leadT1ad

শতবর্ষে সলিল চৌধুরী

বাংলা গানকে নতুন আকাশ দেখিয়েছেন সলিল চৌধুরী

আজ সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষ। আজকের প্লেলিস্ট-যুগেও তাঁর গান প্রমাণ করে সুরের কোনো সীমান্ত নেই। সংগীত হলো এক চিরন্তন মাইগ্রেশন। গ্রাম থেকে শহর, বাংলা থেকে মালায়ালম, অতীত থেকে ভবিষ্যৎ।

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৩৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

সলিল চৌধুরীর পরিচয় আসলে একটিমাত্র শব্দে ধরা যায় না। কেউ তাঁকে বলেন সুরকার, কেউ গীতিকার, কেউ কবি আর কেউ-বা রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু তাঁর পরিচয় ছিল আরও সহজ। তিনি গণমানুষের সংগীতকার। যে সংগীত মানুষের ভেতরের ক্ষুধা, প্রেম, লড়াই, স্বপ্নকে একসঙ্গে গেঁথে তোলে, সেই সংগীতেরই ছিলেন তিনি অনন্য রূপকার।

সলিলের গানের দুনিয়া তৈরি হয়েছিল কখনো লোকগানের সুরে, কখনো পশ্চিমা ধ্রুপদীর হারমনিতে, কখনো-বা শ্রমিকের ঘামের ভেতর দিয়ে। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। সেই হিসেবে আজ তাঁর জন্ম শতবর্ষ। যদিও বছরটি নিয়ে নানা মত আছে। কিছু উৎসে ১৯২৩ বা ১৯২৬–ও পাওয়া যায়। কিন্তু লোকমুখে ২০২৫ সালের কথাই এসেছে সবচেয়ে বেশি। জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগণার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে। মা বিভাবতী দেবী, বাবা জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের ডাক্তার।

সলিলের বাবার জীবন ছিল নাটকীয়। সাহেব ম্যানেজারের অপমান সইতে না পেরে ঘুষি মেরে তিনটে দাঁত ফেলে দেন, আর তার ফলস্বরূপ সব বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ফিরে আসতে হয়। শুধু বাঁচে গ্রামোফোন আর শ খানেক পশ্চিমা সিম্ফনির রেকর্ড। এই রেকর্ডগুলোই পরে সলিলের সংগীতবোধে গভীর ছাপ ফেলে। সেখানে মোজার্ট, বিথোভেন, বাখ তাঁর অদৃশ্য গুরু হয়ে ওঠেন।

সলিল চৌধুরী। সংগৃহীত ছবি
সলিল চৌধুরী। সংগৃহীত ছবি

সলিলের শৈশব কেটেছে আসামের চা–বাগানে, যেখানে শ্রমিকদের গান ও অসমীয়া লোকসুর তাঁকে ছোটবেলা থেকেই টেনে নিয়েছিল। পরে কলকাতায় পড়াশোনা। কিন্তু গান শেখা? কোনো প্রথাগত শিক্ষা নয়। তাঁর কথায়, ‘আমার গুরু রেডিও, রেকর্ড আর পৃথিবীর সংগীত।’

দাদার অর্কেস্ট্রা ক্লাবে নানা বাদ্যযন্ত্র শেখা, আর নিজের আগ্রহে বাঁশি বাজানো। এসব মিলেই তৈরি করেন সলিলের নিজস্ব সাউন্ড-ওয়ার্ল্ড। আইপিটিএ-র সঙ্গে বাঁশি বাজানোর দিনগুলো তাঁর সংগীতচিন্তার ভিত আরও শক্ত করে। দুর্ভিক্ষের সময় আইপিটিএ-র দলের সঙ্গে আসাম ও বাংলা জুড়ে ঘুরে মানুষের যন্ত্রণা দেখে, মানুষের লড়াই শুনে তাঁর শিল্পীসত্তা জেগে ওঠে নতুন মাত্রায়।

কলকাতায় পড়ার সময় সাম্যের রাজনীতির প্রতি টান থেকেই তিনি হন কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সর্বক্ষণের কর্মী। প্রতিটি মিটিংয়ের জন্য তিনি লিখতেন নতুন গান, যা পরিণত হয় গণসংগীতে। তাঁর প্রথম গণসংগীত ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ রচিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীদের বিচার নিয়ে। ১৯৪৬ সালে নৌ–বিদ্রোহের সময় লেখেন ‘ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে’। আবার দাঙ্গার সময় তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে মানবতার ডাক ‘ও মোদের দেশবাসীরে, আয়রে পরাণ ভাই, রহিম ভাই’।

সলিলসংগীতে সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে ‘সিন্থেসিস’। লোকগান, পাশ্চাত্য হারমনি, ভারতীয় ধ্রুপদী, সব একসঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন সংগীতে সীমানা বলে কিছু নেই। তাঁর অর্কেস্ট্রেশনে যে গভীরতা, যে হারমোনিক বিন্যাস পাওয়া যায়, তা বাংলা গানে সেই সময় অকল্পনীয় ছিল।

এসময়ই তিনি সুর দেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঠিকানা আমার চেয়েছ’ প্রভৃতি কবিতায়, আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পাল্কির গান’-এ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এগুলো আজও বাংলা গানের অমূল্য সম্পদ। আর তাঁর বয়স যখন মাত্র কুড়ি, তখনই লেখা ‘গাঁয়ের বধু’ তাঁকে বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর নিজের কথায় ‘গাঁয়ের বধু লিখে যদি আমি মরে যেতাম, তাহলেও আমি সলিল চৌধুরীই হতাম।’

সলিলসংগীতে সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে ‘সিন্থেসিস’। লোকগান, পাশ্চাত্য হারমনি, ভারতীয় ধ্রুপদী, সব একসঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন সংগীতে সীমানা বলে কিছু নেই। তাঁর অর্কেস্ট্রেশনে যে গভীরতা, যে হারমোনিক বিন্যাস পাওয়া যায়, তা বাংলা গানে সেই সময় অকল্পনীয় ছিল। তিনি বাঁশি, পিয়ানো, বেহালা, ম্যান্ডোলিন, এমনকি ফ্রেঞ্চ হর্নও ব্যবহার করেছেন অনায়াসে। তিনি এমন সব বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন, যার নামও অনেকে শোনেনি!

সলিলের সংগীতের আরেক বিশেষ দিক মূল সুরের পাশে পাশে ছোট ছোট সুরধারা বয়ে নিয়ে যাওয়া। তাঁর গান প্রথমে শুনলে সহজ লাগে, কিন্তু গাইতে গেলে বোঝা যায় ভেতরের কারুকাজ।

সংগীত আয়োজনে সলিল চৌধুরী। সংগৃহীত ছবি
সংগীত আয়োজনে সলিল চৌধুরী। সংগৃহীত ছবি

প্রথা ভাঙা ছিল সলিল চৌধুরীর স্বভাব। তখন প্রচলিত নিয়ম ছিল, আগে কথা, পরে সুর। কিন্তু তিনি অনেকসময় উল্টোটা করেন। আগে সুর, পরে কথা। এর ফলে সুরের ভেতর শব্দেরা বসে যেত খুব স্বাভাবিকভাবে। মালায়ালমের ‘চেম্মীন’-এ তিনি এই পদ্ধতি আরও নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেন। সমুদ্রের ঢেউ, চরিত্রদের আকুতি, ভালোবাসা, সবকিছু মিলিয়ে তৈরি করেন এক সাউন্ডস্কেপ। তাই ‘মানসা মাইনে ভারু’ বা ‘পেন্নালে পেন্নালে’ আজও ভাষা ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয়ে গুনগুন করে।

শুধু বাংলা নয়, তাঁর সুর ভেসে গেছে অহমিয়া, মালায়ালম, তামিলসহ মোট ১৪টি ভাষায়। আর প্রত্যেক ভাষাতেই তাঁর সুরের ধাক্কা ছিল আলাদা। তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘সলিল চৌধুরীর কবিতা’ বইতে নিজেই উল্লেখ করেন, যে কাগজেই হাত পেতেছেন, সেখানেই লিখেছেন কিছু লাইন। হোটেলের মেনুকার্ড, ফ্লাইটের রুমাল, পুরোনো ডায়েরি। এসব লিখে হারিয়ে যেতে পারত, কিন্তু তাঁর স্ত্রী গায়িকা সবিতা চৌধুরীর যত্নে সব একত্রিত হয়েছে।

১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি চলে যান। কিন্তু তাঁর সুর রয়ে গেছে বয়স, ভাষা, দেশ ছাড়িয়ে। আজকের প্লেলিস্ট-যুগেও তাঁর গান প্রমাণ করে সুরের কোনো সীমান্ত নেই। সংগীত হলো এক চিরন্তন মাইগ্রেশন। গ্রাম থেকে শহর, বাংলা থেকে মালায়ালম, অতীত থেকে ভবিষ্যৎ।

সলিল চৌধুরী তাই শুধুই এক কিংবদন্তি নন; তিনি আসলে চলমান ব্যাখ্যা। তিনি দেখিয়েছেন, সংগীত শেষ পর্যন্ত মানুষেরই ভাষা। তাঁর সুর শুনলে আজও মনে হয় তারিখ, সময়, ভাষা, মতাদর্শ—সব মিলিয়ে তিনি এক বহুস্বরিক বিস্ময়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত