leadT1ad

সীমাবদ্ধতার সূত্র ছাড়িয়ে হুমায়ুন আজাদ

আজ বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিন। বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর বিশেষ পর্যবেক্ষণ ছিল, পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর মুগ্ধতা। আধুনিকতাবাদী সাহিত্য নিয়ে তাঁর আগ্রহের মূলেও ছিল পশ্চিমপ্রীতি। হুমায়ুন আজাদের এই অবস্থানের কোনো স্ববিরোধিতা আছে কি?

সোহানুজ্জামান
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ০৭
সীমাবদ্ধতার সূত্র ছাড়িয়ে হুমায়ুন আজাদ। স্ট্রিম গ্রাফিক

হুমায়ুন আজাদ আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের লেখক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত; নিজেও কবিতা লেখার ফিরিস্তি হিসেবে সেই পরিচয়কে বিশেষভাবে জাহির করেছেন। শিল্পের নির্মাণে এবং শিল্পের উপস্থাপন-কৌশলের বেলায়ও এই বিষয় সত্য বলে প্রতীয়মান হবে তাঁর সাহিত্য-পাঠের বেলায়। ১৯৯৮ সনে প্রকাশিত তাঁর কাব্যসমগ্রের ভূমিকায় হুমায়ুন আজাদ নিজেই বলছেন এমন যে, সৌন্দর্য তৈরি করাই তাঁর কবিতার, আরও বৃহৎ অর্থে তাঁর সাহিত্যের প্রধান উদ্দেশ্যও বটে।

হুমায়ুন আজাদের আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের বিশ্বাস আবর্তিত হয়েছে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদকে ঘিরে। এই মতবাদ খাতা-কলমে টিকিয়েও রেখেছিলেন আজাদ, বাস্তবে এর প্রমাণ মেলে তাঁর সাহিত্য-পাঠের বেলায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা বোদলেয়ার ও হোসে অর্তেগা ঈ গাসেৎ-এর সাহিত্য-তত্ত্ব অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিল/ শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,/ এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।/ আমার দুঃখ,/ তোমার স্বপ্ন দেখার জন্য/ আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম। (তোমার দিকে আসছি)’। এই কবিতায় প্রকাশিত প্রায় সব ধারণাই আবর্তিত হয়েছে আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের ধারণার ভেতরে, কিন্তু রোমান্টিক মেজাজে।

হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত
হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

আজাদের অনেক প্রবন্ধের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’। এই প্রবন্ধের সারবস্তু আজাদের নয়, কিন্তু এটিই তিনি গ্রহণ করেছেন হোসে অর্তেগা ঈ গাসেৎ-এর প্রস্তাবনা থেকে। একজন সাহিত্যিক এ ধরনের পরিগ্রহণ ও প্রয়োগ করতেই পারেন। কিন্তু যে নির্ধারিত ভূগোলে তিনি এই চর্চা জারি রাখছেন, সেই ভূগোলের জনজীবন ও জনসমাজের বেলায় তা কেমন—এমন প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন। এক্ষেত্রেই আজাদের সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের সীমবদ্ধতা আবিষ্কার সম্ভব। এই বিষয়গুলোই খানিকটা খতিয়ে দেখা যাক।

প্রথমত, আজাদ যে বুর্জোয় আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, তা নির্ধারিত সমাজ থেকে তাঁর সাহিত্যের দূরত্ব নির্মাণ করে; তার সাথে আরো মেশে বিমূর্ততা, প্রায়োগিকতার পরীক্ষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকতার জটিলতা। যা দারুণভাবে সাধারণ জনগণকে শিল্প-সাহিত্য থেকে আলাদা করে ফেলে। কারণ ‘হাই-আর্টের’ বিষয়টি মুখ্যত সমাজের সামান্য অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এই জন্য শিল্প-সাহিত্যের সামাজিক দায়বোধের বিষয়টি বাতিল হয়ে ওঠে এই ধারণার শিল্প-সাহিত্যে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আধুনিকতাবাদী শিল্প কতটুকু প্রয়োগযোগ্য হতে পারে, তা নির্ভর করে এর স্বতন্ত্র সমাজ-আর্থনীতিক কাঠামোর বিবেচনায়। এজন্য আজাদ কতটুকু আধুনিকতাবাদী শিল্প গড়ে তুলতে পারেন তা নির্ধারিত হবে সেই সমাজ দ্বারা—যে রাষ্ট্র-সমাজে আজাদ বসবাসরত। এই দিক থেকে ইউরোপীয় সমাজের আভাগার্দের বিবেচনায় আজাদের আধুনিকতাবাদী ধারণার সমালোচনা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব অতীতকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে নতুন একটি পরিস্থিতি নির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়। ‘প্রগতি’, ‘সভ্যতা’—এমন সব ধারণা যদিও এর ভেতরেই অবস্থান করে। কিন্তু এই ‘প্রগতি’র ধারণায় অতীতের সব চিহ্ন ভেঙে আলাদা হয়ে যাওয়া বেশ বিপদের কারণ হয়ে ওঠে নির্ধারিত রাষ্ট্র কিংবা ভূগোলে। বিশেষ করে একটি রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ হিস্টোরিওগ্রাফির সম্পূর্ণতা দানের বেলায়ও বিষয়টি বহুল অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই হিস্টোরিওগ্রাফি কেবল সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণার অগ্রগতির ভেতরেই লুকিয়ে থাকে না। বরং বহুবিধ ধারণার সমন্বয়ে নির্মিত হয় হিস্টোরিওগ্রাফি। কোনো রাষ্ট্রের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে আমূল পরিবর্তন করা সমস্যামূলক ধারণা। ফলে ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার টিকিয়ে রাখার বিষয়টিকে আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব বেশ খানিক ভেঙে ফেলে। কিন্তু আধুনিকতাবাদীদেরই ওস্তাদ টিএস এলিয়ট অবশ্য ঐতিহ্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা বারবারই বলেছেন।

তৃতীয়ত, আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের সূচনাই হয়েছে ইউরোপীয় আভাগার্দের ধারণার অন্দরে। আর এর পশ্চাতে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো জোরের সঙ্গেই সক্রিয় থেকেছে। আধুনিকতাবাদী শিল্প-ধারণার নির্মাণের এটি বড় এক ঐতিহাসিক সূত্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আধুনিকতাবাদী শিল্প কতটুকু প্রয়োগযোগ্য হতে পারে, তা নির্ভর করে এর স্বতন্ত্র সমাজ-আর্থনীতিক কাঠামোর বিবেচনায়। এজন্য আজাদ কতটুকু আধুনিকতাবাদী শিল্প গড়ে তুলতে পারেন তা নির্ধারিত হবে সেই সমাজ দ্বারা—যে রাষ্ট্র-সমাজে আজাদ বসবাসরত। এই দিক থেকে ইউরোপীয় সমাজের আভাগার্দের বিবেচনায় আজাদের আধুনিকতাবাদী ধারণার সমালোচনা সম্ভব। অর্থাৎ, সামাজিক উৎকর্ষ ও সাহিত্যিক উৎকর্ষ সৃষ্টির তৎপরতার মধ্যে অসামঞ্জস্য শনাক্ত করা যেতে পারে। মোটাদাগে আজাদের সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বের সংকটটাই এখানে প্রকাশিত।

কিন্তু আজাদের এই বিশ্বাসের ফাটল ধরে গেছে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। বিশেষ করে, যে রাষ্ট্রে হুমায়ুন আজাদের ঘর-বসতি ছিল, যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত জীবনযাপন করেছেন, সেই রাষ্ট্রের নানারূপ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা তাঁকে ভাবিয়েছে বিভিন্নভাবে। ভাবতে বাধ্য হন যে কোনো লেখকই; কিন্তু আজাদের বেলায় সেই ভাবনা কেবল ভাবনায়ই সীমাবদ্ধ থাকে নি। সেই সব চিন্তা নানাভাবে বিবর্তিতও হয়েছে। সেই বিবর্তনই নানাভাবে ধরার চেষ্টা করেছেন হুমায়ুন আজাদ এবং তাঁর সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব। ফলে এক পর্যায়ে এসে তিনি বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘চোখের মতোন সেই ইস্টিমার/ নীল নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে গাঢ় বেগে/ যারা শুয়ে আছে পাটাতনে/ প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বিভিন্ন শ্রেণিতে/ তারা আমার গভীর আত্মীয়’ (অলৌকিক ইস্টিমার)। এভাবে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে বুঝি আধুনিকতার ভেতর থেকেও তিনি আলাদা হয়ে ওঠেন ক্রমাগত। এভাবেই গাসেৎপন্থী হুমায়ুন আজাদ তাঁর সাহিত্যে এক করে ফেলেছেন রাষ্ট্র-সম্পর্কিত বিচিত্র বিষয়।

হুমায়ুন আজাদের সমগ্র সাহিত্যকে অন্ততপক্ষে দুইভাবে পাঠ করা সম্ভব; প্রথমত, কেবলই সাহিত্যের জন্য সাহিত্য—এই নন্দনতত্ত্বের তীব্রতায়; দ্বিতীয়ত, সমাজ ও রাষ্ট্রিক পরিসরের চাপে-তাপে সৃষ্ট সাহিত্য হিসেবে। ফলে আজাদের যতো দোষ ও যতো গুণ—এই দুইয়ের সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে তাঁকে পাঠ করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এই পাঠ জরুরি বিষয় হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়।

এই প্রসঙ্গে আজাদের চিন্তারাজ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কালের সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই আন্দোলনসমূহ প্রভাবক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বে।

যদি কেউ বলে দেয় এই যে পরিবর্তন, তা কি খারাপ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে? এ ব্যাপারে বলতে হবে বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়। কারণ সাহিত্যে লেখক ক্রমাগত বদলে যেতে থাকবেন, এটাই একজন ভালো সাহিত্যিকের বড় গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে। হুমায়ুন আজাদ মূলত সেটিই করেছেন।

ভাষা আন্দোলন ও ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেমন তাঁর মানস-জগতে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, তেমনি করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নানান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চড়াই-উৎরাইও হুমায়ুন আজাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের আধিপত্য, পরিপার্শ্বের বিচিত্র আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চিহ্ন প্রভাবিত করেছিল হুমায়ুন আজাদকে। রাষ্ট্রের এই চেহারা সবচেয়ে ভালোভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্য এবং কথাসাহিত্যে। তাঁর কবিতায়ও এসব বিষয়ের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত
হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

আর তাই বোদলেয়ার কিংবা গাসেৎ-এর উদাহরণ টেনে হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যকে বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ফেলে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তিনি যদিও সাহিত্যের শুদ্ধতা বিষয়ে কথা বলেছেন—তা তিনি যতই বলুন না কেন, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না, যদি কেউ তাঁর সমগ্র সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ করেন। কারণ হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-পাঠের মাধ্যমে যে কেউ স্পষ্ট হবেন যে, আজাদ কোন ধরনের সাহিত্য বিষয়ে কথা বলেছেন।

কেউ কেউ হুমায়ুন আজাদকে খণ্ডিত পাঠের মাধ্যমে মন্তব্য ছুড়ে দেন। এটা সাংঘাতিকভাবে বাজে প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ কেউ নন্দনতত্ত্বের হিসেবে হুমায়ুন আজাদকে পুরোপুরি ‘আধুনিকতাবাদী সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের’ লোক হিসেবে বিবেচনা করেন; কিন্তু তাঁর সমগ্র সাহিত্য-পাঠ করলে এই মন্তব্য ভ্রান্ত বলে মনে হয়।

আজাদের সমগ্র সাহিত্যকে অন্ততপক্ষে দুইভাবে পাঠ করা সম্ভব। প্রথমত, কেবলই সাহিত্যের জন্য সাহিত্য—এই নন্দনতত্ত্বের তীব্রতায়; দ্বিতীয়ত, সমাজ ও রাষ্ট্রিক পরিসরের চাপে-তাপে সৃষ্ট সাহিত্য হিসেবে। ফলে আজাদের যত দোষ ও যত গুণ—এই দুইয়ের সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে তাঁকে পাঠ করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এই পাঠ জরুরি বিষয় হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক। শিক্ষক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত