leadT1ad

প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক ও পরিবর্তনশীল সময়ের বুদ্ধিজীবীতা

সাঈদ ইসলাম
সাঈদ ইসলাম

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৩
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। স্ট্রিম গ্রাফিক

বিদ্রোহের দামামা নিয়ে যে বছর পৃথিবীতে এসেছিলেন কবি নজরুল, ঠিক সে বছরই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন আজন্ম জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। এই প্রজন্মের পাঠকের কাছে রাজ্জাক স্যারকে ঠিক কোন পরিচয়ে তুলে ধরাটা উচিত হবে তা নিয়ে আমি নিজেই কিছুটা সন্দিহান! শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, আড্ডারু না গুরুদের গুরু? সব পরিচয়ই তাঁর জন্য উপযুক্ত।

শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের চেয়ে আড্ডার টেবিলে রাজ্জাক স্যারের সান্নিধ্য পাওয়া মানুষদেরই বেশি সৌভাগ্যবান বলতে হবে। আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, সলিমুল্লাহ খান ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছেন সে সময়ের ঢাকাকেন্দ্রিক প্রায় সব লেখক ও চিন্তকদের নাম। অধ্যাপক রাজ্জাকের জীবন ছিল সরলতায় ভরপুর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় তাঁর ময়লা জামা ছাড়া সংগ্রহে আর কিছুই না থাকার গল্প এখনো আমাদের আনন্দ দেয়।

প্রফেসর রাজ্জাক ১৯৩৬ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন, কলকাতার মেয়র শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তখন পরবর্তী নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য ইশতেহার লেখায় বেশ মনোযোগী। ইতোমধ্যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে সমস্ত বাঙালিদের নিয়ে পৃথক এক শাসনব্যবস্থার বয়ান মাঠে ময়দানে বিলি করতে শুরু করেছেন হক সাহেব। সে সময় লন্ডন ফেরত রাজ্জাকের ক্লাসরুমের লেকচারগুলো কেবল অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ধীরে ধীরে ইংরেজবিরোধী মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠা তরুণ ও চিন্তকদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষার আধিপত্যবাদ এবং জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে নানামুখী নতুন চিন্তার জন্ম দেন তিনি। বহু বিষয়ে জ্ঞানের আধার রাজ্জাক ক্রমেই হয়ে উঠতে থাকেন ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান। নারী-পুরুষ, তরুণ-প্রাজ্ঞ সব মহলেই তাঁর পরিচিতি বিস্তৃত হতে থাকে ‘জ্ঞানতাপস’ নামে।

প্লেটোর রিপাবলিক ছাড়া সক্রেটিসকে যেমন তাঁর রচনাবলী থেকে আবিষ্কার করা শ্রমসাধ্য, রাজ্জাকের শিষ্যদের লেখাযোখা বা আলাপচারিতা ছাড়াও রাজ্জাককে আবিষ্কার করা তেমনি দুষ্কর। বিচ্ছিন্নভাবে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপিয়েছেন বটে, তবে আলাপচারিতাতেই ছিল তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। রাজ্জাকের জীবনেও প্রভাব ছিল তাঁর গুরু, পিএইচডি থিসিসের দায়িত্বে থাকা প্রফেসর হ্যারল্ড লাস্কির। ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান হ্যারল্ড লাস্কি পেশাদার রাজনীতিবিদ হলেও ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত তাত্ত্বিক। লাস্কির কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামো, চিন্তাধারা নিয়ে গবেষণায় নেমেছিলেন প্রফেসর রাজ্জাক। দুর্ভাগ্যবশত লাস্কির মৃত্যুতে সেই গবেষণাকর্ম শেষ করতে পারেননি তিনি।

দীর্ঘ চল্লিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবন রাজ্জাককে দিয়েছিল অপার সরলতা ও সক্রেটিক আইরনি। ইউরোপ ও এশিয়ার পৃথক বাস্তবতাকে মোহহীন রুপে তিনি আলাদা করতে পেরেছিলেন

ইতোমধ্যে ভারতবর্ষ উপনিবেশিক শাসনের খোলস ছেড়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র দেশের জন্ম দিয়েছে। তবে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অসহযোগিতায় গণতান্ত্রিক পরিবেশের উত্তরণ ঘটেনি। প্রফেসর রাজ্জাক তাঁর গবেষণায় এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি চর্চার চেয়ে আন্দোলন কেন্দ্রীকতাকে প্রধান লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ইংরেজমুক্ত দেশ পাবার পরেও সে বাস্তবতা কাটেনি। পরিণত রাজ্জাক ধীরে ধীরে বাঙালি মুসলমানের মনকে আত্মস্থ করতে শুরু করলেন। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন চেতনার ভেতর ভাষাগত স্বতন্ত্রবোধ ও মুসলমান হিসেবেও এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বকীয়তা টের পেলেন। খুব সম্ভবত এই দুই চিন্তার যুথবদ্ধ আউটপুটই ‘বাঙালি মুসলমান’ টার্মিনোলজির সূতিকাগার। বিজ্ঞজনেরা রাজ্জাকের চিন্তার সরাসরি প্রভাব ছয় দফাতেও খুঁজে পান।

আজকের দিনে অধ্যাপক রাজ্জাক আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক কি না, এই প্রশ্ন অতীব জরুরী। প্রথমত, জাতিগত জ্ঞানচর্চা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে কিছু নাম অবশ্যই বারবার ফিরে আসবে। সে তালিকায় প্রফেসর রাজ্জাকের আজন্ম জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিত্বের ছাপ পরবর্তী প্রজন্মের লেখক, চিন্তাবিদ এমনকি নতুন পাঠকদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার দায় রয়েছে আমাদের। ৪৭ পরবর্তী ট্রানজিশন পিরিয়ড এবং ৭১ পরবর্তী ভাঙা-গড়ার সময়ের সঙ্গে চব্বিশ পরবর্তী সময়ে লেখক এবং সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে রাজ্জাকের চিন্তার ডটগুলোকে কানেক্ট করাটও সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

‘জীবন মানেই বিসিএস’ চিন্তার কাঠামো ভেঙে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকে ফিরতে হলে রাজ্জাকের মৌলিক চিন্তা আজকের দিনেও সমভাবে কার্যকর। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জনবান্ধব ও প্রকৃত রাজনীতি করার পাটাতন আজও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিবারই আমাদের শুরু করতে হয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাটিতে রক্ত ঢেলে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবন রাজ্জাককে দিয়েছিল অপার সরলতা ও সক্রেটিক আইরনি। ইউরোপ ও এশিয়ার পৃথক বাস্তবতাকে মোহহীন রুপে তিনি আলাদা করতে পেরেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে আঞ্চলিক ভাষায় অভ্যস্ত রাজ্জাক বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ইংরেজ প্রভাবের যে তাত্ত্বিক ব্যখ্যা প্রদান করেন, তা প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষার যাত্রা ভঙ্গের কালপঞ্জি।

দ্বিতীয়ত, অগ্রসর সমাজ তার বুদ্ধিজীবীদের নিয়েই অগ্রসর হয়। কখনো কখনো চিন্তাবিদেরা তার সমাজ ও দুনিয়াকে শত বছর এগিয়ে দিয়ে যান। আমাদের আশা ছিল রাজ্জাক-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতা নতুনভাবে বিকশিত হবে। খণ্ডিত দলীয় প্রভাব ভেদ করে জাতিরাষ্ট্রের মৌলিক লক্ষণগুলো ক্রমশই শক্তিশালী হবে। সারা দুনিয়ার একাডেমিয়াতে আমাদের অংশগ্রহণ হবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালে, এই দীর্ঘ পথচলা অনেকাংশে হতাশ করে এই প্রজন্মের ভাবুকদের। মুক্তচিন্তার দিশারি রাজ্জাক স্যারের উত্তরসূরীরা হয়েছেন ছফার গাভী বিত্তান্তের গাভী!

রাজ্জাক স্যারের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে নতুন করে স্মরণে আনি। আমরা হয়তো তাঁর মতো জ্ঞান-বৃক্ষের বিবিধ শাখায় বিচরণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারব না। কিন্তু একজন রাজ্জাককে স্মরণের মাধ্যমে এই জাতিকে পুনরায় তার আপন মহিমায় বিকশিত হওয়ার ঘন্টাধ্বনি বাজাতেই হবে। এই অসাধ্য আমাদের সাধন করতেই হবে। জন এফ কেনেডির মতো আমাদেরকেও বলতেই হবে—‘We set sail on this new sea because there is knowledge to be gained.’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত