সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ বা আন্দোলনে অর্থ সহযোগিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা বেড়েছে।
জাভেদ হুসেন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ বা আন্দোলনে অর্থ সহযোগিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা বেড়েছে। কোথাও প্রশংসা, আবার কোথাও সন্দেহ। অনেকের চোখে আন্দোলন মানে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিবেক আর ক্ষোভের প্রকাশ। কিন্তু বাস্তবে বড় বড় আন্দোলনের পেছনে থাকে আরেকটি দিক—সংগঠন গড়া, স্বেচ্ছাসেবক জোগাড়, লজিস্টিক সামলানো, আন্তর্জাতিক প্রচার চালানো—এসব কিছুতেই টাকার প্রয়োজন হয়। তাই পেইড অ্যাক্টিভিজম বা আন্দোলনের অর্থনৈতিক সহায়তা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। আর যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় জর্জ সোরোসের মতো আলোচিত দাতা কিংবা গাজা ফ্লোটিলার মতো বিশ্বমানবিক প্রচেষ্টা, তখন বিতর্ক আরও জোরালো হয়।
পেইড অ্যাক্টিভিজমের উত্থান
পেইড অ্যাক্টিভিজম একেবারেই নতুন নয়। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপ আর আমেরিকার দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ধনী দাতাদের টাকা। বিশ শতকের গোড়ার দিকের শ্রমিক আন্দোলন বা সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও সংগঠকদের ভাতা দিত, যাতে তাঁরা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে পারে। ১৯৬০-এর দশকের মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনও নানা ফাউন্ডেশনের অনুদান পেতো—ভোটার রেজিস্ট্রেশন, আইনি সহায়তা, শান্তিপূর্ণ মিছিল এগুলো চালানোর জন্য। এসব অর্থ না থাকলে কেবল স্বেচ্ছাশ্রমে এত বড় আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল।
আজকের পেইড অ্যাক্টিভিজম আরও জটিল ও আন্তর্জাতিক। এখন আন্দোলন মানে এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রচার, পেশাদার সমন্বয়, মিডিয়া ক্যাম্পেইন, আইনি সহায়তা। গরিব বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে যখন নিজস্ব সম্পদ নেই, তখন দাতাদের অর্থে তাদের কণ্ঠ তুলে ধরা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
সমালোচকরা অবশ্য বলেন, টাকার দৌলতে আন্দোলনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে, দাতারা এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে পারেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বেশি টাকাওয়ালা আন্দোলন কি আর ‘আসল’ থাকে? আবার সমর্থকেরা বলেন, পেইড অ্যাক্টিভিজম আসলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকে গণতান্ত্রিক করে তোলে—যাঁরা অর্থের অভাবে লড়াইয়ে থাকতে পারতেন না, তাঁরাও সুযোগ পান। অর্থ সাহসকে প্রতিস্থাপন করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে তোলে।
জর্জ সোরোস: অর্থ আর সমাজসেবা
গত কয়েক দশকের পেইড অ্যাক্টিভিজম নিয়ে আলোচনা জর্জ সোরোস ছাড়া অসম্পূর্ণ। হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান বিনিয়োগকারী ও দাতা নিজের ভাগ্য গড়েছেন অর্থবাজারে। ১৯৭৩ সালে তিনি গড়েন কোয়ান্টাম ফান্ড। ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ মুদ্রায় এক সাহসী লেনদেনে একদিনেই বিলিয়ন খানেক ডলার মুনাফা করে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পান। পরের কয়েক দশকে মুদ্রা, শেয়ার, বন্ড আর পণ্যে বিনিয়োগ করে তিনি হয়ে ওঠেন বিশাল ধনী।
কিন্তু শুধু অর্থ জমিয়ে রাখেননি। ১৯৭৯ সালে তিনি গড়েন ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনস (ওএসএফ)। এই নেটওয়ার্ক মানবাধিকার, শিক্ষা, গণতন্ত্র আর সিভিল সোসাইটি নিয়ে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, আন্দোলন—বিশ্বজুড়ে বহু জায়গায় অনুদান দিয়েছে ওএসএফ। সোরোস ইতিমধ্যেই কয়েক দশকে কয়েক দশক বিলিয়ন ডলার দান করেছেন। এই অর্থ পুরোপুরি এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে, সরকারি খাত থেকে নয়। সমালোচকরা বলেন, সোরোস এসব অনুদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। সমর্থকেরা বলেন, তিনি অবহেলিত মানুষকে কণ্ঠ দেন, এমন জায়গায় অর্থ ঢালেন যেটি অন্যথায় অবহেলায় পড়ে থাকত।
পেইড অ্যাক্টিভিজম আর সোরোস বিতর্ক
‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ শব্দবন্ধটি অনেক সময় জর্জ সোরোসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টার প্রসঙ্গে। নানা প্রতিবেদনে বলা হয়, সোরোসের প্রতিষ্ঠিত ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনস (ওএসএফ) অর্থ দিয়েছে টাইটস ফাউন্ডেশনকে। এই ফাউন্ডেশন আবার অনুদান দিয়েছে জিউইশ ভয়েস ফর পিস আর ইফনটনাও-এর মতো সংগঠনগুলোকে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ, অসহযোগ আন্দোলন আর ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে নানা কর্মসূচি করেছে। সমালোচকেরা দাবি করেন, এসব আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মীরা আসলে টাকা পান। আর এই কারণে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ শব্দটা ছড়িয়েছে।
তবে সোরোস আর তাঁর ফাউন্ডেশন বলেছে, তারা কখনও সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে মিছিল বা প্রতিবাদের জন্য টাকা দেয় না। ওএসএফ স্পষ্ট করে জানায়, তারা কেবল সংগঠনকে অনুদান দেয়, ব্যক্তিকে নয়। আর শর্ত থাকে—কাজ অবশ্যই শান্তিপূর্ণ, আইনের মধ্যে আর মানবাধিকারের ভিত্তিতে হতে হবে।
ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা পলিটিফ্যাক্টও বলেছে, ‘সোরোস টাকা দিয়ে মানুষকে মিছিলে নামায়’—এই দাবি বিভ্রান্তিকর। সংগঠনকে অনুদান দেওয়া মানে সরাসরি মানুষকে টাকা দেওয়া নয়। সোরোস নিজে বলেছেন, ‘দানশীলতায় সঠিক কাজটাই করা উচিত—তা সফল হোক বা না হোক।’ অর্থাৎ, তাঁর লক্ষ্য হলো বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন।
সোরোস কি ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে অর্থ দেন
এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই সন্দেহ, রাজনৈতিক প্রচারণা আর ভিন্ন ভিন্ন বয়ানের মধ্যে ঘেরা। যা স্পষ্ট, তা হলো—সোরোস তাঁর ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের মাধ্যমে এমন কিছু নেটওয়ার্ককে অর্থ জুগিয়েছেন, যারা ফিলিস্তিনপন্থী নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়। এর মধ্যে আছে জিউইশ ভয়েস ফর পিস, ইফনটনাউ, ইউ.এস. ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটস। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিপদে পড়াদের আইনি সহায়তা প্রকল্প যেমন আদালাহ সোরোসের সহায়তা পায়। অনেক ক্ষেত্রেই এই অর্থ গেছে পরোক্ষভাবে, যেমন টাইডস ফাউন্ডেশনের মতো মধ্যস্থ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।
সোরোসের সমর্থকদের মতে, এ সবই স্বাভাবিক দাতব্য কার্যক্রম। মানে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন, আইনি সহায়তা বা বৈষম্যবিরোধী প্রচারণায় সাহায্যের জন্য অনুদান। কিন্তু সমালোচকেরা একে দেখেন আরও হিসেবি কৌশল হিসেবে। তাঁদের মতে, সোরোস সরাসরি আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন, কেবল সমর্থন নয়; বরং অ্যাক্টিভিজমকে দক্ষভাবে তৈরি করে দেওয়া। এখানেই আসে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ বা টাকার বিনিময়ে তৈরি আন্দোলনের অভিযোগ।
বিশেষ করে ফিলিস্তিনি প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ক আরও তীব্র, কারণ সোরোস নিজে একজন ইহুদি। কারও কাছে তাঁর ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান এক রকম বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়। অন্যদের চোখে, এটাই তাঁর দাতব্য কাজের স্বরূপ। একদিকে তা ইহুদি পরিচয়ের ভেতরে ভাঙন তৈরি করছে, আবার অন্যদিকে ফিলিস্তিনি সমর্থনকে শক্তিশালী করছে। প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনগুলো বলে, এটা একেবারেই ন্যায্য অবস্থান। কিন্তু বিরোধীরা মনে করে, সোরোস তাঁর বিপুল সম্পদ ব্যবহার করে একপেশে মতামতকে শক্তিশালী করছেন।
আলোচনায় আরও আসে ২০১০ সালের গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা বা সাম্প্রতিক গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ২০২৫। গুজব ছিল, সোরোস এসব অভিযানে টাকা দিয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই যে সোরোস বা তাঁর সংগঠন সরাসরি জাহাজ বা মিশনকে অর্থায়ন করেছে। তবু গুজব থামেনি। কারণ, সোরোসের নামই এখন হয়ে গেছে বৈশ্বিক আন্দোলনে প্রভাবের প্রতীক। তাঁর দেওয়া টাকায় যেসব সংগঠন টিকে আছে, তারাই আবার এসব উদ্যোগকে নৈতিক বা লজিস্টিক সমর্থন দেয়। তাহলে কি সেটা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা নয়?—এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে বিষয়টা শুধু সোরোসকে ঘিরে নয়; বরং বড় প্রশ্ন হলো, টাকা কি আন্দোলনকে বিকৃত করে? সমালোচকেরা বলেন, কোনো আন্দোলন যখন সম্পূর্ণভাবে ফাউন্ডেশন বা কোটিপতি দাতাদের টাকায় নির্ভরশীল হয়, তখন তার স্বতঃস্ফূর্ততা আর তৃণমূলের চরিত্র হারিয়ে যায়। ওপর থেকে চাপানো কর্মসূচি নিচের মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে হাজির হয়। সমর্থকেরা পাল্টা বলেন, টাকা ছাড়া বঞ্চিত মানুষের আন্দোলন টিকবে কীভাবে? যদি অর্থ না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রচারণা, আইনি লড়াই, কিংবা গণমাধ্যমে শোনা—কোনোটাই সম্ভব নয়।
এই জায়গাতেই সোরোস হয়ে উঠেছেন আধুনিক যুগের এক প্রতীক, যাকে বলা যায় ‘ফিলানথ্রো-অ্যাক্টিভিজম’। সমালোচকেরা যাকে বলেন এক ধরনের অদৃশ্য রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ—অর্থ দিয়ে তিনি আন্দোলনের ভাষা ও দিকনির্দেশ ঠিক করে দেওয়া। সত্যিটা হয়তো এই দুয়ের মাঝখানেই কোথাও।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ২০২৫
পনেরো বছর আগে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটিকেই এগিয়ে নিতে ২০২৫ সালে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে নামল। ‘সুমুদ’ শব্দের মানে হলো অটল থাকা—যা ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের বিশ্বব্যাপী সমর্থকদের প্রতিরোধের প্রতীক। এই ফ্লোটিলায় অংশ নিলেন ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা—এমনকি বাংলাদেশ থেকেও কর্মীরা। তারা শুধু ত্রাণ নয়, সঙ্গে নিয়ে গেলেন বিশ্বসংহতির বার্তা।
কথা চালু আছে, সোরোস বা তাঁর ফাউন্ডেশন এই ফ্লোটিলার খরচ দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। জাহাজ বা পুরো অভিযানের সরাসরি অর্থায়নের তথ্যও মেলেনি। অংশগ্রহণকারীরা এসেছিলেন মানবিক বিবেচনায়, আগের প্রচেষ্টাগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। পথরোধ, আটক বা বিপদ যাই থাকুক, এই প্রতীকী যাত্রা আবার প্রমাণ করেছে—সাহস আর বিবেকই আসল চালিকা শক্তি। অর্থ থাকুক বা না থাকুক, আন্দোলনের প্রাণশক্তি সেখানেই।
সাহসের বিকল্প কী
১৯৪৭ সালের এক্সোডাস—যেখানে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন, ২০১০ সালের গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কিংবা ২০২৫ সালের গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা—ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, সাধারণ মানুষই রাজনৈতিক বাধার সামনে দাঁড়িয়ে সাহস আর নৈতিক শক্তির নজির তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত দানশীলতা হোক বা ফাউন্ডেশন, অর্থ অবশ্যই এই প্রচেষ্টাকে সহজ করেছে। কিন্তু সেটা কখনো মানুষের সাহসের জায়গা দখল করতে পারে না।
পেইড অ্যাক্টিভিজম তাই বিতর্কিত রয়ে যায়। এটা একদিকে আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আবার অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও স্বীকার করে। জর্জ সোরোস, ভালো বা মন্দ যাই হোক, এই বিতর্কের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ বা আন্দোলনে অর্থ সহযোগিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা বেড়েছে। কোথাও প্রশংসা, আবার কোথাও সন্দেহ। অনেকের চোখে আন্দোলন মানে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিবেক আর ক্ষোভের প্রকাশ। কিন্তু বাস্তবে বড় বড় আন্দোলনের পেছনে থাকে আরেকটি দিক—সংগঠন গড়া, স্বেচ্ছাসেবক জোগাড়, লজিস্টিক সামলানো, আন্তর্জাতিক প্রচার চালানো—এসব কিছুতেই টাকার প্রয়োজন হয়। তাই পেইড অ্যাক্টিভিজম বা আন্দোলনের অর্থনৈতিক সহায়তা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। আর যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় জর্জ সোরোসের মতো আলোচিত দাতা কিংবা গাজা ফ্লোটিলার মতো বিশ্বমানবিক প্রচেষ্টা, তখন বিতর্ক আরও জোরালো হয়।
পেইড অ্যাক্টিভিজমের উত্থান
পেইড অ্যাক্টিভিজম একেবারেই নতুন নয়। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপ আর আমেরিকার দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ধনী দাতাদের টাকা। বিশ শতকের গোড়ার দিকের শ্রমিক আন্দোলন বা সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও সংগঠকদের ভাতা দিত, যাতে তাঁরা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে পারে। ১৯৬০-এর দশকের মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনও নানা ফাউন্ডেশনের অনুদান পেতো—ভোটার রেজিস্ট্রেশন, আইনি সহায়তা, শান্তিপূর্ণ মিছিল এগুলো চালানোর জন্য। এসব অর্থ না থাকলে কেবল স্বেচ্ছাশ্রমে এত বড় আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল।
আজকের পেইড অ্যাক্টিভিজম আরও জটিল ও আন্তর্জাতিক। এখন আন্দোলন মানে এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রচার, পেশাদার সমন্বয়, মিডিয়া ক্যাম্পেইন, আইনি সহায়তা। গরিব বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে যখন নিজস্ব সম্পদ নেই, তখন দাতাদের অর্থে তাদের কণ্ঠ তুলে ধরা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
সমালোচকরা অবশ্য বলেন, টাকার দৌলতে আন্দোলনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে, দাতারা এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে পারেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বেশি টাকাওয়ালা আন্দোলন কি আর ‘আসল’ থাকে? আবার সমর্থকেরা বলেন, পেইড অ্যাক্টিভিজম আসলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকে গণতান্ত্রিক করে তোলে—যাঁরা অর্থের অভাবে লড়াইয়ে থাকতে পারতেন না, তাঁরাও সুযোগ পান। অর্থ সাহসকে প্রতিস্থাপন করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে তোলে।
জর্জ সোরোস: অর্থ আর সমাজসেবা
গত কয়েক দশকের পেইড অ্যাক্টিভিজম নিয়ে আলোচনা জর্জ সোরোস ছাড়া অসম্পূর্ণ। হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান বিনিয়োগকারী ও দাতা নিজের ভাগ্য গড়েছেন অর্থবাজারে। ১৯৭৩ সালে তিনি গড়েন কোয়ান্টাম ফান্ড। ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ মুদ্রায় এক সাহসী লেনদেনে একদিনেই বিলিয়ন খানেক ডলার মুনাফা করে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পান। পরের কয়েক দশকে মুদ্রা, শেয়ার, বন্ড আর পণ্যে বিনিয়োগ করে তিনি হয়ে ওঠেন বিশাল ধনী।
কিন্তু শুধু অর্থ জমিয়ে রাখেননি। ১৯৭৯ সালে তিনি গড়েন ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনস (ওএসএফ)। এই নেটওয়ার্ক মানবাধিকার, শিক্ষা, গণতন্ত্র আর সিভিল সোসাইটি নিয়ে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, আন্দোলন—বিশ্বজুড়ে বহু জায়গায় অনুদান দিয়েছে ওএসএফ। সোরোস ইতিমধ্যেই কয়েক দশকে কয়েক দশক বিলিয়ন ডলার দান করেছেন। এই অর্থ পুরোপুরি এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে, সরকারি খাত থেকে নয়। সমালোচকরা বলেন, সোরোস এসব অনুদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। সমর্থকেরা বলেন, তিনি অবহেলিত মানুষকে কণ্ঠ দেন, এমন জায়গায় অর্থ ঢালেন যেটি অন্যথায় অবহেলায় পড়ে থাকত।
পেইড অ্যাক্টিভিজম আর সোরোস বিতর্ক
‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ শব্দবন্ধটি অনেক সময় জর্জ সোরোসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টার প্রসঙ্গে। নানা প্রতিবেদনে বলা হয়, সোরোসের প্রতিষ্ঠিত ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনস (ওএসএফ) অর্থ দিয়েছে টাইটস ফাউন্ডেশনকে। এই ফাউন্ডেশন আবার অনুদান দিয়েছে জিউইশ ভয়েস ফর পিস আর ইফনটনাও-এর মতো সংগঠনগুলোকে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ, অসহযোগ আন্দোলন আর ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে নানা কর্মসূচি করেছে। সমালোচকেরা দাবি করেন, এসব আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মীরা আসলে টাকা পান। আর এই কারণে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ শব্দটা ছড়িয়েছে।
তবে সোরোস আর তাঁর ফাউন্ডেশন বলেছে, তারা কখনও সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে মিছিল বা প্রতিবাদের জন্য টাকা দেয় না। ওএসএফ স্পষ্ট করে জানায়, তারা কেবল সংগঠনকে অনুদান দেয়, ব্যক্তিকে নয়। আর শর্ত থাকে—কাজ অবশ্যই শান্তিপূর্ণ, আইনের মধ্যে আর মানবাধিকারের ভিত্তিতে হতে হবে।
ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা পলিটিফ্যাক্টও বলেছে, ‘সোরোস টাকা দিয়ে মানুষকে মিছিলে নামায়’—এই দাবি বিভ্রান্তিকর। সংগঠনকে অনুদান দেওয়া মানে সরাসরি মানুষকে টাকা দেওয়া নয়। সোরোস নিজে বলেছেন, ‘দানশীলতায় সঠিক কাজটাই করা উচিত—তা সফল হোক বা না হোক।’ অর্থাৎ, তাঁর লক্ষ্য হলো বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন।
সোরোস কি ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে অর্থ দেন
এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই সন্দেহ, রাজনৈতিক প্রচারণা আর ভিন্ন ভিন্ন বয়ানের মধ্যে ঘেরা। যা স্পষ্ট, তা হলো—সোরোস তাঁর ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের মাধ্যমে এমন কিছু নেটওয়ার্ককে অর্থ জুগিয়েছেন, যারা ফিলিস্তিনপন্থী নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়। এর মধ্যে আছে জিউইশ ভয়েস ফর পিস, ইফনটনাউ, ইউ.এস. ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটস। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিপদে পড়াদের আইনি সহায়তা প্রকল্প যেমন আদালাহ সোরোসের সহায়তা পায়। অনেক ক্ষেত্রেই এই অর্থ গেছে পরোক্ষভাবে, যেমন টাইডস ফাউন্ডেশনের মতো মধ্যস্থ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।
সোরোসের সমর্থকদের মতে, এ সবই স্বাভাবিক দাতব্য কার্যক্রম। মানে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন, আইনি সহায়তা বা বৈষম্যবিরোধী প্রচারণায় সাহায্যের জন্য অনুদান। কিন্তু সমালোচকেরা একে দেখেন আরও হিসেবি কৌশল হিসেবে। তাঁদের মতে, সোরোস সরাসরি আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন, কেবল সমর্থন নয়; বরং অ্যাক্টিভিজমকে দক্ষভাবে তৈরি করে দেওয়া। এখানেই আসে ‘পেইড অ্যাক্টিভিজম’ বা টাকার বিনিময়ে তৈরি আন্দোলনের অভিযোগ।
বিশেষ করে ফিলিস্তিনি প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ক আরও তীব্র, কারণ সোরোস নিজে একজন ইহুদি। কারও কাছে তাঁর ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান এক রকম বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়। অন্যদের চোখে, এটাই তাঁর দাতব্য কাজের স্বরূপ। একদিকে তা ইহুদি পরিচয়ের ভেতরে ভাঙন তৈরি করছে, আবার অন্যদিকে ফিলিস্তিনি সমর্থনকে শক্তিশালী করছে। প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনগুলো বলে, এটা একেবারেই ন্যায্য অবস্থান। কিন্তু বিরোধীরা মনে করে, সোরোস তাঁর বিপুল সম্পদ ব্যবহার করে একপেশে মতামতকে শক্তিশালী করছেন।
আলোচনায় আরও আসে ২০১০ সালের গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা বা সাম্প্রতিক গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ২০২৫। গুজব ছিল, সোরোস এসব অভিযানে টাকা দিয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই যে সোরোস বা তাঁর সংগঠন সরাসরি জাহাজ বা মিশনকে অর্থায়ন করেছে। তবু গুজব থামেনি। কারণ, সোরোসের নামই এখন হয়ে গেছে বৈশ্বিক আন্দোলনে প্রভাবের প্রতীক। তাঁর দেওয়া টাকায় যেসব সংগঠন টিকে আছে, তারাই আবার এসব উদ্যোগকে নৈতিক বা লজিস্টিক সমর্থন দেয়। তাহলে কি সেটা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা নয়?—এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে বিষয়টা শুধু সোরোসকে ঘিরে নয়; বরং বড় প্রশ্ন হলো, টাকা কি আন্দোলনকে বিকৃত করে? সমালোচকেরা বলেন, কোনো আন্দোলন যখন সম্পূর্ণভাবে ফাউন্ডেশন বা কোটিপতি দাতাদের টাকায় নির্ভরশীল হয়, তখন তার স্বতঃস্ফূর্ততা আর তৃণমূলের চরিত্র হারিয়ে যায়। ওপর থেকে চাপানো কর্মসূচি নিচের মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে হাজির হয়। সমর্থকেরা পাল্টা বলেন, টাকা ছাড়া বঞ্চিত মানুষের আন্দোলন টিকবে কীভাবে? যদি অর্থ না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রচারণা, আইনি লড়াই, কিংবা গণমাধ্যমে শোনা—কোনোটাই সম্ভব নয়।
এই জায়গাতেই সোরোস হয়ে উঠেছেন আধুনিক যুগের এক প্রতীক, যাকে বলা যায় ‘ফিলানথ্রো-অ্যাক্টিভিজম’। সমালোচকেরা যাকে বলেন এক ধরনের অদৃশ্য রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ—অর্থ দিয়ে তিনি আন্দোলনের ভাষা ও দিকনির্দেশ ঠিক করে দেওয়া। সত্যিটা হয়তো এই দুয়ের মাঝখানেই কোথাও।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ২০২৫
পনেরো বছর আগে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটিকেই এগিয়ে নিতে ২০২৫ সালে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে নামল। ‘সুমুদ’ শব্দের মানে হলো অটল থাকা—যা ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের বিশ্বব্যাপী সমর্থকদের প্রতিরোধের প্রতীক। এই ফ্লোটিলায় অংশ নিলেন ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা—এমনকি বাংলাদেশ থেকেও কর্মীরা। তারা শুধু ত্রাণ নয়, সঙ্গে নিয়ে গেলেন বিশ্বসংহতির বার্তা।
কথা চালু আছে, সোরোস বা তাঁর ফাউন্ডেশন এই ফ্লোটিলার খরচ দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। জাহাজ বা পুরো অভিযানের সরাসরি অর্থায়নের তথ্যও মেলেনি। অংশগ্রহণকারীরা এসেছিলেন মানবিক বিবেচনায়, আগের প্রচেষ্টাগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। পথরোধ, আটক বা বিপদ যাই থাকুক, এই প্রতীকী যাত্রা আবার প্রমাণ করেছে—সাহস আর বিবেকই আসল চালিকা শক্তি। অর্থ থাকুক বা না থাকুক, আন্দোলনের প্রাণশক্তি সেখানেই।
সাহসের বিকল্প কী
১৯৪৭ সালের এক্সোডাস—যেখানে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন, ২০১০ সালের গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কিংবা ২০২৫ সালের গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা—ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, সাধারণ মানুষই রাজনৈতিক বাধার সামনে দাঁড়িয়ে সাহস আর নৈতিক শক্তির নজির তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত দানশীলতা হোক বা ফাউন্ডেশন, অর্থ অবশ্যই এই প্রচেষ্টাকে সহজ করেছে। কিন্তু সেটা কখনো মানুষের সাহসের জায়গা দখল করতে পারে না।
পেইড অ্যাক্টিভিজম তাই বিতর্কিত রয়ে যায়। এটা একদিকে আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আবার অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও স্বীকার করে। জর্জ সোরোস, ভালো বা মন্দ যাই হোক, এই বিতর্কের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
দৃকের সঙ্গে কাজ করছি গত ডিসেম্বর থেকে। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবায় স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা’ শীর্ষক একটা গবেষণা দিয়ে কাজের শুরু। কাজের আগে আমার রেহনুমা আহমেদ কিংবা শহীদুল আলমের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় বা চেনাজানা ছিল না। আমি চিনতাম না তাঁদের, আমাকেও তাঁরা চিনতেন না। তারপর থেকে দৃকের কাজে
১০ ঘণ্টা আগেপ্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তথ্যপ্রবাহকে করেছে দ্রুততর, সম্পর্কগুলোকে করেছে গতিশীল। কিন্তু এই সহজাত বাস্তবতা প্রায়ই আমাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তাকে ভার্চুয়াল জগতের হাতে তুলে দিচ্ছি। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অজান্তেই আমরা প্রাইভেসির সীমান
১০ ঘণ্টা আগেবিসিবি নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। এই তালিকাটিই নির্বাচনের মূলভিত্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার আলো কম, সন্দেহের ছায়া বেশি। সময়মতো তালিকা প্রকাশ হয়নি, সংশোধন নিয়ে বিতর্ক, এমনকি কাউন্সিলরের বৈধতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
১৪ ঘণ্টা আগেবিশ্বের অনেক দেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২১-পদক্ষেপের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শেষ করা এবং গাজা স্ট্রিপ পুনর্গঠন করা। তবে বিশ্লেষকরা প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ নিয়ে সন্দিহান।
১ দিন আগে