leadT1ad

সোমালিয়া থেকে সাহারা: তুরস্ক আফ্রিকায় ক্ষমতার মানচিত্র বদলে দিচ্ছে কি

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৭: ০২
স্ট্রিম গ্রাফিক

আফ্রিকার আকাশে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার টিবি২ ড্রোনের উপস্থিতি নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে বৃহত্তম বিদেশী সামরিক ঘাঁটি গেড়ে বসেছে আঙ্কারা। একই সঙ্গে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেল সম্পদ আহরণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মিশেলই প্রমাণ করে তুরস্ক এখন আফ্রিকার রাজনীতিতে এক গভীর ও কৌশলগত ভূমিকা নিতে প্রস্তুত।

প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক গত দুই দশকে আফ্রিকার প্রতি তার নীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। ২০০২ সালে আফ্রিকায় মাত্র ১২টি দূতাবাস থেকে বর্তমানে ৪৪টিতে উন্নীত হওয়া, এই কূটনৈতিক উত্থানই তুরস্কের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রাথমিক ভিত্তি।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই ৪৪টি দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে মহাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি অঞ্চলে নিজেদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বাড়ানোর জন্য। তুর্কি এয়ারলাইনস ৫০টিরও বেশি আফ্রিকান গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে -- যা বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে সংযোগকে আরও সহজ করেছে। কিন্তু তুরস্কের এই সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো আফ্রিকায় নিছকই দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বা মানবিক সহায়তার মোড়কে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এটি সুচিন্তিতভাবে পরিচালিত ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের একটি কৌশল, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মহাদেশের সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করা এবং নিজেদের সামরিক শিল্পকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করা।

মোগাদিসুতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন থেকে শুরু করে সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তুরস্ক একটি 'ক্ষমতার করিডোর' তৈরি করছে আর ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা ও উদীয়মান এশীয় পরাশক্তিদের প্রভাবকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। কিন্তু তুরস্কের এই বহুমুখী কৌশলগত পদক্ষেপ কি সত্যিই আফ্রিকার ক্ষমতার সমীকরণকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করছে?

তুরস্কের সামরিক নীতির প্রধান স্তম্ভ হলো তার ড্রোন প্রযুক্তি ও সামরিক উপস্থিতি। তুরস্কের এই কৌশলকে প্রায়শই ‘বায়রাকতার কূটনীতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেখানে অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি সশস্ত্র ড্রোন (বিশেষত বায়রাকতার টিবি২) এবং সামরিক অংশীদারত্বকে পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সামরিক নীতির এই অংশটি আফ্রিকা মহাদেশে তাদের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্য তুলে ধরে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক ঘাঁটি

তুরস্কের বাইরে তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে। এটি তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি হর্ন অফ আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় আঙ্কারার আগ্রহ তুলে ধরে। এই ঘাঁটিটি ভারত মহাসাগরের প্রবেশপথে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। এটি তুরস্ককে আন্তর্জাতিক শিপিং রুট এবং ইয়েমেনের কাছাকাছি বাবেল মান্দেব প্রণালির দিকে সামরিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়। এই উপস্থিতি তুরস্ককে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সরবরাহকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ (ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সহায়তাসহ) তুরস্ককে উত্তর আফ্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

‘বায়রাকতার কূটনীতি’ ও অস্ত্র রপ্তানি

তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও সফল দিক হলো তাদের স্থানীয়ভাবে তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্রের রপ্তানি। আফ্রিকার অনেক দেশেই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি মোকাবিলায় তুরস্কের তৈরি ড্রোন (যেমন বায়রাকতার টিবি২) একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধের মাঠে গেম চেঞ্জার এই ড্রোনগুলো তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মতো কঠোর শর্ত ছাড়াই তুরস্ক তা সরবরাহ করে থাকে, যা আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য আকর্ষণীয় বিকল্প। এছাড়া ড্রোনগুলোর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তির চেয়ে অনেক কম, যা দরিদ্র আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।

তুরস্ক ড্রোন বিক্রির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর-এর মতো সুবিধা দেয়, যা ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী সামরিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে। আফ্রিকার কমপক্ষে দশটি দেশে (যেমন নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মরক্কো, নাইজার, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, টোগো, অ্যাঙ্গোলা ইত্যাদি) বায়রাকতার টিবি২ সশস্ত্র ড্রোনের চাহিদা তুঙ্গে। সেনেগালের মতো কিছু দেশে ড্রোন তৈরির কারখানা স্থাপনেরও চুক্তি হয়েছে, যা গভীর কৌশলগত অংশীদারিত্বের ইঙ্গিত দেয়। এই ড্রোনগুলো গোয়েন্দাগিরি, নজরদারি, রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ এবং নির্ভুল হামলা চালাতে সক্ষম, যা আফ্রিকান সামরিক বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে আরও শক্তিশালী করেছে। ড্রোন ছাড়াও তুরস্ক আক্রমণকারী হেলিকপ্টার (টি১২৯ এটিএকে) এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। এই অস্ত্র সরবরাহ তুরস্ককে সংশ্লিষ্ট আফ্রিকান দেশগুলোর সামরিক অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়, যা স্থায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে।

তুরস্কের সামরিক পদক্ষেপগুলো নিছকই নিরাপত্তা সহযোগিতা নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক লক্ষ্য, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ।

সোমালিয়ার তেল ও গ্যাস চুক্তি: সামরিক সুরক্ষার মোড়কে সম্পদ দখল

সোমালিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান ও উৎপাদনের একচেটিয়া অধিকার নিয়ে তুরস্কের চুক্তিটি একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তুরস্কের জ্বালানিমন্ত্রী সোমালিয়ার সঙ্গে তথাকথিত 'হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান ও উৎপাদন চুক্তি' স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে তুরস্ক সোমালি উপকূলের তিনটি ব্লকে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের অধিকার লাভ করে। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার লাভ একটি কৌশলগত আধিপত্যের উদাহরণ, যা ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিক বা নব্য-ঔপনিবেশিক শক্তিরা করে এসেছে।

এই ধরনের চুক্তিগুলি আঞ্চলিক জলসীমা বা সম্পদের মালিকানা নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর (যেমন সোমালিয়া ও কেনিয়া) মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই তুরস্কের পার্লামেন্ট সোমালিয়ায় সামরিক বাহিনী মোতায়েনের আইন অনুমোদন করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তুরস্ক তাদের সামরিক ঘাঁটি ও সৈন্যদের ব্যবহার করে তাদের নতুন পাওয়া তেল ও গ্যাস সম্পদকে নিরাপত্তা দেবে। এটি অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ ব্যবহার।

বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার ও বিনিয়োগ প্রকল্প

তুরস্কের সঙ্গে আফ্রিকার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তুর্কি কোম্পানিগুলো নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও খনিশিল্পে বড় আকারের বিনিয়োগ করছে (যেমন সোমালিয়া, আলজেরিয়া)। তুরস্কের লক্ষ্য আফ্রিকায় শীর্ষস্থানীয় বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা (যেমন আলজেরিয়ায় তুরস্ক এখন ফ্রান্সের চেয়েও বেশি বিনিয়োগকারী)।

২০২৫ সাল নাগাদ আফ্রিকায় তুরস্কের মোট সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় $১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশেপাশে থাকতে পারে। অথচ ২০২৩ সালেই আফ্রিকায় চীনের মোট বিনিয়োগ $২৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা যায়। এই পরিমাণের তুলনায় তুরস্কের বিনিয়োগ (প্রায় $১০ বিলিয়ন) বেশ কম, কিন্তু এটি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এবং তার সরকার আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য (আদান-প্রদান, যা কেবল বিনিয়োগ নয়) ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন।

এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক আফ্রিকান দেশগুলোকে তুরস্কের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলছে, যা আঙ্কারার কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তুরস্ক নিয়মিতভাবে 'তুর্কি-আফ্রিকা ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস ফোরাম'-এর আয়োজন করে, যেখানে হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও মন্ত্রীরা অংশ নেন, যা অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রতি আঙ্কারার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে।

অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ও কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক আফ্রিকান দেশগুলোকে তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে, যা আঙ্কারার কূটনৈতিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রভাব দুটি প্রধান উপায়ে কাজ করে:

১. ডিপ্লোম্যাটিক লিভারেজ: তুরস্ক যখন কোনো দেশে বড় অবকাঠামো বা খনি প্রকল্পে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে, তখন সেই দেশ তুরস্কের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সহজে অবস্থান নিতে পারে না। এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক আঙ্কারাকে নিরাপত্তা, সামরিক ঘাঁটি বা কৌশলগত চুক্তির বিষয়ে অতিরিক্ত কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা দেয়।

২. সহায়তা-ঋণ-বাণিজ্য চক্র: তুরস্ক মানবিক ও উন্নয়নমূলক সহায়তা দিয়ে শুরু করে, যা সম্পর্ক তৈরি করে। এরপর তারা বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ঋণ ও বিনিয়োগ দেয়। এই বিনিয়োগগুলো প্রায়শই তুরস্কের কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। এভাবে আফ্রিকান দেশগুলো তুরস্কের সাপ্লাই চেইন ও অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আলজেরিয়ার মতো উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে তুরস্ক এখন ফ্রান্সের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিকে অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সেই দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা পরিবর্তন হচ্ছে এবং তারা তুরস্কের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হচ্ছে।

তুরস্কের এই কৌশলগত ভূমিকা বৃহৎ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে প্রভাবিত করছে এবং আফ্রিকায় একটি নতুন ‘গ্রেট গেম’-এর জন্ম দিচ্ছে।

ক. আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরাশক্তির প্রতিক্রিয়া

তুরস্ক তার সামরিক নীতির মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশে চীন, রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর (বিশেষত ফ্রান্সের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি) প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। অনেক আফ্রিকান দেশ নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র ফ্রান্সের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তুরস্ককে একটি বিকল্প অংশীদার হিসেবে দেখছে। তুরস্কের ড্রোন কূটনীতি আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার একটি শক্তিশালী বিকল্প তৈরি করছে। ১৯৯৮ সালে গৃহীত 'আফ্রিকান ইনিশিয়েটিভ পলিসি' নীতির মাধ্যমে তুরস্ক শুধু সামরিক নয়, বরং বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো দৃঢ় করার মাধ্যমে আফ্রিকায় একটি দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। তবে হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত-এর মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরা সন্দেহের চোখে দেখছে।

খ. ক্ষমতার মানচিত্রের পরিবর্তন

তুরস্কের শক্তিশালী আগমন আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য একটি বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থার সুবিধা তৈরি করেছে, যেখানে তারা শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা শক্তি, চীন বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন সহযোগিতা আফ্রিকান দেশগুলোকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য একটি তৃতীয় বিকল্প দিয়েছে। এর ফলে তারা যেকোনো একক পরাশক্তির ওপর অত্যধিক নির্ভরতা কমাতে পারছে। যখন একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্র একই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করে, তখন আফ্রিকান দেশগুলো সামরিক চুক্তি, ঋণ বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও ভালো শর্তে আলোচনা করার সুযোগ পায়।

অনেক আফ্রিকান দেশের কাছে তুরস্কের সঙ্গে কাজ করা রাজনৈতিকভাবে সহজ ও কম সংবেদনশীল। তুরস্ক উন্নয়নমূলক প্রকল্প, মানবিক সহায়তা এবং শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এই ‘বন্ধুত্বের’ ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। তবে তুরস্ক নিজেকে 'ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ভারমুক্ত বন্ধু' হিসেবে দাবি করলেও, সামরিক ঘাঁটি এবং তেল চুক্তির মাধ্যমে তারা যে কৌশলী আধিপত্য দেখাচ্ছে, তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং আফ্রিকার সার্বভৌমত্বের জন্য নতুন প্রশ্নচিহ্ন সৃষ্টি করেছে। আমার ধারণা, তুরস্কের আফ্রিকান কৌশল কেবল সামরিক শক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি অর্থনৈতিক শক্তিকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদে মহাদেশটির ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে নিজেদের প্রভাব সুসংহত করার একটি সুচিন্তিত প্রচেষ্টা।

সোমালিয়া থেকে সাহারা পর্যন্ত তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি এবং কৌশলগত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আফ্রিকায় ক্ষমতার মানচিত্রকে বদলে দিচ্ছে। এটি কেবল মানবিক কূটনীতি বা সাধারণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়; এটি সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মিশ্রণে তৈরি একটি সুচিন্তিত ভূ-রাজনৈতিক নকশা। তুরস্কের এই উত্থান দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা প্রভাবকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং উদীয়মান পরাশক্তিদের সামনে একটি নতুন মডেল উপস্থাপন করছে। কিন্তু এই পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত মহাদেশটির জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক- তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে। তুরস্কের এই সামরিক পদচিহ্ন আফ্রিকার মানচিত্রে এক অমোচনীয় ছাপ ফেলেছে, যা প্রমাণ করে যে একবিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকার ভাগ্য নির্ধারণে সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থই প্রধান চালিকা শক্তি।

তুরস্কের এই 'ক্ষমতার করিডোর' তৈরির প্রচেষ্টা আফ্রিকা মহাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন; পুরাতন ঔপনিবেশিক প্রভাবের বদলে যে নতুন শক্তি আসছে, তা কি আসলেই বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে আসা আরেকটি আগ্রাসী শক্তি? এর উত্তর দেবে সময়। কিন্তু ক্ষমতার মানচিত্র বদলানোর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত