রাতুল আল আহমেদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলাম আরও এক দশক আগে। পড়তে যাওয়ার আগে, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ধারণা ঠিক যেমন ছিল, পড়তে গিয়ে সেসবের অনেক কিছুই পালটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে এখন ভাবতে বসে দেখি সেসব ভাবনারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ঠিক যেন থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিস।
সন্দেহ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাই আমার কাছে এখনো শ্রেষ্ঠ সময়। না, কোনো রোমান্টিক নস্টালজিয়া থেকে কথাটা বলছি না। বরং আমি আজ যা, তা ঠিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শেখা। একটা বড় অংশ আমার বিভাগ নৃবিজ্ঞানের থেকে আর বাকিটা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে পথ পাড়ি দেওয়া বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া।
এ ভান্ডারে যেমন বিবিধ সুখকর অভিজ্ঞতা আছে, হতাশার বা না পাওয়ার অভিজ্ঞতাও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিলেও কখনোই পার্টিজান ছিলাম না আমি। ফলে, হয়তো আমাকে বা আমার মতন নন-পার্টিজান শিক্ষার্থীদের কোনো একটা ছকে ফেলা কষ্টকর ছিল। সে সময়ের সরকারি দল ছাত্রলীগের জন্য ব্যাপারটা যতটা না সমস্যার ছিল, তার চেয়ে এ বড় সমস্যা ছিল কিছু শিক্ষকদের, যাঁরা নিজেদের কোনোভাবেই কোনো দলের ‘খোঁয়াড়ে’ নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের পুরতে না পারলে স্বস্তি পেতেন না।
এ ‘খোঁয়াড়ে’ নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের পোরার উদগ্র বাসনা কতিপয় শিক্ষকদের মধ্যে ছিল তা নয়, শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে ছিলেন না। তাদের মধ্যেও অনেকেও খোঁয়াড়ের পথ খুঁজতেন। দেখুন, সমস্যা কিন্তু পার্টিজান হওয়া বা রাজনীতি করা-না-করা নিয়ে নয়। সমস্যাটা গভীর ও গুরুতর।
বাংলাদেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ভেঙে পড়েছিল। কোনো কোনো শিক্ষক চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রশ্ন করা যাবে না। একদম হীরক রাজার দেশের আদর্শ শিক্ষক। হীরক রাজার দেশের আদর্শ শিক্ষার্থীরাও ছিল সে পাঠশালায়। ফলে, পাঠশালা বন্ধ না হয়েও তৈরি হয়েছিল এক দীর্ঘ অচলাবস্থা।
এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে শুরু করেছিল কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার গেটকিপার। প্রশ্নহীন আনুগত্যের এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যা জ্ঞানচর্চার মূল স্পৃহাকেই হত্যা করেছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক পরিণত হয়েছিল এক অসম ভূমিকায়, যেখানে শিক্ষকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই শেষ কথা। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব — যেখানে জ্ঞান আদান-প্রদানের চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা বেশি, তা কেবল ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকেই পঙ্গু করে দিচ্ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চার তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিবর্তে তা হয়ে উঠেছিল মতাদর্শগত বিভেদ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক রণক্ষেত্র। কোনো কোনো শিক্ষক যাঁরা তথাকথিত ‘খোঁয়াড়ে’ আশ্রয় খুঁজেছিলেন, তাঁরা কেবল নিজেদেরই নয়, শিক্ষার্থীদেরও একই অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত করা, যা তাঁদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও স্বাধীন সত্তাকে দমন করত। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হয়ে উঠেছিল ভীতি ও সন্দেহে পূর্ণ, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে বা ভিন্নমত পোষণ করতে ভয় পেত।
শিক্ষকদের এই আচরণ কেবল তাঁদের পেশাগত নৈতিকতার অবক্ষয়ই ঘটাচ্ছিল না, বরং তা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এক দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। যখন শিক্ষকরা নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে শিক্ষার্থীদের পথ দেখানোর পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের হাতিয়ারে পরিণত হন, তখন তা মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি করে। অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়, যা দেশের মেধাপাচারের এক অন্যতম কারণ।
এই ‘খোঁয়াড়ে’ রাজনীতি কেবল শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অনেক শিক্ষার্থীও এর অংশীদার হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের আশায় এই অনৈতিক পথে পা বাড়িয়েছিলেন। এই ধরনের বিভেদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতা তৈরি করেছিল, যা জ্ঞানার্জন ও মানব উন্নয়নের মূল লক্ষ্য থেকে তাদের বিচ্যুত করেছিল।
ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই পতন কেবল জ্ঞানচর্চার পথকেই রুদ্ধ করেনি, বরং তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশেও বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। হীরক রাজার দেশের পাঠশালার মতো — যেখানে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তেমনই এক অচলাবস্থার শিকার হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা তথাকথিত ‘সঠিক’ জ্ঞান অর্জন করার জন্য মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, যা তাদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে খর্ব করেছিল।
মনে রাখা দরকার, জ্ঞানার্জন কোনো একমুখী প্রক্রিয়া নয়। এটি একটি দ্বিমুখী মিথষ্ক্রিয়া যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুজনই একে অপরের কাছ থেকে শেখে। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় সেই মিথষ্ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শিক্ষকরা নিজেদেরকে জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে এবং শিক্ষার্থীদের কেবল গ্রহণকারী হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলেন, যা সম্পর্কটিকে আরও অসম করে তুলেছিল। এই অসমতা কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা ক্যাম্পাসের সামগ্রিক পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলেছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে সুযোগ এসেছিল এ অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসার। কিছু ক্ষেত্রে যেমন তাঁরা সফল হয়েছেন, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে দেখতে পাই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
ভুলে গেলে চলবে না, এ সমস্যা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, তেমন আচমকা সমাধানও হবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অনেক জায়গায় মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখেছি। বিশেষত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে যৌন অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন প্রক্টরের মতন দায়িত্বশীল পদে থাকা শিক্ষক, আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি পোষ্য কোটা বাতিলের আন্দোলনে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও। এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিশ্চিতভাবেই কলঙ্কজনক ঘটনা।
অন্যদিকে, দীর্ঘ অচলাবস্থার পর ডাকসু-জাকসু-রাকসু-চাকসুর মতো ছাত্র-সংসদগুলো সচল হওয়া শুরু করেছে। নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের জন্য এটি একটি শুভ সূচনা। তবে, পথের এ শুরু মাত্র, মঞ্জিল অনেক দূর। হাসিনাকে যেমন তাড়াতে পেরেছে এদেশের শিক্ষার্থী-জনতা, তেমনই অন্তরের ভেতর লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদকেও দূর করতে পারতে হবে।
এই ছাত্র-সংসদগুলোর মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্ব আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্ম একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সূচনার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। ছাত্র-সংসদগুলো এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এই নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, ক্যাম্পাসের উন্নয়ন এবং সার্বিকভাবে দেশ পরিচালনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে, ছাত্র-সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক অনিয়ম, প্রশাসনের পক্ষপাত, ফল প্রকাশে বিলম্ব ইত্যাদি অভিযোগও রয়েছে, যা সুষ্ঠু নেতৃত্ব বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এই বাধাগুলো অতিক্রম করে যদি একটি সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব উঠে আসে, তবে তাঁরা দেশ ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি আমূল পরিবর্তন। প্রথমেই শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিকতা ও পেশাদারত্বের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। তাঁদের বুঝতে হবে যে, তাঁরা কেবল জ্ঞান বিতরণের বাহক নন, বরং তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। তাঁদের উচিত শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন করার স্পৃহা জাগানো, তাঁদের ভিন্নমতকে সম্মান করা এবং তাঁদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বিকাশে সহায়তা করা। ‘হীরক রাজার দেশে’র শিক্ষকের আদলে নয়, বরং তারা হবেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।
আর শিক্ষার্থীদেরও এই পরিবর্তনের অংশ হতে হবে। তাঁদের প্রশ্ন করতে পারতে হবে। নিজের উদ্দেশ্যে, শিক্ষকের ও শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। মনে রাখতে হবে, প্রশ্ন না করলে নতুন জ্ঞানের জন্ম হয় না। কোপার্নিকাস বা গ্যালিলিউ প্রশ্ন না করলে জগত আজ এখানে আসত না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি ডিগ্রি অর্জনের প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি আত্ম-আবিষ্কার ও সমাজ পরিবর্তনের একটি কেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সম্মান করে সমালোচনা করার সাহস অর্জন করা।
সর্বোপরি, এই ‘খোঁয়াড়’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষকদের তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাঁদের মেধার সঠিক বিকাশ ঘটাতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার চর্চা করতে হবে। প্রশাসনকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে একটি আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই হয়তো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলাম আরও এক দশক আগে। পড়তে যাওয়ার আগে, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ধারণা ঠিক যেমন ছিল, পড়তে গিয়ে সেসবের অনেক কিছুই পালটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে এখন ভাবতে বসে দেখি সেসব ভাবনারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ঠিক যেন থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিস।
সন্দেহ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাই আমার কাছে এখনো শ্রেষ্ঠ সময়। না, কোনো রোমান্টিক নস্টালজিয়া থেকে কথাটা বলছি না। বরং আমি আজ যা, তা ঠিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শেখা। একটা বড় অংশ আমার বিভাগ নৃবিজ্ঞানের থেকে আর বাকিটা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে পথ পাড়ি দেওয়া বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া।
এ ভান্ডারে যেমন বিবিধ সুখকর অভিজ্ঞতা আছে, হতাশার বা না পাওয়ার অভিজ্ঞতাও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিলেও কখনোই পার্টিজান ছিলাম না আমি। ফলে, হয়তো আমাকে বা আমার মতন নন-পার্টিজান শিক্ষার্থীদের কোনো একটা ছকে ফেলা কষ্টকর ছিল। সে সময়ের সরকারি দল ছাত্রলীগের জন্য ব্যাপারটা যতটা না সমস্যার ছিল, তার চেয়ে এ বড় সমস্যা ছিল কিছু শিক্ষকদের, যাঁরা নিজেদের কোনোভাবেই কোনো দলের ‘খোঁয়াড়ে’ নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের পুরতে না পারলে স্বস্তি পেতেন না।
এ ‘খোঁয়াড়ে’ নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের পোরার উদগ্র বাসনা কতিপয় শিক্ষকদের মধ্যে ছিল তা নয়, শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে ছিলেন না। তাদের মধ্যেও অনেকেও খোঁয়াড়ের পথ খুঁজতেন। দেখুন, সমস্যা কিন্তু পার্টিজান হওয়া বা রাজনীতি করা-না-করা নিয়ে নয়। সমস্যাটা গভীর ও গুরুতর।
বাংলাদেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ভেঙে পড়েছিল। কোনো কোনো শিক্ষক চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রশ্ন করা যাবে না। একদম হীরক রাজার দেশের আদর্শ শিক্ষক। হীরক রাজার দেশের আদর্শ শিক্ষার্থীরাও ছিল সে পাঠশালায়। ফলে, পাঠশালা বন্ধ না হয়েও তৈরি হয়েছিল এক দীর্ঘ অচলাবস্থা।
এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে শুরু করেছিল কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার গেটকিপার। প্রশ্নহীন আনুগত্যের এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যা জ্ঞানচর্চার মূল স্পৃহাকেই হত্যা করেছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক পরিণত হয়েছিল এক অসম ভূমিকায়, যেখানে শিক্ষকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই শেষ কথা। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব — যেখানে জ্ঞান আদান-প্রদানের চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা বেশি, তা কেবল ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকেই পঙ্গু করে দিচ্ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চার তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিবর্তে তা হয়ে উঠেছিল মতাদর্শগত বিভেদ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক রণক্ষেত্র। কোনো কোনো শিক্ষক যাঁরা তথাকথিত ‘খোঁয়াড়ে’ আশ্রয় খুঁজেছিলেন, তাঁরা কেবল নিজেদেরই নয়, শিক্ষার্থীদেরও একই অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত করা, যা তাঁদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও স্বাধীন সত্তাকে দমন করত। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হয়ে উঠেছিল ভীতি ও সন্দেহে পূর্ণ, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে বা ভিন্নমত পোষণ করতে ভয় পেত।
শিক্ষকদের এই আচরণ কেবল তাঁদের পেশাগত নৈতিকতার অবক্ষয়ই ঘটাচ্ছিল না, বরং তা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এক দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। যখন শিক্ষকরা নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে শিক্ষার্থীদের পথ দেখানোর পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের হাতিয়ারে পরিণত হন, তখন তা মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি করে। অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়, যা দেশের মেধাপাচারের এক অন্যতম কারণ।
এই ‘খোঁয়াড়ে’ রাজনীতি কেবল শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অনেক শিক্ষার্থীও এর অংশীদার হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের আশায় এই অনৈতিক পথে পা বাড়িয়েছিলেন। এই ধরনের বিভেদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতা তৈরি করেছিল, যা জ্ঞানার্জন ও মানব উন্নয়নের মূল লক্ষ্য থেকে তাদের বিচ্যুত করেছিল।
ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই পতন কেবল জ্ঞানচর্চার পথকেই রুদ্ধ করেনি, বরং তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশেও বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। হীরক রাজার দেশের পাঠশালার মতো — যেখানে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তেমনই এক অচলাবস্থার শিকার হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা তথাকথিত ‘সঠিক’ জ্ঞান অর্জন করার জন্য মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, যা তাদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে খর্ব করেছিল।
মনে রাখা দরকার, জ্ঞানার্জন কোনো একমুখী প্রক্রিয়া নয়। এটি একটি দ্বিমুখী মিথষ্ক্রিয়া যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুজনই একে অপরের কাছ থেকে শেখে। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় সেই মিথষ্ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শিক্ষকরা নিজেদেরকে জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে এবং শিক্ষার্থীদের কেবল গ্রহণকারী হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলেন, যা সম্পর্কটিকে আরও অসম করে তুলেছিল। এই অসমতা কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা ক্যাম্পাসের সামগ্রিক পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলেছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে সুযোগ এসেছিল এ অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসার। কিছু ক্ষেত্রে যেমন তাঁরা সফল হয়েছেন, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে দেখতে পাই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
ভুলে গেলে চলবে না, এ সমস্যা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, তেমন আচমকা সমাধানও হবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অনেক জায়গায় মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখেছি। বিশেষত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে যৌন অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন প্রক্টরের মতন দায়িত্বশীল পদে থাকা শিক্ষক, আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি পোষ্য কোটা বাতিলের আন্দোলনে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও। এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিশ্চিতভাবেই কলঙ্কজনক ঘটনা।
অন্যদিকে, দীর্ঘ অচলাবস্থার পর ডাকসু-জাকসু-রাকসু-চাকসুর মতো ছাত্র-সংসদগুলো সচল হওয়া শুরু করেছে। নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের জন্য এটি একটি শুভ সূচনা। তবে, পথের এ শুরু মাত্র, মঞ্জিল অনেক দূর। হাসিনাকে যেমন তাড়াতে পেরেছে এদেশের শিক্ষার্থী-জনতা, তেমনই অন্তরের ভেতর লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদকেও দূর করতে পারতে হবে।
এই ছাত্র-সংসদগুলোর মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্ব আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্ম একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সূচনার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। ছাত্র-সংসদগুলো এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এই নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, ক্যাম্পাসের উন্নয়ন এবং সার্বিকভাবে দেশ পরিচালনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে, ছাত্র-সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক অনিয়ম, প্রশাসনের পক্ষপাত, ফল প্রকাশে বিলম্ব ইত্যাদি অভিযোগও রয়েছে, যা সুষ্ঠু নেতৃত্ব বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এই বাধাগুলো অতিক্রম করে যদি একটি সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব উঠে আসে, তবে তাঁরা দেশ ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি আমূল পরিবর্তন। প্রথমেই শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিকতা ও পেশাদারত্বের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। তাঁদের বুঝতে হবে যে, তাঁরা কেবল জ্ঞান বিতরণের বাহক নন, বরং তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। তাঁদের উচিত শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন করার স্পৃহা জাগানো, তাঁদের ভিন্নমতকে সম্মান করা এবং তাঁদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বিকাশে সহায়তা করা। ‘হীরক রাজার দেশে’র শিক্ষকের আদলে নয়, বরং তারা হবেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।
আর শিক্ষার্থীদেরও এই পরিবর্তনের অংশ হতে হবে। তাঁদের প্রশ্ন করতে পারতে হবে। নিজের উদ্দেশ্যে, শিক্ষকের ও শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। মনে রাখতে হবে, প্রশ্ন না করলে নতুন জ্ঞানের জন্ম হয় না। কোপার্নিকাস বা গ্যালিলিউ প্রশ্ন না করলে জগত আজ এখানে আসত না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি ডিগ্রি অর্জনের প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি আত্ম-আবিষ্কার ও সমাজ পরিবর্তনের একটি কেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সম্মান করে সমালোচনা করার সাহস অর্জন করা।
সর্বোপরি, এই ‘খোঁয়াড়’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষকদের তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাঁদের মেধার সঠিক বিকাশ ঘটাতে এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার চর্চা করতে হবে। প্রশাসনকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে একটি আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই হয়তো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে।
আওয়ামী লীগের রুদ্ধ শাসনামলে দেশের ভেতর কথা বলা যেত না, রাজনীতি করা যেত না বলেই বিদেশে বসে বা বিদেশে গিয়ে অ্যাক্টিভিজম হয়েছে, রাজনীতি হয়েছে, কূটনীতি হয়েছে, এমনকি সাংবাদিকতা হয়েছে। শেখ হাসিনা বিদেশে সফরে গেলে বিশেষত লন্ডন ও নিউইয়র্কে বিএনপিপন্থী প্রবাসীরা প্রতিবাদ জানাতেন।
২ ঘণ্টা আগেকীভাবে সমাজ এক ধাপে ধাপে এমন সংকটে পৌঁছায়, যেখানে আর পুরনো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আমেরিকা কি এখন সেই ধরনের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে? আমেরিকার কি তার শক্তির শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত পেরিয়ে গেছে? সে এখনো বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে চিরকাল এই অবস্থায় থাকব। ইতিহাসের প্রতিটি সা
১ দিন আগেবাংলাদেশে বইমেলা নিছক কোনো বাণিজ্যিক আয়োজন নয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা জাতির রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা এক ঐতিহাসিক উৎসব। একে ঘিরেই লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলন ঘটে, নতুন চিন্তার সঞ্চার হয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
১ দিন আগেআনু মুহাম্মদ অর্থনীতির মৌলিক বিষয় ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে আসছেন, এখনো করছেন। একজন সংগঠক হিসাবে সর্বজনের জন্য রাজনীতিকে গতি দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠের আইকন।
২ দিন আগে