জুলাই গণ-অভ্যুত্থান
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। রংপুরে শহীদ হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। পরদিন ১৭ জুলাই ভাইরাল হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ফেসবুক পোস্ট। পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার ক্লাসে ছাত্রলীগের কোনো নেতা বা সদস্য যেন না আসেন’। এরপর বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এই শিক্ষককে। শিকার হন বুলিংয়ের। ওই সময় কেন এমন পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি, স্ট্রিমের জন্য লিখেছেন সেই শ্বাসরুদ্ধকর বৃত্তান্ত।
উম্মে ফারহানা
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র আন্দোলন হলো এবং এতে তৎকালীন সরকারের ছাত্র-সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী—এই দুইয়ের নৃশংসতায় সহস্রাধিক যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, আজও তা ভুলতে পারি না। মূলত এর পরেই তো শুরু হলো ছাত্র-জনতার গণজোয়ার। আর এই জোয়ারের তোড়ে অতি অল্প সময়ে পালালেন মহাপরাক্রমশালী শেখ হাসিনা। এমনটা যে ঘটতে পারে, গত চার-পাঁচ বছরে তা কি আমরা ভেবেছিলাম! আসলে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুই এক বছর আগে দলমত-ভেদাভেদ ভুলে আমাদের এক করেছিল।
বলতে পারি, এ নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ইতিহাসের কলঙ্কিত একনায়কদের একজন হিসেবে নিজেকে ইতিহাসে স্থাপন করেছেন। ৫ আগস্ট তিনি গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। কেননা সারাদেশ থেকে জড়ো হওয়া লাখো মানুষ, যাঁরা পুলিশ আনসার র্যাব বা সেনাবাহিনীর গুলিতে মরার ভয় না করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোচ্ছিলেন, তাঁদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস এই তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র ছিল না।
টেলিভিশনের পর্দায় যতই তিনি কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করুন আর শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবাকে ডেকে এনে যতই বিচারের আশ্বাসের নাটক করুন না কেন, যে ভয়ানক নিষ্ঠুরতা তিনি দেশের মানুষকে দেখিয়েছেন, এরপর তাঁদের মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস তাঁর থাকার কথা নয়। এরপর থেকে শুনতে থাকলাম, ‘দেশ মৌলবাদীদের দখলে চলে যাবে’। আমাকে ফোন করে অনেকেই বললেন যে এখন আর বোরকা না পরে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, শাড়ি-চুড়ি, টিপ পরে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারব না।
এমন করেই নানা রকম জুজুর ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাতের ভোটের নির্বাচনকে গায়ের জোরে জায়েজ করে নিচ্ছিল। ক্ষমতায় থাকার সব রাস্তা পাকাপোক্ত করছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বজন হারানোর বেদনা বিক্রি করে শেখ হাসিনা একটা প্রজন্মকে নিজের সমব্যথী করতে সমর্থ হয়েছিলেন বটে।
কিন্তু সেই প্রজন্মের অনেকেই জুলাই-আন্দোলনের সময় আমাকে দেখাতে থাকলেন সেই ‘মৌলবাদের জুজু’র ভয়। ‘বিকল্প কে, বিকল্প দেখান’ বয়ানের সাবস্ক্রাইবার একজন তো কাঁচাবাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেশটা তাইলে আমেরিকার কাছে বেঁইচাই দিলা?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘তাইলে কি শেষ বাচ্চাটা মারা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম?’
গত বছরের ১৭ জুলাই আবু সাঈদ হত্যার পরদিন আমি ফেসবুকের একটি পোস্টে এই মর্মে ঘোষণা দিই যে ‘আমার ক্লাসে ছাত্রলীগের কোনো নেতা বা সদস্য যেন না আসেন। যাঁরা ক্ষমতার লোভে নিরস্ত্র সতীর্থদের হেলমেট পরে হাতুড়ি আর হকিস্টিক দিয়ে আক্রমণ করতে পারেন, তাঁরা অন্তত আমার ছাত্র হতে পারেন না।’
একই সঙ্গে ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতাও ঘোষণা করেছিলাম ওই পোস্টে। পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর ঘটল ভয়াবহ ঘটনা —আমার ইনবক্সে বিভিন্ন রকম হুমকি আসতে থাকে। সঙ্গে শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা—টেক্সট মেসেজ ও ফোনকলও কম এল না। আমার নিরাপত্তার জন্যেই এক সহকর্মী ফোন করে আমাকে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বললেন। এমনকি নিজের বড় ভাই আমাকে এই বলে ভর্ৎসনা করলেন যে ফেসবুকে আমার এ রকম বক্তব্য শিক্ষকতার পেশাগত নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজন শিক্ষক হিসেবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের আমি বয়কট করতে পারি না।
ফেসবুকে একজন জিজ্ঞাসাও করলেন, ‘তাহলে কি আপনি জামায়াত-শিবিরের ছাত্রদের পড়াবেন? শিবিরও তো সন্ত্রাসী সংগঠন।’ শুরু হলো বাইনারির আলোকে ট্যাগের খেলা। যেহেতু আমি আওয়ামী সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে পোষা সংগঠন ছাত্রলীগকে বয়কট করছি, তার অর্থ নিশ্চয়ই আমি বিএনপি বা জামায়াতের লোক। কিন্তু ছাত্রলীগ যে ততদিনে আর রাজনৈতিক কোনো সংগঠন নয়, হয়ে উঠেছে একটি গুন্ডাবাহিনী, তা জানলেও মানতে বা প্রকাশ্যে বলতে রাজি ছিলেন না অনেকে। আওয়ামী লীগবিরোধী মানেই জামাতপন্থী—এই বাইনারি যে শিক্ষিত মানুষদের মর্মেও গেঁথে গিয়েছে, তা-ও খুব প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশিত হলো তখন।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর কেবলই চোখে ভাসছিল আমার শিক্ষার্থীদের মুখ। ভাবলাম, আমি যদি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম তবে তিনি তো আমারই ছাত্র হতেন।
এরপর আসে অভিভাবক হিসেবে আমার অবস্থান। চাকরি বাঁচানোর জন্য তখন আমি যদি চুপও থাকতাম, রাস্তায় না-ও নামতাম, আমার সতের বছর বয়সী মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতাম কী করে?
সে সময় একটা জোয়ার এসেছিল, নানা বয়সী শিক্ষার্থীরা দেখছিল, তাঁদের বন্ধুরা গুলি খাচ্ছে, ভাইবোন আহত হয়েছে, হচ্ছে। এক পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলেও ততদিনে জেন-জিরা তো ভিপিএন ব্যবহার করা শিখে গেছে। কোনো একটা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সে খবর পৌঁছে যাচ্ছে সারা দেশে।
আমার এক সহকর্মী, যিনি ছেলেদের স্কুলেও একা পাঠাননি কখনো, তিনিও আটকে রাখতে পারেননি মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকপড়ুয়া তাঁর দুই ছেলেকে। তখন আমি আর কী করতে পারি, ঘরে বসে দোয়া করতাম, আমার মেয়েটা যেন অক্ষতভাবে হাত-পা নিয়ে ফেরে।
তারপর এক সময় নিজেই নেমে গেলাম রাস্তায়। সেটা এমন এক উত্তুঙ্গ সময়। মনে হচ্ছিল, যে দেশে আমার সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে চাকরি বাঁচিয়ে কী করব? মেয়ে মরলে ফিরে পাব মেয়েকে? আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, রাফি, সাগর, রিয়া বা ফাইয়াজের বাবা-মা কি কখনো ফিরে পাবেন তাঁদের বুকের ধন?
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চাকরি করি তার নাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত আমার কর্মস্থলেও বেশ বিরোধিতার মুখে পড়লাম। তবে ২০১১ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় আমি জানতাম, এটি ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। জয়েন করার পর দেখলাম তথ্যটি ভুল। ছাত্র-রাজনীতি আছে, তবে তা একচেটিয়াভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতি। এই সংগঠন বাদে অন্য দলের ছাত্রদের ক্লাস থেকে বের হলে পেটানোর হুমকি, এমনকি পরীক্ষার হলে ঢুকে মারধোর করার ঘটনাও নিজের চোখে দেখেছি।
একবার টাস্ক কমপ্লিট না করে ক্লাসে আসায় ছয়জন বাদে সবাইকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলাম। এ ঘটনায় দুজন নেতাগোছের ছাত্র জানালার কাচ ভেঙে বিক্ষোভ দেখালেন। আর দলের বড় নেতারা এসে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেন-দরবার করলেন। আমি কেন কিন্ডারগার্টেনের মতো করে পড়া ধরে ক্লাস নেব আর পড়া করে না আনলে উপস্থিতি না দিয়ে ক্লাস ত্যাগ করতে বলব, সেই কৈফিয়ত চাইলেন তাঁরা।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিভাগীয় প্রধানও তখন বলতে পারেননি যে এটা আমাদের বিভাগের ব্যাপার, আমরা ছাত্র-শিক্ষকেরা আলোচনা করে সমাধান করব, বাইরের কারও সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলব না। আসলে এ কথা বলার মতো পরিস্থিতি তখন ছিলো না। ছাত্রলীগকে সবাই-ই ভয় পেয়ে চলত। তাই সে সময় আমাকে বলা হলো, এ ব্যাপারটি ছেড়ে দিতে।
আরেকবার ক ইউনিটের ভর্তি কমিটির প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকার সময় এক নেতা ক্যান্টিনে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে নাশতা খেতে খেতে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে ভুলের অভিযোগ তুলে আমাকে হুমকি দিয়ে বললেন, ‘কিছু বলি না বইলা সাহস পায়া গেছেন আপনারা। ডিপার্টমেন্টে তালা লাগায় দেব। তখন বুঝবেন।’ মনে আছে, সেদিন তাঁকে বলেছিলাম, ‘আমি বিভাগে আছি। আপনি তালা নিয়ে আসেন।’
এরপর ক্যান্টিন থেকে ফিরতে না ফিরতেই তৎকালীন উপাচার্য আমাকে ফোন করে বললেন, আমি যেন ওই ছেলেকে ফোন করে সব মিটমাট করে ফেলি। তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি, ফ্রি হয়ে ফোন করব।’ বলাবাহুল্য যে সেই ছাত্রনেতাকে ফোন আমি করিনি।
ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতা প্রদর্শনের আরও উদাহরণ রয়েছে। এই মুহূর্তে দুটিই উল্লেখ করলাম। আসলে এই ছাত্রদের ‘ছাত্র’ হিসেবে গ্রহণ করতে না চাওয়ার সাহস কিংবা তাঁদের ছাত্রত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের স্পর্ধা তখন আমরা কেউই পাইনি। যাঁরা শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকদের কর্তৃত্ব মানতে চান না, সহপাঠীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করেন না, কাগজে-কলমে ছাত্র হলেও নৈতিকভাবে নিজেদের ছাত্র বলে দাবি করার যোগ্যতা তাঁরা বহু আগেই হারিয়েছেন বলে আমি মনে করি। আর জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত সময়ে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর কথায় হেলমেট-হাতুড়ি-হকিস্টিক নিয়ে আন্দোলনকারী সতীর্থদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পর তাঁদের আর ছাত্র হিসেবে গণ্য করি কীভাবে!
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম আমি। এরপর ১৭ জুলাই যখন আমি পোস্টটি দিলাম, তখন আমার পোস্ট শেয়ার করে আওয়ামী লীগের অনেকেই আমাকে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দেওয়ার পাশাপাশি আমার বিরুদ্ধে কুৎসিত গালাগালিতে লিপ্ত হন। বুলিং করতে থাকেন। অনেকে আবার এ-ও বলতে থাকেন যে ‘কীভাবে চাকরি পাইলো? অথচ ছাত্রলীগের কত পোলাপান ভার্সিটির চাকরি পায় না!’
এমন লোভী একদল মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আবু সাঈদের অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদ করে আমি সেদিন ঠিক কাজই করেছিলাম বলে মনে করি।
সে সময় আমরা যাঁরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছিলাম, তাঁরা মূলত রাষ্ট্রীয় শোষণ আর নিপীড়নেরই প্রতিবাদ করেছিলাম। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গিয়েছিলাম সন্তান হত্যার বিচার চাইতে। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগের বেশি চাকরি করে কখনো আওয়ামী সমর্থিত ছাত্রদের ঔদ্ধত্য আর অনাচার নিয়ে মুখ খুলিনি আমি। তাহলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কেন অমন ফেসবুক পোস্ট দিলাম?
উত্তর হলো, তখন সময়টাই এমন ছিল যে কীভাবে কীভাবে যেন আমরা অসীম সাহসী হয়ে উঠেছিলাম।
লেখক: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; কথাসাহিত্যিক
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র আন্দোলন হলো এবং এতে তৎকালীন সরকারের ছাত্র-সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী—এই দুইয়ের নৃশংসতায় সহস্রাধিক যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, আজও তা ভুলতে পারি না। মূলত এর পরেই তো শুরু হলো ছাত্র-জনতার গণজোয়ার। আর এই জোয়ারের তোড়ে অতি অল্প সময়ে পালালেন মহাপরাক্রমশালী শেখ হাসিনা। এমনটা যে ঘটতে পারে, গত চার-পাঁচ বছরে তা কি আমরা ভেবেছিলাম! আসলে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুই এক বছর আগে দলমত-ভেদাভেদ ভুলে আমাদের এক করেছিল।
বলতে পারি, এ নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ইতিহাসের কলঙ্কিত একনায়কদের একজন হিসেবে নিজেকে ইতিহাসে স্থাপন করেছেন। ৫ আগস্ট তিনি গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। কেননা সারাদেশ থেকে জড়ো হওয়া লাখো মানুষ, যাঁরা পুলিশ আনসার র্যাব বা সেনাবাহিনীর গুলিতে মরার ভয় না করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোচ্ছিলেন, তাঁদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস এই তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র ছিল না।
টেলিভিশনের পর্দায় যতই তিনি কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করুন আর শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবাকে ডেকে এনে যতই বিচারের আশ্বাসের নাটক করুন না কেন, যে ভয়ানক নিষ্ঠুরতা তিনি দেশের মানুষকে দেখিয়েছেন, এরপর তাঁদের মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস তাঁর থাকার কথা নয়। এরপর থেকে শুনতে থাকলাম, ‘দেশ মৌলবাদীদের দখলে চলে যাবে’। আমাকে ফোন করে অনেকেই বললেন যে এখন আর বোরকা না পরে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, শাড়ি-চুড়ি, টিপ পরে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারব না।
এমন করেই নানা রকম জুজুর ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাতের ভোটের নির্বাচনকে গায়ের জোরে জায়েজ করে নিচ্ছিল। ক্ষমতায় থাকার সব রাস্তা পাকাপোক্ত করছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বজন হারানোর বেদনা বিক্রি করে শেখ হাসিনা একটা প্রজন্মকে নিজের সমব্যথী করতে সমর্থ হয়েছিলেন বটে।
কিন্তু সেই প্রজন্মের অনেকেই জুলাই-আন্দোলনের সময় আমাকে দেখাতে থাকলেন সেই ‘মৌলবাদের জুজু’র ভয়। ‘বিকল্প কে, বিকল্প দেখান’ বয়ানের সাবস্ক্রাইবার একজন তো কাঁচাবাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেশটা তাইলে আমেরিকার কাছে বেঁইচাই দিলা?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘তাইলে কি শেষ বাচ্চাটা মারা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম?’
গত বছরের ১৭ জুলাই আবু সাঈদ হত্যার পরদিন আমি ফেসবুকের একটি পোস্টে এই মর্মে ঘোষণা দিই যে ‘আমার ক্লাসে ছাত্রলীগের কোনো নেতা বা সদস্য যেন না আসেন। যাঁরা ক্ষমতার লোভে নিরস্ত্র সতীর্থদের হেলমেট পরে হাতুড়ি আর হকিস্টিক দিয়ে আক্রমণ করতে পারেন, তাঁরা অন্তত আমার ছাত্র হতে পারেন না।’
একই সঙ্গে ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতাও ঘোষণা করেছিলাম ওই পোস্টে। পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর ঘটল ভয়াবহ ঘটনা —আমার ইনবক্সে বিভিন্ন রকম হুমকি আসতে থাকে। সঙ্গে শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা—টেক্সট মেসেজ ও ফোনকলও কম এল না। আমার নিরাপত্তার জন্যেই এক সহকর্মী ফোন করে আমাকে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বললেন। এমনকি নিজের বড় ভাই আমাকে এই বলে ভর্ৎসনা করলেন যে ফেসবুকে আমার এ রকম বক্তব্য শিক্ষকতার পেশাগত নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজন শিক্ষক হিসেবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের আমি বয়কট করতে পারি না।
ফেসবুকে একজন জিজ্ঞাসাও করলেন, ‘তাহলে কি আপনি জামায়াত-শিবিরের ছাত্রদের পড়াবেন? শিবিরও তো সন্ত্রাসী সংগঠন।’ শুরু হলো বাইনারির আলোকে ট্যাগের খেলা। যেহেতু আমি আওয়ামী সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে পোষা সংগঠন ছাত্রলীগকে বয়কট করছি, তার অর্থ নিশ্চয়ই আমি বিএনপি বা জামায়াতের লোক। কিন্তু ছাত্রলীগ যে ততদিনে আর রাজনৈতিক কোনো সংগঠন নয়, হয়ে উঠেছে একটি গুন্ডাবাহিনী, তা জানলেও মানতে বা প্রকাশ্যে বলতে রাজি ছিলেন না অনেকে। আওয়ামী লীগবিরোধী মানেই জামাতপন্থী—এই বাইনারি যে শিক্ষিত মানুষদের মর্মেও গেঁথে গিয়েছে, তা-ও খুব প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশিত হলো তখন।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর কেবলই চোখে ভাসছিল আমার শিক্ষার্থীদের মুখ। ভাবলাম, আমি যদি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম তবে তিনি তো আমারই ছাত্র হতেন।
এরপর আসে অভিভাবক হিসেবে আমার অবস্থান। চাকরি বাঁচানোর জন্য তখন আমি যদি চুপও থাকতাম, রাস্তায় না-ও নামতাম, আমার সতের বছর বয়সী মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতাম কী করে?
সে সময় একটা জোয়ার এসেছিল, নানা বয়সী শিক্ষার্থীরা দেখছিল, তাঁদের বন্ধুরা গুলি খাচ্ছে, ভাইবোন আহত হয়েছে, হচ্ছে। এক পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলেও ততদিনে জেন-জিরা তো ভিপিএন ব্যবহার করা শিখে গেছে। কোনো একটা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সে খবর পৌঁছে যাচ্ছে সারা দেশে।
আমার এক সহকর্মী, যিনি ছেলেদের স্কুলেও একা পাঠাননি কখনো, তিনিও আটকে রাখতে পারেননি মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকপড়ুয়া তাঁর দুই ছেলেকে। তখন আমি আর কী করতে পারি, ঘরে বসে দোয়া করতাম, আমার মেয়েটা যেন অক্ষতভাবে হাত-পা নিয়ে ফেরে।
তারপর এক সময় নিজেই নেমে গেলাম রাস্তায়। সেটা এমন এক উত্তুঙ্গ সময়। মনে হচ্ছিল, যে দেশে আমার সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে চাকরি বাঁচিয়ে কী করব? মেয়ে মরলে ফিরে পাব মেয়েকে? আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, রাফি, সাগর, রিয়া বা ফাইয়াজের বাবা-মা কি কখনো ফিরে পাবেন তাঁদের বুকের ধন?
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চাকরি করি তার নাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত আমার কর্মস্থলেও বেশ বিরোধিতার মুখে পড়লাম। তবে ২০১১ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় আমি জানতাম, এটি ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। জয়েন করার পর দেখলাম তথ্যটি ভুল। ছাত্র-রাজনীতি আছে, তবে তা একচেটিয়াভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতি। এই সংগঠন বাদে অন্য দলের ছাত্রদের ক্লাস থেকে বের হলে পেটানোর হুমকি, এমনকি পরীক্ষার হলে ঢুকে মারধোর করার ঘটনাও নিজের চোখে দেখেছি।
একবার টাস্ক কমপ্লিট না করে ক্লাসে আসায় ছয়জন বাদে সবাইকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলাম। এ ঘটনায় দুজন নেতাগোছের ছাত্র জানালার কাচ ভেঙে বিক্ষোভ দেখালেন। আর দলের বড় নেতারা এসে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেন-দরবার করলেন। আমি কেন কিন্ডারগার্টেনের মতো করে পড়া ধরে ক্লাস নেব আর পড়া করে না আনলে উপস্থিতি না দিয়ে ক্লাস ত্যাগ করতে বলব, সেই কৈফিয়ত চাইলেন তাঁরা।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিভাগীয় প্রধানও তখন বলতে পারেননি যে এটা আমাদের বিভাগের ব্যাপার, আমরা ছাত্র-শিক্ষকেরা আলোচনা করে সমাধান করব, বাইরের কারও সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলব না। আসলে এ কথা বলার মতো পরিস্থিতি তখন ছিলো না। ছাত্রলীগকে সবাই-ই ভয় পেয়ে চলত। তাই সে সময় আমাকে বলা হলো, এ ব্যাপারটি ছেড়ে দিতে।
আরেকবার ক ইউনিটের ভর্তি কমিটির প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকার সময় এক নেতা ক্যান্টিনে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে নাশতা খেতে খেতে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে ভুলের অভিযোগ তুলে আমাকে হুমকি দিয়ে বললেন, ‘কিছু বলি না বইলা সাহস পায়া গেছেন আপনারা। ডিপার্টমেন্টে তালা লাগায় দেব। তখন বুঝবেন।’ মনে আছে, সেদিন তাঁকে বলেছিলাম, ‘আমি বিভাগে আছি। আপনি তালা নিয়ে আসেন।’
এরপর ক্যান্টিন থেকে ফিরতে না ফিরতেই তৎকালীন উপাচার্য আমাকে ফোন করে বললেন, আমি যেন ওই ছেলেকে ফোন করে সব মিটমাট করে ফেলি। তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি, ফ্রি হয়ে ফোন করব।’ বলাবাহুল্য যে সেই ছাত্রনেতাকে ফোন আমি করিনি।
ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতা প্রদর্শনের আরও উদাহরণ রয়েছে। এই মুহূর্তে দুটিই উল্লেখ করলাম। আসলে এই ছাত্রদের ‘ছাত্র’ হিসেবে গ্রহণ করতে না চাওয়ার সাহস কিংবা তাঁদের ছাত্রত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের স্পর্ধা তখন আমরা কেউই পাইনি। যাঁরা শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকদের কর্তৃত্ব মানতে চান না, সহপাঠীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করেন না, কাগজে-কলমে ছাত্র হলেও নৈতিকভাবে নিজেদের ছাত্র বলে দাবি করার যোগ্যতা তাঁরা বহু আগেই হারিয়েছেন বলে আমি মনে করি। আর জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত সময়ে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর কথায় হেলমেট-হাতুড়ি-হকিস্টিক নিয়ে আন্দোলনকারী সতীর্থদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পর তাঁদের আর ছাত্র হিসেবে গণ্য করি কীভাবে!
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম আমি। এরপর ১৭ জুলাই যখন আমি পোস্টটি দিলাম, তখন আমার পোস্ট শেয়ার করে আওয়ামী লীগের অনেকেই আমাকে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দেওয়ার পাশাপাশি আমার বিরুদ্ধে কুৎসিত গালাগালিতে লিপ্ত হন। বুলিং করতে থাকেন। অনেকে আবার এ-ও বলতে থাকেন যে ‘কীভাবে চাকরি পাইলো? অথচ ছাত্রলীগের কত পোলাপান ভার্সিটির চাকরি পায় না!’
এমন লোভী একদল মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আবু সাঈদের অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদ করে আমি সেদিন ঠিক কাজই করেছিলাম বলে মনে করি।
সে সময় আমরা যাঁরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছিলাম, তাঁরা মূলত রাষ্ট্রীয় শোষণ আর নিপীড়নেরই প্রতিবাদ করেছিলাম। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গিয়েছিলাম সন্তান হত্যার বিচার চাইতে। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগের বেশি চাকরি করে কখনো আওয়ামী সমর্থিত ছাত্রদের ঔদ্ধত্য আর অনাচার নিয়ে মুখ খুলিনি আমি। তাহলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কেন অমন ফেসবুক পোস্ট দিলাম?
উত্তর হলো, তখন সময়টাই এমন ছিল যে কীভাবে কীভাবে যেন আমরা অসীম সাহসী হয়ে উঠেছিলাম।
লেখক: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; কথাসাহিত্যিক
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি প্রজ্ঞাপন আমার নজরে এল। প্রজ্ঞাপনটি হলো, রাত দশটার পর হলে ফিরলে ছাত্রীদের হলের সিট বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি তা দশটা এক মিনিট হলেও। অবাক করা প্রজ্ঞাপন বটে!
৩৮ মিনিট আগেযুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক আরও জোরদার করা।
১ দিন আগেবিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসন বিশিষ্ট। আর এর সদস্য মনোনীত হবেন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে যে ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে আসন।
১ দিন আগেকেন এত বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি—এর কোনো সদুত্তর কখনোই কোনো সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারেনি। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও সে দাবি বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসনগুলো।
২ দিন আগে