leadT1ad

এমন গণ-অভুত্থানের পরও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা কেন

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, কিন্তু হলে থাকবে না—এটা একটা অদ্ভুত দাবি! সেই অদ্ভুত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর রাতে হলগুলোতে প্রকাশ্য-অদৃশ্য কিংবা উন্মুক্ত-গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মনে হচ্ছে, আইয়ুব খান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরাজনীতিকরণের সময়ে আছি—জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে রাজনীতি ও সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ!

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ২১
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ৪৬
এমন গণ-অভুত্থানের পরও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা কেন? স্ট্রিম গ্রাফিক

আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট ও টারশিয়ারি পর্যায়ে ছিলাম, তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ২০০১ সালের নির্বাচন জেতা চারদলীয় জোট, তথা বিএনপি ও জামায়েত ইসলামি। টারশিয়ারির শেষ পর্যায় পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল ২০০৮ সালে নির্বাচনে জেতা আওয়ামী লীগ। বস্তুত, আমরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ব্যাচ ছিলাম, যারা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ উভয়েরই আধিপত্য প্রত্যক্ষ দেখেছি ক্যাম্পাসে।

লীগের আধিপত্য নিয়ে মায়ের কোলের শিশুও এখন গল্প করতে পারবে। ওই গল্পটা তো মিথই হয়ে যাবে যে, বাচ্চা খাচ্ছে না, মা বলছে, খাও নইলে ছাত্রলীগ আসবে! অতএব, লীগের গল্প চর্বিতচর্বণ হবে।

বরং, যারা লীগের আগের গল্প কম জানেন, কিংবা একদমই জানেন না, তাদের বোধহয় ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক বিচারের স্বার্থেই ওই সময়গুলোর পাঠ-পুনর্পাঠ করা জরুরি। যথেষ্ট বড় হয়ে যাওয়ায়, ওই শাসনামলের সবকিছুই একদম চোখের সামনে ভাসে আমাদের।

ক্যাম্পাসগুলোতে তখন ছাত্রদলের ব্যাপক প্রভাব। সেটা এতটাই যে, ক্যাম্পাসে হাঁটাই দায়। নেতা-ভাই সামনে বা পেছন দিয়ে হেঁটে চললে জমিন ছেড়ে দিতে হয়। হলে-হোস্টেলে চলতে গেলে সমঝে চলতে হয়। মনে হতো, নির্বাচন হলে হয়তো দিন বদলাবে। কিন্তু, সেই নির্বাচন তো হলোই না। উল্টো ওয়ান-ইলেভেন হলো, নির্বাচন প্রলম্বিত হলো, পরে আগস্ট বিদ্রোহ হলো, শিক্ষার্থীদের দামামা ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম, ক্যাম্পাসের রাজত্ব তখনো ছাত্রদলেরই হাতে।

২.

আমি যেহেতু সরকারি কলেজে পড়েছি, ফলে জানি, এই কলেজগুলোতে আধিপত্যবাদী ছাত্র-সংগঠনগুলোর মধ্যে ন্যূনতম কোনো রাজনৈতিক ক্লাস নেই, গ্রাম্য-কাজিয়ার মতো ক্রিয়াকলাপ সব।

ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ছাত্রদল এমন এক সমস্যায় আমাকে ফেলেছিল, আমি শুধু প্রহর গুনছিলাম, এদের আইয়ামে জাহেলিয়া থেকে কবে মুক্ত হবো। বিস্তারিত বলব না, এতে আমার নিজেরই অনেক সহপাঠী আজকে প্রায় দুই যুগ পরে বিব্রত হবে। হয়তো ওদের মনেও নেই৷

ঘটনাটা সামান্য, আমার সাইকেল ছাত্রদলের এক পাতিনেতার পছন্দ হওয়ায় তিনি জোর-জবরদস্তি করে সাইকেলটা কেড়ে নিয়ে দাবি করলেন, সাইকেলটা নাকি তারই!

এরপর এটা নিয়ে ঘটনা পৌরসভার মেয়র পর্যন্ত গড়াল। সাইকেল ফেরত পেলাম। কিন্তু, ছাত্রদল করা সহপাঠীরা এতে নাখোশ হলো। লাঞ্ছিত করতে উদ্যত হলো। সম্পর্ক নষ্ট হলো। আবার ঠিকও হয়ে গেল একটা পর্যায়ে। কিন্তু, ওই সময়টা আমাকে ভাবিয়েছিল, সামান্য একটা সাইকেলের জন্য ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এমন নোংরামি যারা করতে পারে, তারা শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণ করছে।

এটা হলো আমার 'জীবন থেকে নেওয়া' অভিজ্ঞতা।

৩.

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলে এবং সর্বোপরি ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য তৈরি হয় কী করে? তার একটা উদাহরণও আমি আমার 'জীবন থেকে নেওয়া' অভিজ্ঞতা থেকে এখানে তুলে ধরছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। হলে তখন ব্যাপক আসন সংকট 'দেখানো হচ্ছে'। 'প্রথম বর্ষ হিসেবে' (কথাটা পড়লে মনে হবে যেন ডি ফ্যাক্টো এটাই হয়।) আমরা আছি গণরুমে। প্রথম কিছুদিন ভালোই লাগল, বিভিন্ন বিভাগের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পরিচয় ও খাতির হলো। অন্তত পাঁচটা বছর তো একসঙ্গেই কাটাতে হবে। ফলে, এভাবে পরিচয় হওয়াটা খারাপ মনে হয়নি। মানে, সেই বোধোদয়টাই তৈরি হতে দেওয়া হয়নি যে, এটা খারাপ কিছু।

আসল সমস্যা শুরু হলো প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার আগে। প্রায় ১০০ জন থাকি, পড়ার পরিবেশ নেই। পরীক্ষা দিব কী করে। সংগঠনের এক বড় ভাইয়ের কক্ষে গিয়ে পড়ি, রাতে গণরুমে ঘুমাতে যাই। এদিকে, নিজের সংগঠনের সভা-সমাবেশেও যেতে বাধা পাই, যেনবা চুরি করছি। মানে রীতিমতো মানসিক অত্যাচার।

বাংলাদেশে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বহু বছর থেকেই ফলাফলকেন্দ্রিক পড়ালেখায় অনেক ভালো করছে, এটা আনন্দের খবর। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেরা যে মেয়েদের চেয়ে ফলাফলে পিছিয়ে থাকে, তার অন্যতম কারণ প্রথম বর্ষে ছেলেদের হলের এই গণরুম সংস্কৃতি ও তার হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া লাঠিয়াল ছাত্ররাজনীতি।

ওদিকে, হল প্রশাসন নাম কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হচ্ছে না। তথাকথিত রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা আশ্বাস দেন, ‘হবে হবে।’ আবার, তাদের ডিঙিয়ে হল প্রশাসকদের কাছে যাওয়া মানে 'প্রোটোকল ব্রেক' করার শাস্তি। অপ্রাতিষ্ঠানিক টর্চার সেল মানে ফাপর।

একদিন হঠাৎ করে নতুন সূর্য উদিত হলো। হলের প্রভোস্ট কমন মিটিংয়ে বললেন, আসন বণ্টনের ব্যাপারটা তোমাদের বড় ভাইয়েরা যেভাবে বন্দোবস্ত করছে, সেভাবেই চলুক৷ আমরা এর মধ্যে নাক গলাতে চাই না।

বড় ভাই বলতে ছাত্রদলের হলের নেতা-উপনেতারা। তারা আমাদের দিকে মুখ ফিরে চাইলেন। সেই চাওয়াটা এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর বারো মাস পর। কিন্তু, কয়েকজনের (৯-১০ জন) জন্য বিশেষ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাই কয়েকদিন পরপর তাদেরকে কক্ষ বদলের নোটিশ পাঠানো হতো (৪ জনের আসনে ১০ জনের জন্য একটা কক্ষ)। এদের কয়েকজন ছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের, আর কয়েকজন ছাত্রদলের নেতা-উপনেতা কর্তৃক জুনিয়রদের মধ্যে বানানো গ্রুপ-উপগ্রুপের শিকার।

এই শাস্তিগ্রহীতা ৯-১০ জনের মধ্যে আমি ছিলাম, ছিল আমার বন্ধু, এখনকার বিশিষ্ট ব্যান্ডশিল্পী সিনা হাসান, ছিল স্নাতক শেষবর্ষে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া জুবায়ের আহমেদ প্রমুখ। বিস্ময়কর লাগতে পারে, তবে, জুবায়ের মূলত প্রথম বর্ষে ছাত্রদলের এই হলকেন্দ্রিক গ্রুপ-উপগ্রুপ রাজনীতিরই জেরে চতুর্থ বর্ষে গিয়ে খুন হয় তথাকথিত ভিসিলীগের হাতে। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য আমি ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল উভয় সংগঠনকেই দায়ী মনে করি।

যাই হোক, বারো মাস পর আসন বরাদ্দ পেলেও, ততদিনে একাডেমিকভাবে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বহু বছর থেকেই ফলাফলকেন্দ্রিক পড়ালেখায় অনেক ভালো করছে, এটা আনন্দের খবর। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেরা যে মেয়েদের চেয়ে ফলাফলে পিছিয়ে থাকে, তার অন্যতম কারণ প্রথম বর্ষে ছেলেদের হলের এই গণরুম সংস্কৃতি ও তার হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া লাঠিয়াল ছাত্ররাজনীতি৷

৪.

এই গণরুম সংস্কৃতিটা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নিজস্ব সৃষ্টি। তাতে করে হলের আসন বরাদ্দ তাদের হাতে রাখা যায়। পেশিশক্তির রাজনীতি করতে হলে, এই একটাই তাদের পথ। মিছিলে লোক টানতে হলে, ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রোটোকল নেওয়াতে হলে, এই একটাই পথ। নিজেদের নামে একেকটা করে ‘পলিটিক্যাল রুম’ দখল করে রাখার এই একটাই পথ। বাপ-দাদার পৈতৃক সম্পত্তির মতো হলের মধ্যে ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ তৈরি করার এই হলো পথ।

একমাত্র এই পথেই শিক্ষার্থীদের দাসানুদাস বানিয়ে রাখা যায়। একটা আসন বরাদ্দের ক্ষমতা দেখিয়ে আরেকজন শিক্ষার্থীর প্রতি কী যে মানসিক নির্যাতন এরা চালায়, ভাবাই যায় না। দাসত্বের যুগ আর সামন্ত যুগ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রাবাসগুলোতে। অনেকেই সহ্য করে, অনেকেই এই লাইনে আদর্শ-টাদর্শের উর্ধ্বে গিয়ে নিজেরাও 'বড় ভাই' হয়ে ওঠে এবং প্রোটোকলের রাজনীতি শুরু করে। অনেকেই ট্রমায় চলে যায়, অনেকে অপমান নিতে না পেরে জীবনের তরে হল ছেড়ে দিয়ে বাইরে থাকে।

এই যে ওয়ার্কিং মেথোডলজি ও একেকটা সরকারি ছাত্র সংগঠনকে মনস্টার বানানোর ফ্রেমওয়ার্ক, সেটাতে বছরের পর বছর তেলমশলা ঢেলেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনগুলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় আমলেই। নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে তারা তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে হলের আসন বরাদ্দ ছেড়ে দেয়, নইলে এই আধিপত্যবাদী দুষ্টুচক্রটা কাজ করবে না ঠিকঠাক।

তার মানে, সমস্যাটা কি ছাত্ররাজনীতির নাকি প্রশাসনিক সদিচ্ছার? সমস্যাটি কি রাজনীতির নাকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার? সমস্যাটা কি কোনো সংগঠনের মনস্টার হয়ে ওঠার নাকি তাকে মনস্টার করে তোলার পৃষ্ঠপোষকতায়? এগুলো না বুঝে, যারা ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অনেকে উদারতাবাদী প্রমাণ করতে চান, তাদের নড়াচড়া সন্দেহজনক।

৫.

এই আলাপটা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ১৮টি হল কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন। হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনের ক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটি মূলত ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণেরই প্রথম সোপান৷

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, কিন্তু হলে থাকবে না—এটা একটা অদ্ভুত দাবি! সেই অদ্ভুত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর রাতে হলগুলোতে প্রকাশ্য-অদৃশ্য কিংবা উন্মুক্ত-গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মনে হচ্ছে, আইয়ুব খান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরাজনীতিকরণের সময়ে আছি -- জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে রাজনীতি ও সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ!

বিশ্ববিদ্যালয় না বদলালে, বাংলাদেশ বদলাবে—এটা যারা কল্পনা করেন, তারা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করছেন। বাংলাদেশকে বদলাতে পারে তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বারবার বিশ্ববিদ্যালয় সেটি করে দেখিয়েছে। কিন্তু, স্থায়ী সমাধান হয়নি। সেজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থায় আঘাত করা প্রয়োজন।

ওদিকে, ২০ বছর মেয়াদি উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে দেখবেন, বিশ্বব্যাংকও পরোক্ষে চায় হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। ক্যাম্পাসগুলোতে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পখোরবৃন্দ বসে আছেন বিশ্বব্যাংককে খুশি করতে। আসলেই মারহাবা!

প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায়, আইয়ুব যেমন করেছিলেন। কিন্তু, অদৃশ্য রাজনীতি? আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের একটা ইতিহাস আছে; কিন্তু সেটা ক্যাম্পাসগুলোতেও চলে এসেছে! অদৃশ্য রাজনীতি তো তা-ই, যা জনপরিসরে নিষিদ্ধ। তার মানে, যা ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ হয়ে আছে, তা আবার নিষিদ্ধ করার নাটক কি এজন্য যে, তাতে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পথটিও সহজ হয়ে যায়?

ক্যাম্পাসে এই অদৃশ্য রাজনীতির উদ্ভব হয়েছে কোথা থেকে কিংবা কারা এর পেছনের খেলোয়াড়, সেটা উন্মুক্ত না করে এ ধরনের রাজনীতি কীভাবে নিষিদ্ধ করা যায় আসলে? মেথোডলজিটা কী? এটা যতক্ষণ পরিষ্কার না হবে, ততক্ষণ ধরে নিতে হবে যে, এই অদৃশ্য রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্যই প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে।

বিস্ময়করভাবে এই চিন্তার পেছনে পারদ ঢাললেন গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম সক্রিয় মুখ উমামা ফাতেমা, স্যোশাল মিডিয়ায় তিনি লিখলেন, ‘ইউনিভার্সিটি কি পড়াশোনা করার জায়গা নাকি রাজনীতি করার জায়গা।’ এই কথাটা পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন যেকোনো ব্যক্তিই বিস্মিত হবেন যে, মাত্রই এক বছর আগে যিনি এত বড় একটা রাজনৈতিক ঘটনার অন্যতম সম্মুখসারির নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন।

অথচ, গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম স্পিরিটের জায়গা ছিল রাজনীতি করার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না। সংগঠন, সভা-সমাবেশ করা ব্যক্তির নাগরিক অধিকার, এমনকি ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও সেটার নিশ্চয়তা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলও এর আওতাভুক্ত। কিন্তু, উমামারা চব্বিশের জুলাইয়ের হলের একটা বিজ্ঞপ্তি আদায় করার বাস্তবতা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিকে বশ করতে চাইছেন, এটা মারাত্মক সমস্যাজনক।

চব্বিশের জুলাইয়ের সেই কৌশলটা ছিল ছাত্রলীগ নামক মনস্টারকে ঠেকানোর কৌশল। কিন্তু, এখন কি মনস্টার হয়ে উঠেছে কেউ? নাকি আশঙ্কার ওপর নির্ভর করে এই রণকৌশল? নাকি আশঙ্কা আছে বলে মাথাব্যথার দাওয়াই ব্যবহার না করে, মাথাটাই কেটে ফেলার প্রেসক্রিপশন দেওয়া হচ্ছে? এর আগে গত এক বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। যারা দাবি তুলেছেন, দেখা গেছে তারা নিজেরাই একটি বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য।

৬.

সামনে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন। হলে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে নির্বাচন করা যাবে? এর ফলে যে ‘ফাংশনাল ডিজঅর্ডার’ তৈরি হবে ছাত্র-সংগঠনগুলোর মধ্যে, সেটা আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। কেননা, তখন জবাবহীনতার চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে, কাউকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। ছাত্র-সংগঠনগুলো কাদের ছেড়ে কাদের মনোনয়ন দেবে, এটা নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা তৈরি হবে যে, উল্টো ছাত্র সংসদ নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। একদিকে, ছাত্র সংসদের দাবি, আরেকদিকে হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি—এটা সম্পূর্ণরকম দ্বিচারিতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একটা এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করলেন হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়ে। হল কোনো প্রক্টরের সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তার দায়িত্ব ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিধান করা। হল সম্পূর্ণভাবে প্রভোস্টের দায়িত্বে, এমনকি যখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী হলগুলোতে ‘রেইড’ দেয়, তখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি তো নিতেই হয়, বিশেষ করে নিতে হয় প্রভোস্টের অনুমতি। তাহলে, প্রক্টর কোন অধিকারবলে এই ঘোষণা দিলেন?

আমরা বিগত কিছুদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করে আসছিলাম। আমরা মনে করছিলাম যে, এটি একটি পাতানো নাটক, যা শুধু ক্যাম্পাসগুলোকে ঠান্ডা রাখার কৌশল হিসেবেই শিক্ষার্থীদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এই হঠকারিতার মধ্য দিয়ে সেই সংশয় আরও গভীরভাবে ঘনীভূত হলো আমাদের মনে।

সামনে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন। হলে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে নির্বাচন করা যাবে? এর ফলে যে ‘ফাংশনাল ডিজঅর্ডার’ তৈরি হবে ছাত্র-সংগঠনগুলোর মধ্যে, সেটা আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। কেননা, তখন জবাবহীনতার চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে, কাউকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না।

৭.

আরেকটি বিশেষ দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেছে, অনেকেই বিগত দিনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের কয়েকজনের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জেনে ছাত্রদল তাদের প্রাথমিক সদস্যপদও স্থগিত করেছে। কিন্তু, ইতিমধ্যেই বলা শুরু হয়ে গেছে যে, ‘লীগের যারা দলে ঢুকেছে, তারা হলো পুনর্বাসিত।’

অন্যদিকে, আমরা গত বছর ৫ আগস্টের পর দেখেছি, ছাত্রলীগ করা অনেকেই ছাত্র শিবিরের সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাদের ব্যাপারে ভাষ্য হলো, ‘লীগের যারা শিবিরে ঢুকেছে, তারা ছিল সুপ্তগুপ্ত।’

একসঙ্গে এই দুটি বাক্য পাঠ করলে বেশ কাব্যময় বয়ান হাজির হবে আমাদের সামনে:

‘লীগের যারা দলে ঢুকেছে, তারা হলো পুনর্বাসিত।

লীগের যারা শিবিরে ঢুকেছে, তারা ছিল সুপ্তগুপ্ত।’

এই ন্যারেটিভ ভয়ানক সমস্যাজনক। এই ন্যারেটিভের মাধ্যমে লীগের মাধ্যমে দলকেও ঘায়েল করা যায়, কিন্তু বেনিফিট অব ডাউট পায় শিবির। মানে, একযাত্রায় দুই ফল দেখা যাচ্ছে! ছাত্রদলে গেলে পুনর্বাসিতলীগ, শিবিরে গেলে গুপ্তলীগ—এই বয়ান কাউকে নায়ক, কাউকে খলনায়ক বানায়। অথচ, লীগের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে কোনো সংগঠনেরই কাউকেই আসলে বেনিফিট অব ডাউট দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, যারা জড়িত ছিলেন, তারা লীগের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে শক্তি জুগিয়েই জড়িত ছিলেন, এমনকি নিপীড়ন-নির্যাতনেও নিযুক্ত ছিলেন। তাদের বিচার হবে না?

৮.

দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদল প্রকাশ্যে হল কমিটি ঘোষণা করার ফল হিসেবেই নাখোশ হয়ে উন্মুক্ত বা প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। এটা অবশ্যই ছাত্রদলের ‘অযোগ্যতা’ যে, তারা গুপ্ত রাজনীতি করতে পারে না। পারলে এমন নাখোশমূলক পরিস্থিতির সূত্রপাত হতো না। কিন্তু, রাজনীতিটা যে প্রকাশ্যেই করা উচিত, এবং সেটা করলে যে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সাংগঠনকি ও আইনিভাবে সাজা দেওয়া যায়, এটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হতে হয় না।

বরং, একমাত্র নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো উচিত ‘গুপ্ত রাজনীতি’কে, কেননা যা কিছু অদৃশ্য, তা সবসময়ই ধোঁয়াশাজনক ও গভীরভাবে বিপজ্জনক। এটা এতটাই বিপজ্জনক যে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে সেটা ব্যক্তিরই অপরাধ হয়ে থাকবে, অথচ, সেই অপরাধের পেছনে হয়তো অদৃশ্য কোনো সংগঠনের বিশাল খুঁটি ও ইন্ধন আছে। মানে, সেই সংগঠনটা ধরা-ছোঁয়া ও জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাবে।

প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে হলে হলে আর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। হতেই পারে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির তাদের অতীতের ধারাবাহিকতায় নতুন করে মনস্টার হয়ে উঠতে যাচ্ছে বা আগামী দিনে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সচেতনতাবোধ থাকাটা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু, সংগঠনগুলোর মনস্টারগিরি ঠেকানোর উপায় হলো আধিপত্যবাদী ফ্রেমওয়ার্কের প্রাথমিক জায়গাটা ভেঙে দেওয়া। আসন বণ্টনের দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে, কোনো ছাত্র-সংগঠনকে এই 'দায়িত্ব পালন' করতে দেওয়া হবে না—এই স্লোগান হলে হলে, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে উঠতে হবে। তাহলে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, র‌্যাগিং, বুলিং, ম্যানারিজম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শোডাউন, ফাও খাওয়া ইত্যাদির পাইপলাইন বন্ধ হয়ে যাবে।

এই কাজটা যদি শিক্ষার্থীরা গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে হলকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিপরীতে হয়তো শিক্ষার্থীদের নিজেদের অংশীদারত্ব ও অধিকার হলগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হবে। আর অবশ্যই ক্যাম্পাসে ও হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনকে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা, সবকিছুই আসলে দিনশেষে নির্ভর করে প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর কিংবা বলা যেতে পারে, প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতাতেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন মনস্টার হয়ে ওঠে। কিন্তু, প্রশাসন যদি সেই কাঙ্ক্ষিত সদিচ্ছা দেখাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। প্রশাসনকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে না পারলে অযথা ছাত্র রাজনীতির ওপর বিরূপ হওয়ার কোনো অর্থ থাকতে পারে না।

৯.

সংস্কারের প্রশ্নে রাষ্ট্রব্যাপী যে আওয়াজ উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বিক্ষুব্ধ হলেন হলে হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে, কিংবা এর আগে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যাঁরা হয়েছেন, তারা কি শিক্ষা সংস্কার কমিশন করার জন্য দাবি তুলেছেন? না তুলে থাকলে, কেন তুললেন না?

রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলের আকাঙ্ক্ষায় ‘জুলাই সনদ’ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’র দাবি নিয়ে এত হইচই হলো, অথচ আন্দোলনের প্রধান অংশীজনরা ‘ক্যাম্পাস সনদ’ বা ‘ক্যাম্পাস চার্টার’ নিয়ে কেন আওয়াজ তুলছেন না, যেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সকলকে একযোগে সম্মত হতে হবে যে, তারা কেমন বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চান? কেন তারা বলছেন না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ পর্ষদকে কার্যকর করতে হবে?

বিশ্ববিদ্যালয় না বদলালে, বাংলাদেশ বদলাবে—এটা যারা কল্পনা করেন, তারা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করছেন। বাংলাদেশকে বদলাতে পারে তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বারবার বিশ্ববিদ্যালয় সেটি করে দেখিয়েছে। কিন্তু, স্থায়ী সমাধান হয়নি। সেজন্যই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় আঘাত করা প্রয়োজন। কিন্তু, গণ-অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে সেই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা বদলানোর কোনো রূপরেখা হাজির না করে, উল্টো ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা করা শুধু লজ্জাজনকই না, অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গেও প্রতারণা করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

Ad 300x250

সম্পর্কিত