leadT1ad

সর্বমিত্রের ‘লাঠির শাসন’, ডাকসুর ভূমিকা কি বদলে যাচ্ছে

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৫৩
লাঠি হাতে সর্বমিত্র চাকমা। আলোচিত ভিডিও থেকে নেওয়া একটি দৃশ্য

হেমন্তের রাত। হালকা হিম পড়ছে আকাশ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জাতীয় বার্ন ইউনিটের ১ নম্বর গেটের বিপরীতের ফুটপাতে পোটলা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন এক বৃদ্ধ। কিন্তু নিরপরাধ ঘুমের স্পর্শ পাওয়ার আগেই উদ্ধত লাঠির দেখা পেলেন তিনি। কয়েকজন তরুণ লাঠি হাতে বৃদ্ধকে শাসাতে লাগলেন সেখান থেকে উঠে যাওয়ার জন্য।

এই দৃশ্যসম্বলিত ভিডিও এখন ফেসবুকে ভাইরাল। ঘটনাটি গতকাল মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) রাতে। আর যে তরুণদের দেখা গেছে, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য সর্বমিত্র চাকমা।

সর্বমিত্র দাবি করেছেন, ওই বৃদ্ধ মাদকাসক্ত। তাঁকে এর আগেও ক্যাম্পাস থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি তোয়াক্কা করেননি। সর্বমিত্র আরও দাবি করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেমুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ‘মিটিং করেই’ কাজটি করেছেন।

ফলে গতকাল রাতের ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং ছাত্র রাজনীতির নৈতিক কাঠামোয় পচন ধরানোর একটি তীব্র প্রতীকী উপস্থাপন। সর্বমিত্রের উদ্ধত লাঠি শুধু একজন বৃদ্ধের শরীরের দিকেই তেড়ে যায়নি, বরং তা চোখ রাঙিয়েছে আমাদের সংবিধান, মানবিকতা এবং ছাত্র রাজনীতির ঐতিহাসিক মহিমাকেই।

সর্বমিত্রের লাঠি আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্রিক পুরাণের একচক্ষু দানব সাইক্লোপসকে। যার চোখ কেবল শক্তি ও ধ্বংস দেখে, প্রজ্ঞা দেখে না। গতকাল রাতের ঘটনায় আমরা দেখলাম, ডাকসুর সদস্য পদ অর্জনের পর সর্বমিত্রের ভেতরে প্রজ্ঞা নয়, উন্মত্ত শক্তিই তেড়েফুঁড়ে জেগে উঠেছে। অথচ ক্ষমতার প্রাথমিক শর্ত হওয়া উচিত ছিল আত্মসংযম এবং দুর্বলকে রক্ষা করা।

মহান দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আদর্শ শাসকের যে ধারণা দিয়েছিলেন, তা ছিল জ্ঞান, ন্যায় ও আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক। তাদের কাজ ছিল সমাজকে রক্ষা করা, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রনেতাদের উদ্ধত লাঠি প্রমাণ করে, শাসক নিজেই আইনের সীমানা পেরিয়ে ‘নির্বাহী জল্লাদ’-এর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো। কোনো আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বা গণ-আদালতে পরিণত হওয়া ডাকসুর উদ্দেশ্য নয়।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—এই ক্ষমতার উৎস কী? এর উৎস কি জনগণের আস্থা, নাকি একটি ‘প্রিভিলেজড এলিট’ হওয়ার ভ্রান্ত ধারণা, যে ধারনাটি বিচারবহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়?

আইনজীবীরা বলছেন, সর্বমিত্র চাকমার এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি আইন অনুযায়ী অপরাধ।

এছাড়া দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৩২৩ এবং ধারা ৩২৫ অনুযায়ী এই অপরাধ শাস্তিযোগ্য । মাদকাসক্ত সন্দেহে কাউকে লাঠি দিয়ে প্রহার করা কখনোই আত্মরক্ষার আওতায় পড়ে না।

কোনো নাগরিক আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না, এ কথা সর্বমান্য। মাদকাসক্ত বা অপরাধী সন্দেহ হলে পুলিশকে খবর দেওয়াই একমাত্র আইনসম্মত পথ।

একজন দুর্বল, বয়স্ক মানুষকে এভাবে লাঠি দিয়ে শাসিয়ে তুলে দেওয়া সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এই কাজটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ‘বিচারবহির্ভূত শাস্তির সংস্কৃতিকে’ উৎসাহিত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো। কোনো আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বা গণ-আদালতে পরিণত হওয়া ডাকসুর উদ্দেশ্য নয়।

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, এটি ছাত্রদের শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মানোন্নয়নে কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্ব এটি কোনোভাবেই নিজের হাতে নিতে পারে না।

সর্বমিত্রের এই ঘটনা প্রমাণ করে, ডাকসুর মতো একটি প্রতিষ্ঠান তার ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট এবং সাংগঠনিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। যখন একজন ছাত্রনেতা তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অন্যের ওপর শারীরিক শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে হবে এই সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতা গভীর সংকটে। যে ডাকসু নেতারা স্বৈরাচারী শাসকদের লাঠির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ডাকসুর সদস্যের হাতের লাঠিই যখন অসহায় মানুষের ওপর উদ্ধত হয়, তখন সন্দেহ থাকে না যে, সেই ‘বাতিঘরের শিখা’ নিভে গেছে।

ঘটনার পর সর্বমিত্র চাকমা যুক্তি দিচ্ছেন, তিনি টিএসসি এলাকার মাদকাসক্তদের উৎপাত কমানো এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার ‘সদিচ্ছা’ থেকেই এমনটি করেছেন। তিনি দাবি করছেন, স্থানীয় প্রশাসন এই বিষয়ে উদাসীন ছিল, তাই তিনি বাধ্য হয়েছেন।

মাদকাসক্তদের সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য মহৎ হতে পারে, কিন্তু সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য শারীরিক নির্যাতন কোনো সভ্য সমাজ অনুমোদন দেয় না।

লাঠির শাসনের এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে দীর্ঘমেয়াদী পরিণতির দিকেই ঠেলে দেবে। এই ঘটনা সাধারণ মানুষ এবং টিএসসি এলাকার দুর্বল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভয় ও অসহায়ত্বের জন্ম দেবে। মানুষ আর ন্যায়বিচারের জন্য প্রশাসনের কাছে না গিয়ে ক্ষমতার ভয়ে নীরব থাকবে।

যদি প্রশাসন ব্যর্থ হয়ও, একজন দায়িত্বশীল ছাত্রনেতার কাজ হলো প্রশাসনকে প্রশ্ন করা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নয়।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত নিন্দা জানায় এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে শুধুমাত্র নিন্দা জানানো যথেষ্ট নয়। এই ধরনের ঘটনা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য এবং প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।

যাইহোক, লাঠির শাসনের এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে দীর্ঘমেয়াদী পরিণতির দিকেই ঠেলে দেবে। এই ঘটনা সাধারণ মানুষ এবং টিএসসি এলাকার দুর্বল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভয় ও অসহায়ত্বের জন্ম দেবে। মানুষ আর ন্যায়বিচারের জন্য প্রশাসনের কাছে না গিয়ে ক্ষমতার ভয়ে নীরব থাকবে। এই পদক্ষেপ সমাজে এই ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠা করে যে, ‘ক্ষমতা থাকলে সবকিছু করা যায়’। ফলে, দিনশেষে এটি কেবল একজন ব্যক্তি বা ছাত্র সংগঠনকে নয়, বরং পুরো সমাজকে সহিংস করে তুলবে।

মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এর সমাধান প্রহার বা নির্যাতন নয়, বরং চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং মানবিক সহায়তা। একজন ছাত্রনেতার কাছ থেকে আশা করা হয়, তিনি পুনর্বাসনের পক্ষে কথা বলবেন, লাঠির পক্ষে নয়।

সর্বমিত্র চাকমার এই কাজটি কেবল একটি ব্যক্তিগত ভ্রান্তি নয়, এটি আমাদের ছাত্র রাজনীতির ঐতিহাসিক বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করে। ছাত্রনেতাদের মনে রাখতে হবে, তাদের ভূমিকা হলো সমাজকে মুক্তচিন্তা, ন্যায় ও সমতার পথে চালিত করা। যদি তারা নিজেরাই আইনের পথ ছেড়ে লাঠির শাসন শুরু করেন, তবে তারা কেবল একজন নিরপরাধ বৃদ্ধকে প্রহার করেন না, তারা আঘাত করেন রাষ্ট্রচেতনার মূলে।

লেখক:
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত