leadT1ad

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সংগৃহীত ছবি

উনিশ শতকের শেষতম দশক। গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক স্কুল শিক্ষক। এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে পরশপাথরের মতো খুঁজে ফিরছেন ‘অতি সামান্য’ জিনিস, পুরোনো পুঁথি। মনে হতে পারে, আহামরি কিছু নয়। উচ্চবর্গের ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র কাছে এর বিশেষ কদর থাকার কথাও নয়। কিন্তু কেউ কেউ এর মূল্য বুঝেছিলেন ভবিষ্যতের বিচারে; সেই জনাকয়েক সমঝদার ব্যক্তির একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।

পুঁথি খুঁজতে গিয়ে কেরানির চাকরিটিও হারিয়েছিলেন। নিতান্ত অজ্ঞতাবশত পদবি ব্যবহার করে পুঁথির সন্ধানে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। ফলাফল চাকরিচ্যুতি। কিন্তু পুঁথির শিল্পরসে যাঁর আচ্ছাদিত মন তিনি কি পারেন সেই রসের ভুবন ছেড়ে উঠে যেতে? আবদুল করিম ততোধিক মগ্ন হয়েছেন সাহিত্য অনুসন্ধানের তৎপরতায়। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মানুষ অভিনন্দিত হয়েছেন কুলীন কলকাতায়। কিন্তু কেন? আজকের যুগে হয়তো অনেকের পক্ষে বুঝে ওঠাই মুশকিল যে, পুঁথি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? হয়তো মনে হতে পারে, এ এক ‘আদিখ্যেতা’। আদতে তা কিন্তু নয়।

প্রাচীন পুঁথির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আত্মপরিচয়। পৃথিবীর আধুনিক প্রায় সমস্ত জাতির পরিচয় পুনর্গঠিত হয়েছে পুঁথির দৌলতে। পুঁথি হলো ইতিহাসের মহাফেজখানা—আর্কাইভ; যেখানে লুকিয়ে আছে অগণিত তথ্য, যাকে সাজাতে হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক শৃঙ্খলায়। আবদুল করিম প্রবেশ করেছিলেন ইতিহাসের ওই মহাফেজখানায়। একের পর এক তুলে এনেছেন অমুদ্রিত পুঁথি, প্রাচীন মানুষের লেখাজোকা। নিজে নিজে পড়েছেন, অর্থোদ্ধার করেছেন, উত্তরসূরিদের জন্য পাঠ করার বন্দোবস্ত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে দান করেছেন অনেকগুলো পুঁথি। তাঁর সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে গবেষণা। আধুনিক লিপিতে পুঁথিগুলোর সম্পাদিত পাঠ প্রস্তুত করা হয়েছে।

অর্থাৎ বাংলা পুঁথির এক বিপুল সম্ভারের সঙ্গে আধুনিক বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যবিশারদ। আর এ কারণেই তাঁকে প্রধানত বাংলা পুঁথির ‘সংগ্রাহক’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়ে থাকে, যা আদতে খণ্ডিত। কেননা আবদুল করিম পুঁথি বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তুলেছিলেন। তাছাড়া সেগুলোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে হাজির করতে পেরেছিলেন। মনে রাখা দরকার, উনিশ শতকের বঙ্গদেশে ঐতিহাসিক, পুঁথিসংগ্রাহক ও সাহিত্যিক মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মূলত সাহিত্য অধ্যয়নের একাডেমিক পটভূমি তারা প্রস্তুত করেছিলেন। তার উদাহরণ, যেমন: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। পুঁথি সংগ্রাহক পরিচয়ের চাপে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে, সাহিত্য সম্পর্কে আবদুল করিমের একটি রসবাদী ও আনন্দবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

এর বাইরে আবদুল করিমের কাছে সাহিত্য ছিল আত্মপরিচয় অনুসন্ধান ও নির্মিতির মাধ্যম। তাঁর প্রধান দুটি কাজ, প্রথমত, জাতীয় ইতিহাস গড়ে তোলা; দ্বিতীয়ত, ভাষার ইতিহাসকে স্পষ্ট করা। অন্যরা যখন এই পরিচয়ের হদিস নিয়েছেন আধুনিক সাহিত্যের মাধ্যমে করিম তখন ফিরে গেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে। পুরনো পুঁথির পাতায় পাতায় খুঁজেছেন বাঙালির ইতিহাসের চিহ্ন। রাজ-রাজড়ার খোঁজ নয়, কবিদের শিল্পিত ইতিহাস; ঔপনিবেশিক অভিঘাতের ফলে যে ইতিহাসে তৈরি হয়েছে বিচ্ছেদ। করিম যেন সেই ছিন্নভিন্ন ইতিহাসকে জোড়া লাগাতে চেয়েছেন; পুঁথির পাতাগুলোকে ধারাক্রমিকভাবে জুড়ে দেওয়ার ভেতর দেখা যায় তাঁর উদ্যম ও প্রয়াস। জাতীয় ইতিহাস প্রসঙ্গে সাহিত্যবিশারদ লিখেছেন, ‘এই যে প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনার উৎসাহ দেশময় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে, কবিত্ব সৌন্দর্য্য প্রদর্শনই তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য, এমন কথা বলিতে পরি না। প্রাচীন সাহিত্যের মূল প্রকৃতির বিনির্ণয়, তাহার সাহায্যে সত্যনির্দ্ধারণ, বিলুপ্ত জাতীয় ইতিহাসের ভস্মাচ্ছাদিত কঙ্কালের আবিষ্কার ইত্যাদিই তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য।’

আবদুল করিমের এই বয়ানের ভেতর কাজ করছে তাঁর সত্তার দুই দিক: সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক। এটি কোনো আকস্মিক কোনো প্রবণতা নয়; উনিশ শতকে ইউরোপ জুড়েই সাহিত্য ও ইতিহাসকে একসঙ্গে পাঠ ও বিশ্লেষণের তৎপরতা গড়ে উঠেছিল। যেটি পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বাংলা অঞ্চলে সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই রীতির সম্প্রসারণ দেখা যায়। করিম মোটাদাগে তারই অনুসরণ করেছেন। ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকের মেলবন্ধন ঘটেছিল উনিশ শতকের বাংলা অঞ্চলেও। তখন জোরদারভাবে চলছিল ইতিহাস নির্মাণ ও পুনর্গঠনের কাজ। উদ্ধার করা হচ্ছিল পুরনো উপকরণ আর বিবৃত হচ্ছিল ইতিহাস। তবুও ঘাটতি ছিল। করিম লিখেছেন, ‘উপকরণের অভাব নাই; অথচ বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাস নাই। ইহা নিতান্ত দুঃখের বিষয় বটে। কিন্তু দুঃখের অনুভূতি কেবল কথায় দেখাইলেই কর্ত্তব্য শেষ হইবে না, কাজেও দেখাইতে হইবে। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার প্রতি সমান আকর্ষণ না থাকিলে ‘জাতীয়তা’ সৃষ্ট হইতে পারে না। বাঙ্গালীর এই সঙ্কট কালে -- এই গদ্যপদ্যময় জীবনে আবার ‘স্বানুরক্তি’র প্রয়োজন। ঐ দেখ, ‘পরানুরক্তি’র বিষময় ফলে দেশ আজ রসাতলে যাইতে বসিয়াছে! স্বদেশের প্রতি, স্বজাতির প্রতি, স্বভাষার প্রতি অনুরাগ্য—অকৃত্রিত অনুরাগী হও; দেখিতে দেখিতে স্বদেশ আবার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হইবে। জাতীয় অতীত কাহিনীর আলোচনায়, জাতীয় গৌরব স্মৃতির উদ্রেক হইয়া থাকে। এই হিসাবে আমাদের প্রাচীন সর্ব্ববিধ কীর্ত্তিই একান্ত অনুসন্ধেয়া ও অনুশীলনযোগ্য।’’ (‘বঙ্গভাষার আদিম গদ্য’)

ভাষা যে জাতির পরিচয়কে বহন করে চলে সে কথা করিম জানতেন। বাংলা ভাষার ইতিহাস পুনর্গঠন তাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। ভাষার ইতিহাস গড়ে তোলা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘প্রাচীন সাহিত্যের সম্যক্ উদ্ধার না হইলে আমাদের বাঙ্গালা ভাষার ইতিহাস যে অপূর্ণাঙ্গ থাকিবে, তাহা বোধ হয় আর কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। (‘বাঙ্গালার প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার’)। আর তাই প্রাচীন সাহিত্যের প্রকাশিত রূপ চাই। তিনি লিখেছেন, ‘প্রাচীন যে কোনো কাব্য বা কবিতাই প্রকাশিত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। তাহা না হইলে, ভাষার উপকরণ আসিবে কোথা হইতে? (‘বাঙ্গালার প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার’)। করিম মনে করেন, ‘ইহাদের দ্বারাই [প্রাচীন পুঁথি] বঙ্গভাষার ইতিহাস গঠিত হইতে পারিবে এবং ইহাদের বিলোপে বঙ্গভাষার ও সাহিত্যের একাংশ বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। ভাষা-ইতিহাস সঙ্কলনে ইহাদের সাহায্য যে অপরিহার্য্য, তা কে অস্বীকার করিবে? অধুনা যাহা নিতান্ত তুচ্ছ পদার্থ বলিয়া বোধ হইতেছে, ইতিহাসের নিকট তাহাই সমধিক আদরণীয় হইতে পারে। এই সকল কারণে প্রাচীন সমস্ত সাহিত্য-কীর্ত্তিই সযত্নে রক্ষিত হওয়ার উপযুক্ত। (‘প্রাচীন সাহিত্য-কীর্ত্তি: মনসার ধূপাচার’)

জাতীয় ইতিহাস পরিগঠন বিষয়ক এই আবেগের গহনদেশে আছে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি করিমের সপ্রশ্ন সমালোচনা; বহিরাগত শাসন ও তার সংস্কৃতির অনুসরণকে তিনি বলেছেন ‘পরানুরক্তি’, যার ‘বিষময় ফলে দেশ আজ রসাতলে যাইতে বসিয়াছে’ বলে মনে করতেন তিনি। তাহলে বোঝা যায়, এই বিষফলে অমৃতযোগের লক্ষ্যেই দরকার ‘স্বানুরক্তি’, নিজের প্রতি অনুরাগ। আর ওই অনুরাগের ফলেই গড়ে উঠবে জাতীয় ইতিহাস। করিমের মনোবাসনা তা-ই। মূলত সাহিত্যবিশারদকে তাড়িত করেছে বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনের হাওয়া। সে কারণেই প্রবন্ধ লিখেছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের পক্ষে।

আমরা দেখব যে, বাঙালির জাতীয় চেতনা আবদুল করিমের মৌল অবলম্বন, কিন্তু তিনি আটকে পড়েন নি জাতীয়তাবাদী ভাবনার ছকে। সে কালের অনেক কবি-লেখকের মধ্যেই সর্ব ভারতীয় জাতীয় চেতনা দানা বেঁধেছিল। কিন্তু করিমের মধ্যে তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও অভিজাতের রাজনৈতিক আন্দোলন ও মতাদর্শিক লড়াই থেকে নিজেকে তিনি যথাসম্ভব দূরে রেখেছেন বলেই মনে হয়।

সাহিত্যবিশারদের তিন খণ্ডের রচনাবলিতে যুগস্বভাবী রাজনীতির ছায়াপাত খুব বেশি পড়ে নি। তার অর্থ এই নয় যে, আবদুল করিম কেবল পুঁথির অতলেই মুখ গুঁজে ডুবেছিলেন। আদতে রাজনৈতিক প্রতিবেশ সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা পোষণ করতেন। সে কারণেই সম্প্রদায়গত পরিচয় ও সাম্প্রদায়িকতার পার্থক্য নিরূপণ করতে পেরেছিলেন। যে যুগে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা প্রবলভাবে বিকশিত হয়েছে সে যুগে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন শতভাগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিমুক্ত। বরং তিনি ধারণ করতে চেয়েছেন সম্প্রদায়গত পরিচয়, যে পরিচয় গড়ে ওঠে প্রধানত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। সেই সূত্রেই তিনি ভাবতে পেরেছেন ‘মহাজাতি’র কথা, যার ভিত্তিমূলে আছে বাঙালি মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধ -- তিন সম্প্রদায়কেই ‘মহাজাতি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বলা ভালো, রাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রের জাতি ধারণা এখানে প্রযোজ্য নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, করিম মুসলমানের কথা বিশেষভাবে ভাবলেন কেন?

ভাবার কার্যকারণটিও ঐতিহাসিক। আর তাই আমাদের মনে রাখতে হবে উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসে মুসলমানও একটি কর্তাসত্তা। উপনিবেশিত হওয়ার আগপর্যন্ত অন্তত ছয়শ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস তার ছিল। উপনিবেশ তাকে দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা, নতুন ভূমি-বন্দোবস্ত, শাসনের নতুন ব্যবস্থা, নতুন ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা। অভিনবত্বের এই জোয়ারে মুসলমানেরা গা ভাসায় নি। মধ্যবিত্ত হিসেবে বিকশিত হতে তাদের সময় লেগেছে বাঙালি হিন্দু বা খ্রিস্টানের তুলনায় কম করে হলেও পঞ্চাশ বছর বেশি সময়।

ততো দিনে এসে গেছে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি, এসে গেছে চাকরির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতার ভাগাভাগির স্বপ্ন। সাংস্কৃতিক ঘাত ও প্রত্যাঘাতের ফলে অবিশ্বাসের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এর সবই ঘটেছে প্রধানত নগরবাসী শিক্ষিতদের মধ্যে। গ্রামীণ জনপদে পড়েছে তার কালো ছায়া। বাঙালি মুসলমানকে ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসক ও বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়াতে হয়েছে। আবদুল করিম এই ইতিহাসের ভেতরকার মানুষ। আধুনিক বিদ্যার জগতে তাঁকেও লড়াই করতে হয়েছে, রপ্ত করতে হয়েছে জ্ঞানচর্চার চলমান ডিসকোর্সকে। সাহিত্য, পুঁথি, ইতিহাস, জাতীয়তা বুঝে নেওয়ার হিন্দু তৎপরতাকে মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করতে হয়েছে। কেননা অপরায়ণের দুনিয়ায় সম্প্রদায়গত পরিচয়ে তাঁকেও তো একটি ‘আত্মসত্তা’র কাঠামো প্রস্তুত করে নিতে হবে। নয়তো লড়বেন কী করে? নিজের প্রতিচ্ছবি পাবেন কী করে? এই প্রসঙ্গেই করিম বলেছেন জাতীয় সাহিত্যের কথা।

‘জাতীয় সাহিত্য’ নিয়ে আগ্রহের কারণ প্রধানত সাহিত্যের মাধ্যমে আত্মপরিচয়কে নির্মাণ করা। উনিশ শতকের ইউরোপেও জাতীয় সাহিত্যের ধারণা নিয়ে লেখকেরা প্রচুর কথা বলেছেন। আবদুল করিম আমাদের জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। সত্যি কথাটা হলো, ইউরোপ/ব্রিটিশ তার জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবাদ ও ‘জাতীয় সাহিত্যে’র বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বহু আগেই। উনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু-ব্রাহ্মরাও জাতীয় সাহিত্য নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলাপ-আলোচনা সেরে ফেলেছেন।

আর তখন আবদুল করিম যেন বুঝে ফেলেছেন, জাতীয় সাহিত্য আবিষ্কারের এবার পালা মুসলমানের। কারণ মুসলমান জনগোষ্ঠী হিন্দু-ব্রাহ্ম ঘেঁষা জাতীয় সাহিত্যের ধারণা ও প্রস্তাবনার ভেতর নিজেকে খুঁজে পায় না। ইউরোপের ইতিহাসে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণও নাই। এ প্রসঙ্গে আবদুল করিমের উক্তি পড়া যাক, ‘মাতৃভাষা ও জাতীয়-সাহিত্যের উন্নতি ভিন্ন কোনও জাতি কখনও বড় হইতে পারে না। কেন না, জাতীয় সাহিত্যই জাতীয় জীবনের প্রাণ। জাতীয় সাহিত্যেই জাতীয়-জীবন-তরীর দিঙ্নির্ণয় করিয়া থাকে, এবং জাতীয় সাহিত্য হইতে রসাকর্ষণ করিয়াই সমাজদেহ পুষ্টিলাভ করে।’ (‘বাঙ্গালার মুসলমানগণের মাতৃভাষা’)। প্রতিবেশী জাতীয় সাহিত্যের তুলনা করে বলেন, ‘হিন্দুসমাজে বঙ্গসাহিত্য এখন যেরূপ অতর্ক্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, তাহাতে সমাজদেহে এরূপ তীব্র বিক্ষেপ ও নূতন প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বভাবিক। বঙ্গসাহিত্যের প্রসার ও প্রভাব-বৃদ্ধি ব্যতীত হিন্দুসমাজে এত শীঘ্র এমনভাবে জাতীয় ভাব স্ফূরিত হইতে পরিত না। বঙ্গসাহিত্যই তৎসমাজের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এমন ভাবে চেতনাময় করিয়া তুলিয়াছে। একমাত্র জাতীয় সাহিত্যের অভাবেই বঙ্গীয় মুসলমান-সমাজ আজও যে ‘তিমিরে সে তিমিরে’ রহিয়া গিয়াছে।’ (‘বাঙ্গালার মুসলমানগণের মাতৃভাষা’)

করিমের এই সম্প্রদায়গত পরিচয়ে সাম্প্রদায়িকতার কোনো আঁচড় লাগে না। সাহিত্য ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট, ‘সাহিত্যে জাতিভেদ নাই। সৌন্দর্য্যের প্রকাশই যদি সাহিত্য হয়, তবে যেখানেই সৌন্দর্য্য মিলিবে, প্রকৃত সাহিত্য-রসিক সেখান হইতেই সৌন্দর্য্যাহরণ করিয়া লইবে। এ হিন্দু সাহিত্য, এ ইসলামী সাহিত্য, এরূপ ভেদবুদ্ধি, প্রকৃত জ্ঞানসাধক সাহিত্যিকের থাকিতে পারে না। তাঁহার পক্ষে সকল রকম সংস্কার বিমুক্ত ও উদার চিত্ত হওয়া আবশ্যক। যে সাহিত্য সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ, তাহা কি প্রকৃত সাহিত্যপদ-বাচ্য?’ (‘আমাদের পুঁথি-সাহিত্য’)

প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে করিমকে কখনোই ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায় না। সংবেদনশীল ও গ্রহণমনস্ক একটি মন নিয়ে তিনি তাকিয়েছেন প্রতিবেশী সবার দিকে। কখনো কখনো মনে হয় আবদুল করিম বাস করেন পুঁথির এক কল্পিত ভুবনে -- যেখানে সংঘাত নেই, আছে জীবনের স্বস্তি ও সৌন্দর্য। হয়তো এটিই তাঁর আরাধ্য বাস্তবতা। অনেকটা দীনেশচন্দ্র সেন যেমন আশ্রয় পেয়েছেন ‘বৃহৎ বঙ্গে’ কল্পনায়। তবে করিমের কল্পনা বিশেষভাবে আচ্ছন্ন চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রতি। তাঁর পুঁথি সংগ্রহ ও ইতিহাস-অনুসন্ধান প্রধানত এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।

এই আবর্তন সত্ত্বেও দেখা যায়, সামগ্রিক পূর্ববঙ্গীয় জনপদ আদল পায় সাহিত্যবিশারদের লেখায়। নিম্নবর্গের ইতিহাসকার দীপেশ চক্রবর্তী এক লেখায় দীনেশচন্দ্র সেনকে অভিহিত করেছিলেন ‘রোমান্টিক আর্কাইভ’ হিসেবে। একই অভিধা দেওয়া যেতে পারে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে। কেননা তাঁর পুঁথি আবিষ্কার ও অধ্যয়ন যেন সেই সাঁকো যা দিয়ে কায়ক্লেশে হলেও পার হওয়া যায় ঔপনিবেশিক ইতিহাসের খাদ। প্রাচীন সাহিত্য যেন খাদ পূরণের রসদ— জাতীয় ঐক্যের ধারক, বাঙালির যৌথ সত্তার পূর্বসূরি নিদর্শন। সাংস্কৃতিক অতীত নির্মাণের লক্ষ্যে সাহিত্যবিশারদের তৎপরতা কল্পিত আর ইউটোপিয় হলেও আশা-জাগানিয়া।

আবদুল করিমের ভাবনার ফল আমরা জানি। মিলন নয়, বিগত একশো বছরের ইতিহাসে বিভক্তিই সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলন বৃহৎ বঙ্গ বা সর্বভারত— কোনোটিকেই টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গীয় বদ্বীপে নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জেগে উঠেছে নতুন রাষ্ট্রখণ্ড। এই রাষ্ট্রখণ্ডের কোনো ভাবাদর্শিক মনীষী নেই বললেই চলে। নানা মুণির নানা মত আসন পেতেছে। ১৯৫৩ সালে প্রয়াত আবদুল করিম হয়তো এসব কল্পনাও করেন নি। কিন্তু আজ মনে হয়, তাঁর মতো উদার, সম্প্রদায়নিরপেক্ষ ও গ্রহণমনস্ক একজন ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজন আছে। অভ্যুত্থান-উত্তর সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যখন সবাইকে অংশীজন হিসেবে গ্রহণ করার নতুন অবকাশ তৈরি হয়েছে তখন আবদুল করিমের মনস্বিতাকে নতুন আলোয় পাঠ করা দরকার।

দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশে কোনা পাঠই ঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। যেন সেই অমোঘ নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটিয়েই আবদুল করিমের অসম্পাদিত কাজগুলো সম্পন্ন হয় নি। সাহিত্যবিশারদ কর্তৃক সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা কত—এই নিয়েই আছে মতপার্থক্য। আনিসুজ্জামান ও আহমদ শরীফের দেয়া তথ্য পরস্পরের বিপরীত। বিশেষজ্ঞরা আহমদ শরীফের মতকে গুরুত্ব দিয়েছেন—সব মিলিয়ে হাজার খানেক। তা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু সব পুঁথির পাঠ ও সম্পাদনা কি সম্পন্ন হয়েছে? হয় নি। কেন হয় নি?

আমরা দেখব, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যাচর্চায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য অধ্যয়নের পরিসর ছোট হয়ে এসেছে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন বিষয়ক শাস্ত্রের আধুনিকায়ন ঘটে নি, একটি ছোটখাটো শাখা হিসেবে টিকে আছে মধ্যযুগ ও পাণ্ডুলিপি অধ্যয়নবিদ্যা। অথচ ষাটের দশকে এ বিষয়ক চর্চা ও গবেষণা গতি পেয়েছিল। হয়তো জাতীয়তাবাবাদী আবেগ প্রেষণা জুগিয়েছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আখ্যান মুড়লো, পুঁথিচর্চার কিসসাও যেন ফুরলো।

সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কিত আলোচনায় অনেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে বলে থাকেন, ব্যক্তিজীবনে তিনি ‘উচ্চশিক্ষা’ না পেলেও পাণ্ডুলিপি পাঠ ও সম্পাদনায় ঈর্ষণীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা থাকলেও যে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা তৈরি হয় না, তার প্রমাণ সাহিত্যবিশারদ কর্তৃক সংগৃহীত পুঁথির বর্তমান দশা; না পাঠোদ্ধার, না বিশ্লেষণ -- কোনো স্তরেই পুঁথি বিষয়ক কাজের অগ্রগমন ঘটে নি।

তাহলে কি আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই ‘উচ্চ সংস্কৃতি’ ও ‘আধুনিকতাবাদে’র ধারণা, যে ধারণা মাঝেমধ্যে ঐতিহ্যকে ‘আবিষ্কার’ ও ‘উদযাপন’ করলেও ঐতিহ্যকে ধারণ করে না? প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গের বড় একটি অংশই ‘নিম্ন সংস্কৃতি’র ধারক ও বাহক হিসেব মৌখিক ও পুঁথিপত্রনির্ভর সাহিত্যকে অন্য পাশে সরিয়ে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেনদের মতো কেউ কেউ ‘নিম্ন সংস্কৃতি’ কিংবা ‘নিম্নবর্গের সাহিত্য’কে রুচির দূরত্ব সত্ত্বেও কাছে টেনে নিয়েছেন। কিন্তু উচ্চবর্গের সাহিত্যিক ডিসকোর্স বিদ্যায়তনিক পরিসরে সব সময়ই আধিপত্য বজায় রেখেছে। আর তাই উপনিবেশপূর্ব, অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য হারিয়ে ফেলেছে তার স্থান। অথচ জাতীয়তাবাদী আবেগের মৌসুমে বাংলা সাহিত্যের বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠায় কুড়িয়ে পাওয়া পুঁথিগুলোকেই দেখানো হয়েছিল জাতীয় সবলতার প্রতীক হিসেবে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বিশেষভাবে মনে পড়ে; কেননা বিদ্যায়তনের পাঠক্রমে কিংবা সাহিত্যে ইতিহাস অনুসন্ধানে তিনি এখনও ব্রাত্য আর অনাহূতদের দলেই আছেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তার প্রাবল্যের যুগেও করিমের জ্ঞান ও বিদ্যার সম্প্রসারণ ঘটল না। এই বাস্তবতা আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্যের দ্যোতক। খুব দ্রুতই দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটবে কি?

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত