leadT1ad

স্মার্ট প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নগর স্যানিটেশনে আসছে সাফল্য

বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট পাবলিক স্যানিটেশন সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে সামাজিক উদ্যোগ ‘ভূমিজ’। স্মার্ট প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক মডেল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভূমিজ পাবলিক টয়লেটগুলোকে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও সহজলভ্য সেবা কেন্দ্রে রূপান্তর করছে। তাদের ‘যাব কোথায়?’ অ্যাপ এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা নগরবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করছে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাস্থ্যসম্মত শহর গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে, যা নগর ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ফারহানা রশীদ
ফারহানা রশীদ

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। শহরগুলোতে মানুষের চলাচল, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে নগর চিত্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার এবং বিভিন্ন শহরতলি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই উন্নয়নের মাঝেও মৌলিক নগরসেবা, বিশেষ করে পাবলিক স্যানিটেশন, এখনো অপর্যাপ্ত। শহরের জনগণ দিনভর নানা প্রয়োজনের জন্য বাইরে থাকেন, তবে তাদের জন্য নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন এবং মানসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা সীমিত।

শুধু মহানগরী ঢাকাতেই জনসংখ্যা ১ কোটি ২৯ লাখের বেশি। ওয়াটারএইড বাংলাদেশের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে প্রায় ৬৪১টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র প্রায় ১০০টির মতোই মানসম্মত। বাকিগুলোর বেশিরভাগই নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। এই পরিস্থিতি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনকে অপ্রতুল স্যানিটেশন সুবিধার কারণে অনেকাংশে জটিল করে তুলেছে।

ঢাকার কর্মক্ষম জনসংখ্যার বড় অংশ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের সম্প্রদায়ের, যারা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক কাজে নিযুক্ত। তাদের দৈনন্দিন কাজের ধরন ও সময়ের কারণে তারা প্রায় ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় বাড়ির বাইরে থাকেন। এর পাশাপাশি দেশের জেলা থেকে লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা এই জনসংখ্যা চাপ এবং যানজটের কারণে নাগরিকদের অনেক সময় যানবাহন বা সড়কে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অধিকাংশ পাবলিক টয়লেট যথাযথভাবে পরিচালিত হয় না। কিছু ব্যতিক্রম মান সম্মত টয়লেট থাকলেও শহরের প্রায় সব স্থানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে জন্ম নেয় ভূমিজ ব্র্যাক এর আরবান ইনোভেশোন চ্যালেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে একটি সামাজিক উদ্যোগ, যা বাংলাদেশের নগর স্যানিটেশনকে নতুনভাবে বোঝা, তৈরি করা এবং পরিচালনা করা শুরু করে। মূল ধারণা ছিল সহজ: পাবলিক টয়লেটও একটি নাগরিক সেবা। সঠিক পরিকল্পনা, নকশা, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত হলে এটি নগরবাসীর সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে এবং টেকসই নগর বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ভূমিজের যাত্রা সহজ ছিল না। তখন বাংলাদেশের পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো স্পষ্ট ব্যবসায়িক বা পরিচালনা কাঠামো ছিল না। অনেক টয়লেট নির্মাণ হলেও তা দীর্ঘমেয়াদে মানসম্মত সেবা দিতে ব্যর্থ হতো। ভূমিজ এই সমস্যা চিহ্নিত করে একটি স্মার্ট ও স্থানভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে।

এই মডেলের মূল লক্ষ্য হলো টয়লেটকে শুধু নির্মাণ হিসেবে নয়, বরং নগরবাসীর জন্য একটি কার্যকর নাগরিক সেবা হিসেবে গড়ে তোলা। টয়লেট স্থাপন করা হয় জনসংখ্যার ঘনত্ব, চলাচলের হার এবং ব্যবহারকারীর ধরন অনুযায়ী। যেমন—হাসপাতালের আশেপাশে: রোগী ও পরিজনদের উচ্চ চাহিদার জন্য। রাস্তার মোড়ে: পথচারী ও যাত্রীদের জন্য বিরতি এবং প্রয়োজনীয় সেবা। পার্ক বা খোলা স্থানে: পরিবারের এবং শিশুদের জন্য সহজলভ্যতা। রেলওয়ে স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডে: দ্রুত ও পরিচ্ছন্ন সেবা। কোর্ট বিল্ডিং বা আদালতের আশেপাশে: নাগরিক ও আইনগত কর্মকাণ্ডের অংশগ্রহণকারীদের জন্য দ্রুত, নিরাপদ এবং পরিচ্ছন্ন সেবা নিশ্চিত করা।

বিজনেস মডেলটি ব্যবহারকারীর ধরন অনুযায়ী আয়ের উৎস ও পরিচালনা পদ্ধতি নির্ধারণ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টয়লেট ব্যবহার থেকে আয়কৃত অর্থ দিয়ে পুরো পরিচালনা ব্যায় নির্বাহ করা সম্ভব হয়না। সেই ক্ষেত্রে পরিচালনার ব্যয় মেটানোর জন্য সাথে ছোট দোকান বা কফি শপ দোকান তৈরি করা এবং টয়লেটের ভিতরের ও বাইরের দেয়ালের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন প্রাচারের সুযোগ করে তার মাধ্যমে আয়ের সুযোগ তৈরি। এছাড়া লন্ড্রি, ওয়াশিং বা অন্যান্য অতিরিক্ত পরিষেবা যোগ করে আয় বৃদ্ধি করা হয়।

প্রযুক্তির ব্যবহার ভূমিজের মডেলকে আরও শক্তিশালী করেছে। রিয়েল-টাইম মনিটরিং, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবহার ডেটা সংগ্রহ করে সেবার মান নিশ্চিত করা হয়। সেন্সরভিত্তিক টেকনলজি ব্যবহারের মাধ্যমে টয়লেট গুলোর ভিতরের গন্ধ ও অন্যান্য অবস্থা পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রন করা হয়। ফলে, টয়লেটগুলো ক্রমাগত পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়, নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন থাকে এবং নগরবাসীর জীবনযাত্রা স্বাস্থ্যসম্মত ও সুবিধাজনক হয়।

ভূমিজের টয়লেট ব্যবস্থাপনা মডেলের উল্লেখযোগ্য দিক হলো কোলাবোরেটিভ মডেলের মাধ্যমে টেকসই সেবা নিশ্চিত করা। ব্র্যাক, ওয়াটার এইডের মত আইএনজিও/এনজিও যেমন আর্থিক সহযোগিতা, জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে, তেমনি ভাবে কর্পোরেট সংস্থা যেমন ইউনিলিভার বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা ও পরিচালনা ব্যয় বহনে সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিয়ে টয়লেট স্থাপন ও পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও অনেক আইএনজিও/এনজিও, কর্পোরেট সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ভূমিজকে পরামর্শ ও সমর্থন দিয়ে টয়লেটগুলো মানসম্মত, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ রাখার কাজকে শক্তিশালী করেছে।

ভূমিজের মডেল প্রমাণ করেছে, পাবলিক টয়লেট কোনো অবহেলিত স্থান নয়; বরং এটি নিরাপদ, আরামদায়ক এবং মর্যাদাপূর্ণ সেবা কেন্দ্র হতে পারে। আজ প্রতিদিন ৭০ টির মত পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ভূমিজের সেবা গ্রহণ করছেন। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, নারীর নিরাপত্তা এবং উন্নত নগরজীবন নিশ্চিত করতে ভূমিজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এটি শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয়, বরং বাংলাদেশের নগর জীবনের মানসিক ও স্বাস্থ্যগত পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। ২০১৭ সালে নারী ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৩% । বর্তামানে তা বেড়ে ২৫% এবং কোথাও কোথাও ৫০%-এ উন্নিত হয়েছে।

ভূমিজ আরও চালু করেছে ‘যাব কোথায়?’ অ্যাপ। এটি একটি স্মার্ট পাবলিক টয়লেট ফাইন্ডার অ্যাপ, যা নাগরিকদের জন্য নগরের স্যানিটেশন সুবিধাকে ডিজিটালভাবে সহজলভ্য করে। অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা জিপিএস-ভিত্তিক লোকেশন, টয়লেটের ছবি, পরিচ্ছন্নতার অবস্থা, রেটিং এবং সুবিধা দেখতে পারেন। গুগল ম্যাপস ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে সহজে ও দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব। কিউআর কোড স্ক্যান করে নিরাপদে প্রবেশ ও পেমেন্ট করা যায়। বিকাশের মাধ্যমে ব্যালেন্স রিচার্জও করা যায়। ব্যবহার শেষে রেটিং দিয়ে সেবা মান উন্নয়নে সহায়তা করা যায়। এটি শুধুমাত্র একটি অ্যাপ নয়, বরং বাংলাদেশের আরবান স্যানিটেশন ইকোসিস্টেমকে ডিজিটালভাবে যুক্ত করার একটি বড় পদক্ষেপ, যা নাগরিকদের জীবনকে আরও নিরাপদ, সহজ এবং স্বাস্থ্যসম্মত করছে।

ফলে, ভূমিজের উদ্ভাবনী মডেল প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা, স্থানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সহযোগিতার মাধ্যমে পাবলিক স্যানিটেশনকে শুধুমাত্র একটি মৌলিক নাগরিক সেবা হিসেবে নয়, বরং নগরের অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও টেকসই জীবনধারার অংশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এটি নগর ব্যবস্থাপনায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং ভবিষ্যতের শহর পরিকল্পনার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

আগামীর লক্ষ্য আরও বড়। ২০৩০ সালের মধ্যে ১,০০০টি পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনার মাইলফলক অর্জনের মাধ্যমে সারা দেশে স্মার্ট, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন সুবিধা ছড়িয়ে দিতে ভূমিজ অঙ্গীকারবদ্ধ। আর সেটা সম্ভব হবে যদি সিটি কর্পরেশোন থেকে শুরু করে এনজিও, কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ সকলেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসে এক যোগে কাজ করে। ভূমিজ বিশ্বাস করে স্মার্ট সিটি গড়ে ওঠে শুধু বড় অবকাঠামোর মাধ্যমে নয়; মানুষের প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদার প্রতি যত্ন, উদ্ভাবন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই।

লেখক: সিইও, ভূমিজ

Ad 300x250

সম্পর্কিত