leadT1ad

বাংলাদেশে কি নারীর ফাঁসি হয়?

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ২০
ফাঁসির প্রতীকী ছবি। স্ট্রিম গ্রাফিক

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হলেন, প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী যিনি ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেলেন আবার তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পলাতক আছেন। পাশাপাশি আরও একটি বিষয়েও শেখ হাসিনা প্রথম হতে পারেন। যদি কোনোদিন এই রায় কার্যকর হয়, তবে তা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর হওয়া।

বাংলাদেশে কি নারীর ফাঁসি হয়? ইতিহাস বলে, ‘না’। স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫৪ বছরে বহু নারীকে খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জল্লাদের মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছায়নি একজনও। শেষবার এই বাংলার মাটিতে কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল প্রায় ৯০ বছর আগে, ১৯৩৭ সালে। সেবার ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেটে করিমুন্নেসা নামের এক নারীকে স্বামী হত্যার দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

তারপর থেকে এক অদৃশ্য রক্ষাকবচ যেন এদেশের দণ্ডিত নারীদের জল্লাদের দড়ি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এরপর শেখ হাসিনার রায় কি সেই রক্ষাকবচকে ছিন্নভিন্ন করে দিল? কারণ তাঁর অপরাধ কোনো পারিবারিক কলহ, ব্যক্তিগত আক্রোশ বা বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়। তাঁর অপরাধ হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংঘটিত গণহত্যা। এই রায় তাই প্রশ্ন তুলেছে: একজন নারী যখন মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন কি লিঙ্গগত পরিচয় তাঁর অপরাধ লঘু করতে পারে?

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের আদালত বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে নারীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যেমন চট্টগ্রামের শাহিন আক্তার স্বামীকে বিষ দিয়ে হত্যার দায়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন; রংপুরের রওশন আরা বেগম ধর্ষণ-হত্যায় সহযোগিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন; কিংবা ফেনীতে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধে জড়িত সুমি আক্তার। তাদের সবার জন্যই আদালতের চূড়ান্ত রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর মতো কঠোর আইনে অ্যাসিড নিক্ষেপে হত্যার মতো অপরাধেও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের অনেকে নারীরই ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে থমকে গেছে। আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা, কিংবা দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকরে সেই দণ্ডাদেশ আর কার্যকর হয়নি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর মতো কঠোর আইনে অ্যাসিড নিক্ষেপে হত্যার মতো অপরাধেও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের অনেকে নারীরই ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে থমকে গেছে।

এর পেছনে কি কাজ করছে? সম্ভবত কাজ করেছে এক জটিল সামাজিক মনস্তত্ত্ব। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে ‘দুর্বল’, ‘আবেগপ্রবণ’ এবং পুরুষের দ্বারা প্রভাবিত হিসেবে দেখার এক প্রবণতা রয়েছে। জল্লাদের মঞ্চে একজন নারীর ঝুলন্ত দেহ দেখার ধারণাটি সমাজের গভীরে প্রোথিত ‘নারীত্বের’ ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি এক ধরনের ‘অলিখিত বিধান’। রাষ্ট্র যেন তার নারী নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে নীতিগতভাবে কুণ্ঠিত। এই প্রেক্ষাপটে কাছাকাছি সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মামলা ছিল ফেনীর নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ড (২০১৯)। সেই মামলায় দুইজন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই রায়ও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

এই প্রতিটি ঘটনাই প্রমাণ করে, অপরাধের ভয়াবহতা সত্ত্বেও, অপরাধীর লিঙ্গপরিচয় বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে একটি অদৃশ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার বিষয়টি ভিন্ন।

কেন ভিন্ন? কেন তার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের আইনি ও সামাজিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে? এর উত্তর নিহিত রয়েছে তার অপরাধের প্রকৃতি এবং তার পরিচয়ের মধ্যে। প্রথম করিমুন্নেসা থেকে শুরু করে শাহিন আক্তার পর্যন্ত অন্য নারীদের অপরাধ ছিল ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু শেখ হাসিনার অপরাধ ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’। এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে তাঁর সরাসরি নির্দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। শেখ হাসিনার অপরাধ কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ নয়। এটি ছিল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য একটি পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথার গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আইন বলে, এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীর লিঙ্গ, বয়স বা সামাজিক অবস্থান কোনোভাবেই বিবেচ্য হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা কেবল একজন নারী নন। তিনি ছিলেন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তার নির্দেশেই ‘চেইন অব কমান্ড’ সক্রিয় হয়েছিল। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রাজসাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দি সেই সত্যকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে। তিনি একজন নারী হিসেবে নয়, ‘গুলি করার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। তাই তাঁর দায়ও সর্বোচ্চ। এখানে নারীত্বের ‘দুর্বলতা’র যুক্তি খাটানোর কোনো সুযোগ নেই।

এছাড়া পূর্ববর্তী উল্লেখিত মামলাগুলোতে নারীর সাজার ক্ষেত্রে সামাজিক সহানুভূতি বা রাজনৈতিক বিবেচনার একটি সুযোগ ছিল। কিন্তু জুলাই গণহত্যার শিকার হাজারো পরিবার এবং দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে শেখ হাসিনা একজন গণহত্যাকারী স্বৈরাচার। তাঁর প্রতি মানুষের কোনো সামাজিক সহানুভূতি নেই, বরং রয়েছে তীব্র ঘৃণা।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়টি তাঁর পলাতক অবস্থায় দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন ভারতে আশ্রিত। তাই এই রায় কার্যকর হওয়া এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের উপর নির্ভরশীল। যদি কোনোদিন এই রায় কার্যকর হয়, তবে তা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারীর ফাঁসি।

এই রায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে এক নতুন পথে চালিত করার সম্ভাবনা আছে। এখানে অপরাধীর একমাত্র পরিচয় হবে তার অপরাধ, তার লিঙ্গ নয়। এটি ভবিষ্যৎ শাসকদের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা—রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মানে নিরঙ্কুশ হত্যাযজ্ঞের লাইসেন্স নয়।

লেখক:
গবেষক

Ad 300x250

সম্পর্কিত