কাইল জে. অ্যান্ডারসন
‘কোনো মৃত্যুকর নেই, কোনো সম্পত্তিকর নেই। ব্যাংকে গিয়ে আর কখনো ভালো কিংবা কোনো শাইলক ও খারাপ ব্যাংকারের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে না।’ এই কথাগুলো চলতি বছরের জুলাইয়ে আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ডেস মইনে এক সমাবেশে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সদ্য পাস হওয়া কর-ব্যয় বিলের সুবিধার কথা বলতে গিয়ে এই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি। ‘শাইলক’ হলো উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের ইহুদি সুদখোর চরিত্র। এটি দীর্ঘদিন ধরে ইহুদিবিদ্বেষী প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ এই মন্তব্যের নিন্দা জানায়। তবে ট্রাম্প দাবি করেন, শব্দটির ইহুদিবিদ্বেষী অর্থ তিনি জানতেন না।
এই ‘না জানার’ বিষয়টিকে ভুল হিসেবে ধরা যেতে পারত। কিন্তু ট্রাম্পের এই মন্তব্য আসলে একটি বড় প্রবণতার অংশ। তাঁর ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) আন্দোলনের সঙ্গে ইহুদিবিদ্বেষের সম্পর্ক রয়েছে। এ বছরের মে মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইহুদিবিদ্বেষী চরমপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে এমন তিনজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। এদের একজনকে ফেডারেল প্রসিকিউটররা ‘নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে দাবি করেছিলেন। আরেকজন ছিলেন হলোকাস্ট অস্বীকারকারী।
সম্প্রতি এআই চ্যাটবট ‘গ্রক’ হিটলারকে প্রশংসা করে ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ায় ট্রাম্পের সাবেক মিত্র ইলন মাস্কও আবার সমালোচনার মুখে পড়েন।
ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই সোজাসাপ্টা ইসরায়েল-সমর্থক। তাই স্পষ্টতই এত সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলা করা। গত ২৯ জানুয়ারি ‘ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা’ নির্বাহী আদেশে সই করেন ট্রাম্প। আদেশটি ব্যবহার করে তাঁর প্রশাসন মাহমুদ খালিলের মতো ফিলিস্তিন-সমর্থক ছাত্র আন্দোলনকারীদের বহিষ্কারের অজুহাত দাঁড় করায়।
এর এক মাস আগেই, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইরানে বোমা বর্ষণ করার পর ট্রাম্পের নির্দেশে একই জায়গাতে বোমা বর্ষণ করে। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান আলোচনা থেকেও সরে দাঁড়ান ট্রাম্প।
অদ্ভুত জোট
তাহলে মাগা আন্দোলনের এই প্রকাশ্য ইহুদিবিদ্বেষ ও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের জোটকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? পরস্পরবিরোধী এই অবস্থানকে কীভাবে ব্যখ্যা করা যায়। অনেক বিশ্লেষক এর পেছনে দুটি প্রধান কারণকে উল্লেখ করেন। প্রথমত, আমেরিকায় ইসরায়েলপন্থী লবিং গ্রুপ, অর্থদাতা, গণমাধ্যমকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের শক্তি ও প্রভাব।
দ্বিতীয়ত, মাগা আন্দোলনের ভেতরে খ্রিস্টান জায়নবাদিদের ভূমিকা। এর মধ্যে আছেন বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি। হাকাবি স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর ইসরায়েল সমর্থনের মূল কারণ হলো বিশ্বাস। খুব শিগগির ‘ র্যাপচার’ বা মহাপ্রলয় আসছে ও ইসরায়েল হবে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের কেন্দ্রস্থল।
তবে এসব কারণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও ট্রাম্পযুগের আমেরিকান ডানপন্থী রাজনীতির ইসরায়েলের প্রতি এত গভীর টান সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
আমি মনে করি, এর পেছনে শুধু ধর্মতত্ত্ব বা লবিংয়ের প্রভাব নয়, ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে জড়িত মৌলিক একটি প্রেরণাও কাজ করছে। এই প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার চলমান প্রকল্প।
এর মধ্যে আছে ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে পাঠদান বা আলোচনা দমন, ঔপনিবেশিক অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে দুর্বল করার উদ্যোগ ও সক্রিয় বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই।
মাগা-ইসরায়েল জোট আসলে ঔপনিবেশিকতার নৃশংসতার স্মৃতি চাপা দিতে চায়, ইতিহাসকে পরিশোধিত আকারে হাজির করে বর্তমানেই ঔপনিবেশিকতাকে পুনর্জীবিত করতে চায়।
মাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসে ইসরায়েল হলো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার টিকে থাকা শেষ প্রতীক। আর ফিলিস্তিন হলো ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামের শেষ অসমাপ্ত অধ্যায়। ইসরায়েলকে সমর্থন করা শুধু মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ বিষয় নয়, বরং ইতিহাস, পরিচয় ও উপনিবেশ স্থাপনের বৈধতা নিয়ে চলমান সংস্কৃতির যুদ্ধে এক প্রক্সি লড়াই।
অতীতে শ্বেতাঙ্গ, পাশ্চাত্য, খ্রিস্টান সভ্যতার বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল এমন নস্টালজিয়া জাগিয়ে তুলেছে মাগা আন্দোলন। বিশ্লেষকেরা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ নিয়ে এই নস্টালজিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫০-এর দশকে ফিরে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বলে ব্যাখ্যা করেন। ওই সময়কে বলা হতো ‘আমেরিকান শতাব্দীর’ শুরু।
কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই নস্টালজিয়াকে বরং ইউরোপ-আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস হিসেবে দেখা যায়।
ঔপনিবেশিক ভূমি দখল
কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূখণ্ড করার সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। এর পরপরই ট্রাম্প ওভাল অফিসে জেমস কে পোলকের একটি প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে দেন। এটাকে কোনো কাকতালীয় ঘটনা ভাবার সুযোগ নেই।
১৮৪৫–৪৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেমস কে পোলক। তাঁর আমলেই মেক্সিকো যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভূমি দখল করে। মাগা আন্দোলনের দৃষ্টিতে এই ঔপনিবেশিক ভূমি দখলের যুগেই বিশ্বে শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসা অ্যাংলো–আমেরিকান শক্তির উত্থান ঘটে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে বিশাল বিউপনিবেশায়ন আন্দোলন সেই পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে ঝামেলায় ফেলে।
জাতিসংঘে সব রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতার নীতি সনদ প্রণীত হয় ওই সময়েই। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি ও উপনিবেশের মতো শোষণমূলক ও অসম সম্পর্কগুলো ভেঙে ফেলার ভিত্তি তৈরি হয়। সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করে অন্য কোনো ভূখণ্ড দখল করতে পারবে না।
আমেরিকার মধ্যাঞ্চল আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে মোহগ্রস্ত। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও তা স্পষ্ট। ২০১৬ সালে করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, হিস্ট্রি চ্যানেলের সামরিক ইতিহাসভিত্তিক অনুষ্ঠানের ৭০ শতাংশই শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে।
ইসরায়েলের ভূমিকা
এই গল্পে ইসরায়েলের ভূমিকা তার ভূখণ্ডের আকারের ঠিক বিপরীত। একদিকে, হলোকাস্ট-পরবর্তী সময়ে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমা শক্তিগুলো নিজেদের ন্যায়পরায়ণ বলে দাবি করার সুযোগ হয়েছে। অথচ এদের অনেকেই ওই সময়ে ইহুদি হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা কিংবা মৌন সমর্থন করেছিল। এই রাষ্ট্র যেন পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ইহুদিবিদ্বেষের কলঙ্ক থেকে হাত ধোয়ার সুযোগ দিয়েছে।
পশ্চিামারা ইহুদিনিধনকে অপরাধ হিসেবে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। যার মাধ্যমে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলোর করা অসংখ্য ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ থেকে মনোযোগ সরে যায়। শুধু কঙ্গো ফ্রি স্টেটেই রাজা লিওপোল্ডের জোরপূর্বক শ্রমনীতির কারণে ১ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়।
এই অপরাধগুলোর ক্ষতিপূরণ দিতে হলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠন প্রয়োজন হতো। কিন্তু পশ্চিমারা তার মুখোমুখি হতে চায়নি। এর বদলে তারা পুরো দুনিয়ার মনোযোগ আটকে দিয়েছে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ছোট্ট এক ভূখণ্ডের একটিমাত্র ঘটনার ওপর।
বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়নি এমন একমাত্র উপনিবেশ হল ফিলিস্তিন। উপনিবেশবাদ এখন আর সভ্যতার মিশন নয়, বরং অপরাধ। তাই ইসরায়েল আধুনিক বিশ্বের নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে খাপ খায় না।
ইসরায়েল উনিশ শতকীয় ধাঁচের ঔপনিবেশিকতার শেষ দুর্গ। এ কারণেই মাগা মতাদর্শী ও দুনিয়াজোড়া তাদের সহযোগীরা ইসরায়েলকে সমর্থন করে।
(মিডিল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত। সানি ওল্ড ওয়েস্টবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শনের অধ্যাপক কাইল জে. অ্যান্ডারসনের মতামত অবলম্বনে ভাবানুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)
‘কোনো মৃত্যুকর নেই, কোনো সম্পত্তিকর নেই। ব্যাংকে গিয়ে আর কখনো ভালো কিংবা কোনো শাইলক ও খারাপ ব্যাংকারের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে না।’ এই কথাগুলো চলতি বছরের জুলাইয়ে আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ডেস মইনে এক সমাবেশে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সদ্য পাস হওয়া কর-ব্যয় বিলের সুবিধার কথা বলতে গিয়ে এই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি। ‘শাইলক’ হলো উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের ইহুদি সুদখোর চরিত্র। এটি দীর্ঘদিন ধরে ইহুদিবিদ্বেষী প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ এই মন্তব্যের নিন্দা জানায়। তবে ট্রাম্প দাবি করেন, শব্দটির ইহুদিবিদ্বেষী অর্থ তিনি জানতেন না।
এই ‘না জানার’ বিষয়টিকে ভুল হিসেবে ধরা যেতে পারত। কিন্তু ট্রাম্পের এই মন্তব্য আসলে একটি বড় প্রবণতার অংশ। তাঁর ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) আন্দোলনের সঙ্গে ইহুদিবিদ্বেষের সম্পর্ক রয়েছে। এ বছরের মে মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইহুদিবিদ্বেষী চরমপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে এমন তিনজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। এদের একজনকে ফেডারেল প্রসিকিউটররা ‘নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে দাবি করেছিলেন। আরেকজন ছিলেন হলোকাস্ট অস্বীকারকারী।
সম্প্রতি এআই চ্যাটবট ‘গ্রক’ হিটলারকে প্রশংসা করে ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ায় ট্রাম্পের সাবেক মিত্র ইলন মাস্কও আবার সমালোচনার মুখে পড়েন।
ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই সোজাসাপ্টা ইসরায়েল-সমর্থক। তাই স্পষ্টতই এত সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলা করা। গত ২৯ জানুয়ারি ‘ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা’ নির্বাহী আদেশে সই করেন ট্রাম্প। আদেশটি ব্যবহার করে তাঁর প্রশাসন মাহমুদ খালিলের মতো ফিলিস্তিন-সমর্থক ছাত্র আন্দোলনকারীদের বহিষ্কারের অজুহাত দাঁড় করায়।
এর এক মাস আগেই, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইরানে বোমা বর্ষণ করার পর ট্রাম্পের নির্দেশে একই জায়গাতে বোমা বর্ষণ করে। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান আলোচনা থেকেও সরে দাঁড়ান ট্রাম্প।
অদ্ভুত জোট
তাহলে মাগা আন্দোলনের এই প্রকাশ্য ইহুদিবিদ্বেষ ও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের জোটকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? পরস্পরবিরোধী এই অবস্থানকে কীভাবে ব্যখ্যা করা যায়। অনেক বিশ্লেষক এর পেছনে দুটি প্রধান কারণকে উল্লেখ করেন। প্রথমত, আমেরিকায় ইসরায়েলপন্থী লবিং গ্রুপ, অর্থদাতা, গণমাধ্যমকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের শক্তি ও প্রভাব।
দ্বিতীয়ত, মাগা আন্দোলনের ভেতরে খ্রিস্টান জায়নবাদিদের ভূমিকা। এর মধ্যে আছেন বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি। হাকাবি স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর ইসরায়েল সমর্থনের মূল কারণ হলো বিশ্বাস। খুব শিগগির ‘ র্যাপচার’ বা মহাপ্রলয় আসছে ও ইসরায়েল হবে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের কেন্দ্রস্থল।
তবে এসব কারণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও ট্রাম্পযুগের আমেরিকান ডানপন্থী রাজনীতির ইসরায়েলের প্রতি এত গভীর টান সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
আমি মনে করি, এর পেছনে শুধু ধর্মতত্ত্ব বা লবিংয়ের প্রভাব নয়, ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে জড়িত মৌলিক একটি প্রেরণাও কাজ করছে। এই প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার চলমান প্রকল্প।
এর মধ্যে আছে ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে পাঠদান বা আলোচনা দমন, ঔপনিবেশিক অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে দুর্বল করার উদ্যোগ ও সক্রিয় বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই।
মাগা-ইসরায়েল জোট আসলে ঔপনিবেশিকতার নৃশংসতার স্মৃতি চাপা দিতে চায়, ইতিহাসকে পরিশোধিত আকারে হাজির করে বর্তমানেই ঔপনিবেশিকতাকে পুনর্জীবিত করতে চায়।
মাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসে ইসরায়েল হলো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার টিকে থাকা শেষ প্রতীক। আর ফিলিস্তিন হলো ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামের শেষ অসমাপ্ত অধ্যায়। ইসরায়েলকে সমর্থন করা শুধু মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ বিষয় নয়, বরং ইতিহাস, পরিচয় ও উপনিবেশ স্থাপনের বৈধতা নিয়ে চলমান সংস্কৃতির যুদ্ধে এক প্রক্সি লড়াই।
অতীতে শ্বেতাঙ্গ, পাশ্চাত্য, খ্রিস্টান সভ্যতার বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল এমন নস্টালজিয়া জাগিয়ে তুলেছে মাগা আন্দোলন। বিশ্লেষকেরা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ নিয়ে এই নস্টালজিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫০-এর দশকে ফিরে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বলে ব্যাখ্যা করেন। ওই সময়কে বলা হতো ‘আমেরিকান শতাব্দীর’ শুরু।
কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই নস্টালজিয়াকে বরং ইউরোপ-আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস হিসেবে দেখা যায়।
ঔপনিবেশিক ভূমি দখল
কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূখণ্ড করার সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। এর পরপরই ট্রাম্প ওভাল অফিসে জেমস কে পোলকের একটি প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে দেন। এটাকে কোনো কাকতালীয় ঘটনা ভাবার সুযোগ নেই।
১৮৪৫–৪৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেমস কে পোলক। তাঁর আমলেই মেক্সিকো যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভূমি দখল করে। মাগা আন্দোলনের দৃষ্টিতে এই ঔপনিবেশিক ভূমি দখলের যুগেই বিশ্বে শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসা অ্যাংলো–আমেরিকান শক্তির উত্থান ঘটে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে বিশাল বিউপনিবেশায়ন আন্দোলন সেই পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে ঝামেলায় ফেলে।
জাতিসংঘে সব রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতার নীতি সনদ প্রণীত হয় ওই সময়েই। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি ও উপনিবেশের মতো শোষণমূলক ও অসম সম্পর্কগুলো ভেঙে ফেলার ভিত্তি তৈরি হয়। সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করে অন্য কোনো ভূখণ্ড দখল করতে পারবে না।
আমেরিকার মধ্যাঞ্চল আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে মোহগ্রস্ত। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও তা স্পষ্ট। ২০১৬ সালে করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, হিস্ট্রি চ্যানেলের সামরিক ইতিহাসভিত্তিক অনুষ্ঠানের ৭০ শতাংশই শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে।
ইসরায়েলের ভূমিকা
এই গল্পে ইসরায়েলের ভূমিকা তার ভূখণ্ডের আকারের ঠিক বিপরীত। একদিকে, হলোকাস্ট-পরবর্তী সময়ে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমা শক্তিগুলো নিজেদের ন্যায়পরায়ণ বলে দাবি করার সুযোগ হয়েছে। অথচ এদের অনেকেই ওই সময়ে ইহুদি হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা কিংবা মৌন সমর্থন করেছিল। এই রাষ্ট্র যেন পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ইহুদিবিদ্বেষের কলঙ্ক থেকে হাত ধোয়ার সুযোগ দিয়েছে।
পশ্চিামারা ইহুদিনিধনকে অপরাধ হিসেবে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। যার মাধ্যমে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলোর করা অসংখ্য ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ থেকে মনোযোগ সরে যায়। শুধু কঙ্গো ফ্রি স্টেটেই রাজা লিওপোল্ডের জোরপূর্বক শ্রমনীতির কারণে ১ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়।
এই অপরাধগুলোর ক্ষতিপূরণ দিতে হলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠন প্রয়োজন হতো। কিন্তু পশ্চিমারা তার মুখোমুখি হতে চায়নি। এর বদলে তারা পুরো দুনিয়ার মনোযোগ আটকে দিয়েছে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ছোট্ট এক ভূখণ্ডের একটিমাত্র ঘটনার ওপর।
বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়নি এমন একমাত্র উপনিবেশ হল ফিলিস্তিন। উপনিবেশবাদ এখন আর সভ্যতার মিশন নয়, বরং অপরাধ। তাই ইসরায়েল আধুনিক বিশ্বের নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে খাপ খায় না।
ইসরায়েল উনিশ শতকীয় ধাঁচের ঔপনিবেশিকতার শেষ দুর্গ। এ কারণেই মাগা মতাদর্শী ও দুনিয়াজোড়া তাদের সহযোগীরা ইসরায়েলকে সমর্থন করে।
(মিডিল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত। সানি ওল্ড ওয়েস্টবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শনের অধ্যাপক কাইল জে. অ্যান্ডারসনের মতামত অবলম্বনে ভাবানুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)
এক বছর আগে, এই মাসেই, বাংলাদেশের সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাজারো শিক্ষার্থী অসংখ্য সাধারণ মানুষের সমর্থনে আমাদের জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্মম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল। অবশেষে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা ৫ আগস্ট এক স্বৈরাচারীকে দেশত্যাগ
১ দিন আগেযেকোনো মুহূর্তে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক ‘উচ্ছেদের নির্দেশ’ আসার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। আমার প্রিয় শহর গাজা ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি সামরিক দখলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরিকল্পনা হলো আমাদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উচ্ছেদ করে সবাইকে দক্ষিণ গাজায় তাঁবুর নিচে নিয়ে যাওয়া।
২ দিন আগেরাশিয়া যুদ্ধবিরতির কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আরও গুরুতর হলো— ইউরোপকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর যুদ্ধ শেষ করার জন্য কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি।
৪ দিন আগেশামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, জাতীয়তাবাদ, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতার প্রশ্নে আমাদের শহরের কবিদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ভেদরেখা আছে।
৫ দিন আগে