গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় শহীদ নাদিম মিজানকে হত্যা ও তাঁদের বাড়িতে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল ছোড়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী তাবাসসুম আকতার নিহা (২০)। একই দিনের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ছয় বছরের শিশু মো. বাসিত খান মুসা যেভাবে আহত হন এবং তার দাদী মায়া ইসলাম নিহত হন, তারও বর্ণনা দেন আরেক সাক্ষী।
আজ সোমবার (৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ এই দুই সাক্ষী জবানবন্দি দেন। ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা এই মামলায় ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
এ মামলায় আসামিরা হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খিলগাঁও অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান, রামপুরা থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) চঞ্চল চন্দ্র সরকার। এর মধ্যে চঞ্চল চন্দ্র গ্রেপ্তার আছেন এবং আজ তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। বাকিরা পলাতক রয়েছেন।
জবানবন্দিতে শহীদ নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আকতার নিহা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার আমার স্বামী নামাজ পড়তে রামপুরা থানা মসজিদে যায়। আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের সময় স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার স্বামীকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি দেখতে পাই আমার স্বামীর পেট থেকে রক্ত ঝরছিল। আমি আমার স্বামীর এই অবস্থা দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই।’
তিনি বলেন, আনুমানিক পাঁচ-দশ মিনিট পরে আমার জ্ঞান ফিরলে আমি জানতে পারি আমার স্বামীকে স্থানীয় অ্যাডভান্স হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে তখন অনবরত গুলি চলছিল, তাই আমি হাসপাতালে যেতে পারিনি। আমার স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।’
তাবাসসুম আকতার নিহা ট্রাইব্যুনালকে আরও বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে নাদিমের লাশ বাসায় নিয়ে এলে রামপুরা থানার পুলিশ নাদিমের লাশ নিয়ে যেতে চায়। ওই সময় আমাদের বাসায় এবং বাসার আশেপাশে প্রচুর আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। তখন হেলিকপ্টার থেকে আমাদের বাড়ি ও ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি রুমে বসে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাই এবং টিয়ারশেলের গন্ধ পাই, যাতে আমার চোখ মুখ জ্বলছিল।’
সাক্ষ্যদানের শেষ দিকে নিহা বলেন,আমার স্বামীর হত্যার জন্য শেখ হাসিনা এবং যে পুলিশ সদস্যরা গুলি করেছে তারা দায়ী। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’
জবানবন্দি শেষে সাক্ষী তাবাসসুম আকতার নিহাকে জেরা করেন আসামি চঞ্চল চন্দ্রের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনও তাঁকে জেরা করেন।
জেরার জবাবে নিহা বলেন, তিনি স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনেছেন যে পুলিশ ও বিজিবির ছোড়া গুলিতে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে মামলার চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন রামপুরা বনশ্রী এলাকার সেলুন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইয়াকুব মিয়া। তিনি জানান, ঘটনার দিন শুক্রবার আনুমানিক বেলা তিনটার দিকে বাইরের গোলযোগ পরিস্থিতি দেখে তিনি তার বাসার নিচতলায় পার্কিংয়ে অবস্থান করছিলেন। তাদের ভবনটি রামপুরা থানার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত।
ইয়াকুব মিয়া বলেন, ‘বাইরে তখন গোলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের বিল্ডিংয়ের ছয়তলার বাসিন্দা মুসা, মুসার বাবা এবং মুসার দাদিকে বিল্ডিংয়ের নিচে দেখতে পাই। আমি তখন দেখতে পাই থানার দিক থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি মুসার মাথায় লাগে।’
তিনি বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে মুসার বাবা মুসাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। গুলিটি মাথা ভেদ করে মুসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুসার দাদির পেটে গিয়ে লাগে। মুসার দাদি সিঁড়ির ওপরে উঠতে গিয়ে পড়ে যান এবং রক্তে সিঁড়ি ভিজে যায়। আমরা মুসার দাদিকে ধরাধরি করে রিকশাযোগে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
সাক্ষী ইয়াকুব মিয়া আরও জানান, পরের দিন সকালে তিনি জানতে পারেন মুসার দাদি মায়া ইসলাম মারা গেছেন।
শহীদ নাদিম মিজানের নিহতের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে জানতে পারি আমাদের এলাকার শুকুর আলীর জামাই নাদিম মিজানও মসজিদের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।’
সাক্ষী ইয়াকিব মিয়াকে আসামি চঞ্চল চন্দ্রের আইনজীবী সারওয়ার জাহান জেরা করেন। তবে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তাকে জেরা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
আদালত আগামীকাল মঙ্গলবার মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যমতে, ওই অভ্যুত্থানে ৮ শতাধিক মানুষ নিহত হন, যাদের ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকটি মামলার বিচার চলছে।