আসছে ফেব্রুয়ারিতেই ২০২৬ সালের অমর একুশে বইমেলার হবে বলে গতকাল রোববার বাংলা একাডেমি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রকাশক, লেখক ও পাঠকেরা। তবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, অর্থাৎ রমজান মাসেই বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘বইমেলা কবে হবে সেটা নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের আকাঙ্ক্ষা বা বাস্তবতা অনুযায়ী। প্রধান বিষয় হচ্ছে, মেলা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।’
রমজান মাসে মেলা হলে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেলা রমজান মাসেই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রমজান তো ১৮ বা ১৯ তারিখে। তখন কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সবকিছু বিবেচনা করে মেলাটা করতে হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘রমজান মাসে কিন্তু এর আগেও বইমেলা হয়েছে। বইমেলায় পাঠকেরা রমজান মাসে বিকেলবেলাটা একটু ঘুরতে পছন্দ করেন। যদি ইফতারের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে খারাপ হয় না।’
এই কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, মেলাতে পাঠকেরা বই ঠিকই কিনবে। তিনি বলেন, বইয়ের পাঠকের ওপর এটা আমার বিশ্বাস। তবে যারা বইমেলায় সেলফি তুলতে আসেন, তাঁদের ভীড় হয়তো এবার কমবে। তবে পাঠকেরা মেলায় যাবে, এতে সন্দেহ নেই। এটা মূলত আমার পজিটিভ ধারণা। তবে বইমেলাটাকে যারা এনজয় করতে চান, তাদের ক্ষেত্রে একটু সংকট হতে পারে। প্রকৃত লেখক ও পাঠকের জন্য খুব এটা সমস্যা হবে না।’
তবে প্রকাশক ও লেখকদের মধ্যে আসন্ন বইমেলা নিয়ে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যের সত্ত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাঈম মনে করেন, নির্বাচনের পরপরই মেলা শুরু হওয়া উচিত। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘নির্বাচন যদি ৫ বা ৬ তারিখে হয়, তাহলে মেলা হয়তো ৮ বা ৯ তারিখেই শুরু করা যায়। আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ থেকে জানুয়ারির ১৭ তারিখ পর্যন্ত, সেটা ভালোই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু বলছে ওই সময়ে করা ঠিক না, তাই আমরা চাচ্ছি নির্বাচনের পরই মেলাটা শুরু হোক। রমজান মাসে মেলা থাকলে ব্যবসায়িক দিক থেকে ঝুঁকি থাকবে। তবে রাষ্ট্রের স্বার্থে এটা আমাদের করতে হচ্ছে।’
অন্যদিকে প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক কাউছার আহম্মেদ কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া, সেটা হলো বইমেলা হতেই হবে। নির্বাচনের আগেও হতে পারে, পরেও হতে পারে। কিন্তু কথা হলো, বাস্তবসম্মত সময় নির্ধারণ করা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত কোনোভাবে কি বলা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতেই বইমেলা হবে? ফেব্রুয়ারির পরে মেলা হলে মেলা লাভজনক হবে না। তারপরও মেলা আয়োজন সম্ভব কি?’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘যদি তফসিলে ২০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয় তাহলে ২১-২৮ ফেব্রুয়ারি বইমেলা কি সম্ভব?’
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল এই বিষয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘রমজান মাসেই বইমেলা হতে পারে। আগেও তো হয়েছে। এবার হলেও কোনো সমস্যা হবে না। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রাও অব্যাহত থাকে।’
এছাড়াও তিনি স্ট্রিমকে আরও বলেন, ‘আগামী তিন বছর তো রমজান ফেব্রুয়ারিতেই হবে, সেক্ষেত্রে আমরা কি বইমেলা তিন বছরই আগে বা পিছে করব? করা উচিত না। রমজানে তো অন্যসব কাজ ঠিকই চলে। বইমেলা হলে সমস্যা কী? তাই বইমেলা ফেব্রুয়ারিতেই হোক। এবার যেহেতু নির্বাচন আছে, তাই একটু দেরিতে শুরু হলেও ফেব্রুয়ারিতেই হয়ে যাওয়া ভালো। ’
এ বিষয়ে স্ট্রিমকে অনুবাদক ও অধ্যাপক জি এইচ হাবিব বলেন, ‘বইমেলা হচ্ছে, এটা তো ভালো খবর। রমজান মাসে তো সবই হয়। তাই মেলাও হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা কেন আমরা আগেই ধরে নেব? মূল সিদ্ধান্তটা প্রকাশকদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। কারণ রিস্কটা আসলে তাঁদেরই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি তো আছেই যে, বইমেলা ছাড়া বই বের হয় না। হাতে গোনা কিছু বড় প্রকাশক ছাড়া বাকিরা বইমেলার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তাই মেলা হলে ভালো। এমনকি রোজার পুরো সময়জুড়ে হলেও।’
তরুণ লেখক আরিফ রহমান অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ‘নির্বাচনের পরপর বইমেলা হওয়া আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হবে। কারণ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত থাকে, যা পাঠকদের ভীত করে তুলতে পারে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বা জানুয়ারি হবে মেলা করার উপযুক্ত সময়।’
পাঠকদের মধ্যেও আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শোভন বলেন, ‘নির্বাচনের পরপর বইমেলা হলে আগের মতো উত্তেজনা থাকবে না। লেখকেরাও এবার তেমন বইয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন না। তাই আগের মতো মেলার আমেজ থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে।’
স্কুলছাত্র জাবিরের প্রত্যাশা, ‘যখনই হোক, বইমেলা হওয়া দরকার। প্রতিবছরই যাই, বই কিনি। এবার তার ব্যতিক্রম চাই না।’
সব দিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, বইমেলা ২০২৬ আয়োজন নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা। তবে বাংলা একাডেমি ইঙ্গিত দিয়েছে, মেলা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অর্থাৎ রমজান মাসেই শুরু হবে। প্রকাশকেরা ব্যবসায়িক দিক ভাবছেন, লেখকেরা সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলছেন, পাঠকেরা অপেক্ষা করছেন প্রিয় লেখকের নতুন বইয়ের জন্য।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রমজানের মধ্যেই বইমেলা হওয়ার সম্ভাবনাই এখন সবচেয়ে বেশি।