টয়লেট—এই ছোট্ট ঘরটাই মানবসভ্যতার সবচেয়ে সৎ জায়গা। কেননা এখানে কেউ অভিনয় করতে পারে না। গণতন্ত্র, সাহিত্য, নৈতিকতার বিষয়গুলো এখানে এসে ‘ফ্ল্যাশ’ করে পাঠিয়ে দেয় অতল গহীনে। এখানে মানুষ একা। আর একা মানুষ মানে কী?—জিজেক বলতেন, এখানেই আপনার আসল ‘সাবজেক্টিভিটি’ ফাঁস হয়ে যায়।
অন্যদিকে টয়লেট সাহিত্যিকেরা কিন্তু কোনোদিনও লেখক বা কবি হিসেবে নিজেকে জাহির করেন না। লেখার সময়ে হাতে-নাতে ধরা খাওয়ার পরেও তাঁরা বলবে, এই লেখা তো আমার নয়। আসলে টয়লেট সাহিত্য হলো একধরনের গোপন রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর মতো। আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সও বলতে পারেন। গোপন প্রেমেরে মতো বলাও যায়। যা কেউ স্বীকার করে না।
টয়লেট সাহিত্যের লেখাগুলো সাধারণত দুই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়। ১. মানুষের গভীর অস্তিত্বসংকটের মুহূর্তে, ২. কিংবা মানুষের পেটের গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুহূর্তে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি গভীর সাহিত্যিকেরা বুঝতে পারবেন বলে আশা করি। অস্তিত্বসংকটের সময়ে টয়লেট কবিদের বেশি বেশি কবিতা প্রসব হয়। তাঁদেরই একজন কবীন্দ্রনাথ মহাশয়। তিনি অনেকদিন ধরেই টয়লেটের দেয়ালে দেয়ালে কবিতা লিখে যাচ্ছেন। তাঁর কবিতাগুলো নিয়ে বইও বের হয়েছে। বইয়ের নাম ‘মরাঞ্জলি’। বইমেলায় বইটি বেস্টসেলারও হয়েছিল শুনেছি। সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। চলুন তাঁর কিছু কবিতা পড়া যাক।
‘হে জ্ঞানী
দেখুন কি হয়রানী
হা…লাম অথচ
কলে নেই পানি’
এ রকম অস্তিত্বসংকটের মুহূর্তে মহাবিশ্বকবি না হলে কেউ কি এমন কবিতা লিখতে পারে? তারপরে আরেকটি কবিতায় কবি মানুষের জন্ম দিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যেজন হা…য়া না ঢালে পানি, সেসবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এ ছাড়াও কবি অনেক সময় একাকীত্বে ভুগতেন সেটিও কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ‘সেদিন নিরজনে হে…ছিনু বনে চারিদিকে কেউ ছিল না।’ তাঁর জীবন যে দুঃখ-কষ্টে ভরপুর তা এই কবিতার মাধ্যমেই প্রতিয়মান।
টয়লেটে আবার অনেক ডাক্তারও আসেন মাঝেমধ্যে। কেউ কেউ নিজের পরিচয় সেখানে লিখে যান। ‘তাকিওনা মু… আসি’ তেমনই একজন। তিনি টয়লেটে ঢুকেই বুঝেছিলেন যে মানুষের প্রস্রাবে অনেক সমস্যা। তাই নিজের ঠিকানা লিখে গেছেন। ‘আপনার কি মু…তে সমস্যা হচ্ছে? তাহলে আজই যোগাযোগ করুন—কাপানি মু… বিশেষজ্ঞ ‘‘তাকিও না মু…’’র সঙ্গে।’
এছাড়াও একদিকে, ‘জীবন ক্ষণিক, টিস্যু শেষ’- এই ধরনের মেটাফিজিক্যাল স্বীকারোক্তি।
অন্যদিকে, ‘মালিক ভাড়া বাড়াইছে’—এই ধরনের অসহায় প্রলেতারিয়েতের আর্তনাদও আছে।
এগুলো একসঙ্গে পড়লে মনে হয় যেন হেগেল আর হাজির দোকানের বিল এক পাতায় মিলিত হয়েছে। টয়লেটে যান না এমন কেউ কি পৃথিবীতে আছেন? ভারতের মতো জায়গার অনেক ‘প্রকৃতিবাদী’র কথা আলাদা। সেখানে টয়লেট থাকা সত্ত্বেও বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনো প্রায় ৭০ কোটি মানুষ টয়লেট ব্যবহার করেন না। তাঁদের জন্যই বোধহয় কবি লিখেছেন, ‘টয়লেট ব্যবহারের পর পরিষ্কার করিতে না পারিলে জঙ্গলই আপনার জন্য মঙ্গল’।
আবার আপনি যতই ধনী হন; টয়লেটে ঢুকলে আমলাতন্ত্রের সব স্তর ভেঙে পড়ে যাবে। সেখানে ফোনে স্ক্রল করা, ফেসবুক পোস্ট লেখা—সব একইসঙ্গেই হয়।
জিজেক বলেছেন, ‘এখানেই লিবারাল ক্যাপিটালিজমের সবচেয়ে গভীর ভাঙন দেখা যায়।’ কিন্তু এই কথাটি আসলেই কী জিজেক বলেছিলেন? টয়লেট সাহিত্য হিসেবেও আপনারা বিষয়টি নিতে পারেন।
একজন রাজনীতিবিদ টয়লেটে ঢুকেই তিন কাজের দোলাচলে পড়ে; কোনটি আগে করবেন, সেই চিন্তায় তাঁর মাথা গরমও হয় অনেক সময়। কাজ তিনটি হলো শরীর হালকা করা; আত্মা ভারী করা (ইমোশনাল পোস্ট লেখা); নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আপগ্রেড করা (যেমন- ইউটিউবে কোনো রাজনীতির ক্লাস করা)। এই তিনটি কাজের মিলনেই শুরু হয় টয়লেট রাজনীতি।
পাবলিক টয়লেটে ঢুকলেই আজকাল লেখক-হারিসুল হকের ভয় লাগে। ভয়টা দুর্গন্ধে নয়। ওটা তো জীবনেরই অংশ। ভয়টা সাহিত্যে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন। আমাদের দেশের পাবলিক টয়লেটগুলোতে যে সাহিত্য-বিস্ফোরণ ঘটে, তাঁকেই তিনি বলেন টয়লেট উপন্যাসের নবজাগরণ।
দরজায় ঢুকেই প্রথম লাইন: ‘মিম, তুমি আমাকে কেন ভুললে?’ হুমায়ূনীয় দৃষ্টিতে মনে হয়, এই মিম নামের মেয়েটি এখনই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে। আর দরজার ভেতরে যে লোকটা লিখেছে, সে হয়তো টিস্যু নেই দেখে আক্ষেপে এই হৃদয়বিদারক লাইনটি লিখেছে। প্রেমের দুঃখ আর পেটের দুঃখ—একইসঙ্গে মানুষকে কবি বা লেখক বানায়।
টয়লেটে লেখকেরা আবার নিজেদের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখতে চায়। তবে কেউ যদি টয়লেটে ঢুকে ভালো মতো চারপাশে তাকায়, তাহলে যেসব লেখা সেখানে পাবে, সবগুলো নিয়ে নিশ্চয় একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবেন। টয়লেট সাহিত্যকে অবজ্ঞা করার কোনো কারণ নেই। টয়লেট থেকেই সৃষ্টি হতে পারে মহাকাব্য বা মহা-উপন্যাস। কারণ, গ্যারেজ থেকে যদি জেফ বেজোস অ্যামাজনের মতো এত বড় কোম্পানি গড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে টয়লেট থেকে কেন কোনো লেখক নোবেল লরিয়েট হতে পারবেন না?
হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, ‘বাংলাদেশে লেখকের সংখ্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। টয়লেটে ঢুঁ মারলে দেখবে, সবাই লেখক।’