leadT1ad

এনসিপিকে ছাড়া জুলাই সনদ কি ঐক্যের দলিলে বিভক্তি

দলগুলোর মধ্যে তিনটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান এই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। এনসিপি চায় স্বাক্ষরের আগেই ‘সংবিধান আদেশ’ জারি, বিএনপি চায় নির্বাচনের দিন গণভোট, আর জামায়াতে ইসলামী চায় নির্বাচনের আগেই গণভোট।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৫২
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষারই প্রতীক ‘জুলাই সনদ’। স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষারই প্রতীক ‘জুলাই সনদ’। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৮৪ দফা সংবলিত সনদের খসড়া চূড়ান্ত করে। সনদের উদ্দেশ্য ছিল শাসন, বিচার, নির্বাচন ও দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু চূড়ান্ত স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ঠিক আগমুহূর্তে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে তীব্র অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

দলগুলোর মধ্যে তিনটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান এই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে: এনসিপি চায় স্বাক্ষরের আগেই ‘সংবিধান আদেশ’ জারি, বিএনপি চায় নির্বাচনের দিন গণভোট, আর জামায়াতে ইসলামী চায় নির্বাচনের আগেই গণভোট। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানীর বাংলামোটরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদ তৈরি হলে সেটার কোনো অর্থ থাকে না। আর সেকারণেই আগামীকাল এনসিপি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে না। পাশাপাশি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংশোধিত খসড়া না পেলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে।

এই বিভক্তি নিছক পদ্ধতিগত নয়, এর মূলে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাসের চরম অভাব।

এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করলে কী হতে পারে

মতানৈক্যের কারণে রাজনৈতিক দলের জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়টি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল সিদ্দিকী স্ট্রিমকে বলেন, জুলাই সনদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যদি সফল না হয়, তবে এটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক মতামতে রাজনীতি বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, জুলাই সনদ যদি স্বাক্ষরিত না হয় তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তবে এর অর্থ এই নয় যে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সনদকে ঘিরে তৈরি অনিশ্চয়তা নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, যা দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় নতুন সংকট ডেকে আনবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর প্রভাব

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অংশীদারদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আন্দোলনের পর এই অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল বর্তমান ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। তাই জুলাই সনদে যদি এনসিপি স্বাক্ষর না করে, তবে সরকারের নৈতিক কর্তৃত্ব ও আস্থার জায়গাটি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ ভিত্তিতে সংস্কারের দাবি দুর্বল হয়ে পড়বে। পাশাপাশি সনদটি ‘আংশিক ঐকমত্যের’ দলিলে পরিণত হবে। জাহেদ উর রহমানের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং সনদে স্বাক্ষর না হলে এই প্রক্রিয়ায় আস্থার ঘাটতি দেখা দেবে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস বাড়বে এবং সরকারের পক্ষে কঠোর সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

এনসিপির ওপর প্রভাব

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত এনসিপির জন্য ঝুঁকির কৌশল। একদিকে, তারা সংস্কারের প্রশ্নে আপসহীন শক্তি হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় দৃঢ় করতে পারে। অন্যদিকে, তারা মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে জুলাই সনদে এনসিপির অনুপস্থিতি আন্দোলনকারীদের মধ্যে এই সনদের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে। ইতিহাস বলছে, এই ধরনের অনাস্থা অনেক সময়ই নতুন আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ওপর প্রভাব

সনদে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো নিজেদের বাস্তববাদী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পাবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের অনুপস্থিতি পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দলকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে এনসিপির স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নতুন সরকারের জন্যও পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে।

ঐতিহাসিক শিক্ষা: চুক্তিতে অংশ না নেওয়ার পরিণতি

অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তিকে আইরিশ রিপাবলিকানদের একটি বড় অংশ প্রত্যাখ্যান করায় ১৯২২ সালে আয়ারল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যদিও চুক্তি প্রত্যাখ্যানকারীরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হয়েছিল, তবে তারা আদর্শগতভাবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক পথেই ক্ষমতায় আসে চুক্তি প্রত্যাখ্যানকারীদের দল ফিয়ানা ফাইল। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, চুক্তি প্রত্যাখ্যানকারী পক্ষ পরাজিত হলেও তাদের আদর্শ বা রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা টিকে থাকতে পারে।

অন্যদিকে ২০১৫ সালে নেপালের প্রধান তিনটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন সংবিধান গ্রহণ করলে দক্ষিণাঞ্চলের মাধেসি ও থারু জনগোষ্ঠীর দলগুলো এটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে কোনো গৃহযুদ্ধ না হলেও তরাই অঞ্চলে তীব্র সহিংস আন্দোলন, প্রাণহানি ও ভারত-নেপাল সীমান্ত অবরোধের মতো ঘটনা ঘটে। ফলে দেশটিতে ভয়াবহ মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়।

নেপালের ঘটনা এই শিক্ষাই দেয় যে, একটি জাতীয় সনদ বা সংবিধান যদি দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতিগত বা আঞ্চলিক গোষ্ঠীর মৌলিক উদ্বেগগুলোকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে পাস করানো হয়, তবে তা শান্তি আনার পরিবর্তে নতুন করে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জাতীয় বিভাজনের জন্ম দিতে পারে।

জুলাই সনদ বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ক্ষমতার কৌশলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় এসে সনদ বাস্তবায়নের একটি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতিতে একমত হতে না পারে, তবে জুলাই সনদের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সংস্কার আকাঙ্ক্ষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন সনদের ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঐক্যই একটি দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ দ্রুততর করে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত