leadT1ad

নতুন পে–স্কেল: সুখবরের আড়ালে অর্থনৈতিক সতর্কবার্তা

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ১৯
জাতীয় পে-স্কেল। প্রতীকী ছবি

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রস্তাবিত নতুন পে-স্কেল কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও আর্থিক শৃঙ্খলার যৌথ পরীক্ষা। প্রায় এক দশক পর এমন উদ্যোগ এসেছে, যখন মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একসঙ্গে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চাপে ফেলেছে। ২০১৫ সালের পর কোনো পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো সংস্কার হয়নি। ফলে নতুন স্কেল শুধু বেতনবৃদ্ধি নয়, বরং প্রশাসনিক ন্যায্যতা ও দক্ষ মানবসম্পদ ধরে রাখার প্রতিশ্রুতিও বয়ে আনছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই পে-স্কেল বাস্তবায়ন একদিকে রাষ্ট্রের রাজস্ব ঘাটতির চাপ বাড়াবে, অন্যদিকে কর্মচারীদের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। নতুন কাঠামো কার্যকর হলে বেতন ভাতা খাতে সরকারের বার্ষিক ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যেতে পারে, ফলে বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। এই অতিরিক্ত অর্থের উৎসই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। অর্থ বিভাগ এরই মধ্যে দুটি সম্ভাব্য উৎসের কথা বলেছে: আয়কর এবং সরকারি আবাসনের বাড়িভাড়া।

অর্থ বিভাগের হিসাব বলছে, নতুন কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতন ৮২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬০০০ টাকার বেশি হতে পারে। ফলে পূর্বে করের বাইরে থাকা এক বিশাল কর্মীশ্রেণি এবার করদাতার আওতায় আসবে। এতে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মীদের ওপর নতুন আর্থিক চাপও তৈরি হবে। যারা গত এক দশক ধরে মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় জীবনমান কমে যাওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের জন্য আয়করের নতুন দায় মানে প্রকৃত বেতনবৃদ্ধির একটি অংশ আবার রাষ্ট্রের কাছে ফিরে যাওয়া।

অন্যদিকে, সরকারি বাসাবাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি রাজস্ব আয়ের আরেক উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই নীতি বাস্তবে অনেকটা ‘ডান হাত দিয়ে দেওয়া, বাঁ হাত দিয়ে নেওয়া’র মতো হতে পারে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ভাড়া সমন্বয় করলে নেট আয় হ্রাস পেতে পারে। এর সামাজিক প্রভাব অর্থনৈতিক ফলাফলের চেয়েও বড় হতে পারে, কারণ এতে বেতনের প্রকৃত মূল্য নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠবে।

অর্থনীতিতে বলা হয়, সরকার মূলত একটি ‘কিনেসিয়ান মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট’ ধারণার ওপর নির্ভর করছে। এর মানে হলো, বেতন বাড়লে আয় ও ব্যয় দুটোই বাড়বে, বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে এবং পরোক্ষভাবে রাজস্বও বাড়বে। কিন্তু এই সূত্রের কার্যকারিতা নির্ভর করবে দেশের উৎপাদনশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতার ওপর। বেতন বাড়লে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে ঠিকই, কিন্তু যদি দ্রব্যমূল্য ও সেবা খরচ একই হারে বেড়ে যায়, তবে প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা অপরিবর্তিত থেকে যাবে।

প্রধান প্রশ্নটি এখন ভারসাম্যের। বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল তত্ত্বগতভাবে যৌক্তিক হলেও বাস্তবে এটি মুদ্রাস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি ও ঋণচাপকে আরও বাড়াতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে করতে হবে। প্রথমে নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন শুরু করে পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য স্তরে তা সম্প্রসারণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে। এতে একদিকে সামাজিক ন্যায়বোধ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে হঠাৎ চাপ তৈরি হবে না।

রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য শুধুমাত্র আয়কর ও বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভর না করে করভিত্তি বিস্তারে নতুন উৎস খোঁজার প্রয়োজন রয়েছে। সম্পত্তি কর, ডিজিটাল অর্থনীতিতে ভ্যাট, পরিবেশ শুল্ক বা আচরণভিত্তিক করের মতো খাতগুলো মধ্যমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব উৎস হতে পারে। তবে এজন্য দরকার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা। একই সঙ্গে করনীতিতে সরলতা ও স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে নতুন করদাতারা মনে করেন তারা কেবল অর্থ দিচ্ছেন না, রাষ্ট্রও তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।

বেতন কাঠামোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উৎপাদনশীলতার সঙ্গে বেতনের সম্পর্ক। আমার মতে, শুধু স্কেল বৃদ্ধি নয়, পারফরম্যান্সভিত্তিক ইনক্রিমেন্ট ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রণোদনা যুক্ত করা জরুরি। এতে কর্মদক্ষতা বাড়বে এবং রাজস্ব আদায়েও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে, রাজস্ব প্রশাসনকে ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে আয়কর আদায় সহজ করা, প্রি ফিল্ড রিটার্ন ও মোবাইল পেমেন্ট চালু করা গেলে কর সংগ্রহের সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

অর্থ ব্যবস্থাপনার দিক থেকেও সরকারকে নতুন চিন্তা আনতে হবে। ব্যাংকঋণ বা সঞ্চয়পত্রের ওপর অতিনির্ভরতা ব্যয় বাড়ায় এবং বেসরকারি খাতের অর্থায়নে চাপ সৃষ্টি করে। তাই স্বল্পমেয়াদি বিল ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের ভারসাম্য তৈরি করা দরকার, যাতে সুদ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং নগদ প্রবাহে স্থিতিশীলতা আসে।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে জিরো বেসড বাজেটিং, অকার্যকর প্রকল্প বাতিল এবং ক্রয় প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল স্বচ্ছতা বাড়ানো গেলে বিপুল অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সাশ্রয় সম্ভব। এসব পদক্ষেপ কেবল রাজস্ব ঘাটতি কমায় না, সরকারের প্রতি নাগরিক আস্থাও পুনর্গঠন করে। অর্থনীতিবিদদের মতে, “আস্থা” এখন দেশের সবচেয়ে বড় অদৃশ্য সম্পদ। যতক্ষণ জনগণ মনে করে রাষ্ট্র তাদের কল্যাণে ব্যয় করছে, ততক্ষণ রাজস্ব আহরণ সহজ থাকে।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে। এই প্রেক্ষাপটে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও ন্যায়সঙ্গত বেতন কাঠামো কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতারও পূর্বশর্ত। দক্ষ ও মেধাবী জনবল ধরে রাখতে হলে রাষ্ট্রকে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য ও নিরাপত্তা দুইই নিশ্চিত হয়।

আমার মতে, বেতন সংস্কার তখনই সফল হতে পারে, যখন সেটি একটি বৃহত্তর সংস্কার প্যাকেজের অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হবে। এই প্যাকেজের তিনটি স্তম্ভ হওয়া উচিত ন্যায্য বেতন, শৃঙ্খলিত ব্যয় এবং আধুনিক রাজস্ব কাঠামো। সরকার যদি এই ত্রিমাত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, তাহলে নতুন পে-স্কেল কেবল ব্যয়ের বোঝা নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার বিনিয়োগে পরিণত হবে।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের নতুন পে-স্কেল এখন এক ভারসাম্যের লড়াইয়ের প্রতীক। একদিকে সরকারি কর্মচারীদের স্বস্তি, অন্যদিকে রাজস্বের চাপ; এক হাতে সুখবর, অন্য হাতে সতর্কতা। তাই এই উদ্যোগকে দেখা উচিত কেবল বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা হিসেবে নয়, এটি মূলত ইঙ্গিত দিচ্ছে এক বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা। সঠিক বাস্তবায়ন হলে এটি কেবল সরকারি খাত নয়, সমগ্র অর্থনীতিতেই এক নতুন আস্থার বৃত্ত তৈরি করতে পারে, যেখানে ন্যায্যতা, দক্ষতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠবে।

  • ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
    [email protected]
Ad 300x250

সম্পর্কিত