leadT1ad

রাবিতে শিবিরের নবীনবরণে গোলাম আযমের বই উপহার, শিক্ষার্থীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের হাতে উপহার তুলে দিচ্ছেন অতিথিরা। স্ট্রিম ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ইসলামী ছাত্রশিবিরের আয়োজনে অনুষ্ঠিত নবীনবরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের লেখা ‘মনটাকে কাজে দিন’ বইটি। শনিবার (১৫ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে রাবি শাখা ছাত্রশিবির এই নবীনবরণের আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের হাতে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত মানবতাবিরোধীর লেখা বই উপহার দেওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, এমন জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিবির একাত্তরের গণহত্যাকে সিমপ্যাথাইজের চিন্তার বিস্তার ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে আয়োজকরা বলছেন, গোলাম আযমকে ‘মিথ্যা ফ্রেমিং’ করা হয়েছে। আবার শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, এখানে ব্যক্তি গোলাম আযম নয়, মূলত বইয়ে বিষয়বস্তুতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রশিবিরের এই আয়োজন থেকে বই উপহার পেয়েছেন এমন এক নবীন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্ট্রিমকে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ আমাদের জুলাই এবং একাত্তর; একইসঙ্গে ধারণ করা উচিত। কিন্তু নবীনবরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতাবিরোধী একজন লেখকের বই প্রদান করা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

প্রসঙ্গত, অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। দণ্ড চলাকালে ২০১৪ সালে ৯২ বছর বয়সে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

তাঁর লেখা বই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সদ্য অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে বামধারা সংগঠনগুলোর সমর্থিত ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘নবীনবরণের নামে শিক্ষার্থী সমাগম করে একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে আইডলাইজড করা অবশ্যই দৃষ্টিকটূ। এটা নবাগত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণাও বটে। ছাত্রশিবির জাঁকজমকপূর্ণ কর্মসূচি ও উপহার বিলির আড়ালে একাত্তরের গণহত্যাকে সিমপ্যাথাইজের চিন্তার বিস্তার ঘটাচ্ছে।’

অবশ্য ছাত্রশিবির নবীনবরণের অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন রাকসু একই নির্বাচনে জিএস প্রার্থী, রাবি শাখা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক নাফিউল ইসলাম জীবন। তবে গোলাম আযমের বই উপহারের সমালোচনা করেন এই ছাত্রনেতা। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এই দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীবান্ধব ইতিবাচক রাজনীতি চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এর আড়ালে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির স্বীকৃত রাজাকারের বই শিক্ষার্থীদের উপহার দিয়ে স্বাধীনতাকেই অপমান করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের লিখিত বই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া চরমক আপত্তিকর।’ এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান নাফিউল ইসলাম।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাবি ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি। তিনি তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘শিবির একটা সাইকোলজিক্যাল গেম খেলল। শিবির তো গোলাম আজমের বই-ই দেবে, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো তো আর দিবে না। এই বেহুদা তর্ক-বিতর্কে আপনাদের ঠেলে দিলে গোলাম আজমকে নরমালাইজ করলো শিবির। আর আপনারা দারুণভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করলেন। আমাদের বামগুলোর লাল-মলাটের বাইরে গিয়ে একটু রাজনৈতিক বুদ্ধিসুদ্ধি হউক।’

রাবি শাখা ছাত্রদলের সহ সভাপতি এবং রাকসুর সাবেক ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবির বলেন, ‘একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা–বিরোধী গোলাম আযমের বই শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার ইতিহাস ও রাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এ ধরনের কার্যক্রম শিক্ষাঙ্গনকে ভুল পথে পরিচালিত করার সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক চিন্তার জায়গা এখানে যুদ্ধাপরাধীর মতাদর্শ প্রচারের কোনো সুযোগ নেই। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’

তবে এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না আয়োজক ছাত্রশিবিরের নেতারা। বই উপহার দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে রাকসুর তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও রাবি শাখা শিবিরের ছাত্র অধিকার সম্পাদক নাজমুস সাকিব বলেন, ‘আমরা দুইটা পারপাস থেকে এই বইটা দিয়েছি। বিগত যে ফ্যাসিবাদ সরকার ছিল তারা অধ্যাপক গোলাম আযম সম্পর্কে মিথ্যা ফ্রেমিং করার চেষ্টা করেছে। আমরা সচেতন শিক্ষার্থী যারা আছি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমরা চাই তারা অধ্যাপক গোলাম আযমকে পড়বে, জানবে। ওনার চিন্তার যে গভীরতা, সে সম্পর্কে সবাই জানবে।’

নবীনবরণ অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি
নবীনবরণ অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি

অবশ্য বই এবং গোলাম আযম; দুটি প্রসঙ্গকে এক করে দেখতে চাইছেন না রাকসুর সহ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এবং শিবিরকর্মী মুজাহিদুল ইসলাম সায়েম। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি দুইটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন ইস্যু। এখানে বইয়ের নামটা দেখুন, মনটাকে কাজ দিন। বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর ফোকাস করুন। এটা মূলত একটা স্টুডেন্ট কীভাবে তাঁর কাজের প্রতি মনোযোগী হতে পারেন, তা নিয়ে লেখা। আমরা মনে করি এটা শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারী হবে, সেজন্য আমরা দিয়েছি।‘

তিনি তাঁর এই যুক্তির পক্ষে উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘আপনি যদি দেখেন ইতিহাসে আরও অনেকের বই পড়ানো হয়েছে। যেমন হিটলারের বইয়ের কথা তুলে ধরা যায়। তখন তো কেউ প্রশ্ন করছে না, সে কী মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ করেছে কিনা। তারপর মুসোনলিনির ফ্যাসিজম নিয়ে একটা বই আছে, তিনি তো ইতিহাসের খলনায়ক; সেগুলো পড়ানো হচ্ছে অনেক জায়গাতে। সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে না। তাহলে কেন গোলাম আযমের বই নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত হবে?’

শিক্ষার্থীদের বই উপহার দেওয়াতে মূলত বইয়ের বিষয়বস্তুতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কীভাবে একজন শিক্ষার্থী কর্মঠ হবেন, কাজের প্রতি মনোযোগী হবেন; সেই বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দিয়েই আমরা মূলত এই বইটা উপহার হিসেবে দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি প্রশ্ন আসে যে উনি কী স্বাধীনতার পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন তাহলে বলবো উনি ভারতবিরোধী ছিলেন। যদি আপনার কাছে মনে হয়, ভারত-বিরোধিতা স্বাধীনতার পক্ষে কোনো ইস্যু তাহলে উনি অবশ্যই স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ডাকসু ও চাকসু ভিপি সাদিক কায়েম এবং ইব্রাহিম হোসেন রনি। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। এছাড়া রাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সমাজসেবা সম্পাদক আব্দুল মোহাইমিন, কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, প্রভোস্টসহ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত