আজ কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী
স্থান, কাল ও ভাষাগত দিক থেকে ওমর খৈয়াম আমাদের একটু দূরের মানুষ ছিলেন—অথচ তাঁর নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। নজরুলই বলতে গেলে দারুণভাবে তাঁকে আমাদের কাছের মানুষ করে দিয়েছেন। কাজী নজরুলের ৪৯তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর দৃষ্টিতে ওমর খৈয়াম ও রুবাইয়াৎ নিয়ে লিখেছেন হামীম কামরুল হক।
হামীম কামরুল হক
স্থান, কাল ও ভাষাগত দিক থেকে ওমর খৈয়াম আমাদের একটু দূরের মানুষ ছিলেন—অথচ তাঁর নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। নজরুলই বলতে গেলে দারুণভাবে তাঁকে আমাদের কাছের মানুষ করে দিয়েছেন। তিনি নিজে তো আমাদের কাছের মানুষই। বাংলায় লিখেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবিও তিনি।
একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবনের স্বাদ পেতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।’ কিন্তু ‘লেখা’মাত্রই সেই স্থায়িত্ব পায় না। সবার সব লেখাও টিকে থাকার যোগ্যতা লাভ করে না। নশ্বর পৃথিবী ও জীবনে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। ‘অনিত্যতাই এই জগতের একমাত্র নিত্যতা।’—‘কথাসরিৎসাগরে’র রচয়িতা সোমদেব ভট্টই কেবল নয়, বহু বার বহু জায়গায় বহু লোকে এই সত্য কথাটি বলে গেছেন। আর, যে-সত্য সর্ব সত্যে মেলে তা-ই প্রকৃত সত্য। কথাটা মিথ্যার দিক থেকেই মিলিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ—যে-মিথ্যা সর্ব মিথ্যায় মিলে তা-ই প্রকৃত মিথ্যা।
এই মিথ্যার বিরুদ্ধে দুই কালের দুই দেশের দুজন মানুষ একই কাজ করেছেন—খৈয়াম ও নজরুল। নিজের অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’-এর ভূমিকায় স্বয়ং নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে—ভণ্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’
কথিত আছে, কান্তি ঘোষের রুবাই অনুবাদেই প্রথম এর জোয়ার তৈরি হয়, নরেণ দেব তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন, তদুপরি, কোথায় একটু অভাব থেকেই যাচ্ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘ওমরই ওমরের শ্রেষ্ঠ মল্লীনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’ বলে রাখা ভালো, তিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামে’র ভূমিকা লিখেছিলেন। তাঁর মতে, নজরুল ততটা ফারসি জানতেন না। তাঁর ধারণা, তিনিও অন্যদের মতো ইংরেজি থেকেই অনুবাদ করেছেন।
বলাবাহুল্য, নজরুল ফারসি ভাষাটি কতটা আয়ত্ত করেছিলেন—নানান জনের নানান লেখায় এর সবুত মিলবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো পাঠক ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ ও নজরুলের অনুবাদ করা খৈয়ামের রুবাইয়াৎ একটু খেয়াল করে পড়লেই বুঝবেন, যে নজরুল ইংরেজি অনুবাদের ধারে কাছ দিয়েও যাননি। বরং তিনি ছাড়া অন্যদের অনুবাদই ‘ফিটজেরাল্ডের মুখে ঝাল খাওয়া।’
খৈয়ামের প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে দুশোর কাছাকাছি রুবাই নজরুলই অনুবাদ করেছেন। মোট ১৯৭টি। তাঁর অনূদিত ১-৩১ রুবাই ১৩৪০ কার্তিকের, ৩২-৪৬ সংখ্যক রুবাই ১৩৪০ অগ্রহায়ণের এবং ৪৭-৫৯ সংখ্যক রুবাই পৌষের মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আমরা এই দুজন কবির মেজাজমর্জি খেয়াল করলেই দেখব, দুজনেই যাঁর যাঁর যুগের ‘বিদ্রোহী ভৃগু’। ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার হিম্মত ছিল দুজনেরই। সামাজিক অনাচার অবিচারে বিরুদ্ধে দুজনের লড়াই ছিল প্রখর ও অপ্রতিরোধ্য। ওমর লড়েছেন তাঁর সময়ের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নজরুলও তা-ই। তবে নজরুলের আরেক বিরুদ্ধ-শক্তি ছিল বিদেশি সরকার। এছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংস্কৃতবান-মোল্লা-পুরুতদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
ফলে নজরুলের হাতেই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের সার্থক অনুবাদ হবে—সেটিই স্বাভাবিক ছিল। তবে নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিট্জেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়ত আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব—সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।’
উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করার মতো; তাঁর বিনয় তো বটেই, কবিতা ও সংগীত নিয়ে নিজের মতও আছে; সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সামর্থ্যের প্রতি বিপুল আস্থা, আর জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ওমর খৈয়ামকে উল্লেখ করা।
নজরুল ওমর খৈয়ামকে কতটা ভেতর থেকে জেনেছেন, সেটি তাঁর নিজের ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামে’র ভূমিকা পড়লেই যেকোনো পাঠক স্পষ্টভাবে টের পাবেন। আর ফারসি ভাষা জানা? তাঁর নিজের চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন মস্ত ফারসিবেত্তা। ফলে তাঁর পারিবারিক আবহের ভেতরেই ফারসি ছিল।
মুজফ্ফর আহমদের কাছ থেকে আমরা জানি যে, শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুলের দ্বিতীয় ভাষা ছিল ফারসি। হাফিজ নূরন্নবী নামে সেখানে ভালো একজন শিক্ষক তিনি পেয়েছিলেন। এছাড়াও পল্টনে যোগদান করার পর সেখানে এক পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে তিনি কবি হাফিজের কাব্য পড়েছেন। ফলে হাফিজের কবিতাগুলি যেমন তিনি মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন, তেমনি ফারসিসূ্ত্রে অনুবাদ করেছিলেন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতগুলিও।
নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।...তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।’
ওমর কবিতা লিখেছেন। আমরা সেই কবিতা পড়ে আনন্দ পাই। নিজেকে তিনি যতই ‘তত্ত্ব-গুরু’ বলুন, নজরুলেরও রস-পিপাসা মিটেছে এসব কবিতা পড়ে। কবিতায় শব্দ প্রচলিত অর্থ ছেড়ে বিচিত্রমাত্রায় দেখা দেয়। জমে ওঠে রহস্য। খৈয়াম সুরা, সাকি, শারাবসহ আরও যা যা শব্দ ব্যবহার করেছেন—এসবের শাব্দিক অর্থ করতে যারা যাবেন, তারা আদতে সাহিত্যের লীলা থেকে বঞ্চিতই হবেন।
সাহিত্য জীবনের অকপট ভাষ্য নয়। আবার কপট ভাষ্যও নয়। সাহিত্য লীলালাস্যে পরিপূর্ণ জীবনরহস্যের আগার। আমোদ-অস্বস্তি-অপূর্ণ অসংখ্য তাড়না আড়মোড়া ভাঙে সাহিত্যে। যে কারণে একে অবলীলায় পড়ার কথা যারা ভাবেন—তারা গোঁড়াতেই ভুল করেন। যখন বলা হয়, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’
একালে দূরের বাদ্যকে যদি দূরের সাহিত্য ধরে এগুই, তাহলে ফাঁকের বদলে লাভের কথাটাই ভাবতে হয়। একে ইহকাল-পরকালের ব্যাখ্যায়, কি বস্তুগত ও অবস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাখ্যায়ও নেওয়া যায়। এই যে একই কথার অনেক দিকে নেওয়ার, অনেক দিকে যাওয়ার ক্ষমতা, সামর্থ্য—একেই বলি, সাহিত্যের লীলা। আর অবলীলায় যা পড়া যায় ও লেখা যায়, তাতে লীলা থাকে না। ফলে সাহিত্য-রসও পাওয়া যায় না।
যা স্পষ্ট সরাসরি, যাতে কোনো রাখঢাক নেই, তা কতটা সাহিত্য—এই নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। সেই তর্ক রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম পড়তে গিয়ে আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। তাতে নজরুল অনূদিত খৈয়ামের রুবাইগুলি কেবল রসেরই নয়, বোধেরও বৈদূর্যমণি হয়ে ওঠে।
স্থান, কাল ও ভাষাগত দিক থেকে ওমর খৈয়াম আমাদের একটু দূরের মানুষ ছিলেন—অথচ তাঁর নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। নজরুলই বলতে গেলে দারুণভাবে তাঁকে আমাদের কাছের মানুষ করে দিয়েছেন। তিনি নিজে তো আমাদের কাছের মানুষই। বাংলায় লিখেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবিও তিনি।
একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবনের স্বাদ পেতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।’ কিন্তু ‘লেখা’মাত্রই সেই স্থায়িত্ব পায় না। সবার সব লেখাও টিকে থাকার যোগ্যতা লাভ করে না। নশ্বর পৃথিবী ও জীবনে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। ‘অনিত্যতাই এই জগতের একমাত্র নিত্যতা।’—‘কথাসরিৎসাগরে’র রচয়িতা সোমদেব ভট্টই কেবল নয়, বহু বার বহু জায়গায় বহু লোকে এই সত্য কথাটি বলে গেছেন। আর, যে-সত্য সর্ব সত্যে মেলে তা-ই প্রকৃত সত্য। কথাটা মিথ্যার দিক থেকেই মিলিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ—যে-মিথ্যা সর্ব মিথ্যায় মিলে তা-ই প্রকৃত মিথ্যা।
এই মিথ্যার বিরুদ্ধে দুই কালের দুই দেশের দুজন মানুষ একই কাজ করেছেন—খৈয়াম ও নজরুল। নিজের অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’-এর ভূমিকায় স্বয়ং নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে—ভণ্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’
কথিত আছে, কান্তি ঘোষের রুবাই অনুবাদেই প্রথম এর জোয়ার তৈরি হয়, নরেণ দেব তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন, তদুপরি, কোথায় একটু অভাব থেকেই যাচ্ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘ওমরই ওমরের শ্রেষ্ঠ মল্লীনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’ বলে রাখা ভালো, তিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামে’র ভূমিকা লিখেছিলেন। তাঁর মতে, নজরুল ততটা ফারসি জানতেন না। তাঁর ধারণা, তিনিও অন্যদের মতো ইংরেজি থেকেই অনুবাদ করেছেন।
বলাবাহুল্য, নজরুল ফারসি ভাষাটি কতটা আয়ত্ত করেছিলেন—নানান জনের নানান লেখায় এর সবুত মিলবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো পাঠক ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ ও নজরুলের অনুবাদ করা খৈয়ামের রুবাইয়াৎ একটু খেয়াল করে পড়লেই বুঝবেন, যে নজরুল ইংরেজি অনুবাদের ধারে কাছ দিয়েও যাননি। বরং তিনি ছাড়া অন্যদের অনুবাদই ‘ফিটজেরাল্ডের মুখে ঝাল খাওয়া।’
খৈয়ামের প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে দুশোর কাছাকাছি রুবাই নজরুলই অনুবাদ করেছেন। মোট ১৯৭টি। তাঁর অনূদিত ১-৩১ রুবাই ১৩৪০ কার্তিকের, ৩২-৪৬ সংখ্যক রুবাই ১৩৪০ অগ্রহায়ণের এবং ৪৭-৫৯ সংখ্যক রুবাই পৌষের মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আমরা এই দুজন কবির মেজাজমর্জি খেয়াল করলেই দেখব, দুজনেই যাঁর যাঁর যুগের ‘বিদ্রোহী ভৃগু’। ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার হিম্মত ছিল দুজনেরই। সামাজিক অনাচার অবিচারে বিরুদ্ধে দুজনের লড়াই ছিল প্রখর ও অপ্রতিরোধ্য। ওমর লড়েছেন তাঁর সময়ের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নজরুলও তা-ই। তবে নজরুলের আরেক বিরুদ্ধ-শক্তি ছিল বিদেশি সরকার। এছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংস্কৃতবান-মোল্লা-পুরুতদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
ফলে নজরুলের হাতেই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের সার্থক অনুবাদ হবে—সেটিই স্বাভাবিক ছিল। তবে নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিট্জেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়ত আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব—সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।’
উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করার মতো; তাঁর বিনয় তো বটেই, কবিতা ও সংগীত নিয়ে নিজের মতও আছে; সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সামর্থ্যের প্রতি বিপুল আস্থা, আর জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ওমর খৈয়ামকে উল্লেখ করা।
নজরুল ওমর খৈয়ামকে কতটা ভেতর থেকে জেনেছেন, সেটি তাঁর নিজের ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামে’র ভূমিকা পড়লেই যেকোনো পাঠক স্পষ্টভাবে টের পাবেন। আর ফারসি ভাষা জানা? তাঁর নিজের চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন মস্ত ফারসিবেত্তা। ফলে তাঁর পারিবারিক আবহের ভেতরেই ফারসি ছিল।
মুজফ্ফর আহমদের কাছ থেকে আমরা জানি যে, শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুলের দ্বিতীয় ভাষা ছিল ফারসি। হাফিজ নূরন্নবী নামে সেখানে ভালো একজন শিক্ষক তিনি পেয়েছিলেন। এছাড়াও পল্টনে যোগদান করার পর সেখানে এক পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে তিনি কবি হাফিজের কাব্য পড়েছেন। ফলে হাফিজের কবিতাগুলি যেমন তিনি মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন, তেমনি ফারসিসূ্ত্রে অনুবাদ করেছিলেন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতগুলিও।
নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।...তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।’
ওমর কবিতা লিখেছেন। আমরা সেই কবিতা পড়ে আনন্দ পাই। নিজেকে তিনি যতই ‘তত্ত্ব-গুরু’ বলুন, নজরুলেরও রস-পিপাসা মিটেছে এসব কবিতা পড়ে। কবিতায় শব্দ প্রচলিত অর্থ ছেড়ে বিচিত্রমাত্রায় দেখা দেয়। জমে ওঠে রহস্য। খৈয়াম সুরা, সাকি, শারাবসহ আরও যা যা শব্দ ব্যবহার করেছেন—এসবের শাব্দিক অর্থ করতে যারা যাবেন, তারা আদতে সাহিত্যের লীলা থেকে বঞ্চিতই হবেন।
সাহিত্য জীবনের অকপট ভাষ্য নয়। আবার কপট ভাষ্যও নয়। সাহিত্য লীলালাস্যে পরিপূর্ণ জীবনরহস্যের আগার। আমোদ-অস্বস্তি-অপূর্ণ অসংখ্য তাড়না আড়মোড়া ভাঙে সাহিত্যে। যে কারণে একে অবলীলায় পড়ার কথা যারা ভাবেন—তারা গোঁড়াতেই ভুল করেন। যখন বলা হয়, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’
একালে দূরের বাদ্যকে যদি দূরের সাহিত্য ধরে এগুই, তাহলে ফাঁকের বদলে লাভের কথাটাই ভাবতে হয়। একে ইহকাল-পরকালের ব্যাখ্যায়, কি বস্তুগত ও অবস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাখ্যায়ও নেওয়া যায়। এই যে একই কথার অনেক দিকে নেওয়ার, অনেক দিকে যাওয়ার ক্ষমতা, সামর্থ্য—একেই বলি, সাহিত্যের লীলা। আর অবলীলায় যা পড়া যায় ও লেখা যায়, তাতে লীলা থাকে না। ফলে সাহিত্য-রসও পাওয়া যায় না।
যা স্পষ্ট সরাসরি, যাতে কোনো রাখঢাক নেই, তা কতটা সাহিত্য—এই নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। সেই তর্ক রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম পড়তে গিয়ে আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। তাতে নজরুল অনূদিত খৈয়ামের রুবাইগুলি কেবল রসেরই নয়, বোধেরও বৈদূর্যমণি হয়ে ওঠে।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিম বাংলায়। মাঝেমধ্যে তিনি পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের আগে সেই আসা স্থায়ীভাবে তো ছিলেনই না, এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো দীর্ঘ দিনের জন্যও কখনো বাংলাদেশে থাকেননি।
৭ ঘণ্টা আগেচুক্তিতে আসলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, সেই স্বীকৃতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি বাংলাদেশের একমাত্র দাবি ছিল না। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং ১৯৭১-এর আগে যৌথ সম্পদের ন্যায্য অংশও বাংলাদেশের দাবি ছিল।
১৭ ঘণ্টা আগে২০২৫ সালের আগস্টে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি ও আশেপাশের এলাকা থেকে সব পথকুকুর সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আদেশটি দুই সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর করতে বলা হয়েছিল। এই আদেশই জন্ম দেয় ‘কুকুর বাঁচাও’ আন্দোলনের।
১ দিন আগে২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। এখনো এটি এক বৈশ্বিক অভিযান, যার উদ্দেশ্য হলো কথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’ দমন।
১ দিন আগে