শীত আসি আসি করছে। এমন দুপুরের নরম রোদ আর হালকা বাতাস যেন দীর্ঘ পাঠযাত্রার ডাক দিচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে যাত্রা শুরু করা গেল জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গ্রন্থাগারের দিকে। এই গ্রন্থাগারের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার এক অনন্য সত্তা।
১৯৯৯ সালে প্রয়াত হন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। মৃত্যুর পর তাঁর ভাতিজা বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুর হাতে আসে তাঁর বইগুলো। প্রায় ছয় হাজার বই কীভাবে মানুষের কাজে লাগতে পারে, সেই উপায় খুঁজতে গিয়ে গঠন করা হয় জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন। আর এই ফাউন্ডেশনের অধীনেই ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে ‘আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ’ গ্রন্থাগার।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে বেঙ্গল শিল্পালয়ের ষষ্ঠ তলায় (লেভেল-৬) ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গ্রন্থাগার’। এখানে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগ্রহী পাঠক, শিক্ষার্থী, গবেষক বা শিক্ষক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গ্রন্থাগারের সদস্য হতে পারবেন। সদস্যপদ গ্রহণের জন্য কোনো ফি লাগে না। কিছু কাগজপত্র জমা দিয়ে সদস্য হওয়া যায়। আর শুধু সদস্যরাই গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারেন।
এখানে বর্তমানে সদস্য কতজন, তা জিজ্ঞেস করি জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রাজিয়া সুলতানাকে। তিনি স্ট্রিমকে জানান, আগে ১ হাজার ৫০০ জন সদস্য ছিলেন। এখন ১ হাজার ৩৫ জনের মতো আছেন।
‘কমে গেল কেন’—এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘কিছু নতুন নিয়মকানুন করা হয়েছে, সে জন্যই। এ ছাড়া এখানে কোনো ভিজিটর অ্যালাউড (দর্শনার্থী প্রবেশের অনুমতি) না। আমরা আসলে চাই, এখানে যাঁরা সিরিয়াস কাজ করতে চান, তাঁরাই আসুন। সে জন্য এ ব্যবস্থা।’
পোকায় কাটছে দুর্লভ বই
বিশেষ সংগ্রহের ঘরে আছে প্রায় ১৬ হাজার বই। বইগুলোর বেশির ভাগই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সংগ্রহের। তবে এখানে আরেকজন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বইও আছে।
নানা ধরনের বই আছে এখানে। বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন ও বিশ্বচিন্তা নিয়ে বিপুল বইয়ের ভান্ডার। এখানে দেখা পাওয়া যায় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে একাধিক বিরল সংস্করণের বই। বাংলাদেশি ও বিদেশি ম্যাগাজিনও আছে এখানে।
পোকায় কাটছে অনেক বই। কিছু বইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। একটু ধরলেই সেগুলো ছিঁড়ে যাবে—এমন অবস্থা। স্ট্রিম ছবিপেছনের দিকে দেখা গেল, কিছু বইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। একটু ধরলেই সেগুলো ছিঁড়ে যাবে—এমন অবস্থা। প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বই আছে এমন। এগুলো যদি বাঁধাই না করা হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বইগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। অনেক বই পোকায় খেয়ে ফেলছে। সেগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এসব বই যদি গ্রন্থাগারে থাকে, তাহলে অন্য বইগুলোতেও ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করি রাজিয়া সুলতানাকে। তিনি বলেন, ‘বইগুলো দ্রুতই আমরা বাঁধাই করব।’
‘কবে করবেন’—জিজ্ঞেস করি তাঁকে। উত্তরে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব।’ এছাড়া সংগ্রহশালায় ১০৮টি ক্রেস্ট রয়েছে। ক্রেস্টগুলো সবই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের।
ডিজিটাল রিসোর্স ও আধুনিক সুবিধা
গ্রন্থাগারের আরেকটি শক্তি তার ডিজিটাল অংশ। কম্পিউটার কর্নারে আছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, অনলাইন জার্নাল এক্সেস ও ই-বুক সংগ্রহ—যা গবেষকদের অনেক ঝামেলা কমিয়ে দেয়। বইয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল রিসোর্সের এই সংযোগ গ্রন্থাগারটিকে আধুনিক ও সময়োপযোগী করেছে।
এই গ্রন্থাগারের বইগুলো নিয়েও জানতে পারবেন পাঠকেরা। এখানে ‘কোহা’ ও ‘ডি–স্পেস’ নামে দুটি সফটওয়্যার আছে। এগুলো ব্যবহার করে চাইলে সব বই সম্পর্কে জানতে পারবেন সবাই।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অনেক বইও আছে এখানে। স্ট্রিম ছবি
হচ্ছে না কোনো গবেষণা
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের অধীনে এই গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের উদ্যোগে আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা হচ্ছে কি না, প্রশ্ন করা হয়েছিল জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রাজিয়া সুলতানাকে। উত্তরে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘না। রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে এই ফাউন্ডেশন থেকে কোনো গবেষণা হচ্ছে না।’
তবে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান—লেকচার সিরিজ, বইয়ের আলোচনা, অপ্রকাশিত পিএইচডি থিসিস নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে থাকেন।
আর্টিস্টদের জন্য আলাদা জায়গা
আর্টিস্ট বা শিল্পীদের জন্য আলাদা বইয়ের তাক রাখা থাকবে ভবিষ্যতে। সেখানে আর্ট বা শিল্পকলা সম্পর্কিত বই থাকবে। যেকোনো আর্টিস্ট চাইলে এখানে এসে বইগুলো পড়তে পারবেন বা চাইলে গবেষণাও করতে পারবেন বলে জানালেন রাজিয়া সুলতানা।
যেভাবে সদস্য হবেন
গ্রন্থাগারে যে কেউ চাইলে সদস্য হতে পারবেন। তবে তাঁর বয়স কমপক্ষে ১৮ হতে হবে। গ্রন্থাগারের সদস্য হতে হলে কিছু কাগজ জমা দিতে হবে কর্তৃপক্ষের কাছে। সেগুলো হচ্ছে—জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের ফটোকপি, দুই কপি ছবি (একটি পাসপোর্ট ও একটি স্ট্যাম্প সাইজ)। আগ্রহের বিষয় উল্লেখ করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা এবং সাধারণ পাঠক হলে রেফারেন্স হিসেবে একজন শিক্ষকের নাম ও মুঠোফোন নম্বর দিতে হবে।
বিশেষ সংগ্রহের ঘরে আছে প্রায় ১৬ হাজার বই রয়েছে। স্ট্রিম ছবিএসব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর যদি গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকে, তাহলে তিন কর্মদিবসের মধ্যে আপনাকে জানানো হবে। সব তথ্য সন্তোষজনক হলে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে আপনাকে গ্রন্থাগারের সদস্যপদ দেওয়া হবে। সদস্য-পরিচয়পত্র গ্রন্থাগারে এসেই সংগ্রহ করতে হবে।
গ্রন্থাগারের ভেতরে অবস্থানের নিয়ম
গ্রন্থাগারের ভেতরে অবস্থানেরও কিছু নিয়মকানুন আছে। সেগুলো সদস্যরা মানতে বাধ্য থাকবেন বলে জানিয়েছেন রাজিয়া সুলতানা। নিয়মকানুন না মানলে সদস্যপদ বাতিলও হতে পারে।
নিয়মের মধ্যে আছে—গ্রন্থাগার সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে খোলা থাকবে। শুক্র-শনিবার ও সরকারি ছুটির দিনে গ্রন্থাগার বন্ধ থাকবে। দৈনিক ১০ জন সদস্য একসঙ্গে এখানে পড়তে পারবেন। সদস্যরা আগে এলে আগে সিট পাবেন। একনাগাড়ে ৩০ মিনিটের বেশি সময় আসন ত্যাগ করলে সেখানে অন্য কেউ আসন গ্রহণ করতে পারেন ইত্যাদি।