বাংলা স্ট্রিম
২০২৫ সালের ৮ অক্টোবরের ভোর। ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউ ঠেলে এগোচ্ছিল ‘কনশানস’ নামের জাহাজটি। তাতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। সেই সময় তিনি নিজের শেষ বার্তাটি ধারণ করেন মোবাইল ফোনে। শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শহিদুল আলম, বাংলাদেশ থেকে আসা একজন ফটোগ্রাফার ও লেখক। যদি এই ভিডিওটি আপনি দেখে থাকেন, বুঝবেন আমরা সমুদ্রে আটক হয়েছি এবং আমাকে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী অপহরণ করেছে—যারা গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।’
গাজার উপকূল থেকে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায়, ইসরায়েলি নৌকমান্ডোরা যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার থেকে তাদের জাহাজে চড়ে বসে। জাহাজে থাকা ২৫ দেশের সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মীসহ ৯৬ জন যাত্রীর সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাহাজটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে। এখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রত্যাবাসন করা হবে। যেমনটা পূর্ববর্তী নৌবহরের শতশত অধিকার কর্মীর ক্ষেত্রে হয়েছিল।
শহিদুলদের ‘থাউজ্যান্ড মাদলিনস টু গাজা’ জাহাজ বহরে ছোট-বড় মোট ১১টি জাহাজ ছিল। তার মধ্যে তিনটির ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের খবর জানা গেছে। আয়োজক সংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, তাদের জাহাজগুলো গাজার জন্য বহন করছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ডলারের বেশি মূল্যের জরুরি ত্রাণসামগ্রী। এসব ত্রাণের মধ্যে ছিল ওষুধ, শ্বাসযন্ত্র ও পুষ্টি সহায়ক খাদ্য, যা গাজার ক্ষুধার্ত হাসপাতালগুলোতে পৌঁছানোর কথা ছিল।
ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় এফএফসি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জাহাজ আটকের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই। আমাদের নৌবহর কারও ক্ষতি করছে না।’
এর আগে, ইসরায়েল ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র প্রায় ৪০টি জাহাজ আটক করে এবং প্রায় ৫০০ জন অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে ইসরায়েল তাদের অধিকাংশ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠায়, যাদের মধ্যে ছিলেন সুইডেনের জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও।
ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া কয়েকজন কর্মী অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলি হেফাজতে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি-ফিলিস্তিনি সদস্য রিমা হাসান বলেন, তাকে ‘মারধর’ও করা হয়েছে। মার্কিন কর্মী ডেভিড অ্যাডলার জানান, তাকে ‘কাপড় খুলে হাত ও চোখ বেঁধে’ আটকে রাখা হয়, এমনকি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সঙ্গে জোর করে ছবি তুলতেও বাধ্য করা হয়।
কনশানসে ৬৯ বছর বয়সী শহিদুল আলম ছিলেন একমাত্র বাংলাদেশি। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার মিশন শেষ হয় গাজার ‘রেড জোন’-এর প্রান্তেই।
এই যাত্রা শহিদুল আলমের হঠাৎ নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ১৯৫৬ সালে জন্ম নেওয়া এই আলোকচিত্রী ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার দৃক পিকচার লাইব্রেরি, যা নৈতিক ফটোজার্নালিজমের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত—তিনি ন্যায়ের পক্ষে ক্যামেরা ধরেছেন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের পর তিনি ১০১ দিন একাকী কারাবাসে ছিলেন। পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে ‘প্রিজনার অব কনশানস’ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠেন।
ফিলিস্তিন ইস্যুতেও শহিদুল দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিলেন। ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে দৃকের উদ্যোগে ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রদর্শনী ও স্বাক্ষর সংগ্রহ হয়েছে। তার সহধর্মিণী রেহনুমা আহমেদও রামাল্লাহ অবরোধের সময় ইয়াসির আরাফাতের সমর্থনে স্বাক্ষর অভিযানে যুক্ত ছিলেন। শহিদুল বলেছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে এটি আমার কর্তব্য।’ তার কাছে এই নৌযাত্রা ছিল এক নৈতিক আহ্বান—গাজার ওপর ইসরায়েলের ১৮ বছরের অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজহার ওপর সর্বাত্মক—স্থল, নৌ ও আকাশ পথে অবরোধ আরোপ করে।
গাজা থেকে সংবাদ আসা বন্ধ হয়ে গেলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এই অভিযানে অংশ নিতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামের এই উদ্যোগে যুক্ত হয় ৪৫ দেশের প্রায় ৫০০ জন অধিকার কর্মী ও সাংবাদিক। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বেসামরিক নৌবহর—যেখানে ৫০টিরও বেশি জাহাজ বোঝাই ছিল খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রী ও মানবতার বার্তা নিয়ে। গত ২-৩ অক্টোবর বহরটিকে আটক করে ইসরায়েল।
সেই আয়োজনেরই দ্বিতীয় এবং শেষ বহর হিসেবে যাত্রা করেন শহিদুলরা। শহিদুল জানান, ‘আমরা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মূল বহরের অংশ ছিলাম না; তা শুরু থেকেই পরিকল্পিত ছিল।’
গাজার এক সংগ্রামী মা ‘মাদলিন কুলাবে’র নামে এ অভিযাত্রার নাম রাখা হয় ‘থাউজ্যান্ড মাদলিনস টু গাজা।’ মাদলিন গাজার প্রথম নারী জেলে, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের খাবার যোগাড়ের জন্য মাছ ধরার কাজ শুরু করেন।
২০২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে শহিদুল বলেন, ‘ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে গাজায় মানুষ হত্যা করছে। এটি গণহত্যা। আমি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন নিয়ে যাচ্ছি।’
৩০ সেপ্টেম্বর তিনি ইতালির কাতানিয়া থেকে ১০০ মিটার দীর্ঘ ‘কনশানস’ জাহাজে আরোহন করেন—যেখানে ছিলেন ৮২ জন সাংবাদিক ও চিকিৎসক। তবে কনশানসে সাংবাদিকরা থাকায় একে মিডিয়া ফ্লোটিলাও বলা হয়। এভাবেই শুরু হয় তাঁর যাত্রা, মানবতার পক্ষে এক সাহসী অভিযান।
অভিযানটি শুরু থেকেই ছিল এক ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রা। ২ অক্টোবর শহিদুলদের জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। সেসময় ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন তিনি। তাঁকে জাহাজের ডেকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। লাইভে তিনি উত্তাল সাগরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ঝড় চলে গেলেও পরে তিনি আবার অসুস্থও হয়ে পড়েন।
ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘অনেকেই আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। দুঃখিত, সবার বার্তার উত্তর আলাদাভাবে দিতে পারছি না। আজ আমি বমি করেছি এবং পরে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে গুরুতর কিছু হয়নি। জাহাজে প্রায় ২০ জন ডাক্তার ও নার্স আছেন। চিকিৎসার দিক থেকে আমরা যাত্রী হিসেবে সবচেয়ে ভালো যত্ন পাচ্ছি। আমি যে মনোযোগ পেয়েছি তা বেশ উপভোগ করেছি। আমার ভাতিজি মৌলি থাকলে বলত, আমি নাটক করছি।’
এরপরও দমে যাননি তিনি। আরেকটি পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কোনো মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য যাচ্ছি না। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙা। আমরা সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের ওপর ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছি। আমরা বিশেষ করে মিডিয়ার ওপর এবং তথ্যের ওপর ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙতে চাই। আমরা গাজার বাস্তব পরিস্থিতি পুরো বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই। এখন কথা বলার সময় নয়। কাজ করার সময়। বিশ্বনেতারা ব্যর্থ হলেও, আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে যা পারব তাই করব। আপনাদের ভালোবাসা ও উৎসাহই আমাদের শক্তি জোগায়। আমাদের জয় হবে। ফিলিস্তিনও মুক্ত হবে।’
যাত্রাপথে শহিদুল আলমের ফেসবুক পেজের পোস্টগুলো ভরে উঠেছিল কবিতা, প্রতিবাদ ও মানবিক বার্তায়। তিনি গাজার অবরোধের কারণে সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের দুর্ভোগ তুলে ধরেন। জাহাজেও তারা প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আয়োজন করেন। ৭ অক্টোবর শহিদুল জানান, ‘আগামীকাল ভোরে আমরা ‘রেডজোনে’ পৌঁছাব, যেখান থেকে ইসরায়েলি সেনারা এর আগে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের ৪০টির বেশি জাহাজ ও প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মীকে আটক করে।
সেই আটকের প্রসঙ্গ টেনে শহিদুল লেখেন, ‘তবুও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কনশানস জাহাজে মূলত সাংবাদিক ও চিকিৎসকেরা আছেন। তাঁরা সেই দুই পেশাজীবী গাজায় যাঁদের ইসরায়েল সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে হত্যা করছে।’
৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময়) ‘রেড জোন’ এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েলি কমান্ডোরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর আক্রমণ চালায়—যা জাতিসংঘ সমুদ্র আইন লঙ্ঘন করে।
শহিদুলের দুই হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ এই সমুদ্রযাত্রা গাজার অবরোধ ভাঙতে না পারলেও ভেঙে দিয়েছে মানসিক অবরোধের নীরব দেয়াল। তার এই দুঃসাহসিক অভিযানে বিশ্বজুড়ে সহমর্মিতা জেগে ওঠে। বাংলাদেশেও অনেকেই একে মানবতার লড়াই হিসেবে দেখেছেন। কারণ তিনি একসময় আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারের দমননীতির শিকার হয়েছিলেন। এখন তিনি বিশ্বের সামনে ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
শহিদুল তার যাত্রার শুরুতে বলেছিলেন, ‘এখানে পরাজয় মানে মানবতার পরাজয়।’
ঢাকা থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ পর্যন্ত তার এই যাত্রা আজ এক অম্লান আলোকবর্তিকা— যা বিশ্বকে দেখার, ভাবার ও প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
২০২৫ সালের ৮ অক্টোবরের ভোর। ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউ ঠেলে এগোচ্ছিল ‘কনশানস’ নামের জাহাজটি। তাতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। সেই সময় তিনি নিজের শেষ বার্তাটি ধারণ করেন মোবাইল ফোনে। শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শহিদুল আলম, বাংলাদেশ থেকে আসা একজন ফটোগ্রাফার ও লেখক। যদি এই ভিডিওটি আপনি দেখে থাকেন, বুঝবেন আমরা সমুদ্রে আটক হয়েছি এবং আমাকে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী অপহরণ করেছে—যারা গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।’
গাজার উপকূল থেকে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায়, ইসরায়েলি নৌকমান্ডোরা যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার থেকে তাদের জাহাজে চড়ে বসে। জাহাজে থাকা ২৫ দেশের সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মীসহ ৯৬ জন যাত্রীর সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাহাজটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে। এখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রত্যাবাসন করা হবে। যেমনটা পূর্ববর্তী নৌবহরের শতশত অধিকার কর্মীর ক্ষেত্রে হয়েছিল।
শহিদুলদের ‘থাউজ্যান্ড মাদলিনস টু গাজা’ জাহাজ বহরে ছোট-বড় মোট ১১টি জাহাজ ছিল। তার মধ্যে তিনটির ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের খবর জানা গেছে। আয়োজক সংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, তাদের জাহাজগুলো গাজার জন্য বহন করছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ডলারের বেশি মূল্যের জরুরি ত্রাণসামগ্রী। এসব ত্রাণের মধ্যে ছিল ওষুধ, শ্বাসযন্ত্র ও পুষ্টি সহায়ক খাদ্য, যা গাজার ক্ষুধার্ত হাসপাতালগুলোতে পৌঁছানোর কথা ছিল।
ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় এফএফসি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জাহাজ আটকের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই। আমাদের নৌবহর কারও ক্ষতি করছে না।’
এর আগে, ইসরায়েল ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র প্রায় ৪০টি জাহাজ আটক করে এবং প্রায় ৫০০ জন অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে ইসরায়েল তাদের অধিকাংশ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠায়, যাদের মধ্যে ছিলেন সুইডেনের জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও।
ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া কয়েকজন কর্মী অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলি হেফাজতে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি-ফিলিস্তিনি সদস্য রিমা হাসান বলেন, তাকে ‘মারধর’ও করা হয়েছে। মার্কিন কর্মী ডেভিড অ্যাডলার জানান, তাকে ‘কাপড় খুলে হাত ও চোখ বেঁধে’ আটকে রাখা হয়, এমনকি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সঙ্গে জোর করে ছবি তুলতেও বাধ্য করা হয়।
কনশানসে ৬৯ বছর বয়সী শহিদুল আলম ছিলেন একমাত্র বাংলাদেশি। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার মিশন শেষ হয় গাজার ‘রেড জোন’-এর প্রান্তেই।
এই যাত্রা শহিদুল আলমের হঠাৎ নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ১৯৫৬ সালে জন্ম নেওয়া এই আলোকচিত্রী ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার দৃক পিকচার লাইব্রেরি, যা নৈতিক ফটোজার্নালিজমের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত—তিনি ন্যায়ের পক্ষে ক্যামেরা ধরেছেন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের পর তিনি ১০১ দিন একাকী কারাবাসে ছিলেন। পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে ‘প্রিজনার অব কনশানস’ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠেন।
ফিলিস্তিন ইস্যুতেও শহিদুল দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিলেন। ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে দৃকের উদ্যোগে ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রদর্শনী ও স্বাক্ষর সংগ্রহ হয়েছে। তার সহধর্মিণী রেহনুমা আহমেদও রামাল্লাহ অবরোধের সময় ইয়াসির আরাফাতের সমর্থনে স্বাক্ষর অভিযানে যুক্ত ছিলেন। শহিদুল বলেছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে এটি আমার কর্তব্য।’ তার কাছে এই নৌযাত্রা ছিল এক নৈতিক আহ্বান—গাজার ওপর ইসরায়েলের ১৮ বছরের অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজহার ওপর সর্বাত্মক—স্থল, নৌ ও আকাশ পথে অবরোধ আরোপ করে।
গাজা থেকে সংবাদ আসা বন্ধ হয়ে গেলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এই অভিযানে অংশ নিতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামের এই উদ্যোগে যুক্ত হয় ৪৫ দেশের প্রায় ৫০০ জন অধিকার কর্মী ও সাংবাদিক। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বেসামরিক নৌবহর—যেখানে ৫০টিরও বেশি জাহাজ বোঝাই ছিল খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রী ও মানবতার বার্তা নিয়ে। গত ২-৩ অক্টোবর বহরটিকে আটক করে ইসরায়েল।
সেই আয়োজনেরই দ্বিতীয় এবং শেষ বহর হিসেবে যাত্রা করেন শহিদুলরা। শহিদুল জানান, ‘আমরা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মূল বহরের অংশ ছিলাম না; তা শুরু থেকেই পরিকল্পিত ছিল।’
গাজার এক সংগ্রামী মা ‘মাদলিন কুলাবে’র নামে এ অভিযাত্রার নাম রাখা হয় ‘থাউজ্যান্ড মাদলিনস টু গাজা।’ মাদলিন গাজার প্রথম নারী জেলে, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের খাবার যোগাড়ের জন্য মাছ ধরার কাজ শুরু করেন।
২০২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে শহিদুল বলেন, ‘ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে গাজায় মানুষ হত্যা করছে। এটি গণহত্যা। আমি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন নিয়ে যাচ্ছি।’
৩০ সেপ্টেম্বর তিনি ইতালির কাতানিয়া থেকে ১০০ মিটার দীর্ঘ ‘কনশানস’ জাহাজে আরোহন করেন—যেখানে ছিলেন ৮২ জন সাংবাদিক ও চিকিৎসক। তবে কনশানসে সাংবাদিকরা থাকায় একে মিডিয়া ফ্লোটিলাও বলা হয়। এভাবেই শুরু হয় তাঁর যাত্রা, মানবতার পক্ষে এক সাহসী অভিযান।
অভিযানটি শুরু থেকেই ছিল এক ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রা। ২ অক্টোবর শহিদুলদের জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। সেসময় ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন তিনি। তাঁকে জাহাজের ডেকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। লাইভে তিনি উত্তাল সাগরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ঝড় চলে গেলেও পরে তিনি আবার অসুস্থও হয়ে পড়েন।
ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘অনেকেই আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। দুঃখিত, সবার বার্তার উত্তর আলাদাভাবে দিতে পারছি না। আজ আমি বমি করেছি এবং পরে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে গুরুতর কিছু হয়নি। জাহাজে প্রায় ২০ জন ডাক্তার ও নার্স আছেন। চিকিৎসার দিক থেকে আমরা যাত্রী হিসেবে সবচেয়ে ভালো যত্ন পাচ্ছি। আমি যে মনোযোগ পেয়েছি তা বেশ উপভোগ করেছি। আমার ভাতিজি মৌলি থাকলে বলত, আমি নাটক করছি।’
এরপরও দমে যাননি তিনি। আরেকটি পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কোনো মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য যাচ্ছি না। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙা। আমরা সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের ওপর ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছি। আমরা বিশেষ করে মিডিয়ার ওপর এবং তথ্যের ওপর ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙতে চাই। আমরা গাজার বাস্তব পরিস্থিতি পুরো বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই। এখন কথা বলার সময় নয়। কাজ করার সময়। বিশ্বনেতারা ব্যর্থ হলেও, আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে যা পারব তাই করব। আপনাদের ভালোবাসা ও উৎসাহই আমাদের শক্তি জোগায়। আমাদের জয় হবে। ফিলিস্তিনও মুক্ত হবে।’
যাত্রাপথে শহিদুল আলমের ফেসবুক পেজের পোস্টগুলো ভরে উঠেছিল কবিতা, প্রতিবাদ ও মানবিক বার্তায়। তিনি গাজার অবরোধের কারণে সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের দুর্ভোগ তুলে ধরেন। জাহাজেও তারা প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আয়োজন করেন। ৭ অক্টোবর শহিদুল জানান, ‘আগামীকাল ভোরে আমরা ‘রেডজোনে’ পৌঁছাব, যেখান থেকে ইসরায়েলি সেনারা এর আগে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের ৪০টির বেশি জাহাজ ও প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মীকে আটক করে।
সেই আটকের প্রসঙ্গ টেনে শহিদুল লেখেন, ‘তবুও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কনশানস জাহাজে মূলত সাংবাদিক ও চিকিৎসকেরা আছেন। তাঁরা সেই দুই পেশাজীবী গাজায় যাঁদের ইসরায়েল সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে হত্যা করছে।’
৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময়) ‘রেড জোন’ এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েলি কমান্ডোরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর আক্রমণ চালায়—যা জাতিসংঘ সমুদ্র আইন লঙ্ঘন করে।
শহিদুলের দুই হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ এই সমুদ্রযাত্রা গাজার অবরোধ ভাঙতে না পারলেও ভেঙে দিয়েছে মানসিক অবরোধের নীরব দেয়াল। তার এই দুঃসাহসিক অভিযানে বিশ্বজুড়ে সহমর্মিতা জেগে ওঠে। বাংলাদেশেও অনেকেই একে মানবতার লড়াই হিসেবে দেখেছেন। কারণ তিনি একসময় আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারের দমননীতির শিকার হয়েছিলেন। এখন তিনি বিশ্বের সামনে ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
শহিদুল তার যাত্রার শুরুতে বলেছিলেন, ‘এখানে পরাজয় মানে মানবতার পরাজয়।’
ঢাকা থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ পর্যন্ত তার এই যাত্রা আজ এক অম্লান আলোকবর্তিকা— যা বিশ্বকে দেখার, ভাবার ও প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেজুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। তাতে হাসিনা ছাড়াও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীকে আসামি করা হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেআসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারী অধিকারকর্মীরা বলেছেন, সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ানো হলেও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন ছাড়া নারীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে না। তাঁদের দাবি, সরাসরি নির্বাচন না হলে সংরক্ষিত আসন বাড়ানো নিরুৎসাহিত করা উচিত।
৪ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
৫ ঘণ্টা আগে