান-ধর্ম আর দর্শনের গায়ে গা ঘেঁষে বসলে নষ্ট হতো না বিদ্যার জাত। বোঝাই যায়, আজকের অর্থে রাজ্জাকের আলাপগুলো ছিল ভীষণভাবে আন্তশাস্ত্র পরিভ্রমণের নজির। কিন্তু সে রকম গুরু-আশ্রয়ী আড্ডা কি আর আছে?

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ব্যর্থতা থেকে আড্ডা-জাতীয় অনানুষ্ঠানিক আসর গড়ে উঠুক—এমন তত্ত্ব-প্রতিষ্ঠা আমার লক্ষ্য নয়। কিংবা বিদ্যায়তনগুলোর ব্যর্থতার পাশে ‘আড্ডা’কে মহিমান্বিত করাই আমার ধ্রুব অভিপ্রায়, তাও নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, বিদ্যায়তনের আশপাশে কিংবা চত্বরে গড়ে ওঠা আড্ডার সাংস্কৃতিক মূল্য আছে। আড্ডাগুলো নানাসূত্র ও বিভঙ্গে অনেকের চিন্তায়ই গভীর তরঙ্গ তোলে। আর এই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বৌদ্ধিক ইতিহাসে আব্দুর রাজ্জাক হয়ে আছেন উজ্জ্বল স্মৃতি ও কিংবদন্তি।

কল্পনা করা যাক আহমদ ছফার কথা। মনের ভেতর শত রকমের বাসনা নিয়ে তিনি ঢাকা শহরে টইটই করে ঘুরছেন, দিনযাপন করেছেন। পড়ালেখা করবেন, গবেষণা করবেন। কিন্তু তাঁর ট্যাঁকের অবস্থা নিতান্তই শূন্য, আহার্যের উপায়ও ছন্নছাড়া। ছফার মগজভর্তি প্রতিভা তখন একটু যত্ন ও মায়া পেয়েছে রাজ্জাকের সান্নিধ্যে এসে। তাঁর সঙ্গে ছফাকে আমরা তর্ক করতে দেখেছি। কখনো কখনো দেখেছি চুপচাপ শুনে যেতে। ছফা তাঁর অভিজ্ঞতার মুহূর্তগুলোকে প্রাণবান করে তুলছেন তাঁর বইয়ে। ছফার রাজ্জাক নিশ্চয়ই একইসঙ্গে ‘ফিকশনালাইজড’ও। তবে সেই ফ্যাক্ট ও ফিকশন সত্য অথবা তথ্যচ্যুত হয়েছে বলে মনে হয় না। সরদার ফজলুল করিম, হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফার ভাষ্যে তাই খুব বেশি দূরত্ব চোখে পড়ে না।

ইতিহাসের বিচার

আলাপ ও আড্ডার ভেতর দিয়ে আব্দুর রাজ্জাক একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। আমরা তার নাম দিতে পারি ‘ইতিহাসের বিচার’। হ্যাঁ, আব্দুর রাজ্জাক হাজির করেছেন বাঙালি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পাঠ। এই বিচারে তাঁর সম্বল তিনটি—অভিজ্ঞতা, স্মৃতি আর বই। তাঁর সংস্পর্শে আলোড়িত হওয়া ব্যক্তিবর্গের সবাই স্বীকার করেছেন আব্দুর রাজ্জাক স্মৃতি থেকে বয়ান করে যেতেন। তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করেই সরদার ফজলুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে মূর্ত করে তুলেছেন।

আমাদের হাতে উঠে এসেছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ (১৯৯৩)। উপশিরোনামে লেখা ‘অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক-এর সঙ্গে আলাপচারিতা’ অংশটি আদতে প্রতীকীভাবে এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আর পূর্ববঙ্গীয় সমাজের মতো একটি বহুস্বরিক পরিসরকে বোঝার প্রয়াস রাখা হয়েছে একজন ব্যক্তির সঙ্গে অনুপুঙ্খ আলাপের মাধ্যমে।

যদিও সরদার তাঁর লেখা ও রাজ্জাকের বয়ানকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস’ বলে মনে করেননি। তবে এ কথা বলতে বাধ্যই হয়েছেন যে, ‘একজন ব্যক্তির জীবন তার সমগ্র ইতিহাস না হলেও, সে জীবন সেই কালের দেশ-সমাজ ও মানুষের ইতিহাসের উপাদান।’ সত্যি কথা হলো, ব্যক্তি শুধু উপাদান নয়, ইতিহাসের কর্তার ভূমিকায়ও সে আসন পাতে। তা যদি না-ই হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পূর্ববঙ্গে সমাজ বোঝার জন্য আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপের দরকার পড়ল কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ আছে এমন অন্য যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করলেই চলত, ব্যবহার করা যেত অন্য কারো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। তা না করে রাজ্জাকের স্মৃতিসূত্রে সরদার ফজলুল করিম পুনর্গঠিত করতে চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। কারণ রাজ্জাক ছিলেন প্রথম যুগের ছাত্র ও শিক্ষক। বহমান ঘটনার সক্রিয় সাক্ষী। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আব্দুর রাজ্জাক স্বয়ং ইতিহাসের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা—ইতিহাস-প্রক্রিয়ার ভেতর তিনি স্বয়ং বিদ্যমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ছাড়িয়ে আমরা যদি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের কথা ভাবি, দেখতে পাব, আব্দুর রাজ্জাক ইতিহাসের দারুণ এক ভাষ্যকারও। তাঁর স্মৃতিবিবরণ থেকে উঠে আসে বাংলা অঞ্চল ও বাঙালি নামক জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশের পরম্পরা। আধুনিক বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রাজ্জাক ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁ’কে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন। অথচ বঙ্গীয় রেনেসাঁর ধারণাকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেওয়াই ছিল তাঁর সময়কার ঐতিহাসিক গৎ। বাংলার প্রধান ইতিহাসকাররা যখন বঙ্গীয় রেনেসাঁর গদগদ ভাষ্য রচনা করেছেন রাজ্জাক শুনিয়েছেন উল্টো স্রোতের বয়ান।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

ছফার লেখা মারফত অন্তত দুইবার রাজ্জাকের কণ্ঠে বঙ্গীয় রেনেসাঁর সমালোচনা শুনি; একবার ইতিহাসের এক অধ্যাপককে বলেছেন, ‘আপনেরা নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিকে গ্লোরিফাই করার জন্য যত কথাই বলেন না কেন, বেশি দূর নিয়া যাওন, আপনেগো সম্ভব অইব না। যখন সিপাহি বিদ্রোহ চলছিল আপনেগো তথাকথিত মহাপুরুষেরা কোন ভূমিকা পালন করছিলেন, মনে মনে কমপেয়ার কইর‌্যা দেখলে নিজেই জবাব পাইয়া যাইবেন।’ ছফা জানাচ্ছেন, ‘ভদ্রলোক বেঙ্গল রেনেসাঁ যে এই অঞ্চলে বিরাট ঘটনা, প্রমাণ করার জন্য অনেক কথা বলেছিলেন।’ রাজ্জাক তখন সিপাহি বিদ্রোহের প্রসঙ্গ তুলে দাবিটিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। অন্য একবার রাজ্জাক ছফাকে বলেছেন, ‘যেই জিনিসটারে আপনেরা বেঙ্গল রেনেসাঁ কইবার লাগছেন, হেইডা মানতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আপনেরা রামমোহনরে রেনেসাঁর মানুষ কইবেন। কিন্তু হে কামডা কী করছে।’

রাজ্জাকের সংশয়াকুল এই প্রশ্ন চট করে প্রচলিত ও মান্য ইতিহাসের পাটাতনে ঘা মারে। যদুনাথ সরকারসহ জাতীয়তাবাদী ও মার্কসবাদী ইতিহাসকারদের বড় অংশই বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। সবাই মোটা দাগে উনিশ শতকের ইতিহাসকে বাঙালির সর্বব্যাপী জাগরণের ইতিহাস হিসেবে কল্পনা করেছেন। আর এই কল্পনার আলো জ্বেলে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মাপকাঠিতে উনিশ শতকের বাংলার সমাজ-রূপান্তরকে ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁ’ ভেবে যাপন ও উদযাপন করেছেন। অথচ রাজ্জাক সেই ১৯৫০ সালে উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন প্রস্তাব। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল করা পিএইচডি অভিসন্দর্ভে লিখেছেন, ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁর ইতিহাস আদতে বাঙালি হিন্দু-সমাজে আধুনিক ধ্যানধারণা প্রয়োগের ইতিহাস। সাহিত্যিক নথিপত্র থেকে যতটা বোঝা যায়, বিশেষত সৃষ্টিশীল সাহিত্যে প্রতিফলিত চিন্তার ইতিহাস থেকে, বাংলার অ-হিন্দু জনগণের জীবনে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।’

রাজ্জাকের এই সিদ্ধান্ত অভিসন্দর্ভ আকারে গৃহীত না হলেও ছফার সঙ্গে করা আলাপে ঘুরেফিরে রেনেসাঁ-প্রাসঙ্গ উঠে এসেছে। কিন্তু যা তিনি বিশ শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে বলেছেন, তার মর্মবীজ নিহিত ছিল ওই শতকেরই চল্লিশের দশকে। তিনি আসলে কড়া নাড়তে চেয়েছেন ইতিহাসের এক অনালোকিত কুঠুরিতে যেখানে বাঙালি মুসলমানের অর্জন ও বিসর্জনের গল্প চাপা পড়ে আছে। আর তাই আরেকটি নতুন প্রস্তাব তিনি তোলেন; তা এই, ‘উনিশ শতকের শুরুর দিকে যখন এমনকি বাংলা অঞ্চলেও মুসলমান-জাগরণের বিস্তার ঘটেছিল, বাংলার নব-প্রতিষ্ঠিত পত্র-পত্রিকায় সে সংবাদ কখনোই প্রবেশাধিকার পায়নি; বিকাশমান নতুন সাহিত্যেও এর কোনো ছায়া পড়েনি।’ রাজ্জাকের বিবৃতি বলছে, বাঙালি মুসলমানরা জেগে উঠেছিল, কিন্তু সেই বৃত্তান্তের খবর সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয় নি। প্রচলিত ইতিহাসে উনিশ শতকে মুসলমানের জাগরণের কোনো সূত্র দেখা যায় না। রাজ্জাকের প্রস্তাব তাই নিবিড় অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

ইতিহাসের বিচারসভায় বসে রাজ্জাক দেখালেন ‘দুই সমাজের দূরত্ব’ কত গভীরভাবে ব্যাপ্ত। অথচ ঐতিহাসিক অখ্যান নির্মাণ করতে গিয়ে দূরত্বের কার্য ও কারণকে বারবারই উপেক্ষা করা হয়েছে। উপনিবেশিত বাংলার সমাজ-রূপান্তরকে মহিমান্বিত করে তৈরি করা হয়েছিল ‘বঙ্গীর রেনেসাঁ’র মোড়ক। রাঙতা মোড়ানো এই মোড়কের ঝলমলে গল্পে অক্ষয় কীর্তির স্থান যাঁকে দেয়া হয়েছে—সেই রামমোহন রায় অনেক ইতিহাসকারের কাছেই ইউরোপের আদলে বাংলার জন্য এক অত্যাশ্চর্য ‘রেনেসাঁ ম্যান’। আব্দুর রাজ্জাক রামমোহনের এই ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কেননা উনিশ শতকের আগে রামমোহনের মতো ধর্মপ্রচার ভূভারতের আরও অনেকে করেছেন। বাংলা ভাষায় বই লেখার উদ্যোগকেই কেবল মান্য বলে স্মরণ করেন আব্দুর রাজ্জাক।

অন্যদিকে, বিদ্যাসাগরের ব্যাপারে রাজ্জাকের মন্তব্য বেশ দরদি, ‘এন্টায়ার নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিতে পুরুষ সিংহ ওই একজই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’সমস্যা কোথায়? রাজ্জাক জানাচ্ছেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন ‘সকলে তো নতুন কইর্যা রিভাইভিলিজমের বিকাশ ঘটাইছেন।’

বলা ভালো, রেনেসাঁ সংঘটিত হয়েছে কি হয় নি—রাজ্জাক এই প্রশ্ন তোলেন নি; বরং চিহ্নিত করেছেন ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁ’র ধারণাগত সমস্যাকে। জ্ঞানীয় বর্গ হিসেবে ‘রেনেসাঁ’সেখানে সমস্যায়িত বিষয় নয়; উনিশ শতকে মিশনারিদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ড, পত্রিকা ও বইপুস্তক মুদ্রণ-প্রকাশনায় নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়লেও এক অর্থে রাজ্জাক রেনেসাঁর স্বীকৃতিই দিয়েছেন; ‘ভারতের রাজনৈতিক দল’বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রারম্ভিক স্তরে ভাষা ও সাহিত্যের রূপ-নির্মাণে এ দলের ভূমিকা অমূল্য—এরা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল রেনেসাঁর দুয়ার খুলে দিয়ে।’

কিন্তু রাজ্জাকের চোখ আরও একটু গভীরে। তিনি মিশনারি তৎপরতার ভেতরে খুঁজে পেয়েছেন ‘সম্প্রদায়গত মনোভাব’ বৃদ্ধির উদ্যোগ, যা স্থানীয় মানুষের পরিচয় দানের রেওয়াজেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল। রাজ্জাকের পর্যবেক্ষণে হিন্দু, মুসলমান অথবা খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দেয়ার রীতি চালু করতে এদের ভূমিকা কম নয়। প্রমাণ হিসেবে ‘সমাচার দর্পণে’র পৃষ্ঠা খুলে রাজ্জাক দেখিয়েছেন ১৮৩১ সালে ওই পত্রিকায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাসূচক ‘যবন’ অভিধা দিয়ে বলা হয়েছিল ‘বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হলে দৃশ্যপট থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হবে, কারণ তারা কস্মিকালেও বাংলা লিখতে-পড়তে পারবে না।’

মূলত এখানেই নিহিত রাজ্জাকের ইতিহাসদৃষ্টির ভাবসূত্র। তিনি বাঙালির ইতিহাস পড়তে পড়তে বাঙালি মুসলমানের ‘পরিচয় রাজনীতি’ বা ‘আইডেনন্টিটি পলিটিক্সে’র ইতিহাসকেও পড়তে চান। হালকা চালে ইতিহাসের সমস্যাগুলোকে শনাক্ত করেন। প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বয়ানের খাদগুলো ভরে দিতে চান নিজের বক্তব্য দিয়ে। আর তাই, সবাই যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের গদ্য নিয়ে উৎফুল্ল রাজ্জাক তখন বাংলা গদ্যের সঙ্গে মুসলমানদের দূরবর্তীতার জন্য দায়ী করছেন পাদ্রিদের। সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে আলাপে বলেছেন, ‘বাঙালি মুসলমানকে বাংলা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য এদের দায়িত্ব কম নয়। পাদ্রিরা বলল, বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা।’এই আলাপেও রাজ্জাক ‘সমাচার দর্পণে’র সম্পাদকীয় ভাষ্যের প্রসঙ্গ টেনেছেন।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

ভাষা প্রসঙ্গে একটি অনুমান মাথাচাড়া দিচ্ছে—প্রমিত পরিসরে রাজ্জাকের ‘ঢাকাইয়া ভাষা’য় কথা বলার পেছনেও কি কাজ করছে ইতিহাসের বিচার? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উনিশ শতকে বাঙালির মুসলমানের বাংলাকে যেমন ব্যঙ্গের শিকার হতে হয়েছিল তেমন ব্যঙ্গের তির এসে পড়ত পূর্ববঙ্গের ভাষার শরীরেও। রাজ্জাক তা ভালোভাবেই জানতেন। আর সে কারণেই সাধারণ মানুষের ভাষার প্রতি ছিল তার দরদ। তাহলে কি আমরা এমন একটি ভাবনার দিকে যাবো যে, ভদ্রমহলের মান ও মার্জিত বাংলার বিপরীতে ‘ঢাকাইয়া’ জবান ছিল রাজ্জাকের ভাষাকেন্দ্রিক পরিচয় রাজনীতির একাচ অন্তর্ঘাতমূলক স্বর—যে স্বর নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয় প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আকারে নয়, ‘বড়লোকের ড্রইং রুমে বসে থাকা গরিব আত্মীয়ের মতো’ উটকো সমস্যা আকারে—যাকে উপেক্ষা করা যায় না, আবার অস্বীকারও করা যায় না। কারণ, লোকটা তো চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলে, মোটা মোটা ইংরেজি বইও পড়ে। রাজ্জাক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর—এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে।’

ইতিহাসের দিগন্তে চোখ মেলে রাজ্জাক বিশেষভাবে ভাষা, বাংলা গদ্য আর শিক্ষার মতো উপাদানগুলোকে বারবার বুঝতে চান। মূলত ইতিহাসের সুলুকসন্ধানে নেমে উপরিকাঠামোর সিঁড়ি বেয়ে রাজ্জাক উঠে যেতে চান রাষ্ট্রনৈতিক কোঠায়। আর সেখানেই দেখা যায় তাঁর রাষ্ট্রবাসনার প্রতিচ্ছবি।

নতুন রাষ্ট্রবাসনা

প্রকৃতপক্ষে রাজ্জাকের চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ দিক তাঁর ‘রাষ্ট্রবাসনা’। সংশয়হীনভাবে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, আবার দ্বিধাহীনভাবে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক উত্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন। রাজ্জাকের পাকিস্তানবাদিতা ও মুসলিম লীগ সমর্থন নিয়ে ছফা ক্ষুব্ধ হলে তিনি বলেছেন, ‘আমি ত পাকিস্তান চাইছিলাম হেই কথাডা বলতে দোষ কী।’ দোষ নেই। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান চান নি, পূর্ববাংলায় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।

কিন্তু রাজ্জাকের কথা এখানেই ফুরালো না। তিনি আলোচনার ধারাকে প্রবাহিত করলেন সোশ্যাল ডিসকোর্সের দিকে। বেছে নিতে বললেন বাংলা উপন্যাস, দেখতে বললেন, কয়টি মুসলমান নাম আছে ওই উপন্যাসগুলোতে। রাজ্জাক মোক্ষম কথাটি তুললেন, ‘উপন্যাসে যেসব মুসলমান নাম স্থান পাইছে তার সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্টের বেশি অইব না। অথচ বেঙ্গলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি। এই কারণেই আমি পাকিস্তানের দাবির প্রতি সমর্থন জানাইছিলাম।’

রাজ্জাকের যুক্তি ও তাত্ত্বিক অবস্থান শোনা গেলো একটু পরেই। ছফাকে বললেন, ‘আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, উপন্যাস অইল গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স।’ উপন্যাসকে সোশ্যাল ডিসকোর্স বা ‘সামাজিক বাহাস’ হিসেবে পাঠ করার এই প্রবণতাটি যখন বাংলাদেশে গড়ে ওঠে নি, রাজ্জাক যখন সেই চিন্তাকে কাজে লাগাচ্ছেন রাষ্ট্রবাসনার ব্যাখ্যায়। আসলে বাংলা উপন্যাস যেভাবে জাতি, জাতীয়তা, সমাজ ও রাষ্ট্রের গড়নকে তুলে ধরছিল তাতে মুসলমান নামক জনগোষ্ঠীর অনুপস্থিতি ছিল। যদিও তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু বাংলা উপন্যাসে বাঙালির জনগোষ্ঠীর বড়ো অংশের এই ‘বিদ্যমানতা’কে শূন্য করে দেয়া হয়েছে। রাজ্জাক উপন্যাসকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়েছেন মাত্র। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের মতো হাল আমলের গবেষকেরা কিন্তু দেখিয়েছেন উপন্যাস কীভাবে জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিকভাবে ‘কল্পিত জনগোষ্ঠী’ বা ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটি’ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। ওই রকম একটি কল্পিত সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে রাজ্জাক দেখেন, ওখানে মুসলমান নেই। তাহলে আমরা বলত পারি, রাজ্জাকের রাষ্ট্রবাসনার মর্মমূলে ছিল উপেক্ষিতের দহন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই দহনচিহ্ন পরতে পরতে মিশেছিল।

আমরা হয়তো বলতেই পারি, লেখকদের ঐতিহাসিক অবচেতনা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল মুসলমানের অস্তিত্ব। রাজ্জাক দেখাচ্ছেন মুসলামানের নাম-নিশানা না-থাকাটা কোনো ভুলোমনের ব্যাপার নয়। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দু লেখকেরা উপন্যাস লেখার সময় ডেলিবারেটলি মুসলমান সমাজরে ইগনোর কইরা গেছে।... তারা বাংলার বায়ু, বাংলার জল এই সব কথা ভালা কইর্যাই কইয়া গেছে। কিন্তু মুসলমান সমাজের রাইটফুল রিপ্রেজেন্টেশনের কথা যখন উঠছে সকলে এক্কেরে চুপ। মুসলমান সমাজরে সংস্কৃতির অধিকার থাইক্যা বঞ্চিত করার এই যে একটা স্টাবর্ন অ্যটিটিউড হেই সময়ে তার রেমেডির অন্য কোনো পন্থা আছিল না।’

আর তাই, সমাধান হলো ‘পাকিস্তান’। রাজ্জাকের কাছে পাকিস্তানের ভিন্ন অর্থ ছিল। হুমায়ুন আজাদ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পাকিস্তান বলতেই এখন আমরা ইসলামি পাকিস্তান বুঝি। আপনারাও কি ইসলামি পাকিস্তান চেয়েছিলেন?’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘মোটেই না। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পরবর্তী ঘটনা।’ আরও সুনিশ্চিত করতে রাজ্জাক আবারও বললেন, ‘পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পাকিস্তান হওয়ার পরের ঘটনা।’

বাংলাদেশ তাহলে কোন বাসনার অংশ? এই প্রশ্নের জবাব মিলবে আব্দুর রাজ্জাকের ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায়, যা ‘বাংলাদেশে: স্টেট অব দ্য নেশন’ (১৯৮১) নামে প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যায়, এই বাসনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোতে। ভাষা আন্দোলন দিয়ে যার অঙ্কুরোদগম আর বাংলাদেশের মাধ্যমে যার পরিপূর্ণ বৃক্ষদশা। রাজ্জাক বলেছেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছিল ও আছে এক জাতি হওয়ার জেদ। এই জনগোষ্ঠী ভারতীয় জাতি কিংবা পাকিস্তানি জাতির মধ্যে শেষ পর্যন্ত কোনোটিকেই বেছে না নিয়ে অনুভব করেছে ‘আলাদা জাতি’ হয়ে ওঠার বোধ।

ওই বক্তৃতায় রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ একটা জাতি, কারণ তারা একটা জাতি হতে চায়, অন্য কিছু নয়। জাতি হিসেবে মৃত বা জীবন্ত ঐতিহ্যের যা তাকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করেছে, তার কোনো তালিকা এই জাতিসত্তাকে ব্যাখ্যা করতে বা অস্বীকৃতি দিতে পারে না। এই জাতিকে তৈরী করেছে তার অনমনীয় গর্ব, সুখে-দুঃখে আট-কোটি মানুষের সঙ্গে একই পরিচয় বহন করা, অন্য কিছু নয়। শুধু বাঙ্গালী হতে চাওয়ার জেদ।’ এখানে এসে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলা যায়, কোন বাঙালি হওয়ার জেদ? যে বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে এই নতুন দেশের ‘জেদি’ বাঙালির ফারাক কোথায়? বাংলাদেশের অপরাপর ভাষা, সংস্কৃতি, জাতির বাসনাও কি বাঙালি হওয়ার ‘জেদ’কেই আঁকড়ে ধরবে?

রাজ্জাকের বক্তৃতায় সব প্রশ্নের জবাব মেলে না। কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, বাংলাদেশের মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে তিনি ভেবেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের ছকে। একসময় এই জনগোষ্ঠী পাকিস্তান চেয়েছে, ইতিহাসের অন্য সময়ে বাংলাদেশ শুধু চায় নি, বাংলাদেশ গঠনও করেছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে সমরূপতা ও ‘স্বতন্ত্র পরিচয় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের অদম্য ইচ্ছা’র কথা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইচ্ছাই কি সব? পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বাস্তবতা কি তৈরি হয় নি? এইসব প্রশ্নের ব্যাখ্যার দিকে না গিয়ে রাজ্জাক রাষ্ট্র গঠনের পেছনের কারণকে ‘জাতিগত সমস্যা’ হিসেবে বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে ‘জাতীয় রাষ্ট্রের যুগে’ গড়ে ওঠা ‘জাতিগত সমস্যা’র সমাধান।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রগঠনের কথা বলতে গিয়ে রাজ্জাক দ্বিধাহীনভাবে উচ্চরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর নাম। আবার বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতার শনাক্তিতেও রাজ্জাক অটল; ছফার সাক্ষ্যে শোনা যায়, ‘ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটস্ ম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’ কারণও স্পষ্ট¬—বিরোধী দলের প্রতি নির্দয় উপেক্ষা। রাজ্জাক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনের হাতে ত অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন?’ বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, ‘আগামী ইলেকশনে অপজিশান পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সিট পাইব না।’ আব্দুর রাজ্জাক আহত হয়েছিলেন। জওহরলাল নেহরুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ‘আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়া দেবেন না?’ নিরুত্তর বঙ্গবন্ধু শুধু হেসেছিলেন।

প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজ্জাক কেন বিরোধী দল নিয়ে চিন্তিত? কেননা তাঁরা রাষ্ট্রবাসনায় অপজিশনের উপস্থিতি ও অবস্থান জরুরি। জাতি বা রাষ্ট্র গঠনের জন্যই বিরোধী ও সমালোচক শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কোন ধরনের রাষ্ট্র চেয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক? একটি উদার, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত ও সেক্যুলার জাতিরাষ্ট্রই তাঁর বাসনার অংশ। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আলাপে রাজ্জাক স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আর্থনীতিক অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ংকার।’ যদিও অন্য ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতির সহাবস্থানের বিষয়গুলো তাঁর বক্তব্য ও লেখায় অনুল্লেখিতই রয়ে গেছে। স্বীকার করতে হবে, রাজ্জাকের চিন্তায় তা বেশ বড় ধরনের সমস্যা।

তবু আব্দুর রাজ্জাককে আমরা যতটুকু পেয়েছি, তাতে করে বুঝতে পারি, পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমানের আধুনিকায়নের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তিনি। এই জনগোষ্ঠী লড়াই করতে পারে, নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার আকুতি প্রকাশ করতে পারে। ‘বাঙাল’ অভিধাপ্রাপ্ত এই জনগোষ্ঠী যুক্তি-তর্ক দিয়ে চিন্তাও করতে পারে। রাজ্জাক রপ্ত করেছিলেন চিন্তা করার ভাষা, আর তা তিনি ছড়িয়েও দিতে পেরেছিলেন। রাজ্জাক আয়োজন করে তেমন কিছু লেখেন নি, তাতে কী। আমাদের ইতিহাসচেতনায় তিনি আছেন মৌখিকতা ও কথ্য-ইতিহাস নির্মাণের প্রতীক হিসেবে। লেখা আর কথার বিবাদ যেদিন আমরা সত্যিসত্যিই ঘুচাতে পারব সেদিন সম্ভবত আরও বেশি করে আমরা বুঝতে পারব রাজ্জাকের বয়ানের মর্মার্থ, সেদিন হয়তো এই অভিযোগও তুলব না তিনি কতটুকু লিখেছেন!

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত