leadT1ad

‘উড়ন্ত হাসপাতাল’ কাতার রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮: ৪২
ক্যাপশন: কাতারের এই সেবাটিকে ‘রাজকীয়’ বলার কারণ হলো এর আভিজাত্য। সংগৃহীত ছবি

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আগামীকাল শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালের মধ্যেই উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন নেওয়া হবে। নেওয়া হবে কাতার আমিরের পাঠানো কাতার রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে।

এর আগে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে রাজকীয় বহরের বিশেষ বিমান দিয়েছিলেন। ওই একই বিমানে তিনি এ বছরের ৫ মে দেশে ফিরে আসেন।

এই বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স কী, কীভাবে কাজ করে, নানান ধরনের প্রশ্ন মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুরু হয়েছে নানান আলোচনা।

কখন দেওয়া হয় এই অ্যাম্বুলেন্স

জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন প্রতিটি সেকেন্ড অত্যন্ত মূল্যবান, তখন আকাশের বুক চিরে ছুটে চলে এক যান্ত্রিক দেবদূত। নাম তার ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’। মুমূর্ষু ভিআইপি রোগীদের জন্য এটি এক ভাসমান হাসপাতাল। বিশ্বজুড়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের অনেক নামীদামি সংস্থা থাকলেও, কাতারের ‘রয়্যাল’ বা রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেবা এক অনন্য উচ্চতায় আসীন। মূলত ‘কাতার এক্সিকিউটিভ’ এবং কাতারের আমিরি ফ্লাইটের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই সেবাটি আভিজাত্য, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণ।

খালেদা জিয়াকে বহনের জন্য যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি পাঠানো হচ্ছে, সেটি এয়ারবাস এ-৩১৯ মডেলের উড়োজাহাজ। ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি এই অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীদের জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা দিতে সক্ষম। এটি বেশ দ্রুতগতির উড়োজাহাজ। স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ এবং সর্বশেষ প্রযুক্তির চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য এটি অনন্য। ।

কেমন এই ‘রয়্যাল’ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেবা

‘রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’ বলতে কাতারের রাষ্ট্রীয় ভিআইপি এবং ‘কাতার এক্সিকিউটিভ’-এর পরিচালিত উচ্চপদস্থ মেডিকেল ইভাকুয়েশন সার্ভিসকে নির্দেশ করে। কাতার এয়ারওয়েজের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ‘কাতার এক্সিকিউটিভ’ বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল প্রাইভেট জেট সার্ভিস প্রদান করে। যখন কোনো ভিআইপি, রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজপরিবারের সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন এই বিলাসবহুল জেটগুলোকেই মুহূর্তের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রূপান্তর করা হয়।

কাতারের হামাদ মেডিকেল কর্পোরেশন (এইচএমসি)-এর সঙ্গে যৌথভাবে এই সেবা পরিচালিত হয়। অর্থাৎ, বিমানটি দেয় কাতার এক্সিকিউটিভ বা আমিরি ফ্লাইট, আর ভেতরের ডাক্তার, নার্স এবং অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে হামাদ মেডিকেল।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম এ৩১৯ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের উন্নত চিকিৎসা সক্ষমতার প্রসঙ্গে একে ফ্লাইং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘এই উড়োজাহাজটি জরুরি অবস্থায় সর্বাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তিতে সজ্জিত, যা ট্রানজিটের সময় রোগীর নিরবচ্ছিন্ন যত্ন নিশ্চিত করে।’

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ৩১৯ মডেলের এই উড়োজাহাজে ভেন্টিলেটর, ডিফিব্রিলেটর, ইনফিউশন পাম্প ও উন্নত কার্ডিয়াক মনিটর রয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ সংরক্ষণের জন্যেও এতে আলাদা জায়গা রয়েছে। এই উড়োজাহাজে চিকিৎসা কর্মীদের নির্বিঘ্ন চলাচলের সুবিধা ছাড়াও জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে।

প্রযুক্তি

কাতারের এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সগুলো ছোট বিমান নয়। এগুলো মূলত ‘গালফস্ট্রিম জি ৬৫০ ইআর’ বা ‘বোম্বার্ডিয়ার গ্লোবাল ৫০০০’ এর মতো আল্ট্রা-লং রেঞ্জ জেট। কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে রয়েছে: ভেন্টিলেটর, ডিফিব্রিলেটর, মনিটর, ইনফিউশন পাম্প এবং অন্যান্য জরুরি ওষুধ।

উড়ন্ত হাসপাতাল: বিমানের ভেতরটিতে প্রয়োজনে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের কেবিন তৈরি করে ফেলা যায়। এছাড়াও বিশেষ এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে একটি পূর্ণ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও (আইসিইউ) রয়েছে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে অবস্থা স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা মিলবে এ উড়োজাহাজে।

গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য: সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় ওড়ার কারণে এতে টার্বুলেন্স বা ঝাঁকুনি অনুভূত হয় না বললেই চলে, যা মুমূর্ষু রোগীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ৩১৯ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স উন্নত ক্লাইমেট কনট্রোল ব্যবস্থা ও শব্দনিরোধক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাত্রার সময় রোগীর আরাম নিশ্চিত করা হয়। বেশি পরিমাণে জ্বালানি নিতে সক্ষম এ৩১৯ দীর্ঘ দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে, যা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে রোগী পরিবহনের জন্য আদর্শ। ছোট রানওয়েতে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকাতেও অবতরণ করতে সক্ষম এই উড়োজাহাজ।

মেডিকেল টিম: এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি পরিচালনা করেন কাতারের রয়্যাল মেডিক্যাল ইউনিটের একটি চিকিৎসক দল, যেখানে চারজন চিকিৎসক ও প্যারামেডিক অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। তারা যাত্রার সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট থেকে শুরু করে ট্রমা পর্যন্ত জরুরি অবস্থাগুলি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে সক্ষম।

যেভাবে কাজ করে

কাতারের এই বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসটি মূলত ‘বেড-টু-বেড’ সেবা প্রদান করে। এর অর্থ হলো, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের হাসপাতালের বিছানা থেকে রোগীকে তুলে এনে, বিমানে করে অন্য দেশের হাসপাতালের বিছানায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত পুরো দায়িত্ব তারা পালন করে।

প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। প্রথমে একটি কল সেন্টারে যোগাযোগ করা হয়। এরপর মেডিকেল টিম রোগীর রিপোর্ট যাচাই করে। যদি দেখা যায় রোগী আকাশপথে ভ্রমণের ধকল সইতে পারবে, তখন কাতার সিভিল এভিয়েশন এবং গন্তব্য দেশের অনুমতিক্রমে বিমানটি উড্ডয়ন করে। রাজকীয় বা ভিআইপি মুভমেন্টের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রটোকল মেনে মুহূর্তের মধ্যে সব ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়, যা সাধারণ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে সময়সাপেক্ষ।

বিখ্যাত যারা এই সেবা নিয়েছেন

নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে কাতার এক্সিকিউটিভ বা আমিরি ফ্লাইট তাদের রোগীদের নাম সচরাচর প্রকাশ করে না। আন্তর্জাতিক আইন এবং ভিআইপি প্রটোকল অনুযায়ী, হাই-প্রোফাইল রোগীদের তথ্য কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়। তবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আসা খবর এবং কূটনৈতিক সূত্র থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

কাতারের রাজপরিবার (আল থানি পরিবার): নামেই যখন ‘রয়্যাল’, তখন এর প্রধান ব্যবহারকারী খোদ কাতারের রাজপরিবার। কাতারের আমির এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা জরুরি চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র বা লন্ডনে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিশেষায়িত বিমানগুলো ব্যবহৃত হয়। শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বা তার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের যাতায়াতে প্রায়ই এই ‘ফ্লাইং হসপিটাল’ স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ: কাতারের সঙ্গে মিত্রতা রয়েছে এমন অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা অসুস্থ হলে কাতার তাদের এই বিশেষ বিমান সেবা প্রদান করে থাকে। বিশেষ করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ভুক্ত দেশের অনেক নেতা জরুরি প্রয়োজনে এই সেবা নিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

কোভিড-১৯: এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেখা গেছে করোনাকালে।

২০২০-২১ সালে যখন সারা বিশ্ব লকডাউনে ছিল, তখন অনেক দেশের আটকে পড়া ভিআইপি, বিজনেস টাইকুন এবং কূটনীতিকদের জরুরিভিত্তিতে নিজ দেশে ফেরাতে কাতার এক্সিকিউটিভের এই মেডিকেল ফ্লাইটগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।

ফুটবল তারকা ও সেলেব্রিটি: নেইমার জুনিয়র, লিওনেল মেসি বা ডেভিড বেকহ্যামের মতো তারকারা যখন কাতারে বা কাতার এয়ারওয়েজের বিমানে যাতায়াত করেন, তখন তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মেডিকেল টিম এবং ইভাকুয়েশন প্রটোকল সর্বদা প্রস্তুত রাখা হয়। বিশেষ করে ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের সময় কোনো খেলোয়াড় গুরুতর আহত হলে তাদের দ্রুত ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই রয়্যাল ফ্লিট প্রস্তুত ছিল।

কেন এটি অন্যদের চেয়ে আলাদা

বিশ্বে অনেক এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আছে, কিন্তু কাতারের এই সেবাটিকে ‘রাজকীয়’ বলার কারণ হলো এর আভিজাত্য। সাধারণ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে জায়গা খুব সংকীর্ণ থাকে। কিন্তু কাতার এক্সিকিউটিভের বিমানে রোগীর সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও বিলাসবহুলভাবে ভ্রমণ করতে পারেন। রোগীর জন্য থাকে বিশেষ কেবিন, যা তাকে হাসপাতালের ভীতি থেকে দূরে রাখে। এছাড়া স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে বিমান থেকেই যেকোনো দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে পরামর্শ করার সুবিধা রয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত