leadT1ad

বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে না, পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে

ফয়সাল মাহমুদ
ফয়সাল মাহমুদ

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৭
ছবি: আল জাজিরার সৌজন্যে

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘিরে সাম্প্রতিক যে হতাশার অতিকথন, তার অধিকাংশই স্থানীয় ভাষ্যকাররা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করছে। আর এর মাধ্যমে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক গতিপথের অসম্পূর্ণ এবং খানিকটা বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরছে।

যদিও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, নাস্তানুবাদ ব্যাংকিং খাত সত্যিই বাস্তব এবং গুরুতর চ্যালেঞ্জে। কিন্তু এগুলো অর্থনীতির ভেঙে পড়ার প্রমাণ নয়।

আগের সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরম্পরা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নেওয়া সংশোধনমূলক উদ্যোগগুলো বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্ট যে, এই সময়টা কঠিন হলেও সামগ্রিক কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস করতে এটি খুবই দরকারি।

নতুন সরকার একটি ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থা পাচ্ছে দাবির পেছনে মূলত এই তথ্য আড়ালে পড়ে যায়—আগের সরকার এমন এক আর্থিক ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিল যা তাসের ঘরের মতো ছিল। আর তা করেছিল তথ্যের হেরফের এবং ঝুঁকির বিষয়গুলোকে পদ্ধতিগতভাবে গোপন করার মাধ্যমে।

আবার বর্তমান অর্থনীতিকে স্থবির হিসেবে চিত্রিত করার মানে হলো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের যে স্থিতিশীল অগ্রযাত্রা তাকে উপেক্ষা করা। কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধাক্কা সত্ত্বেও, অধিকাংশ আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, পরের বছর ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। টানা কয়েক বছরে বেহিসাবি আর্থিক কর্মকাণ্ডের পর সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃত আর্থিক কঠোরতার প্রতিফলনই আজকের ধীরগতির প্রবৃদ্ধি। এটি ভেঙে পড়ার লক্ষণ নয়, বরং এটি কৃত্রিম উদ্দীপনা শেষে প্রত্যাশিত স্থিরতা কেবল।

উচ্চ অকার্যকর ঋণ, ধীরগতির ঋণ প্রবাহ এবং দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি কাঠামোগত সমস্যার লক্ষণ। অবশেষে এই সমস্যাগুলো সামনে এসেছে। এগুলোর মুখোমুখি হওয়া অনিবার্য ছিল।

অকার্যকর ঋণ এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ঘিরে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা আরও গভীর বাস্তবতা তুলে ধরে। আর সেটি নতুন কোনো চাপের নয়; বরং বহুদিন চাপা থাকা দুর্বলতাগুলোর শেষপর্যন্ত সামনে আসারই গল্পই।

অকার্যকর ঋণের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি—বিশেষ করে এডিবির মূল্যায়নে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবের শ্রেণিবিন্যাসের মানদণ্ডে হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী তা ৩৫ শতাংশের ওপরে। প্রকৃত অর্থে এসবই সঠিক হিসাব নিকাশের প্রতিশ্রুতির ফলে সামনে এসেছে।

আগের সরকার অনেক বছর ধরেই না কি নিয়ন্ত্রকদের ওপর খেলাপি ঋণ গোপন করতে, শ্রেণিবিন্যাসের মানদণ্ড শিথিল রাখতে এবং ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ অনির্দিষ্টভাবে বাড়াতে চাপ সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে ব্যাংকিং খাত বাইরে থেকে সুস্থ দেখালেও ভেতরে ভেতরে নাজুক হতে থাকে। সুতরাং অকার্যকর ঋণের উল্লম্ফন আসলে ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্রের মুখোমুখি হওয়ার ফল।

এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির সংকোচন, যা ২০২৫ সালের শেষের দিকে প্রায় ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এসেছিল, তাও বোঝা উচিত। আগের দুই অঙ্কের ঋণ বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের নেওয়া ঋণের মাধ্যমে আরও বেড়েছিল। সেসব ঋণের খুব কমই ফেরত এসেছিল। শেষ পর্যন্ত তা অকার্যকর ঋণ সংকটকে আরও বাড়িয়েছে।

এই ঋণগুলো অনেকগুলো নেওয়াই হয়েছিল কখনই পরিশোধ করবে না এমন মনোভাব থেকে। অভিযোগ রয়েছে সেই অর্থ বিদেশে আবাসন খাত বা অফশোর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ ব্যাংকগুলো আরও সতর্ক এবং এমন খাতে ঋণ যাচ্ছে যা খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কম।

ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমেছে, কিন্তু মান উন্নত হয়েছে। খারাপ ঋণের পাহাড়কে ভিত্তি করে কোনো অর্থনীতি টেকসই প্রবৃদ্ধি গড়তে পারে না। বিনিয়োগ আগ্রহের পতনের চেয়ে স্থিতিশীলতার দিকে যাওয়ার ইঙ্গিতই হলো বর্তমানের এসব সমন্বয়।

বৃহত্তর সমন্বয়ের কেবল একটি অংশ আর্থিক খাতের এই সংশোধনগুলো। আর্থিক খাতে যে স্থবিরতার দাবি করা হচ্ছে, সেটি আসলে রাজস্ব এবং বৈদেশিক খাতের চলমান রূপান্তর। আর এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নেওয়ার দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাসকে কঠোরভাবে পাল্টে দিয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে সরকার ৫ বিলিয়নের (প্রায় ৪০ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার) বেশি টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করেছে। অথচ এক বছর আগে একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ১৫০ বিলিয়ন টাকা (১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ধার নিয়েছিল।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই পরিবর্তন সুদহারের ওপর চাপ কমিয়ে আনবে এবং বেসরকারি ঋণগ্রহিতাদের জন্য তারল্য উন্মুক্ত করবে। অতীতে রাষ্ট্র বেসরকারি খাতকে বাইরে ঠেলে দিত। বর্তমানে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

এই পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক শৃঙ্খলা ছাড়াই চলতে অভ্যস্ত একটি দেশের জন্য স্থিতিশীলতার দিকে অর্থবহ পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত।

ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টও (এফডিআই) একই ধরনের পরিবর্তনের কথা বলে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণত বিনিয়োগকারীরা শঙ্কায় থাকেন। কিন্তু এই ধারণার উল্টো চিত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। কারণ বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

১৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হওয়া একটি গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অর্থনীতির এই উত্থান খুবই বিরল। সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার পর দেশগুলোতে বছরের পর বছর বহুজাতিক বিনিয়োগ কম থাকে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল দেশে থেকেছে এমন নয়, বরং তারা এখানে অর্জিত মুনাফা পুনঃবিনিয়োগও করছে। এটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনার প্রতি দৃঢ় আস্থারও ইঙ্গিত।

বৈদেশিক খাতে সম্ভবত সবচেয়ে ভালো পরিবর্তন ঘটেছে। কয়েক মাস টানা কমার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে এবং শক্তিশালীও হয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি যেখানে রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। সেটি এক বছর পর ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে।

রেমিটেন্সও ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন এসেছে। এর অর্থ হলো মানি লন্ডারিং বন্ধের উদ্যোগ এবং বাজারভিত্তিক বিনিময়মূল্যে ফিরে আসায় আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি নতুন আস্থা তৈরি করেছে।

একসময় যারা হুন্ডি নেটওয়ার্কে নির্ভর করতেন সেই প্রবাসীরা অধিক স্বচ্ছ ও পূর্বনির্ধারিত মুদ্রানীতি কার্যকর হওয়ায় এখন বৈধভাবে অর্থ পাঠাচ্ছেন। রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি, রেমিটেন্স আসা বৃদ্ধি এবং স্থিতিশীল বিনিময়মূল্যের সমন্বয়ে এটি কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম শক্তিশালী ম্যাক্রোইকোনমিক বাফার তৈরি করেছে।

তবে যথার্থভাবেই মুদ্রাস্ফীতি এখনও সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়। বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এই হারের মুদ্রাস্ফীতি নেই। এটি জীবনযাত্রার ব্যয়কে তীব্র করে তুলেছে।

যদিও এই তুলনায়ও সতর্কতা জরুরি। পুরো অর্থনৈতিক ধস এবং আএমএফ কর্মসূচির অধীনে কঠোর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পরে কেবল শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি কমেছে।

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি কাঠামোগতভাবে ভিন্ন। এর পেছনে সরবরাহ চেইনের সীমাবদ্ধতা, দীর্ঘদিনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা এবং পূর্ববর্তী মুদ্রানীতির প্রভাব রয়েছে। অবস্থা একটু কঠিন, তবে অস্থিতিশীল নয়।

বর্তমান অর্থনীতিকে স্থবির হিসেবে চিত্রিত করার মানে হলো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের যে স্থিতিশীল অগ্রযাত্রা তাকে উপেক্ষা করা। কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধাক্কা সত্ত্বেও, অধিকাংশ আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

একইভাবে সমালোচকরা প্রায়ই উল্লেখ করেন, দেশে দারিদ্র্যের হার ২৮ শতাংশ। তবে সেটি সীমিত নমুনায় করা বেসরকারি গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও চলতি অর্থবছরে দারিদ্র্যতা ধীরে ধীরে কমতে পারে।

সামনের লড়াই কেবল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার রক্ষার নয়; বরং বছরের পর বছর দরিদ্রদের ওপর অদৃশ্য কর হিসেবে বোঝা হয়ে থাকা দুর্নীতিচক্র ভাঙা, চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক এবং প্রশাসনিক জটিলতা দূর করার লড়াই।

আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে নয়; বরং এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণকে এড়িয়ে বাহ্যিক স্থিতিশীলতায় নির্ভরশীল শাসন ব্যবস্থার পর, অপরিহার্য হয়ে ওঠা পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

উচ্চ অকার্যকর ঋণ, ধীরগতির ঋণ প্রবাহ এবং দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি কাঠামোগত সমস্যার লক্ষণ। অবশেষে এই সমস্যাগুলো সামনে এসেছে। এগুলোর মুখোমুখি হওয়া অনিবার্য ছিল। তবে দেরিতে হলেও তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

তবে এর পরিবর্তে এমন কিছু অর্জন দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অর্থনীতিতে দেখা যায় না: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত পুনরুদ্ধার, রেকর্ড রেমিটেন্স প্রবাহ, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অভূতপূর্ব নিয়ন্ত্রণ।

এগুলো স্থবিরতার চিহ্ন নয়; বরং আরও স্বচ্ছ ও টেকসই অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রাথমিক ভিত্তি। বাংলাদেশ এই সংস্কার সম্পন্ন করতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির ওপর, বিশেষত ব্যাংকিং খাতে।

আজকের অর্থনীতির গল্প ভেঙে পড়ার নয়; এটি হলো ‘সংশোধনমূলক কর্মসূচির’ গল্প। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—দেশ এই কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারবে কি না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত