leadT1ad

শহীদুল আলমের মুক্তিতে কেন তুরস্কের সহায়তা নিল বাংলাদেশ

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
ইসরায়েলে থেকে মুক্তি পেয়ে তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসে শহিদুল আলম। ছবি: শহিদুল আলমের ফেসবুক পেজ থেকে।

খ্যাতনামা বাংলাদেশি আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এই মুক্তি সম্ভব হয় বাংলাদেশের দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তুরস্ক। আলমকে আটক করা হয়েছিল ফিলিস্তিনের গাজায় ওপর ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙতে সমুদ্রপথে এক নৌবহরে অংশ নেওয়ার ঘটনায়। বিষয়টি ইসরায়েল-গাজা উত্তেজনার সময় বৈশ্বিক মানবাধিকারকর্মীদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। দীর্ঘদিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে আঙ্কারার সুস্পষ্ট অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তুরস্কের সহযোগিতা চায়।

শহিদুল আলম কীভাবে ইসরায়েলে আটক হন

৬৯ বছর বয়সী শহিদুল আলম একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আলোকচিত্রী, শিক্ষক ও গণমাধ্যম স্বাধীনতার প্রবক্তা। তিনি ‘দৃক পিকচার লাইব্রেরি’ ও ‘পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট’-এর প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নথিবদ্ধ করেছেন। ২০১৮ সালে ফটোজার্নালিজমে অবদানের জন্য তিনি লুসি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। একই বছরে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারের সমালোচনা করায় তিনি বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাঁকে ‘বিবেকের বন্দী’ ঘোষণা করে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ অক্টোবর শহিদুল আলম ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র দ্বিতীয় বহর ‘থাউজেন্ড মাদলিনস টু গাজা’ নামের এক বেসামরিক মিশনে অংশ নেন। এই নৌবহরটি গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে ও ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙতে উদ্যোগ নেয়। ভূমধ্যসাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় নৌবহরটি ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হাতে আটক হয়। অংশগ্রহণকারীদের, যার মধ্যে আলমও ছিলেন, সামুদ্রিক বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে দুই দিন একটি ইসরায়েলি আটক কেন্দ্রে রাখা হয়। মানবাধিকার কর্মীদের এভাবে আটক রাখার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দা শুরু হয়। ঘটনাটি ঘটে এমন এক সময়ে, যখন গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের অভিযানে ৬৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ: বহুমুখী প্রচেষ্টা

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার পতনে গঠিত ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। শহিদুল আলমের আটক হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ জর্ডান, মিসর ও তুরস্কের দূতাবাসগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের নির্দেশ দেয়। ভৌগোলিক অবস্থান, ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতায় পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় এসব দেশকে বেছে নেওয়া হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ইসরায়েলি আটকাদেশকে ‘অবৈধ’ বলে আখ্যা দেয় এবং দ্রুত মুক্তির আহ্বান জানায়। ৯ অক্টোবর থেকে প্রচেষ্টা আরও জোরদার হয়। আঙ্কারায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. আমানুল হক তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এর ফলেই ১০ অক্টোবর শহিদুল আলম মুক্তি পান এবং তেলআবিব থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনসের টিকে-৬৯২১ ফ্লাইটে ইস্তাম্বুলে পৌঁছান। সেখানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ধন্যবাদ জানান সহযোগিতার জন্য। তিনি বলেন, শহিদুল আলমের নিরাপদ মুক্তি বাংলাদেশের সফল কূটনৈতিক উদ্যোগেরই ফল।

কেন তুরস্ক: কৌশলগত সম্পর্ক, ফিলিস্তিন-পন্থী অবস্থান ও আঞ্চলিক প্রভাব

বাংলাদেশ তুরস্ককে বেছে নেওয়া ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত পদক্ষেপ। এর পেছনে ছিল কূটনৈতিক বাস্তবতা, মতাদর্শিক মিল এবং ঐতিহাসিক সংহতির সমন্বয়।

শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক: বাংলাদেশ ও তুরস্কের সম্পর্কের শেকড় ১৯৭১ সালে, যখন তুরস্ক প্রথম দিকের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। অন্তর্বর্তীকালীন ইউনুস সরকারের অধীনে ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বৈঠক। এতে বাণিজ্য (২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার), প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় নিয়ে আলোচনা হয়। ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাস এবং আঙ্কারায় বাংলাদেশের দূতাবাস সংকটকালে কার্যকর যোগাযোগের পথ তৈরি করে।

২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই দেশ ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ জোরদারে আগ্রহী। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে ভিত্তি করে এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে তুরস্কের ‘এশিয়া অ্যানিউ’ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন গড়তে সহায়ক।

তুরস্কের ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান ও প্রভাব: প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলের অন্যতম কড়া সমালোচক। ২০২৪ সালের মে মাসে গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় এবং নির্বাসিত হামাস নেতাদের আশ্রয় দেয়। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান (২০২৪-পূর্বে ইসরায়েলের সঙ্গে বার্ষিক বাণিজ্য ছিল ৭ বিলিয়ন ডলার) তাকে মানবিক ইস্যুতে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দেয়। শহিদুল আলমের ঘটনায় তুর্কি কর্তৃপক্ষ লজিস্টিক সহায়তা দেয়, প্রয়োজনে বিশেষ ফ্লাইটের প্রস্তাবও রাখে। তারা সম্ভবত পরোক্ষ কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে—যেমনটি করেছিল ২০১০ সালের ‘মাভি মারমারা’ ঘটনার সময়।

আঞ্চলিক ও বাস্তবিক সুবিধা: তুরস্ক একদিকে অ-আরব মুসলিম শক্তি, অন্যদিকে ইসরায়েল, মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দ্বন্দ্বে সেতুবন্ধের ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায়, তুরস্কের মতো মিত্রই ছিল সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। ২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের নতুন সরকার মানবাধিকার ও গণতন্ত্রমুখী পররাষ্ট্রনীতির ওপর জোর দিচ্ছে, যা এরদোয়ানের ‘মজলুমের কণ্ঠস্বর’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল ‘নীরব কিন্তু কার্যকর কূটনীতি’, যেখানে তুরস্কের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের সীমিত আঞ্চলিক প্রভাবকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, কোনো উত্তেজনা না বাড়িয়েই।

ফলাফল ও বৃহত্তর তাৎপর্য

শহিদুল আলমের মুক্তি ইউনুস সরকারের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যকর নেতৃত্বের প্রমাণ রাখে। শহিদুল আলম দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে ইস্তাম্বুলে পৌঁছান, সম্ভবত পরবর্তীতে বাংলাদেশে ফেরার পথে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়নি। প্রতিবেদনে জানা যায়, ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া অন্যান্য আটক ব্যক্তিরাও মুক্তি পেয়েছেন।

এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা ও রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগের সুযোগও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে এটি গাজার মানবিক বিপর্যয়ের পটভূমিতে সহিংসতা ও অবরোধবিরোধী প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন এক কূটনৈতিক দৃষ্টান্ত—যেখানে নীতিনিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি শেখ হাসিনার আমলের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারা থেকে আলাদা এক অবস্থান তৈরি করছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এ ধরনের হস্তক্ষেপ কি ভবিষ্যতে মানবাধিকারকর্মীদের নিরাপত্তা বাড়াবে, নাকি আরও ঝুঁকিতে ফেলবে?

বিভক্ত বৈশ্বিক রাজনীতির এই সময়ে, বাংলাদেশের তুরস্কমুখী উদ্যোগ প্রমাণ করে—ক্ষমতা নয়, ন্যায়ের পক্ষে সংহতিই কখনও কখনও কূটনীতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে। শহিদুল আলমের ভাষায় বলতে গেলে, এটি অবরোধের ভেতর থেকেও এক প্রতিরোধের ছবি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত