জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা সোমবার (১৭ নভেম্বর)। এই রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় রবিবার বিক্ষোভ, ককটেল হামলা ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অনলাইনে রায়ের দিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি দিয়েছে। দলটির নেতাকর্মীদের নৈরাজ্যমূলক কার্যক্রম প্রতিহতে রাজনৈতিক দলগুলো রায়ের দিন মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারও বিশৃঙ্খলা রোধে শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের সার্বিক নিরাপত্তাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১৫ নভেম্বর সেনাসদরে এ চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রোববার ডিএমপি কমিশনার ওয়্যারলেস বার্তায় মোটরসাইকেল থেকে পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করতে এলে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি ওয়্যারলেস বার্তায় বলেছি– কেউ বাসে আগুন দিলে, ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করলে, তাকে গুলি করতে। এটা আমাদের আইনেই বলা আছে।’
বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য সদস্য হলেন বিচারক শফিউল আলম মাহমুদ ও মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায় ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলার অন্য দুই আসামি হলেন–সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাদের মধ্যে মামুন রাজসাক্ষী হয়েছেন।
রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের জানান, বেলা ১১টায় ট্রাইব্যুনাল বসবে বলে রেজিস্ট্রার অফিস জানিয়েছে। মামলায় পাঁচটি অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন তারা।
অন্যদিকে আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। রাজসাক্ষী মামুনেরও খালাস চেয়েছেন তাঁর আইনজীবী।
নিরাপত্তায় কঠোর সরকার
রায় ঘিরে নৈরাজ্য ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। রোববার বরিশাল পুলিশ লাইন্সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে সোমবার রায় যা-ই দিক, তা কার্যকর হবে।
ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান বলেছেন, রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সাইবার ইউনিট সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি করছে। কোনো ধরনের নাশকতামূলক কাজ যেন না ঘটে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
রাজধানীর চার স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, পথচারী আহত
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার নির্ধারিত দিন ছিল ১৩ নভেম্বর। সেদিন ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। এর পর ৭ নভেম্বর রাত থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা শুরু হয়। রায় ঘোষণা নিয়েও শনিবার রাত থেকে রোববার রাজধানী অন্তত চার স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় একজন পথচারী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
রোববার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের ওয়াক্ফ ভবনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে আহত হন আবদুল বাসির (৫০)। তিনি বাংলামোটরে অফিসে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে বাসিরের পা ও হাতে জখম হয়।
রাত সাড়ে ৭টার দিকে কারওয়ান বাজার মোড় এলাকায় দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেউ হতাহত হয়নি।
এর আগে শনিবার রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আগারগাঁওয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ভবনের সামনে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। শনিবার রাত ১১টার দিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের কাছে আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে।
সাত জেলায় সড়ক অবরোধ, বাসে আগুন
রায় ঘোষণা নিয়েও শনিবার রাত থেকে রোববার পর্যন্ত অন্তত আট জেলায় ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গাজীপুরের শ্রীপুর এবং বগুড়ার শেরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় পেট্রলবোমা দিয়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। শনিবার গভীর রাতে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে গাছ ফেলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরে পুরিশ ও বিজিবি সদস্যরা এসে গাছ সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
মাদারীপুরের ডাসারের গোপালপুরে রোববার ভোরে গাছ ফেলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর সকাল ১০টার দিকে কালকিনি ও ডাসার থানার পুলিশ, স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থল থেকে গাছ সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
ফেনীর ট্রাংক রোডের মুক্ত বাজার এলাকায় নির্মিত জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রোববার ভোরে স্মৃতিস্তম্ভে আগুনের বিষয়টি দেখতে পান স্থানীয়রা। স্মৃতিস্তম্ভের ফ্লোরের কিছু অংশ ও কয়েকটি অক্ষর আগুনে পুড়ে গেছে। হেমলেট পরা যুবকরা এসে আগুন দেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রোববার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের রাজফুলবাড়িয়া এলাকার আরিচামুখী লেনে ইতিহাস পরিবহনের একটি পার্কিং করা বাসে এবং শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গেন্ডা ইউটার্ন এলাকায় পার্কিং করা শ্রমিকবাহী আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
শনিবার রাতে ময়মনসিংহে নগরীতে দাঁড়িয়ে থাকা কাভার্ডভ্যানে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সে শনিবার মধ্যরাতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।