২২ শ্রাবণ স্মরণে
সুমন সাজ্জাদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম দেখেছিলাম একটা ভিউকার্ডে; সাদা-কালো একটা ছবি—লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল, মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি। তারপর দেখা হয়েছিল বাংলা গানের একটা পুস্তিকায়। নিউজপ্রিন্টে ছাপা সেই বইয়ের ছবিতে ছিলেন তিনজন—লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। আশি-নব্বইয়ের দশকে হাটে-বাজারে এরকম গানের বই পাওয়া যেত। সে রকম বইয়ে দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে। তখন স্টেশনারি দোকানে ঝুলত তাঁর পোস্টার—যুবক বয়সের, কখনোবা দাড়িশোভিত প্রৌঢ়বেলার ছবি। স্টুডিওগুলোতে চিত্রতারকাদের পাশাপাশি ফ্রেমবন্দি রবীন্দ্রনাথও মৃদু হাসতেন।
আজ বহু বছর বাদে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ছবিওয়ালা ভিউকার্ড, গানের বই কারা কিনত? কেন কিনত? আধা গ্রাম-আধা মফসসলে কারা পড়ত রবীন্দ্রনাথের গান অথবা কবিতা? বিশেষত এই দেশে যখন আচমকাই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তৈরি হয় বহুমুখী শোরগোল। বিবাদ হয় রবীন্দ্র-নজরুলের কবিত্ব নিয়ে। দুই কবির মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে পেরে অনেকে পরমানন্দ লাভ করেন।
মাঝেমধ্যে অভিযোগের পাল্লা এমনই ভারী করে তোলা হয় যে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এক সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট; যেন তিনি জবরদস্তি করে চাপিয়ে দিয়েছেন জাতীয় সংগীত। সংস্কৃতির ‘ক্ষমতা’কে ব্যাপ্ত করে তিনিই হয়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক শিরোমণি। অভিযোগের স্মারকলিপিতে লেখা হয়, রবীন্দ্রনাথ সমানুপাতিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের অভিজ্ঞতাকে রূপায়িত করেননি। শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথ বিশেষ শ্রেণিচরিত্রের অধিকারী; তাঁর সাহিত্যে কেবল সেই শ্রেণির প্রতিনিধিত্বই দেখা যায়।
অতএব এখনই জনসমক্ষে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হোক তাঁকে।
আমরা হয়তো অভিযোগ তুলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ আর কিছুই নন—উনিশ শতকের উপনিবেশিত কলকাতার চিত্তদূতমাত্র। জমিদারির অঢেল বিত্তে বেড়ে ওঠাদের দলে তিনিও ছিলেন। তাহলে সে কথা হবে আংশিক সত্য। তা ছাড়া এই অভিযোগ বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে না। উনিশ শতকের প্রধান চিন্তকদের বড় অংশ এই অভিযোগে বাতিল হয়ে যেতে পারেন।
মনে রাখা দরকার, কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সারসত্তা গ্রহণ করেই রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। না জমিদারি, না নতুন পুঁজির প্রলোভন, না রাজনৈতিক ক্ষমতা—কোনোটিই তাঁর সত্তার প্রধান উপাদান নয়। বরং উপনিবেশিত ভূখণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিনির্মিত করেছেন। তবে হ্যাঁ, তাঁর বিনির্মাণের উপাদান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। কেননা রবীন্দ্রনাথ প্রধানত প্রাচীন আর্য ভারতীয় সম্ভার দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চেয়েছেন—ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ‘আর্য’ পরিচয় পরিগ্রহ করেছিল ‘হিন্দুত্বে’র নাম। ঐতিহাসিকভাবে এই পরিচয় ধাবিত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে। এ কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের আরেক অংশীদার মুসলমান জনগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে মনোকষ্টে ভুগেছে।
রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট প্রতিভার কাছে তারা প্রত্যাশা করেছেন আরও একটু উদারতা, চেয়েছে নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে জীবন রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে যাপন করেননি, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি, তার ছবি তিনি আঁকবেন কী করে? আর আঁকলেই যে উদ্দিষ্ট ভোক্তারা সন্তুষ্ট হবেন, তারই-বা নিশ্চয়তা কী? রবীন্দ্রনাথ বরং সৎভাবে তাঁর আর্যত্বকে স্বীকার করেছেন। আর তাই ইরান ভ্রমণের সময় তিনি লিখলেন, ‘পারসিকদের কাছে আমার পরিচয়ের আরো-একটু বিশিষ্টতা আছে। আমি ইন্ডো-এরিয়ান... এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ।’ রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েছেন ইরানের সুফি-সাধকদের। বাঙালি মুসলমানরা হয়তো আরও স্পষ্ট ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে—যা প্রকাশিত হবে তাঁর সাহিত্যের ভেতর দিয়ে।
বাঙালি মুসলমানের এ আশা পূরণ হয়নি। কিন্তু মুসলমান স্বার্থের কথা রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি—এই সরলীকরণও বিভ্রান্তিকর। রবীন্দ্রনাথ বারবার সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের কথা বলেছেন । তাঁর পূর্ববঙ্গে দেওয়া বক্তৃতাগুলোতে উঠে এসেছে একই কথা। পাবনায় প্রাদেশিক সম্মিলনীর অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান, ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান ভাগকে এক রাষ্ট্রসম্মিলনের মধ্যে বাঁধিবার জন্য যে ত্যাগ, যে সহিষ্ণুতা, যে সতর্কতা ও আত্মদমন আবশ্যক তাহা আমাদিগকে অবলম্বন করিতে হইবে। এই প্রকাণ্ড কর্মঋণই যখন আমাদের পক্ষে যথেষ্ট তখন, দোহাই সুবুদ্ধির, দোহাই ধর্মের, প্রাণধর্মের নিয়মে দেশে যে নূতন নূতন দল উঠিবে তাহারা প্রত্যেকেই এক-একটি বিরোধরূপে উঠিয়া যেন দেশকে বহু ভাগে বিদীর্ণ করিতে না থাকে; তাহারা যেন একই তরুকাণ্ডের উপর নব নব সতেজ শাখার মতো উঠিয়া দেশের রাষ্ট্রীয় চিত্তকে পরিণতিদান করিতে থাকে।’
কথাগুলো আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? অথচ রবীন্দ্রনাথ কথাগুলো বলেছিলেন ১৯০৮ সালে। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও অনৈক্যের কালও। রবীন্দ্রনাথ তখন দেশবোধে আন্দোলিত। কিন্তু সেই বক্তৃতায়ই তিনি দেখিয়েছেন স্বদেশি আন্দোলনের দুর্বলতা। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমাদের চেতনা জাতীয় অঙ্গের সর্বত্রই যে প্রসারিত হইতেছে না—আমাদের বেদনাবোধ যে অতিশয়পরিমাণে কেবল শহরে, কেবল বিশিষ্ট সমাজেই বদ্ধ, তাহার একটা প্রমাণ দেখুন। স্বদেশি উদযোগটা তো শহরের শিক্ষিতমণ্ডলীই প্রবর্তন করিয়াছেন; কিন্তু মোটের উপরে তাঁহারা বেশ নিরাপদেই আছে। যাহারা বিপদে পড়িয়াছে তাহারা কাহারা।’ রবীন্দ্রনাথ তাকাতে চেয়েছেন পল্লির দিকে, সমবায়ী চেতনার দিকে।
আমার কাছে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; যেখানে দেখতে পাই আত্ম ও অপরের সঙ্গে লীন হওয়ার বাসনা। রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখি আত্মসত্তার বিচার ও পুনর্বিচার করতে; আমরা তাঁকে মগ্ন হতে দেখি সময়, সমাজ ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে স্থাপন করার অবিরাম তৎপরতায়। সে কারণেই এককালের ইউরোপ তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘সভ্যতার সংকট’।
যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আমাদের অনেকের ঘোরতর আপত্তি, সেই জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সোচ্চার। আমরা দেখবো, রবীন্দ্রনাথ বরাবরই জাতীয়তাবাদের সমালোচক। অথচ তাঁর অত্যন্ত আগ্রহের ক্ষেত্র জাতি, জাতীয় সাহিত্য, জাতীয়তা। কিন্তু যখনই ইতিহাসের মঞ্চে হাজির হয়েছে জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপ, তখনই তিনি লাল পতাকা উঠিয়ে বিদায় নিয়েছেন জাতীয় চেতনার গরিমা থেকে।
এই গ্রহণমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করা যায়, কিন্তু হটানো যায় না। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণেই তা অসম্ভব। সত্যিকার অর্থে কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে চাইলেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না। কেননা সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে ওঠার ব্যাপারটি তেমন সরল-সোজা নয়। এই সমস্ত প্রতীক উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হয় বছরের পর বছর ধরে। ধীরে ধীরে স্থান নেয় একটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আবহমানতায়, পরিণত হয় সাংস্কৃতিক কৃত্যে। এই সব প্রতীক ছাড়া আনুষ্ঠানিকতা হয় না, বিদ্যায়তন জমে না, বুদ্ধিবৃত্তির পাটাতন মজবুত হয় না। প্রতীকী ব্যক্তিত্বেরা প্রবহমান থাকেন চোরাস্রোতের মতো—অন্তঃসলিলা। বোঝাই যায় না যে ঢেউ আছে, চলিষ্ণুতা আছে। জাতীয় চেতনা পরিগঠনের যুগে যাঁরা স্তরে স্তরে সাজিয়ে তুলেছেন ভিত্তিভূমি, তাঁদের উৎখাত করতে চাইলে ভিত্তিটাই আচমকা ভেঙে পড়ে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ভিউকার্ড আর পোস্টারের রবীন্দ্রনাথকে তাঁরাই কিনতেন, যাঁরা জাতীয়তার গতিপথকে কমবেশি শনাক্ত করেতে পেরেছেন, নিজের জাতীয় হিস্যা বুঝতে পেরেছেন; তারাই বাড়ির রুগ্ন বুকশেলফে জমিয়ে রাখতেন ‘সঞ্চয়িতা’, ‘গীতবিতান’, ‘গল্পগুচ্ছ’, থাকত ‘সঞ্চিতা’ও। আমি ভাবি, জীবনযাপনের এই প্রবণতা বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক তৎপরতার অংশ। ঝগড়া বা বিরোধিতার জন্যে বিরোধিতা দিয়ে একে ঠিক ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সাংস্কৃতিকভাবে পরিগৃহীত না হলে কেউ এরকমভাবে অস্তিত্বময় হয়ে উঠতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ তার একটি প্রমাণ। নয়তো চুড়ি-ফিতার দোকানে কেন বিক্রি হবেন রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম দেখেছিলাম একটা ভিউকার্ডে; সাদা-কালো একটা ছবি—লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল, মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি। তারপর দেখা হয়েছিল বাংলা গানের একটা পুস্তিকায়। নিউজপ্রিন্টে ছাপা সেই বইয়ের ছবিতে ছিলেন তিনজন—লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। আশি-নব্বইয়ের দশকে হাটে-বাজারে এরকম গানের বই পাওয়া যেত। সে রকম বইয়ে দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে। তখন স্টেশনারি দোকানে ঝুলত তাঁর পোস্টার—যুবক বয়সের, কখনোবা দাড়িশোভিত প্রৌঢ়বেলার ছবি। স্টুডিওগুলোতে চিত্রতারকাদের পাশাপাশি ফ্রেমবন্দি রবীন্দ্রনাথও মৃদু হাসতেন।
আজ বহু বছর বাদে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ছবিওয়ালা ভিউকার্ড, গানের বই কারা কিনত? কেন কিনত? আধা গ্রাম-আধা মফসসলে কারা পড়ত রবীন্দ্রনাথের গান অথবা কবিতা? বিশেষত এই দেশে যখন আচমকাই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তৈরি হয় বহুমুখী শোরগোল। বিবাদ হয় রবীন্দ্র-নজরুলের কবিত্ব নিয়ে। দুই কবির মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে পেরে অনেকে পরমানন্দ লাভ করেন।
মাঝেমধ্যে অভিযোগের পাল্লা এমনই ভারী করে তোলা হয় যে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এক সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট; যেন তিনি জবরদস্তি করে চাপিয়ে দিয়েছেন জাতীয় সংগীত। সংস্কৃতির ‘ক্ষমতা’কে ব্যাপ্ত করে তিনিই হয়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক শিরোমণি। অভিযোগের স্মারকলিপিতে লেখা হয়, রবীন্দ্রনাথ সমানুপাতিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের অভিজ্ঞতাকে রূপায়িত করেননি। শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথ বিশেষ শ্রেণিচরিত্রের অধিকারী; তাঁর সাহিত্যে কেবল সেই শ্রেণির প্রতিনিধিত্বই দেখা যায়।
অতএব এখনই জনসমক্ষে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হোক তাঁকে।
আমরা হয়তো অভিযোগ তুলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ আর কিছুই নন—উনিশ শতকের উপনিবেশিত কলকাতার চিত্তদূতমাত্র। জমিদারির অঢেল বিত্তে বেড়ে ওঠাদের দলে তিনিও ছিলেন। তাহলে সে কথা হবে আংশিক সত্য। তা ছাড়া এই অভিযোগ বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে না। উনিশ শতকের প্রধান চিন্তকদের বড় অংশ এই অভিযোগে বাতিল হয়ে যেতে পারেন।
মনে রাখা দরকার, কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সারসত্তা গ্রহণ করেই রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। না জমিদারি, না নতুন পুঁজির প্রলোভন, না রাজনৈতিক ক্ষমতা—কোনোটিই তাঁর সত্তার প্রধান উপাদান নয়। বরং উপনিবেশিত ভূখণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিনির্মিত করেছেন। তবে হ্যাঁ, তাঁর বিনির্মাণের উপাদান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। কেননা রবীন্দ্রনাথ প্রধানত প্রাচীন আর্য ভারতীয় সম্ভার দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চেয়েছেন—ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ‘আর্য’ পরিচয় পরিগ্রহ করেছিল ‘হিন্দুত্বে’র নাম। ঐতিহাসিকভাবে এই পরিচয় ধাবিত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে। এ কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের আরেক অংশীদার মুসলমান জনগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে মনোকষ্টে ভুগেছে।
রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট প্রতিভার কাছে তারা প্রত্যাশা করেছেন আরও একটু উদারতা, চেয়েছে নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে জীবন রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে যাপন করেননি, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি, তার ছবি তিনি আঁকবেন কী করে? আর আঁকলেই যে উদ্দিষ্ট ভোক্তারা সন্তুষ্ট হবেন, তারই-বা নিশ্চয়তা কী? রবীন্দ্রনাথ বরং সৎভাবে তাঁর আর্যত্বকে স্বীকার করেছেন। আর তাই ইরান ভ্রমণের সময় তিনি লিখলেন, ‘পারসিকদের কাছে আমার পরিচয়ের আরো-একটু বিশিষ্টতা আছে। আমি ইন্ডো-এরিয়ান... এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ।’ রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েছেন ইরানের সুফি-সাধকদের। বাঙালি মুসলমানরা হয়তো আরও স্পষ্ট ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে—যা প্রকাশিত হবে তাঁর সাহিত্যের ভেতর দিয়ে।
বাঙালি মুসলমানের এ আশা পূরণ হয়নি। কিন্তু মুসলমান স্বার্থের কথা রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি—এই সরলীকরণও বিভ্রান্তিকর। রবীন্দ্রনাথ বারবার সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের কথা বলেছেন । তাঁর পূর্ববঙ্গে দেওয়া বক্তৃতাগুলোতে উঠে এসেছে একই কথা। পাবনায় প্রাদেশিক সম্মিলনীর অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান, ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান ভাগকে এক রাষ্ট্রসম্মিলনের মধ্যে বাঁধিবার জন্য যে ত্যাগ, যে সহিষ্ণুতা, যে সতর্কতা ও আত্মদমন আবশ্যক তাহা আমাদিগকে অবলম্বন করিতে হইবে। এই প্রকাণ্ড কর্মঋণই যখন আমাদের পক্ষে যথেষ্ট তখন, দোহাই সুবুদ্ধির, দোহাই ধর্মের, প্রাণধর্মের নিয়মে দেশে যে নূতন নূতন দল উঠিবে তাহারা প্রত্যেকেই এক-একটি বিরোধরূপে উঠিয়া যেন দেশকে বহু ভাগে বিদীর্ণ করিতে না থাকে; তাহারা যেন একই তরুকাণ্ডের উপর নব নব সতেজ শাখার মতো উঠিয়া দেশের রাষ্ট্রীয় চিত্তকে পরিণতিদান করিতে থাকে।’
কথাগুলো আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? অথচ রবীন্দ্রনাথ কথাগুলো বলেছিলেন ১৯০৮ সালে। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও অনৈক্যের কালও। রবীন্দ্রনাথ তখন দেশবোধে আন্দোলিত। কিন্তু সেই বক্তৃতায়ই তিনি দেখিয়েছেন স্বদেশি আন্দোলনের দুর্বলতা। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমাদের চেতনা জাতীয় অঙ্গের সর্বত্রই যে প্রসারিত হইতেছে না—আমাদের বেদনাবোধ যে অতিশয়পরিমাণে কেবল শহরে, কেবল বিশিষ্ট সমাজেই বদ্ধ, তাহার একটা প্রমাণ দেখুন। স্বদেশি উদযোগটা তো শহরের শিক্ষিতমণ্ডলীই প্রবর্তন করিয়াছেন; কিন্তু মোটের উপরে তাঁহারা বেশ নিরাপদেই আছে। যাহারা বিপদে পড়িয়াছে তাহারা কাহারা।’ রবীন্দ্রনাথ তাকাতে চেয়েছেন পল্লির দিকে, সমবায়ী চেতনার দিকে।
আমার কাছে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; যেখানে দেখতে পাই আত্ম ও অপরের সঙ্গে লীন হওয়ার বাসনা। রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখি আত্মসত্তার বিচার ও পুনর্বিচার করতে; আমরা তাঁকে মগ্ন হতে দেখি সময়, সমাজ ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে স্থাপন করার অবিরাম তৎপরতায়। সে কারণেই এককালের ইউরোপ তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘সভ্যতার সংকট’।
যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আমাদের অনেকের ঘোরতর আপত্তি, সেই জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সোচ্চার। আমরা দেখবো, রবীন্দ্রনাথ বরাবরই জাতীয়তাবাদের সমালোচক। অথচ তাঁর অত্যন্ত আগ্রহের ক্ষেত্র জাতি, জাতীয় সাহিত্য, জাতীয়তা। কিন্তু যখনই ইতিহাসের মঞ্চে হাজির হয়েছে জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপ, তখনই তিনি লাল পতাকা উঠিয়ে বিদায় নিয়েছেন জাতীয় চেতনার গরিমা থেকে।
এই গ্রহণমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করা যায়, কিন্তু হটানো যায় না। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণেই তা অসম্ভব। সত্যিকার অর্থে কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে চাইলেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না। কেননা সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে ওঠার ব্যাপারটি তেমন সরল-সোজা নয়। এই সমস্ত প্রতীক উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হয় বছরের পর বছর ধরে। ধীরে ধীরে স্থান নেয় একটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আবহমানতায়, পরিণত হয় সাংস্কৃতিক কৃত্যে। এই সব প্রতীক ছাড়া আনুষ্ঠানিকতা হয় না, বিদ্যায়তন জমে না, বুদ্ধিবৃত্তির পাটাতন মজবুত হয় না। প্রতীকী ব্যক্তিত্বেরা প্রবহমান থাকেন চোরাস্রোতের মতো—অন্তঃসলিলা। বোঝাই যায় না যে ঢেউ আছে, চলিষ্ণুতা আছে। জাতীয় চেতনা পরিগঠনের যুগে যাঁরা স্তরে স্তরে সাজিয়ে তুলেছেন ভিত্তিভূমি, তাঁদের উৎখাত করতে চাইলে ভিত্তিটাই আচমকা ভেঙে পড়ে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ভিউকার্ড আর পোস্টারের রবীন্দ্রনাথকে তাঁরাই কিনতেন, যাঁরা জাতীয়তার গতিপথকে কমবেশি শনাক্ত করেতে পেরেছেন, নিজের জাতীয় হিস্যা বুঝতে পেরেছেন; তারাই বাড়ির রুগ্ন বুকশেলফে জমিয়ে রাখতেন ‘সঞ্চয়িতা’, ‘গীতবিতান’, ‘গল্পগুচ্ছ’, থাকত ‘সঞ্চিতা’ও। আমি ভাবি, জীবনযাপনের এই প্রবণতা বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক তৎপরতার অংশ। ঝগড়া বা বিরোধিতার জন্যে বিরোধিতা দিয়ে একে ঠিক ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সাংস্কৃতিকভাবে পরিগৃহীত না হলে কেউ এরকমভাবে অস্তিত্বময় হয়ে উঠতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ তার একটি প্রমাণ। নয়তো চুড়ি-ফিতার দোকানে কেন বিক্রি হবেন রবীন্দ্রনাথ?
৫ আগস্ট ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষ্যে ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ‘অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় পেলাম?’ শিরোনামে এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে পঠিত হয় এই লেখা।
৭ ঘণ্টা আগেআজ ২২ শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। বাংলাদেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বিবেচনার মাত্রাগত বৈচিত্র্য আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কখনো কখনো এ দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিচারে কাজ করে নানা সমীকরণ। সেটা কী?
১ দিন আগেদেশের মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক দিনপঞ্জিতে তারিখটিকে স্থায়ী করে দেওয়ার মতো ঘটনাটি ঘটেছে আজ থেকে এক বছর আগে–২০২৪-এর ৫ আগস্ট। সেদিন এদেশের কোটি কোটি মানুষের আত্মার সামষ্টিক আকুতিকে সাফল্যের আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে এক অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতি এসেছিল।
২ দিন আগেবিশ্বজুড়ে মুক্ত বাণিজ্যের যুগ শেষ হয়ে এখন প্রতিটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি নিজেদের স্বার্থে আলাদা জোট তৈরি করছে, বাড়ছে আত্মনির্ভরতার ঝোঁক।
২ দিন আগে