leadT1ad

ইসরায়েলি আগ্রাসন: আরব ও ইসলামি দেশগুলো কী বলছে

দোহা সম্মেলনে আরব ও ইসলামি দেশগুলোর হতাশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গাজায় চলমান যুদ্ধ ও সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। নেতারা বলেন, শুধু নিন্দা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মতো ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

১৫ সেপ্টেম্বর দোহায় জরুরি সম্মেলন বসে আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। ছবি: আল-জাজিরা

ইসরায়েল গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের দোহায় হামাসের একটি কার্যালয়ে বিমান হামলা চালায়। এতে ছয়জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন যুদ্ধবিরতি আলোচনায় যুক্ত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ হামাস নেতা। এই হামলা ছিল একাধিক দেশে ইসরায়েলের ধারাবাহিক অভিযানের অংশ। মাত্র ৭২ ঘণ্টায় ইসরায়েল ছয়টি দেশে হামলা চালায়। ২০২৫ সালে কাতার ছিল সপ্তম দেশ যেখানে ইসরায়েল হামলা চালাল। ফলে পরিস্থিতি এক নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। এর জবাবে আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর দোহায় জরুরি সম্মেলন বসে। এতে সংকট মোকাবিলা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান নির্ধারণের চেষ্টা হয়। কাতারের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করে মুসলিম দেশগুলো।

আরব লীগ

আরব লীগ বা আরব রাষ্ট্রগুলোর লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালে। প্রথমে সাতটি দেশ—মিশর, ইরাক, ট্রান্সজর্ডান (বর্তমান জর্ডান), লেবানন, সৌদি আরব, সিরিয়া ও ইয়েমেন— এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২২। এসব দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ। সংস্থাটি আরব দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয়, আঞ্চলিক সংহতি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে কাজ করে। সৌদি আরব ও ইরাকসহ বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র বড় তেল উৎপাদক। তারা ওপেকের অংশ এবং বিশ্ব তেল উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ যোগান দেয়। আরব লীগের সব সদস্যই ওআইসিরও সদস্য।

ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)

ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। পবিত্র আল-আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর এটি গঠিত হয়। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৫৭। সংস্থাটি বিশ্বের প্রায় ২১০ কোটির বেশি মুসলমানকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ। সংস্থার সদস্যদের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের আলবেনিয়া এবং আমেরিকার গায়ানা ও সুরিনাম অন্তর্ভুক্ত। ওআইসি মুসলিম পবিত্র স্থান রক্ষা, পারস্পরিক সংহতি বাড়ানো এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ অগ্রসর করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। ২০০৮ সালে নতুন নিয়ম যুক্ত হয়। এর অধীনে সদস্য হতে হলে জাতিসংঘের সদস্য হতে হবে (ফিলিস্তিন ব্যতীত), জনসংখ্যার অধিকাংশকে মুসলমান হতে হবে এবং বিদ্যমান সব সদস্যের সম্মতি পেতে হবে।

দোহা সম্মেলন: প্রেক্ষাপট ও লক্ষ্য

কাতারে হামলা এবং গাজা যুদ্ধ ও পশ্চিম তীরে চলমান ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে দোহায় জরুরি আরব-ইসলামিক সম্মেলন বসে। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক প্রস্তুতিমূলক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের খসড়া প্রস্তাব আলোচিত হয়। সম্মেলনে নেতারা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে নিন্দা জানান। তারা দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ জোরদার এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার আহ্বান জানান।

আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের পরিচালক ক্রিস ডয়েল, দোহায় চলমান সম্মেলনকে কাতারের প্রতি আরব ও মুসলিম নেতাদের শক্তিশালী সংহতির প্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বশক্তিগুলো ইসরায়েলকে জবাবদিহির মুখোমুখি করছে না, অথচ ইসরায়েল স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করছে। ডয়েলের মতে, অনেক আগেই ইসরায়েলকে সতর্ক করে সীমা টানা উচিত ছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দোহা সম্মেলন সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে শুধু বক্তব্য নয়, পরবর্তীতে কার্যকর ও সুসংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানী। ছবি: আল-জাজিরা
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানী। ছবি: আল-জাজিরা

কে কী বলেছে

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও সংস্থার প্রতিনিধিরা ইসরায়েলের হামলার কড়া সমালোচনা করেন। তারা অভিন্ন পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানী দোহায় হামলাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আখ্যা দেন। তিনি বলেন, হামলাটি হামাসের আলোচকদের টার্গেট করে চালানো হয়। এতে গাজার যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে ভেস্তে দেওয়া এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ইসরায়েলের লক্ষ্য। আলোচক হত্যার পর ইসরায়েলের বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ায় আন্তরিকতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাসী মানসিকতার’ প্রতিফলন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এসব কর্মকাণ্ড জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতকরণ ও গণহত্যা ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দোহা হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং বিদ্যমান শান্তি চুক্তিগুলোকে দুর্বল করছে।

ইরানের রাষ্ট্রপতি মাসউদ পেজেশকিয়ান মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মানবিক নীতির ভিত্তিতে ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের সকলের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি একটি যৌথ আরব-ইসলামি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এই কমিটি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে অভিন্ন অবস্থান উপস্থাপন করবে। তার মতে, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেন, দোহায় হামলা ইসরায়েলের সীমাহীন হুমকির প্রমাণ। তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিনিদের আরেক দফা বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের ‘অপরাধের’আন্তর্জাতিক জবাবদিহি দাবি করেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘকে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, কেবল নিন্দা জানিয়ে লাভ নেই। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রস্তাব দেন।

ইন্দোনেশিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি জিবরান রাকাবুমিং রাকা বলেন, ফিলিস্তিন প্রশ্ন সব জাতির মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তিনি আহ্বান জানান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কাতারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে টেকসই শান্তির জন্য দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

সবুজ রঙে চিহ্নিত মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র। ছবি: আল-জাজিরা
সবুজ রঙে চিহ্নিত মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র। ছবি: আল-জাজিরা

গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আলবুদাইউই যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের ওপর প্রভাব খাটানোর আহ্বান জানান। তিনি কাতারের আঞ্চলিক মর্যাদা ও ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

ওআইসি মহাসচিব হুসেইন ব্রাহিম তাহা কাতারের ওপর হামলাকে দেশটির সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে নিন্দা করেন। দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

আরব লীগ মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইত ইসরায়েলকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনকে দুর্বল করছে। নীরবতা কেবল আরও আগ্রাসনকে উৎসাহিত করবে বলে তিনি সতর্ক করেন।

বৃহত্তর প্রভাব

দোহা সম্মেলনে আরব ও ইসলামি দেশগুলোর হতাশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গাজায় চলমান যুদ্ধ ও সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। নেতারা বলেন, শুধু নিন্দা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মতো ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন।

আরব লীগ ও ওআইসি দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছে। দোহা সম্মেলন সেই অবস্থান আরও দৃঢ় করে। সম্মেলনে যুদ্ধবিরতি, ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের দাবিতে আবারও জোর দেওয়া হয়।

কাতারে ইসরায়েলি হামলাকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কারণ, কাতার গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী ছিল। এই হামলাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ওআইসি এবং আরব লীগের সদস্যদের অভিন্ন অবস্থান তাদের সম্মিলিত দৃঢ়তা প্রকাশ করেছে। তারা ইসরায়েলের আগ্রাসন মোকাবিলা এবং ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এবারের দোহা সম্মেলন আরব ও ইসলামি দেশগুলোর ঐক্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কণ্ঠ তুলে তারা কাতারের ওপর হামলা এবং ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। সম্মেলনে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় নতুন প্রতিশ্রুতি গৃহীত হয়। এই সম্মেলনের ফলাফল আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে, যা ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত