ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ক্যাওয়াজ দেখে একবার ক্ষেপে উঠলেন শিবরাম চক্রবর্তী। এঁদের মিলন ঘটানো কী অসম্ভব? —ভাবলেন তিনি। একবার মন্দির বানানোর চিন্তা করেছিলেন। পরে দেখলেন সেখানে কেবল হিন্দুরাই আসবেন, আবার মসজিদ বানালে সেখানে আসবে কেবল মুসলমানেরা। গির্জা হলেও তাই। তখন তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন: কী করা যায়? কয়েকদিন ধ্যানে মগ্ন রইলেন। গভীর ধ্যান থেকে পেলেন ‘টয়লেট’-এর আইডিয়া। তাঁর মতে, একমাত্র টয়লেটই ভালো সমাধান। এখানেই সবাই আসবেই আসবে। নিম্নচাপের ফলে কোনো বাঁধাই কেউ মানবে না। টয়লেটে ঢুকতে বাধ্য। তাই বলা যায়, শিবরামের টয়লেট হলো এক সাম্যবাদী প্রকল্প। যেখানে কোনো শ্রেণি বা জাতের বিভাজন নেই।
শিবরাম এমন এক ঘরের কথা বললেন যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অটুট। কোনো বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বা কর্পোরেট ফ্রেশনেসের ফাঁদ নেই। এই ভাবনা হয়তো ইউটোপিয়ান, কিন্তু এর মধ্যে আছে এক ধরনের গণতান্ত্রিক রসবোধ। যেখানে চাপের সামনে সবাই সমান। শিবরামের সৌন্দর্য এখানেই—তিনি দেখালেন, মানুষের মধ্যে জাতই-ধর্মে চরম বৈরিতা থাকলেও ‘নিম্নচাপে’ অদ্ভুত এক মিল আছে।
‘টয়লেটের’ বাংলা তর্জমা কি করা যায়, ‘হাগার ঘর’? কিন্তু টয়লেটে তো মানুষ প্রস্রাবও করে। শুধু হাগার ঘর বলাও সমীচিন নয়। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়া মামুলি এই ঘরখানাকেও বাণিজ্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। ফাইভস্টার হোটেল বা অফিসে টয়লেটের নাম হয়ে গেছে ‘রেস্ট রুম’ বা ‘ফ্রেশ রুম’। সমাজের উচুতলায় ‘টয়লেট’ কথাটাই একটা অচ্ছুত জিনিস।
আমার এক ছোটভাই’র অফিসে গেছি, সে আমাকে চেয়ারে অপেক্ষা করিয়ে বলে, ‘ভাই, বসেন, আমি একটু ফ্রেশরুমে ঢুকবো, দু মিনিট রিলস দেখে আবার কাজে ঝাঁপাইয়া পড়ব।’ শারীরিক চাপের জায়গা হয়ে গেছে মানসিক ফ্রেশনেসের কনসেপ্ট। শিবরামের গণ-আকাঙ্ক্ষার টয়লেট আর কর্পোরেট ফ্রেশরুম—দুই জগতের দুই মেরু, দুইটি আলাদা দর্শন।
পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ হয়ে গেছে বায়ো-মেকানিক্যাল রোবট। কাজ ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর ক্লান্ত কর্মকর্তারা ফ্রেশরুমে গিয়ে রিল দেখে। খানিক বিশ্রাম নেয়। দশ বাই বারো ফুটের ঘরে খাওয়া, থাকা, হাগা, রিলস দেখা—সব একসঙ্গে। রাষ্ট্রও চায় এই আইসোলেশন, যাতে ব্যক্তি সমাজের সঙ্গে কানেক্টেড না থাকে। বিচ্ছিন্ন মানুষই ক্ষমতার কাঠামোকে শক্তিশালী করে।
একসময় রাস্তায় বা গলিতে আড্ডা দিয়ে মিছিল হতো। এখন ফেসবুক স্ক্রল করে বিপ্লবী পোস্ট প্রসব হয়। মেসেঞ্জারে, ফাঁকা রুমে লেনিন শেখানো এখন আধুনিকতা। ঘুপচি দোকানে ছিল আড্ডা। সেখানে আলোচিত হতো কিশোরীর গল্প, রসময়গুপ্তের সাহিত্য বা বন্ধুদের মধ্যে খেলা নিয়ে তর্ক। টয়লেটের ভেতরটাই যেন এখন ছোট্ট এক নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন, যেখানে চাপ সামলানো আর চাপ ঝেড়ে ফেলা সমার্থক হয়ে ওঠে। আমাদের এইসব কর্পোরেট টয়লেটের দরজায় লেখা থাকে ‘ফ্রেশ’—কিন্তু ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়, আসলে সেটা চাপের রুম, যেখানে মানুষ চাপ ঝাড়ে আর চাপ জমায়।
ঘরের ভেতর টয়লেটের ধারণা আমাদের অঞ্চলে খুব পুরোনো নয়—তিন-চার দশকের ইতিহাস। এর সঙ্গে এসেছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি কনসেপ্ট: আমি, আমার স্ত্রী, দুসন্তান—এর বাইরে কেউ নেই। উঠোনে চাচার ঘর, আড্ডা, হুল্লোড়—সব হারিয়ে গেছে। এখন সবাই ঘরের দরোজায় তালা মেরে ভেতরে বানানো টয়লেটে হাগে।
এই পরিবর্তন শুধু স্থাপত্য নয়, সামাজিক সম্পর্ককেও বদলে দিয়েছে। আগে উঠোনে বসে গল্প, হাসি, কান্না ভাগাভাগি হতো; এখন প্রত্যেকে নিজের ঘরে বন্দি। রাষ্ট্র, কর্পোরেট, আধুনিকতা—সব মিলিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। টয়লেট হয়ে উঠেছে এক ধরনের প্রতীক, যেখানে মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তিগত চাপ সামলায়। অথচ শিবরামের টয়লেট ছিলো উন্মুক্ত, গণমুখী, সাম্যবাদী। আজকের টয়লেট হলো ব্যক্তিগত, বদ্ধ, কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত। আগে মানুষ উঠোনে, রাস্তায়, গলিতে বসে চাপ ঝাড়তো, এখন চাপ ঝাড়ে ওয়াই-ফাই রাউটারের পাশে। আর এই চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন বিনোদন—রিল দেখা, কিংবা ফেসবুক স্ক্রল করে পোস্ট দেওয়া। ফলে টয়লেট হয়ে উঠেছে আধুনিকতার এক অদ্ভুত ল্যাবরেটরি, যেখানে চাপ থেকে জন্ম নেয় কনটেন্ট অথবা ‘আই এম আ কন্টেন্ট ক্রিয়েটর’!
ঘরের মধ্যে টয়লেট, নাকি বাইরে টয়লেট বিতর্ক---এর সঙ্গে যুক্ত আছে সময় দেশ ও স্থানিক সংস্কৃতি ও দর্শনের সম্পর্ক। যে কারণে টয়লেটের ধরনও দেশভেদে আলাদা। ফরাসিদের টয়লেটের ধরন হলো, ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ—সরাসরি সুয়ারেজে ফ্লাশ। জার্মানরা নৃশংস—ফলে তাদের বানানো টয়লেটে মল কিছুক্ষণ ভেসে থাকে, যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়। বৃটিশরা মাঝামাঝি—তক্তা আগে নেয়, তক্তার চরিত্র বোঝে তারপর সেখানে পেরেক মারে। তাদের টয়লেটে মলগুলো ব্যক্তির সামনে খুব বেশি সময় হাজির থাকে না আবার খুব দ্রুতও সুয়ারেজে যুক্ত হয় না।
তিনটি দেশের টয়লেট বানানোর পদ্ধতি সামনে এনে জিজেক জার্মান দার্শনিক হেগেলকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন ইউরোপিয়ান দর্শনকে বোঝাতে। আমাদের অঞ্চলে এই ইউরোপীয় সিলসিলা সাংঘর্ষিক। ঘরের মধ্যে ছোট একটি ঘর বানিয়ে সেখানে হাগতে বসা’র অভ্যাস অল্পদিনের।
আমার ৯৫ বছরের মা ঢাকায় এসে ঘরের ভেতর টয়লেট দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন—‘এ আল্লাহ! এহেনি হাগতি গিলি দম আইটকে মইরে যাবানি মনা।’ তাঁর কাছে টিস্যু মানে পাছা মুছতে টাকা খরচ। দরোজা পুরোপুরি লাগান না, ভেজিয়ে দেন—কারণ ভেতরে যদি কিছু ঘটে, বাইরে কেউ বুঝবে না। তিনি পুত্রবধূদের বলেন—‘এ মা আমাদ্দিকি এট্টু খিয়াল রাহিস।’ এই অভিজ্ঞতা দেখায়—টয়লেট শুধু চাপ সামলায় না, প্রজন্মের ভাবনাকেও প্রকাশ করে।
আধুনিকতা যেখানে টয়লেটকে ব্যক্তিগত আইসোলেশনের প্রতীক বানিয়েছে, সেখানে পুরোনো প্রজন্ম টয়লেটকে ভয়, হাস্যরস আর সামাজিকতার সাথে যুক্ত করেছে। শেষমেশ দেখা যায়, টয়লেট আসলে সভ্যতার আয়না—যেখানে চাপের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের চরিত্রও প্রতিফলিত হয়। টয়লেট দিয়ে বোঝা যায়, আমার মায়েদের প্রজন্ম দম আটকে মরে যাবেন? নাকি এখনও খোলা বাতাসে হেঁটে বেড়াবেন?