জুলাই গণ-অভ্যুত্থান
আজ ৩ আগস্ট। গেল বছর এদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একদফার ডাক। নাগরিকদের এই ডাকে সাড়া দিতে আহ্ববান জানিয়েছিলেন তাঁরা। তবে এর আগেই যার যার অবস্থান থেকে শিক্ষার্থীদের অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদে মুখ খুলতে শুরু করেছিল মানুষ। পথে নেমে আসেন ছাত্র-জনতা—নাগরিকেরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদও সে সময় বেরিয়ে পড়েছিলেন পথে। ফেসবুকে লেখালেখির মাধ্যমে যেমন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেমন জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন, তেমনি এক বক্তৃতায় তৎকালীন সরকারকে অভিশাপও দিয়েছিলেন। কেন এমন উচ্চারণ করেছিলেন তিনি? একদফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বর্ষপূর্তিতে লিখেছেন সে কথা।
সুমন সাজ্জাদ
‘অভিশাপ’ দেওয়ার ধারণাটি খুব প্রাচীন আর অনাধুনিক; আমি তবু অভিশাপ দিয়েছিলাম।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। রাত ৮টা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের সিঁড়িতে আমরা দাঁড়িয়েছি। আমাদের হাতে উজ্জ্বল মোমের শিখা। বেদনায় বিষাদে টুপটাপ করে গলে পড়ছে মোম। তার ঠিক দুই দিন আগে ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন আবু সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রথম শহিদ, প্রতিরোধের প্রথম প্রতীক।
দেশ তখন উত্তাল, জনতার কাঁধে কাঁধ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা কেবল খুঁজে পাচ্ছিল ষড়যন্ত্রতত্ত্ব।
ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছিলাম আমরা। তবু আমরা যেন সত্যি কথাগুলো বলতে পারছিলাম না। আমাদের সামনে তখন ভয়ের এক নিঃশব্দ তর্জনি—সরকার, আইন, পুলিশ, ডিজিএফআই, গোয়েন্দা তৎপরতা, গুম, হত্যা। মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নের ভেতর কেউ আমাদের গলা চেপে ধরেছে।
আন্দোলনের ওই মুহূর্তে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সোচ্চার। তাকেও পার করতে হয়েছে বিভীষিকাময় এক রাত।
১৫ জুলাই ২০২৪। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেছিল সশস্ত্র ছাত্রলীগ। আহত হয়েছিলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার পরের দিন নিহত হলেন আবু সাঈদ।
এই সব মর্মান্তিক ঘটনার পরও টেলিভিশনজুড়ে সম্প্রচারিত হচ্ছিল আওয়ামী দুঃশাসনের দম্ভ। তখন ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘গণ-অসন্তোষ নানাভাবেই প্রকাশ পাবে। ভয় নাই, জনতার নিজস্ব নিয়মেই ইতিহাস এগিয়ে যাবে।’
আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার ঘটনাটি আমাকে ব্যাপক দুঃখ আর যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দেয়। অমোঘ উচ্চারণের মতো আমার শ্রুতিতে তখন বেজে চলছিল সাঈদ-জননীর আর্তনাদ, ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?’ সত্যিই তো, মারলি কেন?
আমার সামনে রাশি রাশি দৃশ্যের মতো আবির্ভূত হয়েছে দুঃশাসনের ১৫টি বছর—যাকে কেবলই ‘ঘেন্না’ করা যায়। যদিও ‘ঘৃণা’ শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করি না, করতে চাই না। তবু শেষ পর্যন্ত হাসিনার কুৎসিৎ ও নির্মম শাসনকালকে তীব্রভাবে ‘ঘেন্না’ করতে আরম্ভ করলাম।
টেলিভিশনে যাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছিল, কোনো বিশেষণেই তাঁদের ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, অভিধানে থাকা বিশেষণবাচক সবচেয়ে খারাপ শব্দটিও এঁদের চরিত্র ধারণে ব্যর্থ। বড়জোর ‘পিশাচ’ শব্দটি দিয়ে এঁদের খানিকটা ব্যাখ্যা করা যায়।
সারা দিন সরকারের তল্পিবাহকদের মুখে শুনতে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্তের কথা। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁদের ব্যবসার প্রধান মূলধন। তাঁরা নিজেদের দুর্নীতি, লুটপাট আর অপশাসনকে ঢাকতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বয়ান দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের এই গোমর অনেক আগেই ধরে ফেলেছিল। মাঝখান থেকে সে সময়ের সরকার ডানপন্থীদের সুপ্ত ও প্রকাশ্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
ফেসবুকে তখন আমি ‘২৪-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছিলাম : জালিমের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, ভোট চুরির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্টও দিয়েছিলাম।
১৭ জুলাই। মহররমের ১০ তারিখ। দেশজুড়ে বিষাদের কালো ছায়া। সেদিন বারবার মনে পড়ছিল নজরুলের বিখ্যাত কবিতা, ‘নীল সিয়া আসমান,/ লালে লাল দুনিয়াসে—/ ‘আম্মা! লাল তেরি/ খুন কিয়া খুনিয়া।’ আবু সাঈদের মায়ের কান্নার ধ্বনি যেন কারাবালা আর ফোরাত ঘুরে বাংলাদেশে এসে মিশে গিয়েছিল।
২০২৪ সালের মহররমে তাই লিখেছিলাম, ‘কাল ঝরে গেছে কতগুলো সতেজ প্রাণ। নজরুলের এই লাইনগুলো আজ খুব খুব খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে লাল অক্ষর। শাসকগোষ্ঠী, রক্তপাত বন্ধ করুন! অহমিকার গর্তে নিজেরাই ডুবে মরবেন, থই পাবেন না। মনে রাখবেন, ইতিহাস আপনাদের মুক্তি দেবে না। অতীত তা-ই বলে।’
তখনও টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল সরকারি ‘শয়তানদের’ মুখ। তাঁরা হুমকি দিচ্ছিলেন।
সম্ভবত এরই মাঝখানে ফ্যাসিবাদ নিয়ে তর্ক হয়ে গেলো এক বুজুর্গ অধ্যাপকের সঙ্গে। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটির প্রয়োগ আছে—এমন আপত্তি তুলে এক শিক্ষার্থীর একটি লেখা ছাপবেন না বলে জানালেন তিনি। বললেন, ফ্যাসিবাদ অন্য জিনিস। আমি বললাম, ফ্যাসিবাদ কোনটা? তিনি বললেন, এখানে তো মিডিয়া ঠিকভাবে কথা বলছে, বাকস্বাধীনতার সমস্যা নেই... কাউকে তো বাধা দিচ্ছে না কেউ। বললাম, এত এত গুম, খুন আর মানুষের মৃত্যুর পরও এ কথা কীভাবে বলেন...! কী বলছেন আপনি এটা...! বুজুর্গ ফোন কেটে দিলেন।
১. ভোট চোরের ‘গণতন্ত্রে’র মাশুল দিচ্ছে বাংলাদেশ! ক্ষমতা কামড়ে ধরা এই কুমিরের দাঁত এরশাদের দাঁতের চেয়ে ধারালো, নির্মম ও ভয়াবহ।
২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একচ্ছত্র আওয়ামী ন্যারেটিভ ও ভার্শন আইডিওলজিক্যালি ব্যর্থ। এই বিক্ষোভ/ আন্দোলন তার প্রমাণ।
৩. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট আর এখনকার তরুণদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষা এক নয়। আওয়ামী লীগ জাতীয় ঘেন্নাকে নিজেই উসকে দিয়েছে।
৪. রাজনৈতিক অনাস্থা ও গণ-হতাশার চূড়ান্ত প্রকাশ এই গণ-অসন্তোষ।
৫. এই আন্দোলনের পেছনকার রাজনৈতিক অর্থনীতিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। জীবন চালানোর টাকাটা সবাইকে বাড়ি থেকেই আনতে হয়। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, ক্ষমতার শীর্ষে আছে দুর্নীতিবাজের দল।
৬. বাংলাদেশের জাতীয় বিভক্তির দায় এই সরকার ও আওয়ামী লীগকে বহন করতেই হবে।
৭. আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি, এই সরকার স্বৈরাচার। আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/ বাংলাদেশ মুক্তি পাক।’
স্বাধীন দেশে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ করছি, অন্তরের গভীর থেকে নিন্দা জানাচ্ছি এবং একজন বাবা হিসেবে অভিশাপ দিচ্ছি।
বাংলাদেশ, ভালোবাসার বাংলাদেশ।
১৮ তারিখ সন্ধ্যায় ডাক পেলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সাঈদ-স্মরণে একটি প্রতিবাদ সভা করা হবে। সেখানে জ্বালানো হবে মোম। হঠাৎ করেই আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমি অপ্রস্তুত।
সারা জীবনে আমি কখনো কোনো সমাবেশে বক্তৃতা করিনি। আমি খেয়াল করলাম, আমার সমস্ত শরীর ও সত্তা থেকে একটি শব্দ উচ্চারিত হতে চাইছে, সেটি হলো ‘অভিশাপ’; আমি ‘অভিশাপ’ শব্দটি উচ্চারণ করলাম।
অভিশাপের পাশাপাশি আরেকটি শব্দ আমাকে আলোড়িত করল, সেটি হলো ‘প্রত্যাখ্যান’। আমি আওয়ামী সরকার ও শাসনকে প্রত্যাখ্যান করলাম। মানে হলো ওই সরকারকে আমি আর চাই না। ওই না-চাওয়াকেই আমি তখন প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।
কারণ, শেখ হাসিনার শাসনকালে মনে হচ্ছিল দেশ, রাষ্ট্র, আইন, বাংলাদেশ—সবই টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসেছে; মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ তাঁর পৈত্রিক সম্পদ। যেন তিনি ঐশী দূত, তিনিই নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ শাসন করার ঐশী বাণী, দেশজুড়ে হাসিনারই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর কাছ থেকেই শিখতে হবে দেশপ্রেমের সংজ্ঞার্থ। অদ্বিতীয় তিনি—একমাত্র তিনিই দেশকে ভালোবাসেন। তাঁর মতো ‘পরম প্রভু’র নাম নিয়েই সূচিত হবে প্রতিটি সকাল।
কিন্তু হাসিনার মতো করে দেশকে ভালোবাসতে গেলে দেশের বারোটা বাজাতে হয়; দেশকে সাজাতে হয় কর্তৃত্ববাদের ছকে, যার অন্য নাম হতে পারে ‘হাসিনাতন্ত্র’। যার কাজ হলো রাষ্ট্রের নাগরিকের বিমানবায়ন (ডিহিউম্যানাইজেশন) আর বস্তুকরণ (থিংগিফিকেশন)। অর্থাৎ সেই নাগরিকের নিজস্ব কোনো কথা থাকবে না আর তিনি নিষ্প্রাণ বস্তুর মতোই জড়। এখানে মানুষকে হতে হবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াহীন প্রাণী অথবা বস্তু। হতে হবে রাষ্ট্রীয় ক্রীতদাস।
এই হাসিনাতান্ত্রিক শাসনে একসময় শেখ হাসিনাকে আমার মনে হচ্ছিল ফারাও বা ফেরাউন। ১৫ বছরব্যাপী যিনি তুলে ধরেছেন অহমিকার মাস্তুল। পাকিস্তানি প্রেক্ষাপটে বাঙলি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন, ‘এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ ক’টি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি।’ হাসিনার চোখেমুখে, শরীরী ভাষায় ছিল সেই ঔদ্ধত্য। আমার মনে হচ্ছিল, হাসিনার পতন আসন্ন। ছাত্রের শরীরে হাত রেখে এদেশে কোনো শাসক কোনোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, পারবে না। আমি তাই হাসিনা-সাম্রাজ্যের আমূল ধ্বংস চেয়েছিলাম। ক্ষমতার মসনদে হাসিনার গুণসম্পন্ন অন্য কোনো শাসক/ মতাদর্শ থাকলেও আমি একই কাজ করতাম।
‘অভিশাপ’—আরবিতে যাকে বলা হয়, ‘লানত’; আমার দাদির মুখে তেমনটাই শুনতাম। ১৮ তারিখ যেদিন বক্তৃতাটি দিলাম, তার আগের দিন ছিল মহররম। আমি তাই কারবালার বিষণ্ণতায় বলতে চেয়েছিলাম সেই ‘লানত’ নেমে আসুক হাসিনা-সাম্রাজ্যের ওপর, তাঁরা ধ্বংস হোক। যে শাসন মানুষকে বস্তু আর মানবেতর প্রাণীতে পরিণত করতে চায়, সে শাসন ধ্বংস হোক। আর তাই আমার কাছে ‘অভিশাপ’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল এক অবিকল্প উচ্চারণ।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
‘অভিশাপ’ দেওয়ার ধারণাটি খুব প্রাচীন আর অনাধুনিক; আমি তবু অভিশাপ দিয়েছিলাম।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। রাত ৮টা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের সিঁড়িতে আমরা দাঁড়িয়েছি। আমাদের হাতে উজ্জ্বল মোমের শিখা। বেদনায় বিষাদে টুপটাপ করে গলে পড়ছে মোম। তার ঠিক দুই দিন আগে ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন আবু সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রথম শহিদ, প্রতিরোধের প্রথম প্রতীক।
দেশ তখন উত্তাল, জনতার কাঁধে কাঁধ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা কেবল খুঁজে পাচ্ছিল ষড়যন্ত্রতত্ত্ব।
ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছিলাম আমরা। তবু আমরা যেন সত্যি কথাগুলো বলতে পারছিলাম না। আমাদের সামনে তখন ভয়ের এক নিঃশব্দ তর্জনি—সরকার, আইন, পুলিশ, ডিজিএফআই, গোয়েন্দা তৎপরতা, গুম, হত্যা। মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নের ভেতর কেউ আমাদের গলা চেপে ধরেছে।
আন্দোলনের ওই মুহূর্তে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সোচ্চার। তাকেও পার করতে হয়েছে বিভীষিকাময় এক রাত।
১৫ জুলাই ২০২৪। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেছিল সশস্ত্র ছাত্রলীগ। আহত হয়েছিলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার পরের দিন নিহত হলেন আবু সাঈদ।
এই সব মর্মান্তিক ঘটনার পরও টেলিভিশনজুড়ে সম্প্রচারিত হচ্ছিল আওয়ামী দুঃশাসনের দম্ভ। তখন ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘গণ-অসন্তোষ নানাভাবেই প্রকাশ পাবে। ভয় নাই, জনতার নিজস্ব নিয়মেই ইতিহাস এগিয়ে যাবে।’
আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার ঘটনাটি আমাকে ব্যাপক দুঃখ আর যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দেয়। অমোঘ উচ্চারণের মতো আমার শ্রুতিতে তখন বেজে চলছিল সাঈদ-জননীর আর্তনাদ, ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?’ সত্যিই তো, মারলি কেন?
আমার সামনে রাশি রাশি দৃশ্যের মতো আবির্ভূত হয়েছে দুঃশাসনের ১৫টি বছর—যাকে কেবলই ‘ঘেন্না’ করা যায়। যদিও ‘ঘৃণা’ শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করি না, করতে চাই না। তবু শেষ পর্যন্ত হাসিনার কুৎসিৎ ও নির্মম শাসনকালকে তীব্রভাবে ‘ঘেন্না’ করতে আরম্ভ করলাম।
টেলিভিশনে যাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছিল, কোনো বিশেষণেই তাঁদের ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, অভিধানে থাকা বিশেষণবাচক সবচেয়ে খারাপ শব্দটিও এঁদের চরিত্র ধারণে ব্যর্থ। বড়জোর ‘পিশাচ’ শব্দটি দিয়ে এঁদের খানিকটা ব্যাখ্যা করা যায়।
সারা দিন সরকারের তল্পিবাহকদের মুখে শুনতে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্তের কথা। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁদের ব্যবসার প্রধান মূলধন। তাঁরা নিজেদের দুর্নীতি, লুটপাট আর অপশাসনকে ঢাকতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বয়ান দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের এই গোমর অনেক আগেই ধরে ফেলেছিল। মাঝখান থেকে সে সময়ের সরকার ডানপন্থীদের সুপ্ত ও প্রকাশ্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
ফেসবুকে তখন আমি ‘২৪-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছিলাম : জালিমের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, ভোট চুরির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্টও দিয়েছিলাম।
১৭ জুলাই। মহররমের ১০ তারিখ। দেশজুড়ে বিষাদের কালো ছায়া। সেদিন বারবার মনে পড়ছিল নজরুলের বিখ্যাত কবিতা, ‘নীল সিয়া আসমান,/ লালে লাল দুনিয়াসে—/ ‘আম্মা! লাল তেরি/ খুন কিয়া খুনিয়া।’ আবু সাঈদের মায়ের কান্নার ধ্বনি যেন কারাবালা আর ফোরাত ঘুরে বাংলাদেশে এসে মিশে গিয়েছিল।
২০২৪ সালের মহররমে তাই লিখেছিলাম, ‘কাল ঝরে গেছে কতগুলো সতেজ প্রাণ। নজরুলের এই লাইনগুলো আজ খুব খুব খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে লাল অক্ষর। শাসকগোষ্ঠী, রক্তপাত বন্ধ করুন! অহমিকার গর্তে নিজেরাই ডুবে মরবেন, থই পাবেন না। মনে রাখবেন, ইতিহাস আপনাদের মুক্তি দেবে না। অতীত তা-ই বলে।’
তখনও টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল সরকারি ‘শয়তানদের’ মুখ। তাঁরা হুমকি দিচ্ছিলেন।
সম্ভবত এরই মাঝখানে ফ্যাসিবাদ নিয়ে তর্ক হয়ে গেলো এক বুজুর্গ অধ্যাপকের সঙ্গে। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটির প্রয়োগ আছে—এমন আপত্তি তুলে এক শিক্ষার্থীর একটি লেখা ছাপবেন না বলে জানালেন তিনি। বললেন, ফ্যাসিবাদ অন্য জিনিস। আমি বললাম, ফ্যাসিবাদ কোনটা? তিনি বললেন, এখানে তো মিডিয়া ঠিকভাবে কথা বলছে, বাকস্বাধীনতার সমস্যা নেই... কাউকে তো বাধা দিচ্ছে না কেউ। বললাম, এত এত গুম, খুন আর মানুষের মৃত্যুর পরও এ কথা কীভাবে বলেন...! কী বলছেন আপনি এটা...! বুজুর্গ ফোন কেটে দিলেন।
১. ভোট চোরের ‘গণতন্ত্রে’র মাশুল দিচ্ছে বাংলাদেশ! ক্ষমতা কামড়ে ধরা এই কুমিরের দাঁত এরশাদের দাঁতের চেয়ে ধারালো, নির্মম ও ভয়াবহ।
২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একচ্ছত্র আওয়ামী ন্যারেটিভ ও ভার্শন আইডিওলজিক্যালি ব্যর্থ। এই বিক্ষোভ/ আন্দোলন তার প্রমাণ।
৩. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট আর এখনকার তরুণদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষা এক নয়। আওয়ামী লীগ জাতীয় ঘেন্নাকে নিজেই উসকে দিয়েছে।
৪. রাজনৈতিক অনাস্থা ও গণ-হতাশার চূড়ান্ত প্রকাশ এই গণ-অসন্তোষ।
৫. এই আন্দোলনের পেছনকার রাজনৈতিক অর্থনীতিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। জীবন চালানোর টাকাটা সবাইকে বাড়ি থেকেই আনতে হয়। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, ক্ষমতার শীর্ষে আছে দুর্নীতিবাজের দল।
৬. বাংলাদেশের জাতীয় বিভক্তির দায় এই সরকার ও আওয়ামী লীগকে বহন করতেই হবে।
৭. আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি, এই সরকার স্বৈরাচার। আমি দ্বিধাহীনভাবে বলছি, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/ বাংলাদেশ মুক্তি পাক।’
স্বাধীন দেশে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ করছি, অন্তরের গভীর থেকে নিন্দা জানাচ্ছি এবং একজন বাবা হিসেবে অভিশাপ দিচ্ছি।
বাংলাদেশ, ভালোবাসার বাংলাদেশ।
১৮ তারিখ সন্ধ্যায় ডাক পেলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সাঈদ-স্মরণে একটি প্রতিবাদ সভা করা হবে। সেখানে জ্বালানো হবে মোম। হঠাৎ করেই আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমি অপ্রস্তুত।
সারা জীবনে আমি কখনো কোনো সমাবেশে বক্তৃতা করিনি। আমি খেয়াল করলাম, আমার সমস্ত শরীর ও সত্তা থেকে একটি শব্দ উচ্চারিত হতে চাইছে, সেটি হলো ‘অভিশাপ’; আমি ‘অভিশাপ’ শব্দটি উচ্চারণ করলাম।
অভিশাপের পাশাপাশি আরেকটি শব্দ আমাকে আলোড়িত করল, সেটি হলো ‘প্রত্যাখ্যান’। আমি আওয়ামী সরকার ও শাসনকে প্রত্যাখ্যান করলাম। মানে হলো ওই সরকারকে আমি আর চাই না। ওই না-চাওয়াকেই আমি তখন প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।
কারণ, শেখ হাসিনার শাসনকালে মনে হচ্ছিল দেশ, রাষ্ট্র, আইন, বাংলাদেশ—সবই টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসেছে; মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ তাঁর পৈত্রিক সম্পদ। যেন তিনি ঐশী দূত, তিনিই নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ শাসন করার ঐশী বাণী, দেশজুড়ে হাসিনারই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর কাছ থেকেই শিখতে হবে দেশপ্রেমের সংজ্ঞার্থ। অদ্বিতীয় তিনি—একমাত্র তিনিই দেশকে ভালোবাসেন। তাঁর মতো ‘পরম প্রভু’র নাম নিয়েই সূচিত হবে প্রতিটি সকাল।
কিন্তু হাসিনার মতো করে দেশকে ভালোবাসতে গেলে দেশের বারোটা বাজাতে হয়; দেশকে সাজাতে হয় কর্তৃত্ববাদের ছকে, যার অন্য নাম হতে পারে ‘হাসিনাতন্ত্র’। যার কাজ হলো রাষ্ট্রের নাগরিকের বিমানবায়ন (ডিহিউম্যানাইজেশন) আর বস্তুকরণ (থিংগিফিকেশন)। অর্থাৎ সেই নাগরিকের নিজস্ব কোনো কথা থাকবে না আর তিনি নিষ্প্রাণ বস্তুর মতোই জড়। এখানে মানুষকে হতে হবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াহীন প্রাণী অথবা বস্তু। হতে হবে রাষ্ট্রীয় ক্রীতদাস।
এই হাসিনাতান্ত্রিক শাসনে একসময় শেখ হাসিনাকে আমার মনে হচ্ছিল ফারাও বা ফেরাউন। ১৫ বছরব্যাপী যিনি তুলে ধরেছেন অহমিকার মাস্তুল। পাকিস্তানি প্রেক্ষাপটে বাঙলি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন, ‘এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ ক’টি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি।’ হাসিনার চোখেমুখে, শরীরী ভাষায় ছিল সেই ঔদ্ধত্য। আমার মনে হচ্ছিল, হাসিনার পতন আসন্ন। ছাত্রের শরীরে হাত রেখে এদেশে কোনো শাসক কোনোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, পারবে না। আমি তাই হাসিনা-সাম্রাজ্যের আমূল ধ্বংস চেয়েছিলাম। ক্ষমতার মসনদে হাসিনার গুণসম্পন্ন অন্য কোনো শাসক/ মতাদর্শ থাকলেও আমি একই কাজ করতাম।
‘অভিশাপ’—আরবিতে যাকে বলা হয়, ‘লানত’; আমার দাদির মুখে তেমনটাই শুনতাম। ১৮ তারিখ যেদিন বক্তৃতাটি দিলাম, তার আগের দিন ছিল মহররম। আমি তাই কারবালার বিষণ্ণতায় বলতে চেয়েছিলাম সেই ‘লানত’ নেমে আসুক হাসিনা-সাম্রাজ্যের ওপর, তাঁরা ধ্বংস হোক। যে শাসন মানুষকে বস্তু আর মানবেতর প্রাণীতে পরিণত করতে চায়, সে শাসন ধ্বংস হোক। আর তাই আমার কাছে ‘অভিশাপ’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল এক অবিকল্প উচ্চারণ।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ভাষায়, দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিশ্বাসের মাত্রার ওপর অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ভর করে।
১ দিন আগেসম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি প্রজ্ঞাপন আমার নজরে এল। প্রজ্ঞাপনটি হলো, রাত দশটার পর হলে ফিরলে ছাত্রীদের হলের সিট বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি তা দশটা এক মিনিট হলেও। অবাক করা প্রজ্ঞাপন বটে!
৩ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক আরও জোরদার করা।
৪ দিন আগেবিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসন বিশিষ্ট। আর এর সদস্য মনোনীত হবেন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে যে ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে আসন।
৪ দিন আগে