জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের লাশ ভ্যানে তোলা ও পেট্রোল ঢেলে আগুনে পোড়ানোর ঘটনায় নেতৃত্ব দেন থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বিশ্বজিৎ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি জানলেও তখন কোনো ব্যবস্থা নেননি। ওই ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ আবজালুল হক রাজসাক্ষীর জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন।
আজ বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিচারক মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর দুই সদস্যের প্যানেল তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাঁকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
জবানবন্দিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ওই ঘটনার বর্ণনায় এসআই আবজালুল বলেন, ওই দিন সকালে আশুলিয়া থানায় ওসি সায়েদ সবাইকে ডেকে হ্যান্ডমাইকে ব্রিফিং দেন। তিনি আন্দোলনকারীদের শক্তভাবে দমনে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন। এরপর দুপুরের দিকে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর এলে ওসি ফোর্স নিয়ে থানায় ফিরে আসেন এবং থানার গেটে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টার দিকে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল থানার দিকে এগোলে ওসির নির্দেশে এএসআই বিশ্বজিৎ ও অন্য সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান।
তিনি আরও বলেন, ওই সময় ওসি সায়েদ থানার ভেতর পায়চারী করছিলেন এবং ফোনে ‘স্যার, স্যার’ বলে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। পরে ওসির নির্দেশেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য রাস্তায় পড়ে থাকা লাশগুলো ভ্যানে তুলে পুলিশের একটি পিকআপে রাখেন। ওই সময় ওসি সায়েদ, এসআই মালেক ও এএসআই বিশ্বজিৎ নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে পরামর্শ করছিলেন। তিনি (আবজালুল) সেখানে গেলে তাঁরা কথা বন্ধ করে দেন।
আবজালুলের ভাষ্য, ‘তাদের আচরণ দেখে মনে হলো তাঁরা কোনো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করছেন। আমি তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি এবং নার্ভাস ফিল করি। সিদ্ধান্ত নিই, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না।’
এরপর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে সাধারণ পোশাকে নিজের ইস্যু করা পিস্তলসহ থানার অদূরে এক ফল বিক্রেতার বাসায় আশ্রয় নেন তিনি। পরে সেখান থেকে নিজের বাসায় যান। ঘটনার ১০ দিন পর ১৫ আগস্ট থানায় অস্ত্র জমা দিতে গিয়ে লাশ পোড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত হন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে আবজালুল ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ৫ আগস্টই ওসি সায়েদ ও বিশ্বজিৎ মিলে ভ্যানে থাকা লাশগুলোতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় এলাকা ছাড়েন। ঢাকার তৎকালীন ডিআইজি, এসপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
জবানবন্দির শেষপর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কোনো প্রলোভন ছাড়াই আমি রাজসাক্ষী হয়েছি। শহীদ ভাইদের জন্য কিছু করতে না পারায় আমি তাঁদের পরিবার ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চাই।’
গত বছরের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান পাঁচ তরুণ। তাঁদের লাশের পাশাপাশি গুরুতর আহত এক তরুণকে পরে একটি পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। এরপর গাড়িটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়।
এ মামলায় চলতি বছরের ২ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশন। এতে ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। পরে আট আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন– ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) এ মামলায় শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনো পলাতক রয়েছেন।
গত ২১ আগস্ট এ মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ওই সময় উপস্থিত আট আসামির সাতজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। আর দোষ স্বীকার করে এসআই শেখ আবজালুল হক ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হতে আবেদন করলে আদালত তা গ্রহণ করেন।
গত ১২ নভেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ থাকলেও প্রসিকিউশন আবজালুলকে হাজির করেননি। গতকাল মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) পরবর্তী দিনে আসামিদের হাজির করা হলেও সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। পরে আজ আবজালুলের জবানবন্দি নেওয়া হয়।