leadT1ad

সমতল থেকে পাহাড়, বেড়েছে ধর্ষণ, কমবে কবে

সমতল থেকে পাহাড়, বেড়েছে ধর্ষণ, কমবে কবে। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত জুলাই মাসে (৪ জুলাই ২০২৫) বিবিসির একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রের ভূমিকা’। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে পাওয়া যাচ্ছে, ধর্ষণ ও নিপীড়নের খবর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতি মাসের তথ্যে নিপীড়ন ও নিগ্রহের বহুমাত্রিক ছবি পাওয়া যায়, যা ভীতিকর। ধর্ষণ বেড়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও। কিছুদিন পরপরই গণমাধ্যমে উঠে আসছে বিভীষিকাময় সব ধর্ষণের সংবাদ। সমতল থেকে পাহাড় -- সবখানে ধেয়ে আসছে ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতার করাল থাবা।

২০১৮ সালে ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির বিলাইছড়িতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন দুই মারমা তরুণী। এ বছর ১৮ জুলাই বিবিসি বাংলা ছেপেছিল ‘দলবদ্ধ ধর্ষণে’র একটি বিশ্লেষণী সংবাদ। বিডিনিউজের প্রতিবেদনমতে, ২৭ জুন আর ১৮ সেপ্টেম্বরে ঘটেছে ধর্ষণ। এ বছরের ২৫ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত রাঙামাটির কাউখালীতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক মারমা নারী। ‘এখন টিভি’র সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষক নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের একজন নেতা।

ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, কোনো-না-কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত থাকে ‘ক্ষমতায়িত’ ব্যক্তি; থাকে জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধিত্বকারী কেউ। তাদের দাপটের উৎসে থাকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা।

এ মাসের ২৪ সেপ্টেম্বর আবারও জানা গেল ধর্ষণ ঘটেছে। এবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক পাহাড়ি কিশোরী। প্রাইভেট পড়ে বাড়িতে ফিরছিল মেয়েটি। তাকে উদ্ধার করা হয়েছে রাস্তার পাশের একটি খেত থেকে। এই বীভৎসতা নতুন নয়। পার্বত্য জনপদের জন্য এই নির্মমতা প্রকৃতপক্ষে বেশ পুরোনো প্রতিচ্ছবি।

সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’, দিয়েছে আধা বেলা সড়ক অবরোধের কর্মসূচি। গতকাল বৃহস্পতিবার তা পালিতও হয়েছে। রাস্তার দুপাশে আটকা পড়েছে মানুষ। একটি পত্রিকায় বিশেষভাবে ছাপা হয়েছে সাজেকগামী পর্যটকদের আটকে পড়ার খবর। ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তাঁরা। পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হয়েছে পর্যটকবাহী বাস।

সংবাদগুলো পড়তে পড়তে ভাবছি, পাহাড়, পাহাড়ি জনপদ আর সেসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে দেখি? নিবিড়ভাবে কখনো কি পাহাড়ের দিকে তাকাই?

আমাদের কাছে পাহাড় হলো ‘এক্সোটিক জোন’ -- ‘থ্রিল’ আর ‘চিল’ করার জায়গা। গেলাম, দেখলাম, উপভোগ করলাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেলফিসমেত সবুজাভ ছবি দিলাম – বাস্, হয়ে গেলো। সত্যিই যদি মমত্বের চোখ দিয়ে তাকাতাম, তাহলে আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ত অদেখা আখ্যান; বুঝতে পারতাম, ওই সম্মোহনী সৌন্দর্যের নিচে চাপা পড়ে আছে লাখো পাহাড়ির অশ্রু। স্মৃতি থেকে ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে আমরা ঠিকঠাক মনে করতে পারতাম কল্পনা চাকমার মুখ।

প্রতিবাদ সমাবেশে বলা বক্তাদের এই উচ্চারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেশ কিছু অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে; প্রথমত, অভ্যুত্থান-উত্তর প্রেক্ষাপটেও ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’র কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটে নি; দ্বিতীয়ত, অনগ্রসর ও প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ায় এসব অঞ্চলে এই সংস্কৃতি আরও প্রবল হয়ে উঠেছে; তৃতীয়ত, শান্তিচুক্তি, বহুত্ববাদ ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ইত্যাদির মতো রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি অঞ্চলে বৈষম্য ও নিপীড়ন কমে নি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন। রাঙামাটির বাড়ি থেকে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন কল্পনা চাকমা। তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিরিশটি বছর। আজও নিখোঁজ তিনি। কে জানে, কোন অতলে হারিয়ে গেছেন তিনি!

পাহাড় থেকে যখন কারো ধর্ষণের শিকার হওয়া কিংবা নিখোঁজের খবর আসে, তখন কল্পনা চাকমাকে মনে পড়ে। তাঁর লেখা ডায়েরির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি নারীর মুক্তির বার্তা। কল্পনা লিখেছিলেন, ‘নারী কোন পণ্য সামগ্রী নয়, কারোর ভোগের জিনিস নয়, কারোর ব্যবহারের জিনিস নয়, কারো খেলার পুতুল নয়। কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রও নয়, নারীও একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা থাকতে হবে। আমরা এইসব নিপীড়ন নির্যাতন আর নীরবে সহ্য করবো না। এইসব ধর্ষণ, হত্যা, শ্লীলতাহানি, এই নির্মম অবমাননা আর নীরবে হজম করতে দেয়া হবে না। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবোই দাঁড়াবো।’

শুধু ডায়েরির নির্জন পাতায় নয়, কল্পনা এরকম কথা বলেছেন সোচ্চার মিছিলে, জন-সমাবেশে। নির্মম সত্য এই যে কল্পনা চাকমা স্বয়ং হারিয়ে গেছেন। নারীর পণ্যায়ন কমে নি, কমে নি ধর্ষণ, হত্যা অথবা শ্লীলতাহানি। এখনও গভীর ঘন হয়ে ঝরে পড়ে পাহাড়ের কান্না। কেননা কল্পনার মতো সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা যখন চিরকালের জন্য লুপ্ত হয়ে যেতে পারেন, তখন পাহাড়ের যেকোনো নারীই হতে পারেন যৌনসহিংসতার শিকার। পাহাড়ি জনপদে অব্যাহত নিপীড়ন ও ধর্ষণ যেন সেই সত্যকেই হাজির করে।

পাহাড়ি জনপদের মানুষকে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের অংশীজন হিসেবে ভাবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধানে তাদের অস্তিত্বকে মেনে নিতে হবে, নাগরিক হিসেবে তাদের মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে।

ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, কোনো-না-কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত থাকে ‘ক্ষমতায়িত’ ব্যক্তি; থাকে জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধিত্বকারী কেউ। তাদের দাপটের উৎসে থাকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা। আর তাই জুলাই মাসে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনায় পাওয়া গিয়েছিল ‘বিএনপির রাজনীতি’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, যদিও বিএনপি এর দায় স্বীকার করে নি। পাহাড়ি-বাঙালি বাইনারির বাইরে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে জড়িয়ে আছে ধর্ষকের ‘পুরুষ’ পরিচয়। পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে পঞ্চান্ন বছরের এক পুরুষ। ২০২৩ সালে এক বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করেছে রোহিঙ্গা যুবক। তিন বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে তার দাদা।

ভুক্তভোগীরা বারবারই বিচারহীনতার কথা বলেছেন। জুলাই মাসে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের এক নেতা বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমাদের মা-বোনেরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু কোনো শাস্তি দেখতে পাচ্ছি না। গ্রেফতার করা হয়, দুইদিন জেলে পাঠায়। এরপর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’।

২৪ সেপ্টেম্বরেও শোনা গেল একই রকম অভিযোগমাখা দীর্ঘশ্বাস, ‘পাহাড়ে কোনো নারী নিরাপদ নয়। এখানে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। কোনো বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা এ ধরনের কাজ করেই যাচ্ছে।’ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এক নেতা বলেছেন, ‘পাহাড়ে একের পর এক ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা যেন একটা রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। ধর্ষক ধর্ষণ করে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো ধর্ষণ, হত্যা, গুমের ঘটনা ঘটেছে; তার আজ পর্যন্ত একটারও সঠিক বিচার হয়নি। এ দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে।’ ধর্ষণ-নিপীড়ন প্রসঙ্গে ‘রুটিন ওয়ার্ক’ শব্দবন্ধই বলে দেয় কতোটা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে ধর্ষণ এবং বিভিন্ন মাত্রার যৌন-সহিংসতা।

প্রতিবাদ সমাবেশে বলা বক্তাদের এই উচ্চারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেশ কিছু অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে; প্রথমত, অভ্যুত্থান-উত্তর প্রেক্ষাপটেও ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’র কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটে নি; দ্বিতীয়ত, অনগ্রসর ও প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ায় এসব অঞ্চলে এই সংস্কৃতি আরও প্রবল হয়ে উঠেছে; তৃতীয়ত, শান্তিচুক্তি, বহুত্ববাদ ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ইত্যাদির মতো রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি অঞ্চলে বৈষম্য ও নিপীড়ন কমে নি। একের পর এক ধর্ষণ যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক বাস্তবতার এক প্রতীকী প্রতিচ্ছবি। তাহলে পাহাড়ের জন্য ধর্ষণ কি একটি নির্মম নিয়তি হিসেবেই টিকে থাকবে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আশাবাদের গল্প শোনানো খুব কঠিন। কারণ ২৪-এর অভ্যুত্থান-উত্তর পরিপ্রেক্ষিতে চাইলেই হতাশাকে আশাবাদে রূপান্তরিত করা যাচ্ছে না। সারা দেশে নারীনিগ্রহ বেড়েছে। পার্বত্য অঞ্চল তার ব্যতিক্রম নয়।

তবু কিছু ভাবনার জায়গা আছে বলে মনে করি। যেমন বিগত এক বছর ধরে ‘ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের’-এর কথা বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে সর্বজনের অংশগ্রহণের কথা। পাহাড়ি জনপদের মানুষকে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের অংশীজন হিসেবে ভাবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধানে তাদের অস্তিত্বকে মেনে নিতে হবে, নাগরিক হিসেবে তাদের মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে। নয়তো ভিন জাতি, ভিন ভাষা, ভিন সংস্কৃতির মানুষ ধর্ষণযোগ্য বলেই বিবেচিত হতে থাকবে।

সত্যিকার অর্থে, পাহাড়ে ধর্ষণ কখনোই কমবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাহাড়ি জনপদের মানুষকে আমরা অপরায়ণ প্রক্রিয়ার একমুখী চশমা দিয়ে দেখা থেকে বিরত হবো। বিশেষভাবে শুধু পাহাড় নয়, সারা বাংলাদেশেই ধর্ষণ কমবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নারী ও শিশুবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক; কবি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত