(এই লেখাটি শামারুহ মির্জার একটি সাক্ষাৎকারের কিছু চুম্বক অংশ। সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটির লিংক নিচে দেওয়া আছে।)
খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম যখন দেখা হয়, তখন আমি নিতান্তই শিশু। আমার দাদা এবং আব্বার চাচা—দুজনই তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই সুবাদে তিনি প্রায়ই ঠাকুরগাঁওয়ে আসতেন। কখনোবা ঠাকুরগাঁও হয়ে পঞ্চগড় যেতেন। তেমনই এক সময়ের কথা। সম্ভবত এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। ঠাকুরগাঁওয়ের এক রেস্ট হাউজে আব্বু আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে আমরা রুমে ঢুকলাম। দেখলাম তিনি গেস্ট হাউজের সাধারণ একটি সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন। কিন্তু আমার শিশুমনে মনে হলো, পুরো ব্যাপারটার মধ্যে এক রাজকীয় আবহ রয়েছে। তিনি যখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, সেই মুহূর্তটিকে আমার কাছে কোনো সাধারণ ঘটনা মনে হয়নি। মনে হয়েছিল— কোথাও যেন একটা ম্যাজিক হয়ে গেল! সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘর যেন আলোয় ভরে উঠল। তিনি আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওইটুকু বয়সে সেই জাদুকরী মুহূর্তটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, যা আমি আজও ভুলিনি।
তার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় অনেক বছর পর। সম্ভবত ২০১২ বা ২০১৩ সালে। তখন আমার আব্বা (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর), ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মির্জা আব্বাসসহ দলের অনেক বড় বড় নেতা জেলে। আমি আর আমার ছোট বোন তখন মন খারাপ করে তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম দেখা করতে। আমাদের দেখামাত্রই যেন মুহূর্তের মধ্যে তিনি একজন অভিভাবক হয়ে উঠলেন। তিনি আমাদের জন্য চা দিতে বললেন। অভয় দিয়ে বললেন, ‘তোমরা এত চিন্তা করছ কেন? আমরা তো আছি।’ তিনি সচেতনভাবেই চেষ্টা করছিলেন যাতে আমাদের মন খারাপ না থাকে। এমনকি পাশে থাকা শিমুল বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে মজা করে বললেন, ‘তোমাদের বাবারা তো জেলের মধ্যে বেশ ভালোই আছে, সবাই মিলে চা-নাস্তা খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। বাইরে থাকলে তো এত রেস্ট পায় না।’ কঠিন সময়েও মানুষকে মানসিকভাবে শক্তি জোগানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর মধ্যে দেখেছি।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও বেগম খালেদা জিয়াকে আমি সব সময় এক অনন্য উচ্চতায় দেখি। বাংলাদেশ কখনোই খুব বেশি উদার বা ‘আলট্রা লিবারেল’ ছিল না। বরং এখানে সবসময়ই রক্ষণশীলতার একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় ছিল। বেগম খালেদা জিয়া সেই গণ্ডি বা নিজের রক্ষণশীলতা বজায় রেখেই নারীদের জন্য এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি যখন মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করলেন, তখন আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথমেই মেয়েদের জন্য এমন একটি পদক্ষেপ নিলেন। ব্যাপারটা আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। আমার দৃষ্টিতে তিনি একজন সত্যিকারের বিপ্লবী নারী।
বাংলাদেশে অনেক প্রখ্যাত নারীবাদী আছেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া যখন বারবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন, তখন তাদের জোরালো কোনো প্রতিবাদ করতে দেখিনি। এমনকি সংসদে যখন তাকে অশ্লীলভাবে আক্রমণ করা হলো, তথাকথিত নারীবাদী গবেষকরাও তখন চুপ ছিলেন। অথচ বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নারী জাগরণের প্রকৃত বাতিঘর।
তবে তাঁর ক্যারিয়ারের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে, তা হলো—দেশ ছেড়ে না যাওয়ার ইস্পাতকঠিন সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের মানুষ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে খুব দুর্ভাগা, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নেতা এ দেশে খুব কমই এসেছেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি এই মাটিরই নেতা। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার সামনে দেশ ছাড়ার সুযোগ ছিল, তিনি যাননি। এমনকি শেষবার লন্ডন থেকে ফেরার সময় তিনি জানতেন যে দেশে ফিরলেই তাকে জেলে যেতে হবে, অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হবে। সব জেনেও তিনি ফিরে এসেছেন।
গত ১৫ বছর ধরে জেল-জুলুম সহ্য করেও তিনি দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশ ত্যাগ না করার এই যে মানসিকতা, এটাই তাকে বাংলাদেশের অন্য সকল নেতার চেয়ে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে।
শামারুহ মির্জা: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বড় মেয়ে
ইউটিউব লিংক - https://www.youtube.com/watch?v=sjd65aQq7y8