.png)
বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী

স্ট্রিম ডেস্ক

মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী বলেছেন, জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তগুলো তাদেরকে গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে। তিনি অভিযোগ করেন, দলটির একের পর এক ভারতপন্থী অবস্থান এবং ভারতের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ তাদেরকে হতাশ করেছে এবং দূরত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ফলস্বরূপ, তারা জামায়াতের শিবিরে যোগ না দিয়ে ভিন্ন কোনো পথে অগ্রসর হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন। সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো:
স্ট্রিম: আপনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছেন। কোন পরিচয়টিকে আপনি বড় করে দেখেন?
মনির হোসেন কাসেমী: আমরা যেহেতু সবটাই দ্বীনের জন্য করি, আমাদের রাজনীতিও দ্বীনের খাতিরে, ইসলামের খাতিরে, জনগণের খাতিরে এবং আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড- সেটাও ইসলামের খাতিরে এবং জনগণের খাতিরে। অতএব কোনটাকে বড় বা ছোট করে দেখার মতো সুযোগ এখানে নেই।
স্ট্রিম: সম্প্রতি আপনাকে বিএনপি'র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, আপনারা কি বিএনপির সঙ্গে জোট করতে যাচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: স্বাভাবিকভাবেই দুইটা শিবির যেহেতু হতে যাচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। যেভাবে দুই শিবির হচ্ছে এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষায় ছিল না। তারপরও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। এ পর্যন্ত দুইটা শিবির দেখা যাচ্ছে দৃশ্যমান সামনে, একটা জামাতের এবং আরেকটা বিএনপি'র। তাহলে নিশ্চয়ই অন্যান্য দলগুলো যেকোনো এক শিবিরেই ভিড়বে। সেই দিক দিয়ে বলতে গেলে বিএনপি'র সাথে ভিড়ার সম্ভাবনাটা বেশি। বাকি এখনো একেবারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুটি রাজনৈতিক শিবির তৈরি হতে যাচ্ছে, যা আমাদের কাম্য ছিল না। তারপরও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। এখন পর্যন্ত দুইটা শিবির আমাদের সামনে দৃশ্যমান, একটি জামায়াতের এবং অন্যটি বিএনপি'র। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দলগুলো যেকোনো একটি শিবিরে যুক্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই দিক থেকে বিএনপি'র সঙ্গে আমাদের জোট করার সম্ভাবনা বেশি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
স্ট্রিম: আপনি বিএনপির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার কথা বলছেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি ইসলামপন্থী দলকে রেখে আপনারা কেন বিএনপির মতো একটি সেক্যুলার দলের সঙ্গে জোট করতে বেশি আগ্রহী?
মনির হোসেন কাসেমী: জোটের ক্ষেত্রে বিএনপিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ হলো, আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে, ইসলামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিকভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে। আমরা রাজনীতির মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই বর্তমান বিশ্বে একটি স্বাভাবিক বিষয়। তাই দেশে একটি সুন্দর পরিবর্তন আনার জন্য যারা রাজনৈতিকভাবে কম ভুল করছে, আমরা তাদের শিবিরে থাকতে চাইব, এটাই স্বাভাবিক।
স্ট্রিম: আপনি ইসলামপন্থী দলগুলোর 'রাজনৈতিক ভুল'-এর কথা উল্লেখ করলেন। এই রাজনৈতিক ভুল বলতে ঠিক কোন বিষয়গুলোকে নির্দেশ করছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল হলো ঐক্যের সংকট। আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একসঙ্গে নির্যাতিত হয়েছি, কারাবরণ করেছি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। আল্লাহর রহমতে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আমরা যখন পূর্ণ স্বাধীনতা পেলাম, তখন আমাদের উচিত ছিল বিগত দিনের মতোই ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশ গড়ার কাজে মনোযোগ দেওয়া। এই ঐক্য ধরে রাখতে না পারার পেছনে কোনো এক পক্ষকে এককভাবে দায়ী করা না গেলেও, দায়ের মাত্রায় কমবেশি রয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে, জামায়াতে ইসলামী এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভুল করেছে। যখন তাদের সেই ভুলগুলো একের পর এক প্রকাশ পেতে শুরু করলো, তখন আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না যে, তারা হয়তো কোনো একটি ‘কালো হাতের ইশারায়’ পরিচালিত হচ্ছে।
স্ট্রিম: জামায়াতে ইসলামী ঠিক কোন ভুলগুলো করেছে বলে আপনি মনে করেন, যার কারণে আপনারা তাদের থেকে দূরে সরে এসেছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: ক্ষমতা পরিবর্তনের একেবারে শুরুতেই, মাত্র দুই দিনের মাথায়, তিনি (জামায়াতের আমির) ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বললেন। যে তীব্র ভারত-বিরোধী অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটি আন্দোলন ও বিপ্লব হলো, যেখানে এত রক্ত ঝরলো এবং এত আত্মত্যাগ করা হলো, সেই ভারতের প্রতি তাদের এই নমনীয় মনোভাব আমাদের কাছে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, বিশেষ করে তাদের নেতৃত্ব থেকে এমন বক্তব্য আসায়। দ্বিতীয়ত, শুধু গত ১৭ বছরই নয়, এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যারা আমাদের ওপর একই কায়দায় স্টিমরোলার চালিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে এখন বলা হচ্ছে যে ‘ফ্যাসিবাদ’ বা ‘স্বৈরাচার’—এই শব্দগুলো শুনতে আর ভালো লাগে না। এটি তাদের দ্বিতীয় বড় রাজনৈতিক ভুল।
তৃতীয় ভুলটি হলো, হাজারো মায়ের সন্তান হারানোর পর একতরফাভাবে সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা। ১৯৭১ সালে তারা যে ভুল করেছিল, এখানেও এত অবদান রাখার পরেও তারা সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে গেল। তিনি এককভাবে "আমি সবাইকে মাফ করে দিলাম" বলার কে? তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, এই কথা বলার অধিকার অন্তত এককভাবে তিনি রাখেন না। এই সিদ্ধান্তটি যদি সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই বিভাজন তৈরিই হতো না। এজন্যই, তাদের একের পর এক এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তগুলো আমাদেরকে গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে। ফলস্বরূপ, আমরা তাদের শিবিরে যোগ না দিয়ে ভিন্ন কোনো পথে অগ্রসর হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছি।
স্ট্রিম: ৫ই আগস্ট, ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জামায়াতের আমিরের আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানে আপনারা অংশ নিয়েছিলেন, যা আপনাদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এরপরও কেন এই দূরত্ব তৈরি হলো?
মনির হোসেন কাসেমী: ঠিকই বলেছেন, শুরুতে আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। আমরা একসঙ্গে কারাবরণ করেছি, নির্যাতিত হয়েছি, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এমনকি পরিবর্তনের পর ১৭ তারিখে আল-ফালাহ-তে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি আমার বক্তব্যে জামায়াতের নেতৃত্বকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম যে, একটি বড় দল হিসেবে ঐক্যের স্বার্থে তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তারা যদি আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসে, তবেই একটি সুন্দর ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমরা সেই ঐক্যের আশাতেই ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের একের পর এক ভারতপন্থী অবস্থান এবং ভারতের প্রতি তাদের অতিরিক্ত অনুরাগ আমাদের হতাশ করেছে এবং দূরত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
স্ট্রিম: মানে জামায়াতে ইসলামীর ভারতপন্থী রাজনীতিই আপনাদের জোট না করার পেছনে প্রধান কারণ?
মনির হোসেন কাসেমী: ভারতপন্থী রাজনীতি একটি অন্যতম প্রধান কারণ, তবে এর সাথে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক এই নতুন যাত্রায় ধর্মীয় বিতর্কগুলোকে সামনে আনতে চাইনি। কিন্তু জামায়াতের কিছু ঐতিহাসিক ধর্মীয় ভুল ধারণা রয়েছে, এবং আমরা দেখেছি যে তাদের ঘরানার বক্তারা (যেমন: মাওলানা তারেক মনোয়ার, আমির হামজা প্রমুখ) উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাহফিলগুলোতে সেই বিতর্কিত বিষয়গুলো নতুন করে উত্থাপন করা শুরু করেন। যখন আমাদের রাসূল (সা.), উম্মাহাতুল মুমিনিন (যেমন: মা খাদিজা রা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সম্পর্কে অহেতুক ও বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়, তখন এদেশের একজন সচেতন আলেম হিসেবে কওমি আলেমরা চুপ থাকতে পারেন না। এই কাঁদা ছোড়াছুড়ি কাম্য না হলেও, এক পক্ষ সীমা লঙ্ঘন করলে জবাব দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।
এর পাশাপাশি, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে তারা যে ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, যেমন—‘হরি হরিবোল’ শেখানো, ‘অর্ধেক রোজা-অর্ধেক পূজা’র মতো কথা বলা, গীতা পাঠ করা এবং প্রতিমার সামনে শ্রদ্ধা নিবেদন ও নমস্কার জানানো—এগুলো ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো মিলেই তাদের সাথে আমাদের চূড়ান্ত দূরত্ব তৈরি করেছে।
স্ট্রিম: জামায়াতের হিন্দু জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে আপনি কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নীতি কী? মানে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আপনারা কিভাবে আপনাদের দিকে টানবেন? তাদের ভোট মনোনয়ন কিভাবে পাবেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রথমত, আমরা ভোটকেন্দ্রিক টানাটানির রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। আমরা একটি আদর্শিক দল এবং আমরা আদর্শের মাধ্যমেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমার আদর্শ আমাকে কতটুকু পর্যন্ত অনুমতি দেয়? একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক। ধরুন, আমরা একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াই। কারো বাড়িতে শোক জানাতে বা কোনো অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। আমার সীমা কতটুকু? আমি তার উঠান, আঙিনা বা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত যেতে পারি, কিন্তু তাই বলে কি তার শোবার ঘরেও প্রবেশ করতে পারি? শোক বা শুভেচ্ছা জানানোর অজুহাতে কারো ব্যক্তিগত শোবার ঘরে চলে যাওয়াটা কখনোই শোভন বা ভদ্রোচিত কাজ নয়।
ঠিক একইভাবে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন—আমি এখানে শুধুমাত্র দায়িত্বশীলদের কথাই বলছি, কোনো রাজনৈতিক দল, নেতা-নেত্রী বা সাধারণ মানুষের কথা নয়—তাদের একটি সীমা রয়েছে। হিন্দু ভাই-বোনেরা এদেশের সমান অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক। সুতরাং, প্রশাসন তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াবে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনে সরকারি কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, প্রশাসন তা করতে বাধ্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, প্রশাসন প্রতিমার সামনে গিয়ে কুর্নিশ করবে। প্রশাসন তাদের ড্রয়িংরুম বা অভ্যর্থনা কেন্দ্র পর্যন্ত যাবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে। কিন্তু কোনো মুসলমানের জন্য, তিনি প্রশাসনের দায়িত্বে থাকলেও, প্রতিমার সামনে গিয়ে কুর্নিশ করা বৈধ নয়। আর যারা প্রশাসনের বাইরে সাধারণ মানুষ, তাদের জন্য তো এটি কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।
স্ট্রিম: বিএনপি এবং জামায়াত কেন্দ্রিক দুটি রাজনৈতিক শিবিরের বাইরে দেওবন্দী ধারার ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের চেষ্টা হয়েছিল, যেখানে আপনারাও যুক্ত ছিলেন। সেই প্রচেষ্টা থেকে আপনারা কেন সরে আসলেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রকৃতপক্ষে, আমরা জোট থেকে বের হয়ে আসিনি। আমরা ধারাবাহিকভাবে মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করছিলাম, কিন্তু এর মধ্যেই তারা আমাদেরকে হতাশ ও নিরাশ করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আপনারা জানেন, এই ‘সমমনা’ জোটের গোড়াপত্তনই হয়েছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের হাত ধরে। ২০১২-১৩ সালের দিকে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী (মরহুম) এবং আমাদের বর্তমান সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেবের পরামর্শেই এটি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব আরও বড় দায়িত্বে যুক্ত থাকায়, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেবের নেতৃত্বেই সমমনা জোটের কার্যক্রম চলছিল।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর যখন সমমনা জোটের বৈঠকগুলো পুনরায় শুরু হলো, তখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম শুরু থেকেই একটি আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। আমাদের পক্ষ থেকে একটি শর্ত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো জোট করা যাবে না। এর জবাবে তারা আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিল যে, যদি জামায়াতের সাথে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি তৈরিও হয়, তবে তা সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই হবে। তারা আরও বলেছিল, ‘আপনারা যেহেতু আমাদের সঙ্গে আছেন, তাই সেই পরামর্শ প্রক্রিয়ায় আপনারাও অংশ নেবেন। সুতরাং সমস্যা কোথায়? ওদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’ এভাবে প্রতিটি বৈঠকেই এই প্রসঙ্গটি উঠত এবং প্রতিবারই আমাদের আশ্বস্ত করা হতো। কিন্তু এর মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বড় সমাবেশের ডাক দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সমাবেশের ঠিক আগের দিনও সমমনা জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেখানে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। অথচ পরের দিনই দেখা গেল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সদলবলে মিছিল নিয়ে জামায়াতের সেই মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছে। অন্যান্য শরিক দলগুলোও হয় সরাসরি, নয়তো প্রতিনিধির মাধ্যমে সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনাটিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কাছে এক ধরনের তামাশা বলে মনে হয়েছে। আমরা চিন্তা করলাম, আমাদের তো আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনো রকম পরামর্শ ছাড়াই কেন তারা সেখানে চলে গেল? সেদিন থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম তাদের ডাকা বৈঠক বর্জন করে আসছে।
তবে আমরা কিন্তু আজও আনুষ্ঠানিকভাবে বলিনি যে, ‘আমরা তোমাদের সাথে নেই’। আমরা শুধু বৈঠক বর্জন করেছি। তাই দায়িত্বটা ছিল তাদেরই। তাদের উচিত ছিল নিজেদের ভুল স্বীকার করে বা একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে পুনরায় বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো। আমার মনে হয়, সেই উদ্যোগের ঘাটতি থাকার কারণেই জমিয়ত আজও তাদের সঙ্গে এক হতে পারছে না। আর বর্তমানে সমমনা জোটের যে পরিণতি দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এমন ধারার সঙ্গে কখনোই থাকতে পারতো না।
স্ট্রিম: মানে জামাতের সঙ্গে একসঙ্গে হযয়ে আপনারা আর এগোতে চান না?
মনির হোসেন কাসেমী: এটা অসম্ভব, এমনটা হতেই পারে না। আমাদের দৃষ্টিতে, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং একইসাথে তাদের পুরোনো ধর্মীয় ভুলগুলোকেও নতুন করে সামনে নিয়ে আসছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়’। এ কারণে আমাদের মধ্যে গভীর দুশ্চিন্তা কাজ করে যে, তারা যেকোনো মুহূর্তে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আর এই বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্ণধারগণ সদা সচেতন। ইনশাআল্লাহ, জমিয়ত তাদের কোনো ভুল সিদ্ধান্তকে—সেটি রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয়—কখনোই সমর্থন জানাবে না।
স্ট্রিম: ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বিএনপির পাশে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু এবারই প্রথম জামায়াতকে কেন্দ্র করে একটি বিভাজন এবং নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: মোটেও ভালোভাবে দেখি না। বাকি এর ব্যাখ্যা তারা নিজেরা দিবে। সেই ব্যাখ্যায় আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।
স্ট্রিম: জমিয়তের হেভিওয়েট নেতা যারা আছেন, তারা কে কোথা থেকে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন? কার সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: জমিয়তের সকল নেতাই সমান মর্যাদার অধিকারী। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক পদ-পদবীর দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে আমাদের এখানে কেউ কম বা বেশি নন। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এই সাম্যের নীতিটি খুব ভালোভাবে বজায় রাখি এবং ‘হেভিওয়েট’ বা ‘লাইটওয়েট’-এর মতো পরিভাষাগুলো সচেতনভাবে পরিহার করে চলি।
মনোনয়নের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, আমাদের মহাসচিব, সভাপতি এবং আরও কয়েকজন নেতা আছেন যারা অতীতেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং ভালো ফলাফল করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, এবারও তাদের নামগুলোই প্রথমে আসবে। এর বাইরে আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করছি যে, অতীতের তুলনায় এবার আমাদের আসন সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। এটি বর্তমান সময়ের দাবি এবং আমরা এর সুস্পষ্ট লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, এটাই ঘটবে।
স্ট্রিম: বিএনপির জোটে যাওয়ার ব্যাপারে আপনাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, এরকম খবর শোনা যায়। আপনাদের জোটের সমঝোতা বা অন্যান্য বিষয়ে কতটুকু এগুলো?
মনির হোসেন কাসেমী: একেবারে অসত্য নয়। আপনি নিজেই বললেন যে, এখন নীতিগত সিদ্ধান্তের পর্যায়ে আছে। যেহেতু নীতিগত সিদ্ধান্ত তার মানে সেটার প্রকাশ এখনো নিষেধ অথবা এটা যেকোনো সময় পরিবর্তনশীল। আসলে সেই পর্যায়েই আছে।
স্ট্রিম: জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সমঝোতা কি হয়েছে? কয়েকটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের বিষয়ে যে কথা শোনা যাচ্ছে, তার সত্যতা কতটুকু?
মনির হোসেন কাসেমী: না, হয়নি। যেসব কথা প্রচার হচ্ছে এগুলো আসলে নানান ধরনের রিউমার।
স্ট্রিম: আপনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে মনস্থির করেছেন। আপনার নির্বাচনী প্রস্তুতি কেমন চলছে?
মনির হোসেন কাসেমী: আশা করছি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচন করব। আর প্রস্তুতি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। যেহেতু আজ প্রায় ছয় মাস যাবত ওখানে কাজ করে চলেছি। সবমিলে আলহামদুলিল্লাহ ভালো, খুবই ভালো।
স্ট্রিম: জোটের অংশ হিসেবে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশিত সমর্থন পাচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ।
স্ট্রিম: তার মানে, আপনারা যৌথভাবেই ওখানে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রস্তুতিটা সেভাবেই চলছে। বাকি শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। সামনে কি অপেক্ষা করছে সেটা সময়ই বলে দেবে।
স্ট্রিম: যদি আপনাদের জোট নির্বাচনে জয়ী হয় এবং বিএনপি সরকার গঠন করে, সেক্ষেত্রে আপনারা কোন মন্ত্রণালয়গুলো চাইবেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আমাদের দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। সত্যি বলতে, এই মুহূর্তে এ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশাও নেই।
স্ট্রিম: আপনারা জয়ী হলে জনগণের জন্য কি করবেন জমিয়তের পক্ষ থেকে? আপনাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী?
মনির হোসেন কাসেমী: নির্বাচনে আমাদের অংশগ্রহণ যদি সীমিতও হয়, আমাদের এই উপস্থিতিই ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং একটি সুন্দর দেশ গড়ার পথে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হবে বলে মনে করি। এর মধ্য দিয়ে জনগণ উপলব্ধি করতে পারবে যে, জমিয়ত ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে এবং দেশের জন্য ইতিবাচক কিছু করার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে।
স্ট্রিম: হেফাজতে ইসলামের আমির জামায়াতে ইসলামী বিরোধী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে মাওলানা মামুনুল হক 'আমিরের ব্যক্তিগত' বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? আপনিও কি এটিকে আমিরের ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: মাওলানা মামুনুল হক সাহেব আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এবং খুবই কাছের একজন বন্ধু। তবে তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, আমিরের বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে তিনি যে মন্তব্যটি করেছেন, সেটিও তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা।
হেফাজতের আমির আমাদের সারাদেশের আমির এবং তিনি সংগঠনটির প্রধান মুখপাত্র। সবচেয়ে বড় আলেম হিসেবে তিনি আমাদের শীর্ষস্থানে রয়েছেন এবং আমাদের সকলের মুরুব্বি। তিনি আমাদের দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও আকিদার প্রধান প্রতিনিধি। সুতরাং, তার বক্তব্যটি ব্যক্তিগত নয়; বরং তিনি আমাদের আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আল্লাহ তায়ালাই তার মুখ দিয়ে সেই কথাটি প্রকাশ করিয়েছেন, যা এদেশের আপামর ওলামায়ে কেরামের মনের কথা।
স্ট্রিম: সম্প্রতি আপনি আফগানিস্তান সফর করেছেন। আপনার এই সফর সম্পর্কে জানতে চাই। কার আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলেন, কী কী দেখেছেন এবং কাদের সঙ্গে কথা হয়েছে? বাংলাদেশ নিয়ে তাদের আগ্রহ কেমন দেখলেন?
মনির হোসেন কাসেমী: ধন্যবাদ আপনাকে, এমন সুন্দর একটি প্রসঙ্গ তোলার জন্য। ইসলাম, দ্বীন এবং কোরআন-সুন্নাহ নিয়ে পড়াশোনার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমার মনের গভীরে একটি স্বপ্ন ছিল—যদি জীবনে এমন একটি রাষ্ট্র দেখার সুযোগ হতো, যা জীবন্ত কোরআন-সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয়। আফগানিস্তানে দশ দিন অবস্থান করে আমি যখন নিজ চোখে উপলব্ধি করলাম যে দেশটি সত্যিই কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, তখন আমার অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়। এই সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল সেখানকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। আমাদের প্রায় ছয়-সাতজন মন্ত্রী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) এবং প্রধান বিচারপতির কার্যালয় পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। এছাড়াও আমরা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি।
সেখানে গিয়ে আমি যা দেখেছি, তা আমার এতদিনের লালিত স্বপ্নেরই এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, মাত্র চার বছরের মধ্যে তারা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে দারিদ্র্যতার প্রভাব রয়েছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে সততা বা পারস্পরিক মঙ্গলকামনার কোনো অভাব নেই। সেখানকার দ্রব্যমূল্য আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম, অথচ তাদের মুদ্রার মান আমাদের দ্বিগুণেরও বেশি। সর্বোপরি, সেখানকার সাধারণ মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও জীবনযাপন আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করেছে।
স্ট্রিম: আপনার পর্যবেক্ষণে, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের এই সাফল্যগুলো অর্জনের পেছনে মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এর একমাত্র এবং প্রধান কারণ হলো সেখানে দুর্নীতি নেই। আমি তাদের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদাহরণ দিতে চাই, যিনি সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন—তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মুত্তাকী সাহেব। তিনি আমাদের বলছিলেন, আফগানিস্তানে ফলমূল বা সবজি ৭ কেজির প্যাকেটে বিক্রি হয়। যেমন, ৭ কেজি আঙ্গুরের দাম ১৪০ আফগানি, আপেল ১২০ আফগানি বা বেদানার দাম ১৫০ আফগানির মতো। এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী মহোদয় তার জীবনযাত্রা সম্পর্কে যা বললেন তা অভাবনীয়। তিনি বলেন, “আপনারা আমার মন্ত্রণালয়ে যে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখছেন, এই পুরোটাই প্রতিষ্ঠানের জন্য, এখানে কর্মরতদের জন্য; আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নয়। আমি তো সাইকেল চালিয়েই অফিসে আসি এবং সাইকেল চালিয়েই বাড়ি ফিরি।” একজন মন্ত্রীর জন্য সেখানে আলাদা কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনই হয় না।
তিনি তার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, “সরকার থেকে আমি যে বেতন পাই, তা দিয়ে যে সপ্তাহে আমি আমার মা বা মেয়েদের পছন্দের ‘শাম্মাম’ (এক প্রকার বাঙ্গি) কিনি, সেই সপ্তাহে আঙ্গুর কেনার সামর্থ্য থাকে না। আবার যেদিন আঙ্গুর কিনি, সেদিন শাম্মাম কিনতে পারি না। এটাই আমার বেতনের অবস্থা।”তিনি আরও একটি বিষয় তুলে ধরেন, “আমার মতোই বড় দাড়ি-পাগড়ি পরা যে নিরাপত্তা প্রহরীরা বিভিন্ন স্তরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের অনেকের বেতন আমার চেয়েও বেশি। কারণ সেখানে পদ-পদবি দিয়ে নয়, বরং পরিবারের সদস্য বা সন্তানের সংখ্যা দিয়ে বেতন নির্ধারিত হয়। যার প্রয়োজন যত বেশি, তার বেতনও তত বেশি।”
যেখানে দুর্নীতি একেবারে শূন্যের কোঠায়, সেই দেশ উন্নতি করবে না তো কোন দেশ করবে? একটি হাদিস আছে: "আন্নাসু আলা দ্বীনি মুলুকিহিম", অর্থাৎ শাসকের চরিত্র যেমন হয়, জনগণের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। শাসক যদি দুর্নীতিবাজ হয়, জনগণও সেরকম হয়। আফগানিস্তানের শাসকরা দুর্নীতিমুক্ত ও চরিত্রবান বলেই অল্প সময়ের মধ্যে জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা যদি আমাদের দেশেও এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলেই জমিয়তের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব—যেখানে দায়িত্বশীলরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ সম্পর্কে আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের অর্থাৎ তালেবান সরকারের ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর আগ্রহ রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি তারা আমাদের কাছে কিছুটা উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সারির যে কয়েকটি দেশ দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েছিল, আফগানিস্তান তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় এখন তারাও বাংলাদেশের কাছ থেকে একই ধরনের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে।
তারা বলেন, “আমরা এক সাগর রক্ত এবং প্রায় ৪৫ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর আমাদের এই দেশ পেয়েছি। তাই নিকটতম একটি মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আমাদের স্বীকৃতি দেবে, এটাই আমাদের আশা। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একসময় আমাদের স্বীকৃতি দেবেই।”
স্ট্রিম: আফগান সরকার কি বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করছে?
মনির হোসেন কাসেমী: যোগাযোগের চেষ্টা চলছে এবং যোগাযোগ হচ্ছেও। জাতিসংঘের অধনে ঢাকায় আফগান দূতাবাসও রয়েছে।
স্ট্রিম: একসময় অনেক বাংলাদেশি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সফরে সেরকম কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
মনির হোসেন কাসেমী: না, এই সুযোগটা হয়নি আমাদের। আমাদের সফরের সময় কম ছিল। তবে এমন অনেক বাংলাদেশির কবর জিয়ারত করেছি যারা ওখানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন।
স্ট্রিম: বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আফগানিস্তানের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি কোনো মিল আছে? সেখানেও কি দরসে নিজামী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে হুবহু মিল রয়েছে। বিষয়বস্তু এবং পাঠ্যক্রম – উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি এই মিলটি শতভাগ।
মূল পার্থক্যটি কেবল শিক্ষার মাধ্যমে; আফগানিস্তানে পশতু এবং আমাদের দেশে বাংলা ব্যবহৃত হয়। এই মিলটি আকস্মিক নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। তারা আইন পাসের মাধ্যমে এটিকে তাদের সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। এই আইন অনুযায়ী, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস, চিন্তাধারা এবং ফিকাহ—সবকিছুই দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে। এবং হ্যাঁ, বর্তমানে এটিই আফগানিস্তানের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা।
স্ট্রিম: আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর, যেমন জামায়াতে ইসলামী, বর্তমান অবস্থা কী? তারা কি রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে?
মনির হোসেন কাসেমী: খেলাফত ব্যবস্থায় ‘বিরোধী দল’ থাকার কোনো সুযোগ নেই, তবে সরকারের ‘বিরোধিতা’ বা সমালোচনা করার সুযোগ রয়েছে। আফগানিস্তানে বর্তমানে পূর্বের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন—যদিও আমরা অভ্যাসগতভাবে তাদের ‘তালেবান’ বলি, কিন্তু তারা নিজেদের এই নামে পরিচয় দেয় না। তারা তাদের রাষ্ট্রকে বলে ‘ইমারতে ইসলামিয়া’ (ইসলামিক এমিরেট)। ‘তালেবান’সহ অন্য সব দলের নাম এখন বিলুপ্ত। ‘ইমারতে ইসলামিয়া’ হলো সরকার এবং রাষ্ট্র—এর বাইরে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই।
এর অর্থ এই নয় যে, সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। যেকোনো ব্যক্তি বা সামাজিক সংগঠন সরকারের সমালোচনা করতে পারে, ভুল ধরিয়ে দিতে পারে। মূল কথা হলো—বিরোধী মত থাকতে পারবে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধী দল থাকতে পারবে না।
স্ট্রিম: আপনার সফরের সময় একটি খবর প্রচারিত হয় যে, তালেবান সরকার নারী লেখকের বইসহ মওদুদী ও আলবানীর মতো ইসলামি চিন্তাবিদদের বইও নিষিদ্ধ করেছে। এই খবরের সত্যতা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জেনেছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: বিষয়টি ঠিক সেরকম নয়। আফগানিস্তানে যেসব লেখালেখি তাদের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আকিদা ও মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেসব চিন্তাধারার সকল বই-পুস্তক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে লেখকের লিঙ্গ—নারী বা পুরুষ—বিবেচনা করা হয়নি। এই নীতির কারণে সৌদি আরবের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী লেখকের বই যেমন বাদ পড়েছে, তেমনি মাওলানা মওদুদী এবং নাসিরুদ্দিন আলবানীর মতো পরিচিত চিন্তাবিদদের নামও এই তালিকায় এসেছে। সর্বমোট প্রায় ১৩০ জন লেখকের লেখা সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাদের বই নিষিদ্ধ করার মূল ভিত্তি ছিল লেখার বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত বার্তা (spirit), লেখকের পরিচয় নয়। তারা দেখেছে, লেখাটি কি ইসলামের পক্ষে নাকি বিপক্ষে? তবে কোনো লেখা ইসলামের পক্ষে হলেও তাতে চরমপন্থা বা উগ্রতার উপাদান আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওহীদ’-ও নিষিদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এই কঠোরতার সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলিমদের আকিদার সম্পর্ক রয়েছে, তবে আমরা সাধারণত এতটা কড়াকড়ি আরোপ করি না, যতটা তারা করে থাকে।
স্ট্রিম: ভবিষ্যতে জমিয়ত যদি বাংলাদেশে সরকার গঠন করার সুযোগ পায়, তাহলে আফগানিস্তানের আদলে কোনো শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা আপনাদের আছে কি?
মনির হোসেন কাসেমী: এখনও সেই সময় আসেনি যে আমরা আফগানিস্তানকে আমাদের জন্য একটি নমুনা বা মডেল হিসেবে বিবেচনা করব। আমাদের মূল আদর্শ ও নমুনা হলো সরাসরি কোরআন ও সুন্নাহ। ভবিষ্যতে যদি কখনো সুযোগ আসে, তবে আমরা কোরআন-সুন্নাহর আলোকেই এই দেশ পরিচালনা করব, যার সুশীতল ছায়াতলে দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এর জন্য আমাদের মদিনা, মক্কা, কায়রো, ইস্তাম্বুল, সুদান, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো কোনো নির্দিষ্ট দেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের নেই, আর এ বিষয়ে আমাদের কোনো আগ্রহও নেই।
স্ট্রিম: একটা খবর শোনা যাচ্ছে, আরপিও সংশোধনের পরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির সঙ্গে জোট করবে কি করবে না, এটা নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এটা কি সত্য?
মনির হোসেন কাসেমী: না, এটিকে ঠিক ‘সংশয়’ বলা যাবে না; বরং এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ আলাপ-আলোচনার একটি অংশ। বিভিন্ন বৈঠকে যখন এই প্রসঙ্গটি উঠেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত বা সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য আসেনি। তাই বলা যায়, জমিয়ত মোটামুটিভাবে তার আগের অবস্থানেই রয়েছে।
স্ট্রিম: এটা কি নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে যে আগে আপনারা সরাসরি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারতেন কিন্তু এখন সেই প্রতীক পাবেন না?
মনির হোসেন কাসেমী: আমার মনে হয় না এটি নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে। এখানে মূল বিষয় হলো জোটটি হচ্ছে কি না। জোট গঠিত হওয়ার পর যদি নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হয়, তবে সেটি খারাপ নয়, বরং আমি মনে করি তা ভালো। এটি একদিকে যেমন দলের জন্য ইতিবাচক, তেমনি এর মাধ্যমে একটি নতুন চর্চাও হতে পারে।
অন্যদিকে, যদি আরপিও সংশোধন করে পুনরায় জোটের প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়, তাতেও আমরা অখুশি হব না; বরং খুশিই হব। কারণ সেক্ষেত্রে জোটের ঐক্যের একটি সুন্দর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
স্ট্রিম: ধন্যবাদ আপনাকে।
মনির হোসেন কাসেমী: ধন্যবাদ আপনাকে এবং ঢাকা স্ট্রিমের দর্শক ও পাঠকদেরও।

মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী বলেছেন, জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তগুলো তাদেরকে গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে। তিনি অভিযোগ করেন, দলটির একের পর এক ভারতপন্থী অবস্থান এবং ভারতের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ তাদেরকে হতাশ করেছে এবং দূরত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ফলস্বরূপ, তারা জামায়াতের শিবিরে যোগ না দিয়ে ভিন্ন কোনো পথে অগ্রসর হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন। সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো:
স্ট্রিম: আপনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছেন। কোন পরিচয়টিকে আপনি বড় করে দেখেন?
মনির হোসেন কাসেমী: আমরা যেহেতু সবটাই দ্বীনের জন্য করি, আমাদের রাজনীতিও দ্বীনের খাতিরে, ইসলামের খাতিরে, জনগণের খাতিরে এবং আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড- সেটাও ইসলামের খাতিরে এবং জনগণের খাতিরে। অতএব কোনটাকে বড় বা ছোট করে দেখার মতো সুযোগ এখানে নেই।
স্ট্রিম: সম্প্রতি আপনাকে বিএনপি'র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, আপনারা কি বিএনপির সঙ্গে জোট করতে যাচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: স্বাভাবিকভাবেই দুইটা শিবির যেহেতু হতে যাচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। যেভাবে দুই শিবির হচ্ছে এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষায় ছিল না। তারপরও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। এ পর্যন্ত দুইটা শিবির দেখা যাচ্ছে দৃশ্যমান সামনে, একটা জামাতের এবং আরেকটা বিএনপি'র। তাহলে নিশ্চয়ই অন্যান্য দলগুলো যেকোনো এক শিবিরেই ভিড়বে। সেই দিক দিয়ে বলতে গেলে বিএনপি'র সাথে ভিড়ার সম্ভাবনাটা বেশি। বাকি এখনো একেবারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুটি রাজনৈতিক শিবির তৈরি হতে যাচ্ছে, যা আমাদের কাম্য ছিল না। তারপরও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। এখন পর্যন্ত দুইটা শিবির আমাদের সামনে দৃশ্যমান, একটি জামায়াতের এবং অন্যটি বিএনপি'র। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দলগুলো যেকোনো একটি শিবিরে যুক্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই দিক থেকে বিএনপি'র সঙ্গে আমাদের জোট করার সম্ভাবনা বেশি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
স্ট্রিম: আপনি বিএনপির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার কথা বলছেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি ইসলামপন্থী দলকে রেখে আপনারা কেন বিএনপির মতো একটি সেক্যুলার দলের সঙ্গে জোট করতে বেশি আগ্রহী?
মনির হোসেন কাসেমী: জোটের ক্ষেত্রে বিএনপিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ হলো, আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে, ইসলামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিকভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে। আমরা রাজনীতির মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই বর্তমান বিশ্বে একটি স্বাভাবিক বিষয়। তাই দেশে একটি সুন্দর পরিবর্তন আনার জন্য যারা রাজনৈতিকভাবে কম ভুল করছে, আমরা তাদের শিবিরে থাকতে চাইব, এটাই স্বাভাবিক।
স্ট্রিম: আপনি ইসলামপন্থী দলগুলোর 'রাজনৈতিক ভুল'-এর কথা উল্লেখ করলেন। এই রাজনৈতিক ভুল বলতে ঠিক কোন বিষয়গুলোকে নির্দেশ করছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল হলো ঐক্যের সংকট। আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একসঙ্গে নির্যাতিত হয়েছি, কারাবরণ করেছি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। আল্লাহর রহমতে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আমরা যখন পূর্ণ স্বাধীনতা পেলাম, তখন আমাদের উচিত ছিল বিগত দিনের মতোই ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশ গড়ার কাজে মনোযোগ দেওয়া। এই ঐক্য ধরে রাখতে না পারার পেছনে কোনো এক পক্ষকে এককভাবে দায়ী করা না গেলেও, দায়ের মাত্রায় কমবেশি রয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে, জামায়াতে ইসলামী এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভুল করেছে। যখন তাদের সেই ভুলগুলো একের পর এক প্রকাশ পেতে শুরু করলো, তখন আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না যে, তারা হয়তো কোনো একটি ‘কালো হাতের ইশারায়’ পরিচালিত হচ্ছে।
স্ট্রিম: জামায়াতে ইসলামী ঠিক কোন ভুলগুলো করেছে বলে আপনি মনে করেন, যার কারণে আপনারা তাদের থেকে দূরে সরে এসেছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: ক্ষমতা পরিবর্তনের একেবারে শুরুতেই, মাত্র দুই দিনের মাথায়, তিনি (জামায়াতের আমির) ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বললেন। যে তীব্র ভারত-বিরোধী অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটি আন্দোলন ও বিপ্লব হলো, যেখানে এত রক্ত ঝরলো এবং এত আত্মত্যাগ করা হলো, সেই ভারতের প্রতি তাদের এই নমনীয় মনোভাব আমাদের কাছে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, বিশেষ করে তাদের নেতৃত্ব থেকে এমন বক্তব্য আসায়। দ্বিতীয়ত, শুধু গত ১৭ বছরই নয়, এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যারা আমাদের ওপর একই কায়দায় স্টিমরোলার চালিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে এখন বলা হচ্ছে যে ‘ফ্যাসিবাদ’ বা ‘স্বৈরাচার’—এই শব্দগুলো শুনতে আর ভালো লাগে না। এটি তাদের দ্বিতীয় বড় রাজনৈতিক ভুল।
তৃতীয় ভুলটি হলো, হাজারো মায়ের সন্তান হারানোর পর একতরফাভাবে সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা। ১৯৭১ সালে তারা যে ভুল করেছিল, এখানেও এত অবদান রাখার পরেও তারা সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে গেল। তিনি এককভাবে "আমি সবাইকে মাফ করে দিলাম" বলার কে? তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, এই কথা বলার অধিকার অন্তত এককভাবে তিনি রাখেন না। এই সিদ্ধান্তটি যদি সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই বিভাজন তৈরিই হতো না। এজন্যই, তাদের একের পর এক এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তগুলো আমাদেরকে গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে। ফলস্বরূপ, আমরা তাদের শিবিরে যোগ না দিয়ে ভিন্ন কোনো পথে অগ্রসর হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছি।
স্ট্রিম: ৫ই আগস্ট, ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জামায়াতের আমিরের আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানে আপনারা অংশ নিয়েছিলেন, যা আপনাদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এরপরও কেন এই দূরত্ব তৈরি হলো?
মনির হোসেন কাসেমী: ঠিকই বলেছেন, শুরুতে আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। আমরা একসঙ্গে কারাবরণ করেছি, নির্যাতিত হয়েছি, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এমনকি পরিবর্তনের পর ১৭ তারিখে আল-ফালাহ-তে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি আমার বক্তব্যে জামায়াতের নেতৃত্বকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম যে, একটি বড় দল হিসেবে ঐক্যের স্বার্থে তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তারা যদি আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসে, তবেই একটি সুন্দর ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমরা সেই ঐক্যের আশাতেই ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের একের পর এক ভারতপন্থী অবস্থান এবং ভারতের প্রতি তাদের অতিরিক্ত অনুরাগ আমাদের হতাশ করেছে এবং দূরত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
স্ট্রিম: মানে জামায়াতে ইসলামীর ভারতপন্থী রাজনীতিই আপনাদের জোট না করার পেছনে প্রধান কারণ?
মনির হোসেন কাসেমী: ভারতপন্থী রাজনীতি একটি অন্যতম প্রধান কারণ, তবে এর সাথে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক এই নতুন যাত্রায় ধর্মীয় বিতর্কগুলোকে সামনে আনতে চাইনি। কিন্তু জামায়াতের কিছু ঐতিহাসিক ধর্মীয় ভুল ধারণা রয়েছে, এবং আমরা দেখেছি যে তাদের ঘরানার বক্তারা (যেমন: মাওলানা তারেক মনোয়ার, আমির হামজা প্রমুখ) উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাহফিলগুলোতে সেই বিতর্কিত বিষয়গুলো নতুন করে উত্থাপন করা শুরু করেন। যখন আমাদের রাসূল (সা.), উম্মাহাতুল মুমিনিন (যেমন: মা খাদিজা রা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সম্পর্কে অহেতুক ও বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়, তখন এদেশের একজন সচেতন আলেম হিসেবে কওমি আলেমরা চুপ থাকতে পারেন না। এই কাঁদা ছোড়াছুড়ি কাম্য না হলেও, এক পক্ষ সীমা লঙ্ঘন করলে জবাব দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।
এর পাশাপাশি, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে তারা যে ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, যেমন—‘হরি হরিবোল’ শেখানো, ‘অর্ধেক রোজা-অর্ধেক পূজা’র মতো কথা বলা, গীতা পাঠ করা এবং প্রতিমার সামনে শ্রদ্ধা নিবেদন ও নমস্কার জানানো—এগুলো ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো মিলেই তাদের সাথে আমাদের চূড়ান্ত দূরত্ব তৈরি করেছে।
স্ট্রিম: জামায়াতের হিন্দু জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে আপনি কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নীতি কী? মানে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আপনারা কিভাবে আপনাদের দিকে টানবেন? তাদের ভোট মনোনয়ন কিভাবে পাবেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রথমত, আমরা ভোটকেন্দ্রিক টানাটানির রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। আমরা একটি আদর্শিক দল এবং আমরা আদর্শের মাধ্যমেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমার আদর্শ আমাকে কতটুকু পর্যন্ত অনুমতি দেয়? একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক। ধরুন, আমরা একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াই। কারো বাড়িতে শোক জানাতে বা কোনো অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। আমার সীমা কতটুকু? আমি তার উঠান, আঙিনা বা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত যেতে পারি, কিন্তু তাই বলে কি তার শোবার ঘরেও প্রবেশ করতে পারি? শোক বা শুভেচ্ছা জানানোর অজুহাতে কারো ব্যক্তিগত শোবার ঘরে চলে যাওয়াটা কখনোই শোভন বা ভদ্রোচিত কাজ নয়।
ঠিক একইভাবে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন—আমি এখানে শুধুমাত্র দায়িত্বশীলদের কথাই বলছি, কোনো রাজনৈতিক দল, নেতা-নেত্রী বা সাধারণ মানুষের কথা নয়—তাদের একটি সীমা রয়েছে। হিন্দু ভাই-বোনেরা এদেশের সমান অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক। সুতরাং, প্রশাসন তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াবে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনে সরকারি কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, প্রশাসন তা করতে বাধ্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, প্রশাসন প্রতিমার সামনে গিয়ে কুর্নিশ করবে। প্রশাসন তাদের ড্রয়িংরুম বা অভ্যর্থনা কেন্দ্র পর্যন্ত যাবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে। কিন্তু কোনো মুসলমানের জন্য, তিনি প্রশাসনের দায়িত্বে থাকলেও, প্রতিমার সামনে গিয়ে কুর্নিশ করা বৈধ নয়। আর যারা প্রশাসনের বাইরে সাধারণ মানুষ, তাদের জন্য তো এটি কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।
স্ট্রিম: বিএনপি এবং জামায়াত কেন্দ্রিক দুটি রাজনৈতিক শিবিরের বাইরে দেওবন্দী ধারার ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের চেষ্টা হয়েছিল, যেখানে আপনারাও যুক্ত ছিলেন। সেই প্রচেষ্টা থেকে আপনারা কেন সরে আসলেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রকৃতপক্ষে, আমরা জোট থেকে বের হয়ে আসিনি। আমরা ধারাবাহিকভাবে মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করছিলাম, কিন্তু এর মধ্যেই তারা আমাদেরকে হতাশ ও নিরাশ করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আপনারা জানেন, এই ‘সমমনা’ জোটের গোড়াপত্তনই হয়েছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের হাত ধরে। ২০১২-১৩ সালের দিকে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী (মরহুম) এবং আমাদের বর্তমান সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেবের পরামর্শেই এটি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব আরও বড় দায়িত্বে যুক্ত থাকায়, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেবের নেতৃত্বেই সমমনা জোটের কার্যক্রম চলছিল।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর যখন সমমনা জোটের বৈঠকগুলো পুনরায় শুরু হলো, তখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম শুরু থেকেই একটি আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। আমাদের পক্ষ থেকে একটি শর্ত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো জোট করা যাবে না। এর জবাবে তারা আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিল যে, যদি জামায়াতের সাথে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি তৈরিও হয়, তবে তা সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই হবে। তারা আরও বলেছিল, ‘আপনারা যেহেতু আমাদের সঙ্গে আছেন, তাই সেই পরামর্শ প্রক্রিয়ায় আপনারাও অংশ নেবেন। সুতরাং সমস্যা কোথায়? ওদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’ এভাবে প্রতিটি বৈঠকেই এই প্রসঙ্গটি উঠত এবং প্রতিবারই আমাদের আশ্বস্ত করা হতো। কিন্তু এর মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বড় সমাবেশের ডাক দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সমাবেশের ঠিক আগের দিনও সমমনা জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেখানে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। অথচ পরের দিনই দেখা গেল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সদলবলে মিছিল নিয়ে জামায়াতের সেই মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছে। অন্যান্য শরিক দলগুলোও হয় সরাসরি, নয়তো প্রতিনিধির মাধ্যমে সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনাটিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কাছে এক ধরনের তামাশা বলে মনে হয়েছে। আমরা চিন্তা করলাম, আমাদের তো আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনো রকম পরামর্শ ছাড়াই কেন তারা সেখানে চলে গেল? সেদিন থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম তাদের ডাকা বৈঠক বর্জন করে আসছে।
তবে আমরা কিন্তু আজও আনুষ্ঠানিকভাবে বলিনি যে, ‘আমরা তোমাদের সাথে নেই’। আমরা শুধু বৈঠক বর্জন করেছি। তাই দায়িত্বটা ছিল তাদেরই। তাদের উচিত ছিল নিজেদের ভুল স্বীকার করে বা একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে পুনরায় বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো। আমার মনে হয়, সেই উদ্যোগের ঘাটতি থাকার কারণেই জমিয়ত আজও তাদের সঙ্গে এক হতে পারছে না। আর বর্তমানে সমমনা জোটের যে পরিণতি দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এমন ধারার সঙ্গে কখনোই থাকতে পারতো না।
স্ট্রিম: মানে জামাতের সঙ্গে একসঙ্গে হযয়ে আপনারা আর এগোতে চান না?
মনির হোসেন কাসেমী: এটা অসম্ভব, এমনটা হতেই পারে না। আমাদের দৃষ্টিতে, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং একইসাথে তাদের পুরোনো ধর্মীয় ভুলগুলোকেও নতুন করে সামনে নিয়ে আসছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়’। এ কারণে আমাদের মধ্যে গভীর দুশ্চিন্তা কাজ করে যে, তারা যেকোনো মুহূর্তে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আর এই বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্ণধারগণ সদা সচেতন। ইনশাআল্লাহ, জমিয়ত তাদের কোনো ভুল সিদ্ধান্তকে—সেটি রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয়—কখনোই সমর্থন জানাবে না।
স্ট্রিম: ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বিএনপির পাশে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু এবারই প্রথম জামায়াতকে কেন্দ্র করে একটি বিভাজন এবং নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: মোটেও ভালোভাবে দেখি না। বাকি এর ব্যাখ্যা তারা নিজেরা দিবে। সেই ব্যাখ্যায় আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।
স্ট্রিম: জমিয়তের হেভিওয়েট নেতা যারা আছেন, তারা কে কোথা থেকে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন? কার সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: জমিয়তের সকল নেতাই সমান মর্যাদার অধিকারী। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক পদ-পদবীর দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে আমাদের এখানে কেউ কম বা বেশি নন। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এই সাম্যের নীতিটি খুব ভালোভাবে বজায় রাখি এবং ‘হেভিওয়েট’ বা ‘লাইটওয়েট’-এর মতো পরিভাষাগুলো সচেতনভাবে পরিহার করে চলি।
মনোনয়নের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, আমাদের মহাসচিব, সভাপতি এবং আরও কয়েকজন নেতা আছেন যারা অতীতেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং ভালো ফলাফল করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, এবারও তাদের নামগুলোই প্রথমে আসবে। এর বাইরে আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করছি যে, অতীতের তুলনায় এবার আমাদের আসন সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। এটি বর্তমান সময়ের দাবি এবং আমরা এর সুস্পষ্ট লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, এটাই ঘটবে।
স্ট্রিম: বিএনপির জোটে যাওয়ার ব্যাপারে আপনাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, এরকম খবর শোনা যায়। আপনাদের জোটের সমঝোতা বা অন্যান্য বিষয়ে কতটুকু এগুলো?
মনির হোসেন কাসেমী: একেবারে অসত্য নয়। আপনি নিজেই বললেন যে, এখন নীতিগত সিদ্ধান্তের পর্যায়ে আছে। যেহেতু নীতিগত সিদ্ধান্ত তার মানে সেটার প্রকাশ এখনো নিষেধ অথবা এটা যেকোনো সময় পরিবর্তনশীল। আসলে সেই পর্যায়েই আছে।
স্ট্রিম: জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সমঝোতা কি হয়েছে? কয়েকটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের বিষয়ে যে কথা শোনা যাচ্ছে, তার সত্যতা কতটুকু?
মনির হোসেন কাসেমী: না, হয়নি। যেসব কথা প্রচার হচ্ছে এগুলো আসলে নানান ধরনের রিউমার।
স্ট্রিম: আপনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে মনস্থির করেছেন। আপনার নির্বাচনী প্রস্তুতি কেমন চলছে?
মনির হোসেন কাসেমী: আশা করছি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচন করব। আর প্রস্তুতি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। যেহেতু আজ প্রায় ছয় মাস যাবত ওখানে কাজ করে চলেছি। সবমিলে আলহামদুলিল্লাহ ভালো, খুবই ভালো।
স্ট্রিম: জোটের অংশ হিসেবে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশিত সমর্থন পাচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ।
স্ট্রিম: তার মানে, আপনারা যৌথভাবেই ওখানে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: প্রস্তুতিটা সেভাবেই চলছে। বাকি শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। সামনে কি অপেক্ষা করছে সেটা সময়ই বলে দেবে।
স্ট্রিম: যদি আপনাদের জোট নির্বাচনে জয়ী হয় এবং বিএনপি সরকার গঠন করে, সেক্ষেত্রে আপনারা কোন মন্ত্রণালয়গুলো চাইবেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আমাদের দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। সত্যি বলতে, এই মুহূর্তে এ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশাও নেই।
স্ট্রিম: আপনারা জয়ী হলে জনগণের জন্য কি করবেন জমিয়তের পক্ষ থেকে? আপনাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী?
মনির হোসেন কাসেমী: নির্বাচনে আমাদের অংশগ্রহণ যদি সীমিতও হয়, আমাদের এই উপস্থিতিই ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং একটি সুন্দর দেশ গড়ার পথে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হবে বলে মনে করি। এর মধ্য দিয়ে জনগণ উপলব্ধি করতে পারবে যে, জমিয়ত ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে এবং দেশের জন্য ইতিবাচক কিছু করার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে।
স্ট্রিম: হেফাজতে ইসলামের আমির জামায়াতে ইসলামী বিরোধী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে মাওলানা মামুনুল হক 'আমিরের ব্যক্তিগত' বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? আপনিও কি এটিকে আমিরের ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: মাওলানা মামুনুল হক সাহেব আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এবং খুবই কাছের একজন বন্ধু। তবে তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, আমিরের বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে তিনি যে মন্তব্যটি করেছেন, সেটিও তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা।
হেফাজতের আমির আমাদের সারাদেশের আমির এবং তিনি সংগঠনটির প্রধান মুখপাত্র। সবচেয়ে বড় আলেম হিসেবে তিনি আমাদের শীর্ষস্থানে রয়েছেন এবং আমাদের সকলের মুরুব্বি। তিনি আমাদের দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও আকিদার প্রধান প্রতিনিধি। সুতরাং, তার বক্তব্যটি ব্যক্তিগত নয়; বরং তিনি আমাদের আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আল্লাহ তায়ালাই তার মুখ দিয়ে সেই কথাটি প্রকাশ করিয়েছেন, যা এদেশের আপামর ওলামায়ে কেরামের মনের কথা।
স্ট্রিম: সম্প্রতি আপনি আফগানিস্তান সফর করেছেন। আপনার এই সফর সম্পর্কে জানতে চাই। কার আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলেন, কী কী দেখেছেন এবং কাদের সঙ্গে কথা হয়েছে? বাংলাদেশ নিয়ে তাদের আগ্রহ কেমন দেখলেন?
মনির হোসেন কাসেমী: ধন্যবাদ আপনাকে, এমন সুন্দর একটি প্রসঙ্গ তোলার জন্য। ইসলাম, দ্বীন এবং কোরআন-সুন্নাহ নিয়ে পড়াশোনার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমার মনের গভীরে একটি স্বপ্ন ছিল—যদি জীবনে এমন একটি রাষ্ট্র দেখার সুযোগ হতো, যা জীবন্ত কোরআন-সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয়। আফগানিস্তানে দশ দিন অবস্থান করে আমি যখন নিজ চোখে উপলব্ধি করলাম যে দেশটি সত্যিই কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, তখন আমার অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়। এই সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল সেখানকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। আমাদের প্রায় ছয়-সাতজন মন্ত্রী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) এবং প্রধান বিচারপতির কার্যালয় পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। এছাড়াও আমরা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি।
সেখানে গিয়ে আমি যা দেখেছি, তা আমার এতদিনের লালিত স্বপ্নেরই এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, মাত্র চার বছরের মধ্যে তারা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে দারিদ্র্যতার প্রভাব রয়েছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে সততা বা পারস্পরিক মঙ্গলকামনার কোনো অভাব নেই। সেখানকার দ্রব্যমূল্য আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম, অথচ তাদের মুদ্রার মান আমাদের দ্বিগুণেরও বেশি। সর্বোপরি, সেখানকার সাধারণ মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও জীবনযাপন আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করেছে।
স্ট্রিম: আপনার পর্যবেক্ষণে, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের এই সাফল্যগুলো অর্জনের পেছনে মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মনির হোসেন কাসেমী: এর একমাত্র এবং প্রধান কারণ হলো সেখানে দুর্নীতি নেই। আমি তাদের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদাহরণ দিতে চাই, যিনি সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন—তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মুত্তাকী সাহেব। তিনি আমাদের বলছিলেন, আফগানিস্তানে ফলমূল বা সবজি ৭ কেজির প্যাকেটে বিক্রি হয়। যেমন, ৭ কেজি আঙ্গুরের দাম ১৪০ আফগানি, আপেল ১২০ আফগানি বা বেদানার দাম ১৫০ আফগানির মতো। এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী মহোদয় তার জীবনযাত্রা সম্পর্কে যা বললেন তা অভাবনীয়। তিনি বলেন, “আপনারা আমার মন্ত্রণালয়ে যে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখছেন, এই পুরোটাই প্রতিষ্ঠানের জন্য, এখানে কর্মরতদের জন্য; আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নয়। আমি তো সাইকেল চালিয়েই অফিসে আসি এবং সাইকেল চালিয়েই বাড়ি ফিরি।” একজন মন্ত্রীর জন্য সেখানে আলাদা কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনই হয় না।
তিনি তার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, “সরকার থেকে আমি যে বেতন পাই, তা দিয়ে যে সপ্তাহে আমি আমার মা বা মেয়েদের পছন্দের ‘শাম্মাম’ (এক প্রকার বাঙ্গি) কিনি, সেই সপ্তাহে আঙ্গুর কেনার সামর্থ্য থাকে না। আবার যেদিন আঙ্গুর কিনি, সেদিন শাম্মাম কিনতে পারি না। এটাই আমার বেতনের অবস্থা।”তিনি আরও একটি বিষয় তুলে ধরেন, “আমার মতোই বড় দাড়ি-পাগড়ি পরা যে নিরাপত্তা প্রহরীরা বিভিন্ন স্তরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের অনেকের বেতন আমার চেয়েও বেশি। কারণ সেখানে পদ-পদবি দিয়ে নয়, বরং পরিবারের সদস্য বা সন্তানের সংখ্যা দিয়ে বেতন নির্ধারিত হয়। যার প্রয়োজন যত বেশি, তার বেতনও তত বেশি।”
যেখানে দুর্নীতি একেবারে শূন্যের কোঠায়, সেই দেশ উন্নতি করবে না তো কোন দেশ করবে? একটি হাদিস আছে: "আন্নাসু আলা দ্বীনি মুলুকিহিম", অর্থাৎ শাসকের চরিত্র যেমন হয়, জনগণের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। শাসক যদি দুর্নীতিবাজ হয়, জনগণও সেরকম হয়। আফগানিস্তানের শাসকরা দুর্নীতিমুক্ত ও চরিত্রবান বলেই অল্প সময়ের মধ্যে জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা যদি আমাদের দেশেও এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলেই জমিয়তের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব—যেখানে দায়িত্বশীলরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ সম্পর্কে আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের অর্থাৎ তালেবান সরকারের ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর আগ্রহ রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি তারা আমাদের কাছে কিছুটা উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সারির যে কয়েকটি দেশ দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েছিল, আফগানিস্তান তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় এখন তারাও বাংলাদেশের কাছ থেকে একই ধরনের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে।
তারা বলেন, “আমরা এক সাগর রক্ত এবং প্রায় ৪৫ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর আমাদের এই দেশ পেয়েছি। তাই নিকটতম একটি মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আমাদের স্বীকৃতি দেবে, এটাই আমাদের আশা। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একসময় আমাদের স্বীকৃতি দেবেই।”
স্ট্রিম: আফগান সরকার কি বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করছে?
মনির হোসেন কাসেমী: যোগাযোগের চেষ্টা চলছে এবং যোগাযোগ হচ্ছেও। জাতিসংঘের অধনে ঢাকায় আফগান দূতাবাসও রয়েছে।
স্ট্রিম: একসময় অনেক বাংলাদেশি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সফরে সেরকম কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
মনির হোসেন কাসেমী: না, এই সুযোগটা হয়নি আমাদের। আমাদের সফরের সময় কম ছিল। তবে এমন অনেক বাংলাদেশির কবর জিয়ারত করেছি যারা ওখানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন।
স্ট্রিম: বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আফগানিস্তানের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি কোনো মিল আছে? সেখানেও কি দরসে নিজামী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়?
মনির হোসেন কাসেমী: হ্যাঁ, দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে হুবহু মিল রয়েছে। বিষয়বস্তু এবং পাঠ্যক্রম – উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি এই মিলটি শতভাগ।
মূল পার্থক্যটি কেবল শিক্ষার মাধ্যমে; আফগানিস্তানে পশতু এবং আমাদের দেশে বাংলা ব্যবহৃত হয়। এই মিলটি আকস্মিক নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। তারা আইন পাসের মাধ্যমে এটিকে তাদের সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। এই আইন অনুযায়ী, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস, চিন্তাধারা এবং ফিকাহ—সবকিছুই দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে। এবং হ্যাঁ, বর্তমানে এটিই আফগানিস্তানের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা।
স্ট্রিম: আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর, যেমন জামায়াতে ইসলামী, বর্তমান অবস্থা কী? তারা কি রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে?
মনির হোসেন কাসেমী: খেলাফত ব্যবস্থায় ‘বিরোধী দল’ থাকার কোনো সুযোগ নেই, তবে সরকারের ‘বিরোধিতা’ বা সমালোচনা করার সুযোগ রয়েছে। আফগানিস্তানে বর্তমানে পূর্বের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন—যদিও আমরা অভ্যাসগতভাবে তাদের ‘তালেবান’ বলি, কিন্তু তারা নিজেদের এই নামে পরিচয় দেয় না। তারা তাদের রাষ্ট্রকে বলে ‘ইমারতে ইসলামিয়া’ (ইসলামিক এমিরেট)। ‘তালেবান’সহ অন্য সব দলের নাম এখন বিলুপ্ত। ‘ইমারতে ইসলামিয়া’ হলো সরকার এবং রাষ্ট্র—এর বাইরে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই।
এর অর্থ এই নয় যে, সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। যেকোনো ব্যক্তি বা সামাজিক সংগঠন সরকারের সমালোচনা করতে পারে, ভুল ধরিয়ে দিতে পারে। মূল কথা হলো—বিরোধী মত থাকতে পারবে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধী দল থাকতে পারবে না।
স্ট্রিম: আপনার সফরের সময় একটি খবর প্রচারিত হয় যে, তালেবান সরকার নারী লেখকের বইসহ মওদুদী ও আলবানীর মতো ইসলামি চিন্তাবিদদের বইও নিষিদ্ধ করেছে। এই খবরের সত্যতা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জেনেছেন?
মনির হোসেন কাসেমী: বিষয়টি ঠিক সেরকম নয়। আফগানিস্তানে যেসব লেখালেখি তাদের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আকিদা ও মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেসব চিন্তাধারার সকল বই-পুস্তক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে লেখকের লিঙ্গ—নারী বা পুরুষ—বিবেচনা করা হয়নি। এই নীতির কারণে সৌদি আরবের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী লেখকের বই যেমন বাদ পড়েছে, তেমনি মাওলানা মওদুদী এবং নাসিরুদ্দিন আলবানীর মতো পরিচিত চিন্তাবিদদের নামও এই তালিকায় এসেছে। সর্বমোট প্রায় ১৩০ জন লেখকের লেখা সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাদের বই নিষিদ্ধ করার মূল ভিত্তি ছিল লেখার বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত বার্তা (spirit), লেখকের পরিচয় নয়। তারা দেখেছে, লেখাটি কি ইসলামের পক্ষে নাকি বিপক্ষে? তবে কোনো লেখা ইসলামের পক্ষে হলেও তাতে চরমপন্থা বা উগ্রতার উপাদান আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওহীদ’-ও নিষিদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এই কঠোরতার সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলিমদের আকিদার সম্পর্ক রয়েছে, তবে আমরা সাধারণত এতটা কড়াকড়ি আরোপ করি না, যতটা তারা করে থাকে।
স্ট্রিম: ভবিষ্যতে জমিয়ত যদি বাংলাদেশে সরকার গঠন করার সুযোগ পায়, তাহলে আফগানিস্তানের আদলে কোনো শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা আপনাদের আছে কি?
মনির হোসেন কাসেমী: এখনও সেই সময় আসেনি যে আমরা আফগানিস্তানকে আমাদের জন্য একটি নমুনা বা মডেল হিসেবে বিবেচনা করব। আমাদের মূল আদর্শ ও নমুনা হলো সরাসরি কোরআন ও সুন্নাহ। ভবিষ্যতে যদি কখনো সুযোগ আসে, তবে আমরা কোরআন-সুন্নাহর আলোকেই এই দেশ পরিচালনা করব, যার সুশীতল ছায়াতলে দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এর জন্য আমাদের মদিনা, মক্কা, কায়রো, ইস্তাম্বুল, সুদান, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো কোনো নির্দিষ্ট দেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের নেই, আর এ বিষয়ে আমাদের কোনো আগ্রহও নেই।
স্ট্রিম: একটা খবর শোনা যাচ্ছে, আরপিও সংশোধনের পরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির সঙ্গে জোট করবে কি করবে না, এটা নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এটা কি সত্য?
মনির হোসেন কাসেমী: না, এটিকে ঠিক ‘সংশয়’ বলা যাবে না; বরং এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ আলাপ-আলোচনার একটি অংশ। বিভিন্ন বৈঠকে যখন এই প্রসঙ্গটি উঠেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত বা সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য আসেনি। তাই বলা যায়, জমিয়ত মোটামুটিভাবে তার আগের অবস্থানেই রয়েছে।
স্ট্রিম: এটা কি নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে যে আগে আপনারা সরাসরি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারতেন কিন্তু এখন সেই প্রতীক পাবেন না?
মনির হোসেন কাসেমী: আমার মনে হয় না এটি নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে। এখানে মূল বিষয় হলো জোটটি হচ্ছে কি না। জোট গঠিত হওয়ার পর যদি নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হয়, তবে সেটি খারাপ নয়, বরং আমি মনে করি তা ভালো। এটি একদিকে যেমন দলের জন্য ইতিবাচক, তেমনি এর মাধ্যমে একটি নতুন চর্চাও হতে পারে।
অন্যদিকে, যদি আরপিও সংশোধন করে পুনরায় জোটের প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়, তাতেও আমরা অখুশি হব না; বরং খুশিই হব। কারণ সেক্ষেত্রে জোটের ঐক্যের একটি সুন্দর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
স্ট্রিম: ধন্যবাদ আপনাকে।
মনির হোসেন কাসেমী: ধন্যবাদ আপনাকে এবং ঢাকা স্ট্রিমের দর্শক ও পাঠকদেরও।
.png)

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রস্তাবিত নতুন পে-স্কেল কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও আর্থিক শৃঙ্খলার যৌথ পরীক্ষা।
১০ ঘণ্টা আগে
মনোনয়ন দেওয়ার ব্যপারে দলের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা, জনপ্রিয়তা ও প্রার্থীর যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেছেন, বিএনপি জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচনী জোটে আগ্রহী এবং আসন ছাড়তেও প্রস্তুত।
১ দিন আগে
জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে সম্পর্কে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি পুরুষ নেতাদের চেয়েও কঠোর হতে পারেন। অভিবাসন ও প্রতিরক্ষা নীতিতে তার কড়া অবস্থানের কারণে এমন ধারণা প্রকট হচ্ছে।
১ দিন আগে
রাশিয়াতে যখন ১৯১৭ সালে বিপ্লব ঘটল, তখন বহির্বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে এর গভীরতা অনুধাবন করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ডামাডোলের মধ্যে এটিকে অনেকেই আরেকটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে গণ্য করেছিল। তবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত দরিদ্র দেশগুলোর কাছে এই বিপ্লব এক নতুন দৃষ্টিকোণ এনে দেয়।
২ দিন আগে