ম্যানিলার রাজপথ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এক নতুন প্রজন্মের উত্থানের সাক্ষী, তারা হলো জেন-জি। বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণরা যখন জলবায়ু থেকে ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার, তখন এশিয়াও এই পরিবর্তনের ঢেউয়ে ভাসছে।
শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালয়া’-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের ‘জুলাই বিপ্লবে’ দীর্ঘদিনের কোটা ব্যবস্থা ও স্বৈরাচার সরকারের পতন, এই সবই এশিয়ার তরুণ শক্তির প্রমাণ। নেপালের মতো দেশেও সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে, আবার ইন্দোনেশিয়ার তরুণরাও সংসদ সদস্যদের উচ্চ ভাতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলাতেও এই প্রজন্ম এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেছে।
তবে এই আন্দোলন কেবল স্থানীয় বিক্ষোভ নয় বরং এটি এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো দেশের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতি, ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ। যার সূত্রপাত হয়েছিল ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ডিজিটাল ও সীমিত রাজপথের প্রতিবাদের মাধ্যমে।
২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিবারগুলোর দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে অসন্তোষ তীব্র হলে এই আন্দোলন আরও জোরালো রূপ নেয়। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা অন্যান্য বৃহৎ সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মতো বিভিন্ন কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর থেকে এটি নিয়মিত বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে।
বিশেষভাবে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বিশাল দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন শুরু হয় এবং ২১ সেপ্টেম্বর ম্যানিলার রিজাল পার্কে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের অংশগ্রহণে ‘ট্রিলিয়ন পেসো মার্চ’ ও ‘বাহা সা লুনেটা’ নামে বিশাল প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। অতি সম্প্রতি, ৩০ নভেম্বরের প্রতিবাদেও হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়।
জেন-জি নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলন প্রথাগত রাজনীতির জঞ্জাল সরিয়ে সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মৌলিক দাবিতে কেন্দ্রীভূত। বিলিয়ন পেসোর দুর্নীতিতে জড়িতদের বিচার, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক সংস্কার তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই আন্দোলনকে আলাদা করেছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য, আর তা হলো ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি ও এর বিকেন্দ্রীভূত শক্তি। টিকটক, টুইটার ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা দ্রুত জনমত তৈরি করছে এবং সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষা আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে। যদিও নেতৃত্ববিহীন হওয়ার কারণে স্থায়িত্ব ও ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির প্রতিরোধ এই আন্দোলনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, তবুও তরুণ ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে তারা ফিলিপাইনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করার এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
আন্দোলনের মূল দাবি: ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলনের মূল ভিত্তি হলো সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাদের দাবিগুলো দেশের গভীরে বিস্তৃত দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন কেবল প্রতিবাদ নয় বরং একটি নতুন ফিলিপাইন গড়ার আকাঙ্ক্ষা, যেখানে নাগরিকরা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
ক. দুর্নীতিবিরোধী লড়াই ও ন্যায়বিচারের দাবি
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলনের প্রধান ফোকাস হলো সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং দেশে ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে তরুণদের ক্ষোভের মূল কারণ হলো সরকারি তহবিলের ব্যাপক অপব্যবহার, যেখানে বিলিয়ন পেসোর দুর্নীতিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে জড়িত।
এই প্রজন্ম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যতক্ষণ পর্যন্ত উচ্চপদস্থ দুর্নীতিবাজদের বিচার না হবে, ততক্ষণ দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই তাদের প্রধান দাবি দুর্নীতিতে জড়িত সকল কর্মকর্তা ও আইনপ্রণেতাদের অবিলম্বে পদত্যাগ ও কঠোর বিচার নিশ্চিত করা। এই আন্দোলন কেবল বর্তমান সরকারের সমালোচনা নয় বরং এটি ফিলিপাইনের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের গেঁড়ে বসা স্বজনপ্রীতি ও অপব্যবহারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ। তাদের জোরালো স্লোগান ‘নো জাস্টিস, নো পিস’ এই দাবির তীব্রতাকেই তুলে ধরে।
খ. অর্থনৈতিক সমতাও সুযোগের অনুসন্ধান
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলন গভীরভাবে অর্থনৈতিক সমতা ও সুযোগের অভাবের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। এই প্রজন্ম নিজেদের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, স্বল্প মজুরি আর লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির শিকার হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী রাজনৈতিক পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত, যা সাধারণ তরুণদের সুযোগের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই তাদের অন্যতম প্রধান দাবি, দেশের সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। তারা একইসঙ্গে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জন্য মানসম্মত ও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ দাবি করছে।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছে, যা কেবল গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর জন্য নয়, বরং দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান উন্নতির সুযোগ তৈরি করবে।
গ. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কাঠামোগত সংস্কার
জেন-জি প্রজন্ম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কাঠামোগত সংস্কারের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও মানহীন অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা সরকারের চরম অব্যবস্থাপনার দিকটি তরুণদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা মনে করে একটি সুস্থ ও শিক্ষিত জাতি গড়তে সকলের জন্য সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা অপরিহার্য। একইভাবে মানসম্মত ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিও তাদের আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে।
এই দাবিগুলো সরকারের কাছে কেবল দ্রুত প্রতিকার নয়, বরং দেশের মৌলিক সামাজিক পরিষেবাগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য: ডিজিটাল কৌশল ও বিকেন্দ্রীভূত শক্তি
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলন ট্র্যাডিশনাল প্রতিবাদের ধারা ভেঙে দিয়েছে। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ডিজিটাল দক্ষতা ও কৌশলগত বিকেন্দ্রীকরণ। তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দ্রুত তথ্য ও প্রমাণ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই আন্দোলন কোনো একক বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে না, যা একে দমন করা কঠিন করে তোলে।
এর ফলে জেন-জি আন্দোলনের প্রতিবাদ কেবল রাজপথে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও ডিজিটাল আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
ক. ডিজিটাল কৌশল ও সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এর ডিজিটাল দক্ষতা ও কৌশলগত ব্যবহার, যা একে ট্র্যাডিশনাল আন্দোলনের রূপ থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করেছে। এই প্রজন্ম টিকটক, টুইটার (বর্তমানে এক্স) এবং ফেসবুক-এর মতো প্ল্যাটফর্মকে প্রতিবাদের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তারা কেবল তথ্য প্রচার করে না বরং দ্রুততার সঙ্গে দুর্নীতির ভিডিও প্রমাণ ও নথি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।
এই প্রক্রিয়ায় তারা ‘#AccountabilityNow’-এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড তৈরি করে, যা দেশব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মুহূর্তের মধ্যে জনমতকে প্রভাবিত করে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা কোনো সরকারি বাধা ছাড়াই লাখ লাখ মানুষের কাছে তাদের দাবি পৌঁছে দিতে পেরেছে।
এই ডিজিটাল সক্রিয়তা তাদের আন্দোলনকে একটি শক্তিশালী গণআন্দোলনে পরিণত করেছে এবং রাজনৈতিক আলোচনাকে রাজপথ থেকে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে নিয়ে এসেছে।
খ. নেতৃত্ববিহীন আন্দোলন ও বিকেন্দ্রীভূত শক্তি
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলনের একটি কৌশলগত সুবিধা হলো এর নেতৃত্ববিহীন ও বিকেন্দ্রীভূত প্রকৃতি। এই আন্দোলনের কোনো একক বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। যার ফলে একে সরকারের পক্ষে দমন করা বা দুর্বল করে দেওয়া কঠিন। আন্দোলনটি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, যুব এনজিও এবং স্বাধীন অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
এই বিকেন্দ্রীভূত কাঠামো নিশ্চিত করে যে যদি কোনো একটি অংশ বা নেতাকে লক্ষ্য করে দমন-পীড়ন চালানো হয়, তবে অন্য অংশগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে সক্ষম। এই বৈশিষ্ট্য আন্দোলনটিকে স্থিতিশীলতা দিয়ে এর স্থায়িত্ব বাড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জেন-জি প্রজন্ম ট্র্যাডিশনাল নেতৃত্বের উপর নির্ভর না করে সামষ্টিক ও সম্মিলিত শক্তির উপর ভরসা করে পরিবর্তনের পথ খুঁজছে।
গ. সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ও পপ-কালচারের ব্যবহার
আন্দোলনের প্রভাবকে আরও বিস্তৃত ও আকর্ষণীয় করতে ম্যানিলার জেন-জি প্রজন্ম তাদের প্রতিবাদে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। তারা পপ-সংস্কৃতি, আধুনিক সঙ্গীত, শিল্প ও ইন্টারনেট মিম ব্যবহার করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে। এই শৈল্পিক পদ্ধতি প্রতিবাদের ভাষাকে আরও বেশি সৃজনশীল ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
কঠিন রাজনৈতিক বিষয়গুলো যখন হাস্যরসাত্মক বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির মোড়কে উপস্থাপন করা হয় তখন তা কেবল তরুণদের কাছেই নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও সহজে পৌঁছায় এবং তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
এভাবে আন্দোলনটি কেবল একটি রাজনৈতিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যটি নিশ্চিত করেছে জেন-জির প্রতিবাদ কেবল ক্ষোভ প্রকাশ নয় বরং তা একটি নতুন ও উদ্ভাবনী উপায়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
ভবিষ্যৎ গতিপথ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলন ফিলিপাইনের রাজনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রাখে, তবে এর সামনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এই আন্দোলনের প্রধান ঝুঁকি হলো এর স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারা। কারণ এটি কোনো একক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়। ট্র্যাডিশনাল শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিবার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা তরুণ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ তৈরি করবে।
তবে এই প্রজন্ম যদি তাদের ডিজিটাল প্রভাবকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মতো বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সফলভাবে রূপান্তরিত করতে পারে, তাহলে তারা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে।
ক. স্থায়িত্বের চ্যালেঞ্জ ও সাংগঠনিক দুর্বলতা
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলন ফিলিপাইনের রাজনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রাখলেও এর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আন্দোলনটি যেহেতু নেতৃত্ববিহীন ও বিকেন্দ্রীভূত তাই দীর্ঘমেয়াদে একটি সুসংহত পথ ও লক্ষ্য ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।
একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কাঠামোর অভাব থাকার কারণে এই আন্দোলনকে কেবল প্রতিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নির্দিষ্ট আইনি বা নীতিগত বিজয়ে রূপান্তরিত করা কঠিন। এছাড়াও আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদী পরিচালনার জন্য অর্থায়নের সমস্যা এটিকে দুর্বল করে দিতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জেন-জিকে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তিকে কাঠামোগত ও টেকসই সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তর করার কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।
খ. প্রথাগত রাজনীতির প্রতিরোধ ও দমন-পীড়ন
এই তরুণ আন্দোলনের আরেকটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো ফিলিপাইনের ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির শক্তিশালী প্রতিরোধ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা তরুণ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে একটি বড় বাধা।
এই রাজনৈতিক শক্তি তাদের ক্ষমতা বজায় রাখতে প্রায়শই নানা কৌশল অবলম্বন করে। সরকার ও প্রভাবশালী মহল সাধারণত বিভাজন সৃষ্টি, ভুল তথ্য প্রচার এবং কঠোর হাতে দমন-পীড়নের কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলনের শক্তি কমাতে চায়। জেন-জি প্রজন্মকে সফল হতে হলে তাই কেবল রাজপথেই নয়, বরং রাজনৈতিক ও আইনি উভয় ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিরোধ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
গ. পরিবর্তনের সম্ভাবনা: ডিজিটাল শক্তিকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে রূপান্তর
বিবিধ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলনের একটি বিশাল পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই সম্ভাবনা নির্ভর করছে তরুণ প্রজন্ম তাদের ডিজিটাল প্রভাবকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সফলভাবে রূপান্তর করতে পারে কীনা তার উপর। যদি তারা সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সংখ্যক তরুণকে ভোটার রেজিস্ট্রেশন এবং নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তবে তারা ফিলিপাইনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারবে।
এই আন্দোলন দেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে মূল ভূমিকা রাখবে। সুতরাং জেন-জির আসল সফলতা নির্ভর করবে প্রতিবাদী শক্তি থেকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীতে তাদের উত্তরণের ওপর।
ম্যানিলার জেন-জি আন্দোলন শুধু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি আসলে ফিলিপাইনের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সংকেত। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে প্রথম ডিজিটাল প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত ‘ট্রিলিয়ন পেসো মার্চ’ (যা সেপ্টেম্বর ২১ ও নভেম্বর ৩০ তারিখে বিশাল আকার ধারণ করে)—এই পুরো প্রক্রিয়াটি দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোকেই নির্দেশ করে। তাদের মূল দাবি, যেমন দুর্নীতিবিরোধী লড়াই, অর্থনৈতিক সমতা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার, প্রমাণ করে যে তরুণরা সমস্যার গভীরে প্রবেশ করেছে।
আন্দোলনের ডিজিটাল কৌশল ও বিকেন্দ্রীভূত শক্তি একে তাৎক্ষণিক সাফল্য এনে দিলেও, এর দীর্ঘমেয়াদি সফলতার পথ মসৃণ নয়। প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এই বিশাল নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনটির স্থায়িত্ব ধরে রাখা। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের অভাব এটিকে সময়ের সঙ্গে দুর্বল করে দিতে পারে। পাশাপাশি বহু দশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক পরিবার এবং পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এর ফলে জেন-জির আসল লড়াই হবে রাস্তার প্রতিবাদকে একটি সংগঠিত, টেকসই রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করা।
তবে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলন ফিলিপাইনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ বদলে দেওয়ার বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করে। বিশেষ করে ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে তরুণ ভোটারদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে জেন-জি প্রজন্ম যদি তাদের ডিজিটাল প্রভাবকে বাস্তব জীবনে ভোটার রেজিস্ট্রেশন, নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং যোগ্য নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সফলভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে তা হবে এক বিশাল বিজয়।
এই আন্দোলন দেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সচেতনতা ও যোগ্য নেতার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। তারা গতানুগতিক পরিবার-ভিত্তিক রাজনীতির উপর প্রশ্ন তুলছে এবং সততা ও মেধার ভিত্তিতে শাসন প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করছে। জেন-জির এই বিদ্রোহের সফল রূপান্তর নির্ভর করবে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও ভিন্নমতকে একত্রিত করার ক্ষমতার ওপর। ম্যানিলার এই তরুণ শক্তি দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা কেবল বর্তমানের সমস্যার সমাধান চায় না, বরং স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার এবং সমতার ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন ফিলিপাইন গড়তে বদ্ধপরিকর।