.png)
জাপানে ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’ নামে বিচিত্র এক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। এটি জাপানে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে ২০১৭ সাল থেকে এই বিষয়বস্তু নিয়ে জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজও তৈরি হয়েছে। সিরিজগুলো প্রকাশের পর ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’ সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।

সুমন সুবহান

কার্ল মার্কস তাঁর ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক মেনুস্ক্রিপ্ট ১৮৪৪’-এর পাণ্ডুলিপিতে পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতাকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো--পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা, মানুষ হিসেবে নিজের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যান্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কাজের একঘেঁয়েমি আর প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সৃজনশীলতা ও আবেগের জন্য সময় ও শক্তি খুঁজে পায় না। এর ফলে তারা তাদের শ্রমের ফলাফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাজ শেষ করার পর মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারণে মানুষের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার আগ্রহ কমে যায়। কেননা পুঁজিবাদে সময় হলো অর্থ; প্রতিটি মুহূর্তকে তাই উৎপাদনশীল ও লাভজনক করার চাপ থাকে। এজন্য সম্পর্ক তৈরি করা বা মানসিক পরিচর্যার মতো 'অলাভজনক' বিষয়গুলো সেখানে গুরুত্ব হারায়, যা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এই প্রবণতা মানুষকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হতে উৎসাহিত করে। আর তাই অপরের প্রতি সহানুভূতির অভাব দেখা যায় আর সম্পর্কগুলোও গড়ে ওঠে লেনদেনের ভিত্তিতে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ঐতিহ্যগত পরিবার ও সম্প্রদায়ের বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মানুষ একা হয়ে পড়ে। শহরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা ও কাজের চাপে প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় না। এই গভীর একাকিত্ব দূর করার জন্যই মানুষ অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক খোঁজে। জাপানে ঠিক এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’নামে বিচিত্র এক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। জাপানে এটি এমন এক ধরনের পরিষেবা, যেখানে পুরুষেরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন মহিলা সঙ্গীকে ভাড়া নিতে পারেন।
জাপানে কবে থেকে এই পরিষেবার আরম্ভ তার সুনির্দিষ্ট তারিখ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ কোনো একক ঘটনার মাধ্যমে তা শুরু হয়নি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাপানের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ‘কম্পেনসেটেড ডেটিং’ বা ‘এসকর্ট’ পরিষেবার ধারণা থেকেই এর উদ্ভব হয়েছে। ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকে জাপানে এই ধরনের ডেটিং পরিষেবা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এই সংস্কৃতি জাপানে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, ২০১৭ সাল থেকে এই বিষয়বস্তু নিয়ে জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজও তৈরি হয়েছে। সিরিজগুলো প্রকাশের পর ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’ সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
মাঙ্গা কী? জাপানের অত্যন্ত জনপ্রিয় কমিক্স বা গ্রাফিক উপন্যাস হলো ‘মাঙ্গা’। ‘মান’মানে খেয়ালি, ‘গা’মানে ছবি অর্থাৎ মাঙ্গা মানে, ‘খেয়ালি ছবি’। জাপানে শব্দটি সব ধরনের কমিক্স, কার্টুন ও অ্যানিমেশন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যার স্বতন্ত্র শৈল্পিক ধরন রয়েছে। যেমন মাঙ্গা সাধারণত সাদা-কালোতে প্রকাশিত হয়; এর গল্পের গতি ও চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তি (বিশেষত বড় চোখ ও মুখের ভাব) পশ্চিমা কমিক্স থেকে আলাদা। জাপানে জনপ্রিয় মাঙ্গাগুলো প্রায়শই অ্যানিমে সিরিজে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া মাঙ্গা থেকে চলচ্চিত্র, ভিডিও গেম ও লাইভ-অ্যাকশন সিরিজও তৈরি করা হয়। শিল্পীদের মধ্যে যারা মাঙ্গা তৈরি করেন, তাদের বলা হয় ‘মাঙ্গাকা’।
মাঙ্গাকা রেজি মিয়াজিমার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজের নাম ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’। সিরিজটি কাল্পনিক হলেও জাপানের জনপ্রিয় ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’পরিষেবার ধারণার ওপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করা হয়েছে। এই সিরিজের প্রধান চরিত্র কাজুয়া কিনোশিতা একজন কলেজ ছাত্র, যে তার প্রেমিকা মামি নানামির কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হতাশ হয়ে গার্লফ্রেন্ড ভাড়া করার পরিষেবা ব্যবহার শুরু করে। আর চিজুরু মিজোহারা হলো সেই পেশাদার 'ভাড়াটে গার্লফ্রেন্ড', যাকে কাজুয়া ভাড়া করেছিল।
চিজুরু তার কাজে খুবই সিরিয়াস, কমিক্সে কাজুয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটি ভুল বোঝাবুঝি, হাস্যরস আর জটিল অনুভূতির মধ্য দিয়ে এগোয়। হতাশা থেকে সে একটি 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' অ্যাপের মাধ্যমে চিজুরু মিজোহারাকে ভাড়া করে। প্রথম ডেটে চিজুরুর নিখুঁত আচরণে কাজুয়া মুগ্ধ হয়। কিন্তু পরে কিছু ঘটনাচক্রে, যেমন তাদের দাদিদের একই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং ভুল করে একে অপরের প্রতিবেশী হওয়া, কাজুয়া ও চিজুরুকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করে যে তারা আসলে ডেটিং করছে। তাদের এই 'ভাড়াটে' সম্পর্কটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জটিল ও গভীর হতে থাকে, যেখানে চিজুরু তার পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। কাজুয়া ধীরে ধীরে চিজুরুর আসল গুণাবলি আবিষ্কার করে এবং তার প্রেমে পড়ে। মাঙ্গাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এটিকে অ্যানিমে সিরিজে রূপান্তরিত করা হয়, যার বেশ কয়েকটি সিজন মুক্তি পেয়েছে। এই সিরিজ জাপানের 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে আরও বেশি পরিচিত করে তুলেছে।
'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতি মূলত মানুষের একাকিত্ব দূর করা এবং রোমান্টিক ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তৈরি হয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও সীমা মেনে চলে। জাপানে এই সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ সেখানকার মানুষের একাকিত্ব বিশেষত যাদের সামাজিক সম্পর্ক কম। যারা ডেটিংয়ে আত্মবিশ্বাসী নন অথবা বাস্তব জীবনে সঙ্গী খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন, তারা এই পরিষেবার মাধ্যমে ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। আবার অনেকসময় বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীর সামনে সঙ্গী হিসেবে কাউকে উপস্থাপন করার সামাজিক চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে এই পরিষেবা ব্যবহার করেন।
'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' পরিষেবাগুলো হলো, ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলা, সিনেমা দেখা, পার্কে ঘোরা, থিম পার্কে যাওয়া, বা কেনাকাটা করা, বেশিরভাগ পরিষেবায় হাতে হাত রাখা বা কাঁধে মাথা রাখার মতো হালকা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অনুমোদিত। কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহক তার বন্ধু বা পরিবারের কাছে সঙ্গী হিসেবে ভাড়া করা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যেতে পারলেও এই পরিষেবাগুলি যৌন পরিষেবা নয়। এর কিছু কঠোর নিয়ম রয়েছে; যেমন রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কোনো ধরনের যৌন কার্যকলাপ বা ঘনিষ্ঠতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ; উভয় পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেটিং সাধারণত জনসমক্ষে আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ক্যাজুয়াল চুম্বন বা আলিঙ্গনের বেশি ঘনিষ্ঠতা নিষিদ্ধ। ডেটিংয়ের স্থানের খরচ (যেমন খাবার, সিনেমার টিকিট) গ্রাহককে বহন করতে হয়।

জাপানে 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বেশ জটিল। আর সেগুলো জাপানি সমাজের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আর আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তেমন কিছু কারণ:
জাপানে অনেক যুবক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, যা 'হিক্কিকোমোরি' নামে পরিচিত। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের বাস্তব জীবনে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড পরিষেবা তাদের সাময়িক ও নিরাপদ উপায়ে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ দেয়। এছাড়া বাস্তব জীবনে একটি সম্পর্ক শুরু করা, বজায় রাখা এবং তার প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের মধ্যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এই পরিষেবা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সম্পর্কের জটিলতা ও মানসিক ঝুঁকি অথবা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে শুধু একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা পেতে পারে।
অনেক ব্যবহারকারী মনে করেন যে তারা নিজের যোগ্যতায় একজন সঙ্গিনী খুঁজে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয় বা সফল নন। অথচ অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে তারা সহজে একজন সুন্দর ও মনোযোগী সঙ্গিনী পান, যা তাদের ধারণামতে আত্মসম্মান সাময়িকভাবে বাড়িয়ে তোলে। এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে সমালোচিত হওয়ার বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় কম থাকে, যা দুর্বল আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য মানসিক স্বস্তি এনে দেয়।
রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড পরিষেবার গার্লফ্রেন্ডরা তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে সবসময় সহানুভূতিশীল, মনোযোগী ও বিনোদনমূলক হন। কারণ এটিই তাদের পেশা। গ্রাহক টাকা দিয়ে সম্পর্কের একটি আদর্শ সংস্করণ উপভোগ করতে পারে, যেখানে ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি বা বিরক্তি নেই। তবে তা আসলে এক ধরনের পলায়নবাদ।
জাপানের কঠোর কর্ম সংস্কৃতি আর একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন থেকে মুক্তি পেতে, নতুনত্বের স্বাদ পেতে অনেকেই এই পরিষেবা ব্যবহার করেন।
জাপানের আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষদের মধ্যে আবেগ প্রকাশের সুযোগ কম থাকে; তারা নিজেদের অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ডরা মূলত তাদের আবেগিক শ্রম বিক্রি করেন—তারা শোনেন, প্রশংসা করেন এবং গ্রাহকের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করেন। কিছু গ্রাহক নিয়মিত মানুষের সঙ্গে কথা বলার ও মেলামেশার অভ্যাস বজায় রাখার জন্য এটি ব্যবহার করেন, যদিও তা একটি কৃত্রিম প্ল্যাটফর্মে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে জাপানে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠার মূল মনস্তাত্ত্বিক কারণ হল জাপানি সমাজে গভীর শিকড় জুড়ে গেঁড়ে থাকা বিচ্ছিন্নতা।
রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড বা অন্যান্য পরিষেবাগুলোতে আবেগ যখন 'পণ্য' হিসেবে বিক্রি হয়, তখন এটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, ‘মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করে, পণ্যের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে।’পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষ তার সৃজনশীল, মানবিক প্রকৃতি ভুলে গিয়ে কেবল টাকা উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত হয়। বাজারের প্রতিযোগিতা আর কাজের চাপ মানুষকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অন্যান্য মানুষ আর সহযোগী বা বন্ধু থাকে না, বরং প্রতিযোগী বা অন্যান্য শ্রমিকের দাস হিসেবে গণ্য হয়।

কার্ল মার্কস তাঁর ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক মেনুস্ক্রিপ্ট ১৮৪৪’-এর পাণ্ডুলিপিতে পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতাকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো--পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা, মানুষ হিসেবে নিজের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যান্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কাজের একঘেঁয়েমি আর প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সৃজনশীলতা ও আবেগের জন্য সময় ও শক্তি খুঁজে পায় না। এর ফলে তারা তাদের শ্রমের ফলাফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাজ শেষ করার পর মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারণে মানুষের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার আগ্রহ কমে যায়। কেননা পুঁজিবাদে সময় হলো অর্থ; প্রতিটি মুহূর্তকে তাই উৎপাদনশীল ও লাভজনক করার চাপ থাকে। এজন্য সম্পর্ক তৈরি করা বা মানসিক পরিচর্যার মতো 'অলাভজনক' বিষয়গুলো সেখানে গুরুত্ব হারায়, যা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এই প্রবণতা মানুষকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হতে উৎসাহিত করে। আর তাই অপরের প্রতি সহানুভূতির অভাব দেখা যায় আর সম্পর্কগুলোও গড়ে ওঠে লেনদেনের ভিত্তিতে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ঐতিহ্যগত পরিবার ও সম্প্রদায়ের বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মানুষ একা হয়ে পড়ে। শহরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা ও কাজের চাপে প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় না। এই গভীর একাকিত্ব দূর করার জন্যই মানুষ অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক খোঁজে। জাপানে ঠিক এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’নামে বিচিত্র এক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। জাপানে এটি এমন এক ধরনের পরিষেবা, যেখানে পুরুষেরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন মহিলা সঙ্গীকে ভাড়া নিতে পারেন।
জাপানে কবে থেকে এই পরিষেবার আরম্ভ তার সুনির্দিষ্ট তারিখ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ কোনো একক ঘটনার মাধ্যমে তা শুরু হয়নি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাপানের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ‘কম্পেনসেটেড ডেটিং’ বা ‘এসকর্ট’ পরিষেবার ধারণা থেকেই এর উদ্ভব হয়েছে। ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকে জাপানে এই ধরনের ডেটিং পরিষেবা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এই সংস্কৃতি জাপানে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, ২০১৭ সাল থেকে এই বিষয়বস্তু নিয়ে জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজও তৈরি হয়েছে। সিরিজগুলো প্রকাশের পর ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’ সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
মাঙ্গা কী? জাপানের অত্যন্ত জনপ্রিয় কমিক্স বা গ্রাফিক উপন্যাস হলো ‘মাঙ্গা’। ‘মান’মানে খেয়ালি, ‘গা’মানে ছবি অর্থাৎ মাঙ্গা মানে, ‘খেয়ালি ছবি’। জাপানে শব্দটি সব ধরনের কমিক্স, কার্টুন ও অ্যানিমেশন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যার স্বতন্ত্র শৈল্পিক ধরন রয়েছে। যেমন মাঙ্গা সাধারণত সাদা-কালোতে প্রকাশিত হয়; এর গল্পের গতি ও চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তি (বিশেষত বড় চোখ ও মুখের ভাব) পশ্চিমা কমিক্স থেকে আলাদা। জাপানে জনপ্রিয় মাঙ্গাগুলো প্রায়শই অ্যানিমে সিরিজে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া মাঙ্গা থেকে চলচ্চিত্র, ভিডিও গেম ও লাইভ-অ্যাকশন সিরিজও তৈরি করা হয়। শিল্পীদের মধ্যে যারা মাঙ্গা তৈরি করেন, তাদের বলা হয় ‘মাঙ্গাকা’।
মাঙ্গাকা রেজি মিয়াজিমার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজের নাম ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’। সিরিজটি কাল্পনিক হলেও জাপানের জনপ্রিয় ‘রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড’পরিষেবার ধারণার ওপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করা হয়েছে। এই সিরিজের প্রধান চরিত্র কাজুয়া কিনোশিতা একজন কলেজ ছাত্র, যে তার প্রেমিকা মামি নানামির কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হতাশ হয়ে গার্লফ্রেন্ড ভাড়া করার পরিষেবা ব্যবহার শুরু করে। আর চিজুরু মিজোহারা হলো সেই পেশাদার 'ভাড়াটে গার্লফ্রেন্ড', যাকে কাজুয়া ভাড়া করেছিল।
চিজুরু তার কাজে খুবই সিরিয়াস, কমিক্সে কাজুয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটি ভুল বোঝাবুঝি, হাস্যরস আর জটিল অনুভূতির মধ্য দিয়ে এগোয়। হতাশা থেকে সে একটি 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' অ্যাপের মাধ্যমে চিজুরু মিজোহারাকে ভাড়া করে। প্রথম ডেটে চিজুরুর নিখুঁত আচরণে কাজুয়া মুগ্ধ হয়। কিন্তু পরে কিছু ঘটনাচক্রে, যেমন তাদের দাদিদের একই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং ভুল করে একে অপরের প্রতিবেশী হওয়া, কাজুয়া ও চিজুরুকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করে যে তারা আসলে ডেটিং করছে। তাদের এই 'ভাড়াটে' সম্পর্কটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জটিল ও গভীর হতে থাকে, যেখানে চিজুরু তার পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। কাজুয়া ধীরে ধীরে চিজুরুর আসল গুণাবলি আবিষ্কার করে এবং তার প্রেমে পড়ে। মাঙ্গাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এটিকে অ্যানিমে সিরিজে রূপান্তরিত করা হয়, যার বেশ কয়েকটি সিজন মুক্তি পেয়েছে। এই সিরিজ জাপানের 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে আরও বেশি পরিচিত করে তুলেছে।
'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতি মূলত মানুষের একাকিত্ব দূর করা এবং রোমান্টিক ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তৈরি হয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও সীমা মেনে চলে। জাপানে এই সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ সেখানকার মানুষের একাকিত্ব বিশেষত যাদের সামাজিক সম্পর্ক কম। যারা ডেটিংয়ে আত্মবিশ্বাসী নন অথবা বাস্তব জীবনে সঙ্গী খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন, তারা এই পরিষেবার মাধ্যমে ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। আবার অনেকসময় বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীর সামনে সঙ্গী হিসেবে কাউকে উপস্থাপন করার সামাজিক চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে এই পরিষেবা ব্যবহার করেন।
'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' পরিষেবাগুলো হলো, ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলা, সিনেমা দেখা, পার্কে ঘোরা, থিম পার্কে যাওয়া, বা কেনাকাটা করা, বেশিরভাগ পরিষেবায় হাতে হাত রাখা বা কাঁধে মাথা রাখার মতো হালকা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অনুমোদিত। কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহক তার বন্ধু বা পরিবারের কাছে সঙ্গী হিসেবে ভাড়া করা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যেতে পারলেও এই পরিষেবাগুলি যৌন পরিষেবা নয়। এর কিছু কঠোর নিয়ম রয়েছে; যেমন রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কোনো ধরনের যৌন কার্যকলাপ বা ঘনিষ্ঠতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ; উভয় পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেটিং সাধারণত জনসমক্ষে আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ক্যাজুয়াল চুম্বন বা আলিঙ্গনের বেশি ঘনিষ্ঠতা নিষিদ্ধ। ডেটিংয়ের স্থানের খরচ (যেমন খাবার, সিনেমার টিকিট) গ্রাহককে বহন করতে হয়।

জাপানে 'রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড' সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বেশ জটিল। আর সেগুলো জাপানি সমাজের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আর আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তেমন কিছু কারণ:
জাপানে অনেক যুবক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, যা 'হিক্কিকোমোরি' নামে পরিচিত। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের বাস্তব জীবনে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড পরিষেবা তাদের সাময়িক ও নিরাপদ উপায়ে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ দেয়। এছাড়া বাস্তব জীবনে একটি সম্পর্ক শুরু করা, বজায় রাখা এবং তার প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের মধ্যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এই পরিষেবা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সম্পর্কের জটিলতা ও মানসিক ঝুঁকি অথবা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে শুধু একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা পেতে পারে।
অনেক ব্যবহারকারী মনে করেন যে তারা নিজের যোগ্যতায় একজন সঙ্গিনী খুঁজে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয় বা সফল নন। অথচ অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে তারা সহজে একজন সুন্দর ও মনোযোগী সঙ্গিনী পান, যা তাদের ধারণামতে আত্মসম্মান সাময়িকভাবে বাড়িয়ে তোলে। এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে সমালোচিত হওয়ার বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় কম থাকে, যা দুর্বল আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য মানসিক স্বস্তি এনে দেয়।
রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড পরিষেবার গার্লফ্রেন্ডরা তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে সবসময় সহানুভূতিশীল, মনোযোগী ও বিনোদনমূলক হন। কারণ এটিই তাদের পেশা। গ্রাহক টাকা দিয়ে সম্পর্কের একটি আদর্শ সংস্করণ উপভোগ করতে পারে, যেখানে ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি বা বিরক্তি নেই। তবে তা আসলে এক ধরনের পলায়নবাদ।
জাপানের কঠোর কর্ম সংস্কৃতি আর একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন থেকে মুক্তি পেতে, নতুনত্বের স্বাদ পেতে অনেকেই এই পরিষেবা ব্যবহার করেন।
জাপানের আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষদের মধ্যে আবেগ প্রকাশের সুযোগ কম থাকে; তারা নিজেদের অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ডরা মূলত তাদের আবেগিক শ্রম বিক্রি করেন—তারা শোনেন, প্রশংসা করেন এবং গ্রাহকের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করেন। কিছু গ্রাহক নিয়মিত মানুষের সঙ্গে কথা বলার ও মেলামেশার অভ্যাস বজায় রাখার জন্য এটি ব্যবহার করেন, যদিও তা একটি কৃত্রিম প্ল্যাটফর্মে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে জাপানে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠার মূল মনস্তাত্ত্বিক কারণ হল জাপানি সমাজে গভীর শিকড় জুড়ে গেঁড়ে থাকা বিচ্ছিন্নতা।
রেন্ট-এ-গার্লফ্রেন্ড বা অন্যান্য পরিষেবাগুলোতে আবেগ যখন 'পণ্য' হিসেবে বিক্রি হয়, তখন এটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, ‘মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করে, পণ্যের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে।’পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষ তার সৃজনশীল, মানবিক প্রকৃতি ভুলে গিয়ে কেবল টাকা উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত হয়। বাজারের প্রতিযোগিতা আর কাজের চাপ মানুষকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অন্যান্য মানুষ আর সহযোগী বা বন্ধু থাকে না, বরং প্রতিযোগী বা অন্যান্য শ্রমিকের দাস হিসেবে গণ্য হয়।
.png)

ক্যালেন্ডারের পাতায় গতকাল ছিল ১৭ নভেম্বর। এক বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে এই দিনটি ‘আনফ্রেন্ড ডে’। আপনি কতজনকে আনফ্রেন্ড বা মোস্তফা জব্বারের ভাষায় ‘অবন্ধু’ করলেন?
১ দিন আগে
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক কিংবদন্তিতুল্য পুরুষ। তাঁর সংগ্রামী ও আপোষহীন নেতৃত্ব অগণিত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত এই নেতার রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই রাজনীতিতে এসেছিলেন।
২ দিন আগে
আজ সুর-সম্রাজ্ঞী রুনা লায়লার জন্মদিন। রুনা লায়লা ও তাঁর গানে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি, সময়ের আবেশ, প্রেম ও একাকিত্ব নিয়ে ‘মায়ার সিংহাসন’ গীতি-উপন্যাস লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির। উপন্যাস লেখার ঘোরলাগা ভ্রমণ লেখক শেয়ার করেছেন স্ট্রিম পাঠকদের সঙ্গে।
২ দিন আগে
আজ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। শোষণ ও বঞ্চনাহীন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে এ লেখা।
২ দিন আগে