বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে একথা বলা যায় যে, বিশ্ব এক অস্থির সময়ে মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় কোন্দল, ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দেশে দেশে ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের ফলে রক্ষণশীল নীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিকে এক নাজুক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই খাতে বিনিয়োগের উলম্ফন। উন্নত দেশে হাইটেক কোম্পানিগুলো এআই অবকাঠামোতে এতবেশি বিনিয়োগ করেছে যা বিনিয়োগকারীদের মনে এক আকাশচুম্বী প্রত্যাশার জন্ম দিয়ছে। ফলে এইসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে অভাবনীয় হারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের নভেম্বরে চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের মোট আয়ের প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশই এসেছে এআই কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধি থেকে।
এছাড়াও, মোট মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধির ৯০ শতাংশই করেছে এআই কোম্পানি। শুধু তাই নয়, বিশ্ব পুঁজিবাজার সূচকের (এমএসসিআই, যা বিশ্বের বড় এবং মাঝারি আকারের এক হাজার তিনশো কোম্পানি’র শেয়ারের দাম নিয়ে গঠিত) এক পঞ্চমাংশ দখল করে আছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি (এনভিডিয়া, মাইক্রোসফ্ট, অ্যাপল, অ্যালফাবেট এবং অ্যামাজন)। এই পাঁচটি কোম্পানি’র সাথে মেটা আর টেসলা মিলে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ বা ‘অসাধারণ সাত’ কোম্পানির ধারণা তৈরি হয়েছে’ যাদের দখলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পুজিবাজারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পুঁজি।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এআই কোম্পানির প্রকৃত আয়ের তুলনায় বর্তমান দাম অনেক বেশি। নোবেল অর্থনীতিবিদ রবার্ট শিলার’-এর মূল্য-আয় অনুপাত (কোম্পানির বর্তমান মূল্যকে বিগত ১০ বছরে মুদ্রাস্ফীতি-সমন্বিত আয়ের গড় দিয়ে ভাগ করে) ইতিমধ্যে ৪০ গুণিতক অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এআই কোম্পানির বর্তমান বাজার তার গত ১০ বছরের গড় আয়ের ৪০ গুণ।
তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অনুপাত ১৭ থেকে ২৮ এর মধ্যে হলে কাম্য মনে করা হয়। তবে এই অনুপাত যখন ৩০ অতিক্রম করে, তখন সেই বাজারকে অতিমূল্যয়িত বা কোন নির্দিষ্ট শেয়ারকে অতিমূল্যয়িত শেয়ার হিসেবে ধরা হয়। ২০০০ সালে ডটকম বুদবুদ ধসের পর মূল্য-আয় অনুপাতের এতো উলম্ফন এবারই প্রথম।
বাজারের এই উলম্ফন প্রত্যক্ষ করে অনেক প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে, এআই-সম্পর্কিত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর অধিক ব্যয় পুঁজিবাজারে ইতিমধ্যে একটি বাবল বা বুদবুদ তৈরি করেছে। যেমন, ওপেনএআই-এর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বর্তমান বাজারের পরিস্থিতিকে ১৯৯০-দশকের ডটকম উত্থানের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এআই কোম্পানির বিনিয়োগ এবং আয়ের প্রত্যাশা কিছুটা অতিরঞ্জিত। একই অভিমত প্রকাশ করেছেন মেটা’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘জেপি মর্গান চেজ’-এর প্রধান নির্বাহী জেমি ডাইমন বলেছেন, আগামী ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে এআই কোম্পানির শেয়ার দামের একটা বিশাল পতন আসন্ন।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যখন অল্প কয়েকটি কোম্পানি বাজারের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তখন পুঁজিবাজার প্রায়শই খারাপের ধিকে ধাবিত হয়। এছাড়াও, বাজারের উত্থান যদি ঋণের টাকায় হয়, তবে তার পরিণতি হয় আরও ভয়াবহ।
১৯২৯ সালের মহামন্দা এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট—উভয়ই অতিরিক্ত ঋণ করে বিনিয়োগের কারণে ঘটেছিল। ২০০৮ সালের সংকটের মূলে ছিল এমন সব বিনিয়োগের উপকরণ যেগুলোর ঋণমান সঠিকভাবে নির্ণয় সমসাময়িক প্রযুক্তির সামর্থ্যের মধ্যে ছিলনা। বর্তমান পরিস্থিতিও অনেকটা একই রকম—অস্বচ্ছতা এবং পুরো ব্যবস্থা জুড়ে অতিরিক্ত ঋণ (ব্যাংক থেকে শুরু করে প্রাইভেট ক্রেডিট এবং ক্রিপ্টো মার্কেট পর্যন্ত)।
এআই প্রযুক্তি এতো দ্রুত এগোচ্ছে যে এর প্রভাবে অর্থনীতির পুরনো অনেক খাত বদলে যেতে বাধ্য হচ্ছে বা একেবারেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা প্রযুক্তি বিনিয়োগকারীদের একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। হয় তাঁরা স্রোতে গা না ভাসিয়ে এআই খাতে বিনিয়োগের হাতছানি থেকে দূরে সরে থাকবে (যেমনটা করছে অ্যাপল), অথবা এআই খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে লাভ করার পথ খুঁজে বের করবে, যেমনটা করছে গুগল, মেটা, মাইক্রোসফ্ট এবং অ্যামাজন।
মাইক্রোসফট ও মেটা তাদের মোট বিক্রির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন বিনিয়োগ করছে এআই খাতে। মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে ধরলে, এআই অবকাঠামোতে এই ব্যয় ইতিমধ্যেই ডটকম বুদবুদের সময় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট অবকাঠামোতে ব্যয়কে অতিক্রম করে এখনো বেড়েই চলছে। যদি এআই প্রযুক্তির বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় এই বিপুল খরচের সাথে পাল্লা দিয়ে না বাড়ে, তবে ডাটা সেন্টারগুলোতে ধস নামবে। এতে শেয়ারহোল্ডাররা বড় লোকসানের মুখে পড়বেন এবং কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ বন্ধ করে দেবে, যা সরাসরি অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনতে পারে।
এখনো পর্যন্ত এআই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল অসামঞ্জস্য রয়েছে। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে বিনিয়োগের বাড়তি তহবিল মেটাতে পুরো শিল্পটি বিশাল ঋণের উপর নির্ভরশীল। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে প্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিনিয়োগ-গ্রেড ঋণ ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ৭০% বেশি ছিল। এপ্রিল মাসে অ্যালফাবেট ২০২০ সালের পর প্রথমবারের মতো বন্ড ইস্যু করেছে।
মাইক্রোসফট সম্প্রতি তার নগদ অর্থ কমিয়ে এনেছে। কোম্পানিটির ফিনান্স লিজ (যা আদতে ঋণের মতো) ২০২৩ সাল থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ডেটা সেন্টারের আয়-নির্ভর ঋণ সিকিউরিটিজ বাজার ২০১৮ সালের শূন্য থেকে বেড়ে বর্তমানে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আরও ভয়ের বিষয় হলো, এই ঋণের একটা বড় অংশ আসছে অনিয়ন্ত্রিত খাত বা ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’ থেকে। হেজ ফান্ডগুলোর ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালে রেকর্ড ৬ লক্ষ ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এছাড়া বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মূলধারার আর্থিক বাজারের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে, যার পেছনে কোনো উৎপাদনশীল সম্পদ নেই। একইভাবে, প্রাইভেট ঋণ তহবিল, যেমন ব্যক্তিগত ইক্যুইটি তহবিল, যা অর্থ ধার করে ব্যক্তিগত বাজারে সেই অর্থ ধার দেয়, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ঋণের অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অর্থের একটা বড় অংশ ব্যাংক থেকে ধার করা হয়। তার ওপর, অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও ব্যাংক ঋণ বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, বা মোট বকেয়া ঋণের ১৪ শতাংশ, যেখানে ২০১৩ সালে এটি ছিল মাত্র এক শতাংশ। ব্যাংকগুলো প্রাইভেট ঋণ তহবিল এবং অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করে এআই প্রযুক্তি খাত উত্থানের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে। যার ফলে ছায়া ব্যাংকিং এবং অব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি এখন মূল ব্যাংকিং খাতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাছাড়া, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ এবং শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। যেমন—ওপেনএআই-তে মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া’র বিনিয়োগ আছে, আবার মাইক্রোসফট ও ওপেনএআই উভয়েই এনভিডিয়া’র গ্রাহক।
মাইক্রোসফট আবার এআই ক্লাউড কোম্পানি ‘কোরওয়েভ’-এর গ্রাহক, যেখানে এনভিডিয়া’র মালিকানা আছে। অর্থাৎ, নিজের গ্রাহকের কোম্পানিতে নিজেই বিনিয়োগ করে তারা কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। যদি এই চক্র ভেঙে পড়ে এবং এআই তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে শেয়ারের দাম কমে যাবে নিশ্চিত। তখন হেজ ফান্ডগুলো তাদের ঋণ শোধ করতে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হবে, যা বাজারে ধস নামাবে এবং ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলবে।
এদিকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো আর্থিক বাজারকে ক্রিপ্টো বাজারের সাথে একীভূত করার অনুমতি দিয়েছে, যা পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টো সম্পদ পুঁজিবাজারের ঝুঁকির বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা বলয় হিসাবে কাজ করার কথা বলা হলেও এইসব ক্রিপ্টো-সম্পদের মূল্যের গতিবিধি মূলত কোম্পানির শেয়ার দামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমেয় যে এআই কোম্পানির বর্তমান অবস্থার নেতিবাচক কোন হেরফের হলে ক্রিপ্টো-সম্পদের মূল্যেও আঘাত আসবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ এমন ধারনা করছেন যে এআই বিনিয়োগের উলম্ফনে যে বুদবুদের সৃষ্টি হয়েছে, তার পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এমনটা যদি সত্যিই ঘটে, তবে যেসব অর্থনীতিতে এআই খাতের বড় অবদান রয়েছে, বিশেষ করে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতি, সেসব দেশে এর নেতিবাচক প্রভাবটা বেশি পরিলক্ষিত হবে। এটা অনুমেয় যে এআই-সৃষ্ট বুদবুদ উন্নয়নশীল দেশগুলিকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারের উচিত হবে এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে, সরকারের উচিৎ হবে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। একইসঙ্গে দরকার অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় আগে থেকেই নীতিমালা প্রস্তুত রাখা, ছায়া ব্যাংকিং ব্যবস্থার হ্রাস টেনে ধরা, অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যথোপযুক্ত নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসা, বাণিজ্যের জন্য বিকল্প অংশীদার বা দেশ খুঁজে বের করা।
তবে সবচেয়ে জরুরি হলো নিজস্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার ব্যবস্থা করা। এই নীতিগুলির যদি কার্যকর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আশা করা যায় যে বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিকূল অবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খুব একটা প্রভাবিত করবে না।
ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক, কলেজ অব ব্যাংকিং এন্ড ফিনান্সিয়াল স্টাডিজ, মাস্কাট, ওমান