গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ নভেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য উইক-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধের শিরোনাম ‘অতীতেও আমি অনির্বাচিত রাজনীতিবিদদের মোকাবিলা করেছি’ শিরোনামে। দিল্লি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক এই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ লেখা এটি। দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রায় দেড় বছর পর প্রকাশিত নিবন্ধটি নিঃসন্দেহে এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলিল।
নিবন্ধটি পাঠ করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন, শেখ হাসিনা লেখাটিতে নিজেকে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে (নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন) সফল আন্দোলনকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে চিত্রিত করেছেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার হিসেবে।
নিবন্ধটিতে সুকৌশলে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতীক, সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপক এবং একটি অবৈধ বিচার প্রক্রিয়ার ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা।
এই কৌশলের একাধিক দুর্বল দিক আছে। সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে, ‘অনির্বাচিত’ ইউনূস সরকারের ওপর যেসব অভিযোগের দায় চাপিয়েছেন শেখ হাসিনা, সেই অভিযোগগুলো হাসিনার নিজের শাসনামলের শেষ বছরগুলোতে (২০০৯-২০২৪) প্রকট হয়ে উঠেছিল।
‘মিথ্যা তথ্য’ মানে সব সময় অসত্য তথ্য উপস্থাপন নয়, বরং কিছু তথ্যকে কৌশলগতভাবে বাদ দেওয়া এবং প্রয়োজন মতো কিছু তথ্যকে বেছে নেওয়াও মিথ্যার বেসাতি উপস্থাপনেরই শামিল।
শেখ হাসিনার নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হাসিনা ও তাঁর দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং ৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই কৌশলের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনসহ বিগত ১৫ বছরের সকল অপশাসন থেকে জনগণের মনোযোগ সরানো।
একইভাবে শেখ হাসিনা বর্তমান বিচারিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে না দেখিয়ে একটি ‘বৃহত্তর চক্রান্ত’ হিসেব উপস্থাপন করেছেন, যাতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায়।
শেখ হাসিনা অবশ্য তাঁর লেখায় স্বীকার করেছেন যে ‘কখনো কখনো ভুল হয়েছে’ এবং ‘কিছু সরকারি কর্মকর্তা অসাধু ছিলেন’, যার ফলে ‘অন্যায়ের দৃষ্টান্ত’ তৈরি হয়েছিল। এই চাতুরতাময় স্বীকারোক্তির সবচেয়ে বড় ফাঁক হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সাফল্যকে সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দেখিয়ে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিকে ‘কতিপয় ব্যক্তির অসততা’ হিসেবে দেখানো।
অর্থনীতি নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন
শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলের অর্থনৈতিক রেকর্ডকে ‘স্বর্ণালী সময়’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর সরকার পতনের ঠিক আগের সময়ের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দশা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতির কথা চেপে গিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেত্রী তাঁর নিবন্ধে দাবি করেছেন, তাঁর সরকারের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ‘একসময় অকল্পনীয় স্তরে’ পৌঁছেছিল। এই দাবিটি ইতিহাসের দীর্ঘ পরিসরে সত্য হলেও, তাঁর পতনের আগের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। তাঁর সরকারের সময়েরই নথিবদ্ধ তথ্য বলছে, হাসিনা সরকারের শেষ বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে দ্রুত হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। এই তীব্র রিজার্ভ হ্রাস এবং চলতি হিসাবের ব্যাপক ঘাটতি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হয়। আইএমএফের বিবৃতি অনুযায়ী, এই ঋণ ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে’ অপরিহার্য ছিল।
সুতরাং, হাসিনা তাঁর লেখায় কৌশলগত সময় নির্বাচন করেছেন। তিনি ১৯৭১ সাল থেকে পরিসংখ্যানের ওপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু নিজের শাসনামলের অর্থনৈতিক পতন উপেক্ষা করেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিবন্ধে দাবি করেছেন, জিডিপি ৪৭ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল এবং বৈশ্বিক মহামারির আগে প্রবৃদ্ধি ‘প্রায় ৮ শতাংশ’ বজায় ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশিত শ্বেতপত্র থেকে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪০ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে। এই বিশাল অংকের অর্থ পাচার ইঙ্গিত দেয়, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দাবি সত্ত্বেও অর্থনীতি ছিল দুর্বল এবং পদ্ধতিগত দুর্নীতি দ্বারা জর্জরিত।
শেখ হাসিনা অবশ্য তাঁর লেখায় স্বীকার করেছেন যে ‘কখনো কখনো ভুল হয়েছে’ এবং ‘কিছু সরকারি কর্মকর্তা অসাধু ছিলেন’, যার ফলে ‘অন্যায়ের দৃষ্টান্ত’ তৈরি হয়েছিল। এই চাতুরতাময় স্বীকারোক্তির সবচেয়ে বড় ফাঁক হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সাফল্যকে সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দেখিয়ে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিকে ‘কতিপয় ব্যক্তির অসততা’ হিসেবে দেখানো।
হাসিনা তাঁর নিবন্ধে অভিযোগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে’ এবং ‘কয়েক কোটি নাগরিককে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে’। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে গত ১০ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটের বিকৃতি
শেখ হাসিনা তাঁর নিবন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা, তাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো এনেছেন, সেগুলো আংশিক সত্য এবং কিছু ক্ষেত্রে চরম মিথ্যাচার। হাসিনা বলেছেন, ইউনূস প্রশাসন ‘জবাবদিহিহীন এলিটদের’ দ্বারা পরিচালিত এবং যাদের ‘কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি বা নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই’। এই অভিযোগটি ভাষাগত দিক থেকে সঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তা তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তাঁর এড়িয়ে যাওয়া অস্বস্তিকর অংশ হচ্ছে, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সৃষ্ট সাংবিধানিক শূন্যতার কারণে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
শেখ হাসিনা বারবার ‘অনির্বাচিত’ সরকার শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর শাসনামলে তিনি যে ব্যাপক দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) থেকে দূরে রেখেছিলেন, তা উল্লেখ করেননি।
জুলাই সনদের ভুল ব্যাখ্যা
হাসিনা দাবি করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘একটি অসাংবিধানিক সনদ দিয়ে আমাদের সংবিধানকে হুমকির মুখে ফেলেছে’। এটিকে ‘স্বৈরাচারী শাসনকে বৈধতা’ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। কিন্তু প্রকৃত তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা একটি অবাধ্যতামূলক সংস্কারের রোডম্যাপ। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—অভ্যুত্থানকারীদের দাবির ভিত্তিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এই সনদে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল সমর্থন করেছে। হাসিনা মূলত এমন একটি প্রক্রিয়াকে অবৈধ প্রমাণ করতে চাইছেন, যা তাঁর নিজের শাসনামলের ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা রোধ করার জন্য তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রেক্ষাপট গোপন করা
হাসিনা তাঁর নিবন্ধে অভিযোগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে’ এবং ‘কয়েক কোটি নাগরিককে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে’।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে গত ১০ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, হাসিনা সরকার নিজেই ২০২৪ সালের আগস্টে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল। জাতিসংঘ তখন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল। এখন শেখ হাসিনা সেই সত্য ইতিহাস উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন।
শেখ হাসিনা এখন সংবিধানের দোহাই দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আক্রমণ করেন। অথচ তার সরকার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচনী ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছিল (অংশগ্রহণহীন নির্বাচন, বিরোধীদের আইনি দমন) । এটি প্রমাণ করে যে ‘সাংবিধানিক সততার’ সংজ্ঞা আওয়ামী লীগের কাছে নির্ভর করে কেবল তারা ক্ষমতায় আছে কিনা তার ওপর।
শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে ‘অন্যায়ের কিছু দৃষ্টান্তের’ কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অন্যায়ের উল্লেখ করেননি। তিনি সুকৌশলে ২০০৯-২০২৪ সময়কালে নথিভুক্ত গুম, হেফাজতে মৃত্যু এবং নির্যাতনের তথ্যগুলো বাদ দিয়েছেন।
সহিংসতা সম্পর্কে ‘পছন্দসই’ তথ্য পরিবেশন
হাসিনা তাঁর নিবন্ধে দাবি করেছেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়নে তাঁর সরকারের কোনো কমান্ড দায়বদ্ধতা ছিল না। উল্টো তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অরাজকতার চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে প্রাণঘাতী সহিংসতা হয়েছে, তা রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশে হয়নি। বরং তা ছিল ‘চেইন অব কমান্ডের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাবের’ ফল। তিনি আরও দাবি করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি ‘আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন’।
শেখ হাসিনার এই দাবি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে সরাসরি খণ্ডন করা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনটি একটি স্বাধীন ও পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘন ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞান, সমন্বয় এবং নির্দেশনায়’ সংঘটিত হয়েছিল। এই লঙ্ঘনগুলো বিক্ষোভ দমন করার একটি কৌশলের অংশ ছিল। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দমন-পীড়নটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং পদ্ধতিগত ছিল ।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, হাসিনা একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্রের নির্বিচার ব্যবহারের’ জন্য ফৌজদারিভাবে দায়ী হতে পারেন।
শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে ‘অন্যায়ের কিছু দৃষ্টান্তের’ কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অন্যায়ের উল্লেখ করেননি। তিনি সুকৌশলে ২০০৯-২০২৪ সময়কালে নথিভুক্ত গুম, হেফাজতে মৃত্যু এবং নির্যাতনের তথ্যগুলো বাদ দিয়েছেন।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) দ্বারা নথিভুক্ত গুমের অভিযোগে হাসিনা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের চার্জ গঠন করা হয়েছে। তাঁর বিচার কেবল ২০২৪ সালের গণহত্যাকাণ্ডের জন্য নয়, বরং ১৫ বছরের পদ্ধতিগত অপশাসনের জন্য হচ্ছে।
হাসিনা বর্তমান ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীর (যেমন হিজবুত তাহরীর) প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনেছেন। তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির পর সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা ঘটেছে এবং জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চরমপন্থীদের প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর শাসনামলেও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে, হলি আর্টিজানের মতো জঙ্গি হামলা হয়েছে, যে তথ্যগুলো তিনি এড়িয়ে গেছেন।
ইউনূস প্রশাসনের জন্য এই বিচারিক প্রক্রিয়া একটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা। অন্তর্বর্তী সরকার মূলত জাতিসংঘ মিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং উচ্চ-পর্যায়ের বিচার শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নৈতিক ও আইনি ম্যান্ডেটে পরিণত করেছে। হাসিনা কেবল প্রক্রিয়াগত ত্রুটিগুলোর (যেমন বিচারকদের অভিজ্ঞতা, আইনজীবীদের পক্ষপাত) ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে অভিযোগের সারবস্তু দুর্বল হয়ে যায়।
বিচারিক প্রক্রিয়া এবং জাতিসংঘের ভূমিকার ভুল ব্যাখ্যা
হাসিনা দাবি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে চলমান বিচার একটি ‘ভুয়া, কারচুপি করা এবং অবৈধ শো-ট্রায়াল’। এই ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। যদিও তাঁর শাসনামলে গঠিত আইসিটিও ন্যায্য বিচারের মানদণ্ডে সমালোচিত ছিল।
ইউনূস প্রশাসনের জন্য এই বিচারিক প্রক্রিয়া একটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা। অন্তর্বর্তী সরকার মূলত জাতিসংঘ মিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং উচ্চ-পর্যায়ের বিচার শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নৈতিক ও আইনি ম্যান্ডেটে পরিণত করেছে। হাসিনা কেবল প্রক্রিয়াগত ত্রুটিগুলোর (যেমন বিচারকদের অভিজ্ঞতা, আইনজীবীদের পক্ষপাত) ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে অভিযোগের সারবস্তু দুর্বল হয়ে যায়।
যেহেতু অভিযোগের সারবস্তু আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত, তাই হাসিনা ও তাঁর দল খুব সুচিন্তিতভাবেই বিচারব্যবস্থার বিশ্বস্ততাকে আক্রমণ করছেন, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে ন্যায়বিচার হিসেবে না দেখে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখে।
পুরো নিবন্ধ পাঠশেষে এই উপলব্ধি হয় যে, পলাতক শেখ হাসিনা একটি আত্মরক্ষামূলক আখ্যান তৈরি করতে চেয়েছেন, যা বাস্তব রাজনৈতিক ও বিচারিক সত্যের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পুরো নিবন্ধে অন্তত তিনটি সরাসরি মিথ্যাচারের ঘটনা চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে মিথ্যাচার। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের সহিংসতাকে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের’ ফল হিসেবে দাবি করা, যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত স্বাধীন তদন্তের ফলাফলের সরাসরি বিরোধী। জাতিসংঘ সুস্পষ্টভাবে বলেছে, দমন-পীড়নটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশেই সংঘটিত হয়েছিল। তৃতীয়ত, জুলাই চার্টারকে স্বৈরাচারী শাসনের হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করা।
শেখ হাসিনার নিবন্ধের সবচেয়ে লক্ষণীয় উপাদান হলো, প্রয়োজন মতো তথ্য বেছে নেওয়া আর সত্যকে ছোত করে দেখানো। তিনি দীর্ঘমেয়াদি গুম, হেফাজতে মৃত্যু এবং নির্যাতনের পদ্ধতিগত ইতিহাসকে কেবল ‘অন্যায়ের দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে ১৫ বছরের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর পতনের পরে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অরাজকতার জন্য ইউনূস সরকারকে দায়ী করেছেন। কিন্তু এড়িয়ে গেছেন যে সেই অস্থিরতার বীজ তাঁর নিজের শাসনামলের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মধ্যেই নিহিত ছিল।
এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার নিন্দা করেছেন। অথচ ক্ষমতায় থাকার সময়ে তিনি নিজেই অন্য প্রধান বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করার নজির স্থাপন করেছিলেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক